somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজো নিষিদ্ধ হতে পারে: জীবন থেকে নেয়া

২৮ শে মে, ২০১২ বিকাল ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
“একটি দেশ
একটি সংসার
একটি চাবির গোছা
একটি আন্দোলন
একটি চলচ্চিত্র......”

এমনি একটি শ্লোগান নিয়ে পোষ্টার ছাপা হয়েছিল ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটির। ১৯৬৮ সালের শেষের দিক। তখন দুই পাকিস্তান এক সুতায় বাধা। তবে সেই সুতা দিন দিন চিকন হচ্ছিল। সামরিক শাষণের বেড়াজালে রাজনীতি যখন তখন বিস্ফোরিত হতে পারে এমনই এক আগ্নেয়গিরি। পরিচালক জহির রায়হান চাচ্ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক প্রোপট আর বাঙ্গালীর ছাই চাপা থাকা ক্রোধ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র করতে। ইতিমধ্যে (১৯৬৫-৬৬) তিনি ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেও সরকারের বাধায় শেষ করতে না পেরে কিছুটা বিমর্ষ।

সময় ১৯৬৯-৭০। বিহারী প্রযোজক আনিস দোসানি জহিরকে ডেকে একটি ছবি বানাতে বললেন। তখনকার প্রযোজকেরা আজকের মতো হয়ত ছিল না। কারণ তিনি শুধু জানতেন যে একটি ছবি বানাচ্ছেন। কি ছবি হচ্ছে তার খোঁজ নেননি। যদি নিতেন তাহলে হয়ত আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম গল্পটি হয়ত রচিত হতো না। যাই হোক, চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য (কাহিনী ও সংলাপ) করার জন্য তিনি ডাকলেন সে সময়ের তরুণ চিত্রনাট্যকার আমজাদ হোসেনকে। কারণ আমজাদ হোসেন সে সময় খুব ভাল লিখছিলেন। জহির তাকে জানালেন, এমন একটা গল্প হবে যেখানে এক বোন আরেক বোনকে বিষ খাওয়াবে। আমজাদ বললেন, বোন বোনকে বিষ খাওয়াবে! দর্শক কি ব্যপারটা গ্রহণ করবে? জহির নিজ অবস্থানে শক্ত রইলেন। আমজাদ লিখে ফেললেন প্রথম দৃশ্য। এক বোন আরেক বোনকে দুধ-ভাই খাওয়াচ্ছে। কিছুণ পর ফিরে এসে জহির স্ক্রীপ্ট দেখলেন। দেখেই বললেন, খাওয়াতে বললাম বিষ! আর খাওয়াচ্ছেন দুধ! আমজাদ হেসে বলেন, দুধ না খাওয়ালে বিষ খাওয়াবো কিভাবে! এরপর আমজাদ কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়লেন। যেভাবেই লেখেন না কেন, তা পারিবারিক গল্পকে ছুঁয়ে রাজনৈতিক গল্পে চলে যাচ্ছিল। এখানেও আছে আরেকটা গল্প।

গণঅভ্যুত্থানে আসাদ শহীদ হবার কিছুদিন পর মাওলানা ভাসানী তার দলীয় কর্মী আমজাদ হোসেনকে ডেকে আসাদকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারী করার জন্য বলেন। আর সে মোতাবেক স্ক্রিপ্ট তৈরি করে কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু বিরাট সমাবেশের শুটিংয়ের দিন আসাদের পরিবার থেকে জানানো হয়, তারা কোন ডকুমেন্টারি চাচ্ছেন না (তৎকালীন সরকারে প থেকে আসাদের পরিবারকে চাপ দেয়া হয়)। ফলে সে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া ডকুমেন্টারিটার কথা কোনভাবেই ভুলতে পারছিলেন না আমজাদ। ফলে তিনি জীবন থেকে নেয়ার স্ক্রিপ্ট লিখতে বসে বারবার রাজনৈতিক গল্পে ঢুকে যাচ্ছিলেন। তাই তিনি রচনা করলেন কতগুলো ঐতিহাসিক মিছিলের গল্প। পরিবারের গল্পে নিয়ে আসলেন ঊনসত্তর। এদিকে এক রাজনৈতিক ঘটনায় দেখেছিলেন নেতা-কর্মীদের পোষ্টার ছিঁড়ার দৃশ্য, সেটাকে আনলেন কাহিনীতে। জহির দেখলেন গল্পটি এগোচ্ছে রাজনীতির দিকে। নিজের ইচ্ছের প্রতিচ্ছবি যেন দেখলেন আমজাদের লেখায়। আর তারপরপরই তিনিও আমজাদের সাথে সময় দেয়া শুরু করলেন। একটু পরপর এসে খোঁজ নিতে লাগলেন কতদুর এগোল। দুজন মিলে স্ক্রীপ্ট শেষ করলেন। শুরু করলেন চরিত্রের লোকগুলোকে খুঁজে বের করা। আনোয়ার হোসেন, রাজ্জাক, খান আতা, শওকত আকবর, রোজি সামাদ, বেবী জামান সবাইকে ডাকলেন নিজ বাড়িতে। আর গওহর জামিল এর স্ত্রী রওশন জামিলকে তারা চাচ্ছিলেন স্বৈরাচার চরিত্রে। রওশন জামিল তখন শুধুই নাচের শিল্পী। কিন্তু পরিচালকের নাম যে জহির রায়হান! তিনি কথা দিলেন রওশনকে তিনি নির্মাণ করবেন। আর আমরা আজ সবাই জানি, রওশন জামিল কতটা ভয়ঙ্কর রকম সুন্দর অভিনয় করেছেন তাতে। আর সবটাতেই ছিল জহিরের আন্তরিক শ্রম আর রওশনের দায়িত্ববোধ। তো যাই হোক। সবার গোপন মিটিং বসল জহির রায়হানের বাসায়। জহির জানালেন সবাইকে, আমরা শুধু অভিনয় করবো। এদেশের জন্য অনেকে রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। আর আমরা একটু অন্যভাবে তাদের কথা জানাবো। জানাবো আমাদের আজকের অবস্থার কথা। কিছুটা ঝুঁকি হয়ত থাকবে। কিন্তু আমি কাজটা করবো। আপনারা কি থাকবেন আমার সাথে? কেউ কিছু বলার আগে রাজ্জাক বলে দিলেন, দেশের জন্য কাজ করবেন আর তাতে থাকবো না, তা কি হয়!

প্রথমে চলচ্চিত্রটির নাম ঠিক করা হয় ‘তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ’। কিন্তু স্ক্রীপ্ট লেখা মাঝামাঝি অবস্থায় একদিন হঠাৎ করেই জহির রায়হান আমজাদ হোসেনকে জানান যে, ছবির নাম পেয়ে গেছি। আমার এই ছবির নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’। এবং সত্যি সিনেমাটি হয়ে গেল সে সময়ের বাঙ্গালীর জীবনের গল্প। এখানে রওশন জামিলের চরিত্রটি পেল তৎকালীন স্বৈরশাসক ও একনায়কতন্ত্রের (আইয়ুব খান/ ইয়াহিয়া খান) মুখচ্ছবি। আনোয়ার হোসেন সে সময়ের জনপ্রিয় ও সচেতন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা, রাজ্জাক প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিক। নবজাতকের নাম মুক্তি রাখার মাধ্যমে জহির যেন যে কারো আগে এদেশের স্বাধীনতাই ঘোষণা দিয়ে বসলেন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। জেলে উচ্চারিত কবিতার লাইন ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’ এর মাধ্যমে জহির যেন স্বাধীনতার প্রশ্নে শহীদ হবার আহবানই জানালেন জাতির মুক্তির কান্ডারীর মতো। একই ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ ছিল প্রেরণাদায়ক, নজরুলের গান ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ ছিল উদ্দিপনার, ইকবালের ‘দাও দাও দুনিয়ার সব জাতিকে’ কিংবা খান আতার ‘এ খাঁচা ভাঙ্গব আমি’ ছিল বিশ্ব মানবিকতা আর মৌলিক অধিকারের আর গফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ ছিল শোক আর মুক্তির প্রতীক।

সময় ১৯৭০। শুরু হয়ে গেল শুটিং। আর শুটিংয়ের চলাকালে একদিন এফডিসির ২নং ফোরে আর্মি এসে শুটিং বন্ধ করে দিয়ে সকাল দশটায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে গেলেন জহির রায়হান এবং রাজ্জাককে। (তবে আমজাদ হোসেন এবং আফজাল চৌধুরী এ ব্যপারটি কখনো শুনেননি বলে জানান। আফজাল জানান, আমরা খুব স্মোথলি মাত্র ৩০ দিনে শুটিং শেষ করি) বিকেল চারটায় ফিরে এলেন তারা। আসার আগে জহির রায়হান বন্ড দিয়ে এলেন, যদি এই চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবার পর দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তবে তার সব দায়ভার জহির রায়হান বহন করবেন। শুটিং হলো সাভার, এফডিসি এবং জহির রায়হানের বাড়ির ছাদে। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেল ১০ এপ্রিল ১৯৭০। তবে সেটা অত সহজ ছিল না। কারণ ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী ও মেজর মালেক এবং তাদের এদেশীয় তাবেদার দোসররা সেন্সর পর্যায়েও এ সিনেমার ছাড়পত্র না দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। কারণ তারা আবিস্কার করে যে, রওশন জামিলের চরিত্রটি একটি স্বৈরাচারের চরিত্র। যা আইয়ুব খানকে ইঙ্গিত করছে। একে ছাড়পত্র দেয়া যাবে না। কারণ এটি সরকার বিরোধী ছবি। জহির রায়হান দমে না গিয়ে নতুন করে আবার আবেদন করলেন। এবারে সেন্সর বোর্ডে ছিলেন কিছু বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবি। তারা চাইছিলেন ছবিটি মুক্তি পাক। এদিকে দেশপ্রেমিক সচেতন দর্শক আগেই জানতে পেরে মিছিল শ্লোগানে প্রকম্পিত করতে থাকে বাংলার আকাশ বাতাস। ফলে সামরিক সরকার বাধ্য হয় ছবিটি মুক্তি দিতে। মুক্তির প্রথম দিনই সারাদেশে হৈচৈ পড়ে গেল। কারণ বাঙ্গালী এর আগে (এমনকি আজো) এত চমৎকারভাবে শৈল্পিকভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য এবং একটি দেশের সংগ্রামের চিত্র পায়নি। তবে ছবিটি কোন দলের প্রচারপত্র ছিল না। ছিল একটি জাতির মুখপাত্র। এই চলচ্চিত্রের বক্তব্য মানুষকে খুব নাড়া দেয়। আর তখনকার সাধারণ মানুষও ছিল মেধা, মনন আর চেতনায় আজকের সময়ের চেয়ে অনেক বেশী আলোকিত এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। ফলে তারা ধরে ফেলে বাইরের রূপকে ভেতরের কথা। ফলে যা হবার তা-ই হলো। প্রথম দিনই নিষিদ্ধ হলো এর প্রদর্শনী। সব সিনেমা হল থেকে পাক আর্মি জব্দ করে নিয়ে গেল সিনেমার রিল। ঢাকার গুলিস্তান হলের সামনে শুরু হলো বিক্ষোভ। পরদিন সেন্সর বোর্ড আবার বসবে সিনেমাটি দেখতে। সাথে থাকবে রাও ফরমান নিজে। জহির অনেক ভেবে একজনের কথাই স্মরণে আনতে পারলেন, যিনি পারেন ছবিটিকে আবার আলোর মুখ দেখাতে। জহির আমজাদকে দায়িত্বটা দিলেন। কারণ আমজাদের এলাকার মানুষ তিনি। আমজাদ গেলেন সেন্সর বোর্ডের সদস্য নাট্যকার আসকার ইবনে সাইকের কাছে। ভদ্রলোক আবার নিয়মিত নামায রোজা করতেন। আমজাদ হোসেন তার হাটুর কাছে বসে পা টিপতে টিপতে বললেন, স্যার আপনার উপরে সবকিছু। আপনি প্লিজ কালকে যাবেন। উনি বললেন, আমি অসুস্থ। হাই প্রেসার তাই যেতে পারবো না। ফ্যান ছেড়ে হাত পা ছেড়ে বসে রইলেন। আমজাদ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন, স্যার সারাদেশ আপনার দিকে তাকিয়ে।

পরদিন সাইক সাহেব গেলেন সেন্সর বোর্ডে। বোর্ডে উপস্থিত অল পাকিস্তান সেন্সর মেম্বার। মানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল সদস্য। আর আমজাদ প্রজেকশন রুমে চুরি করে অবস্থান নিয়ে প্রজেকশনের ছোট ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। ছবিটি শেষ হলো। রাও ফরমান সহ বাকি সদস্যরা ছবিটি দেখলেন। ছবি শেষ হলে পিন পতন নিস্তব্ধতা গোটা রুম জুড়ে। চেয়ারম্যান সাহেব সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কি মনে করে আসকার ইবনে সাইককে বললেন, আপনি বলেন। তিনি, কিছুণ চুপ থেকে তারপর দাঁড়ালেন। সবার মুখের দিকে একবার চেয়ে বললেন, ‘স্যার পবিত্র কোরআনে কোন মিথ্যে কথা বলা নেই। মিথ্যে কথা বলবার কোন সুযোগও সেখানে দেয়া হয়নি। জহির হয়ত ভুল করে একটা সত্য সিনেমা বানিয়ে ফেলেছে। এই সত্যকে আমি কিভাবে মিথ্যা বলি!’ কেউ আর কোন কথা বলল না। ছবিটি মুক্তি পেল। তবে প্রজেকশন শেষে রাও ফরমান জহিরকে বললেন, ‘ছবিটি ছেড়ে দিলাম। বাট আই উইল সি ইউ’। আর এই ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ছবিটি নিজেই হয়ে গেল এক জীবন্ত ইতিহাস। এটিই এদেশের প্রথম ছবি যা দেখার অধিকার আদায়ে এদেশের দর্শক আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার আদায় করেছে।

এখানে একটা কথা সকলের জানা প্রয়োজন যে, জহির রায়হান ৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারীর একজন প্রত্যেক্ষ অংশগ্রহণকারী এবং ১ম দশজন কারাবরণকারীদের একজন। তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন গল্প ‘পোষ্টার’ এবং উপন্যাস ‘আরেক ফাগুন’। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারী নিয়ে তাঁর ছিল অন্য রকম এক আবেগ। যা আগেই উল্লেখ করেছি যে, একুশে ফেব্রুয়ারী নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করলেও সরকারের বাধায় পারেন নি। কিন্তু ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনিই একুশকে এনেছেন প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রের পর্দায়। শুধু এনেছেন বললে ভুল হবে। কারণ আজ পর্যন্ত আর কেউ এভাবে আনতে পারেননি। এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার আমজাদ হোসেন এবং সিনেমাটোগ্রাফার আফজাল চৌধুরীর সাথে কথা বলে জানলাম সেদিনের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা। আফজাল চৌধুরীর চিফ এ্যসিসটেন্ট অরুণ রায় উঁচু থেকে প্রভাতফেরীর শর্ট নিচ্ছিলেন। আর এ্যসিসটেন্ট তমাল (পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের ছেলে) নিচ্ছিলেন দূর থেকে যেসব দল এগিয়ে আসছিল শহীদ বেদীর দিকে তার ফুটেজ। এদিকে আফজাল চৌধুরী নিজে ধারণ করছিলেন শহীদ বেদীতে আসা দলগুলোর নগ্ন পায়ে আসা এবং ফুল দেয়ার দৃশ্য। প্রভাত ফেরির একটি দৃশ্যে অবশ্য জহির রায়হান নিজেই উপস্থিত ছিলেন। এভাবে যখন কাজ চলছে তখন হঠাৎ করেই জহির যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি ছুটে গেলেন আফজালের কাছে। গিয়ে বলেন, আমাকে একটু দেখিয়ে দিন তো কিভাবে ক্যামেরায় শ্যুট করতে হয়! আমি নিজে ধারণ করবো। তখন আফজাল তাঁকে জুম, মিড, লং সহ অতি সংপ্তি একটি ধারণা দিয়ে দিলেন। আর জহির মনের আনন্দে শুরু করলেন ভিডিও ধারণ। জহির রায়হান নিজেই একজন এডিটর ছিলেন, ফলে মাথায় এডিটিং এর ভাবনা রেখে ধারণ করলেন বেশ কিছু দৃশ্য।

এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন খান আতাউর রহমান। তিনি এই ছবির জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কম্পোজিশন করলেন। শুধু তাই না, উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্র সংগীতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় এই গানটির মাধ্যমে। আর কলকাতার নামীদামি রবীন্দ্র গবেষক ও শিল্পীরা এই সাহসী এবং অসাধারণ কাজের জন্য খান আতা’র ভূয়সী প্রশংসা করেন। অন্যদিকে স্বাধীনতার আগে এটিই ছিল এই গানের প্রথম আনুষ্ঠানিক ব্যবহার। আর গানটার আবেগ মানুষকে এত বেশী স্পর্শ করল যে, যখন স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গানটিকে বাছাই করা হলো তখন কোন আপত্তি এসেছে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা নেই। একইভাবে কাজি নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ সহ একটি বাদে (এ খাঁচা ভাঙ্গব আমি কেমন করে) প্রায় সবগুলো গানেই তিনি করেন আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কম্পোজিশন। এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়া প্রয়োজন যে, আজ আমরা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ শিরোনামে যে গানটি শুনি এটা কিন্তু ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে খান আতার দেয়া সেই কম্পোজিশনটাই শুনি। গানটি এর আগে একই সুরে হলেও খান আতা সিনেমার জন্য গানটাতে হামিং সহ আরো কিছু আবেগমাখা শ্রুতিমধুরতা যুক্ত করেন।

এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে আরো একটি বৃহত্তর তথ্য এখানে জানানো প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে: মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হান ভাত না খেয়ে রিল কিনতেন যুদ্ধের বিভৎসতার ছবি ধারণ করতে। এমনি একটা সময় তিনি খবর পেলেন (সম্ভবত) রংপুরের এক সিনেমা হলের মালিক কলকাতার এক ডিস্ট্রিবিউটরের হাতে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটির রিল দেন সেখানে চালানোর জন্য। জহির সেই ডিস্ট্রিবিউটরের সাথে দেখা করে জানান যে, তিনি এই ছবির পরিচালক। ছবিটি তার। তিনি তাকে অনুরোধ করেন, ছবিটি থেকে তাঁর প্রাপ্য টাকা তাঁকে বুঝিয়ে দিলে তিনি তা মুক্তিযোদ্ধাদের ফান্ডে জমা দেবেন। ছবিটি কলকাতার হলে রেকর্ড ব্যবসা করে। প্রযোজকও জহিরকে তাঁর প্রাপ্য শতভাগ বুঝিয়ে দেন। আর জহির যখন তাঁর প্রাপ্য টাকা হাতে পেলেন, তখন তিনি অবাক টাকার বিশাল অংক দেখে। কিন্তু এখান থেকে একটা টাকাও জহির নিজে খরচ করেন নি। পুরোটাই তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে। সহকারী অরুণ রায় পরবর্তীতে তাঁর চীফ আফজাল চৌধুরীকে বলেছিলেন, সেদিন পকেটে খাবার পয়সা ছিল না, অথচ জহির ভাই সবগুলো টাকা মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে জমা দিয়ে দেন। শুধু তা-ই না। যুদ্ধকালীন সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের ফিল্ম বিভাগের দায়িত্বে থাকা জনাব আবুল খায়ের'র কাছে টাকা জমা দেয়ার সময় তিনি জহিরকে বলেন, এখান থেকে তুমি পাবে এক লাখের মতো টাকা। তোমারটা তুমি বুঝে নাও। জহির নেন নি। অথচ তার একদিন পরই জহির আবুল খায়ের সাহেবের কাছ থেকে ১০০ টাকা ধার করেন খাবার কেনার জন্য। আর একটা কথা হচ্ছে, সে সময়ও আজকের মতো অসভ্য সচিব জাতীয় কিছু চামার ছিল। তারা জহিরকে নিয়ে নানা চক্রান্ত শুরু করেছিল। যেটা হয়েছিল স্টপ জেনোসাইড করার সময়। সে গল্প আরেকদিন হবে। আরেকটা গোপন কথা: বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রধান কুচক্রি এবং ষড়যন্ত্রকারী আওয়ামীলীগ নেতা, এমপি এবং মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক, তাজউদ্দিনের কাছ থেকে লিখিত নিতে চেয়েছিল জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্র থেকে আয় করা সব টাকা তার ফান্ডে জমা দেয়ার ব্যপারে। কিন্তু জনাব আবুল খায়ের সাহেবের হস্তক্ষেপে এবং তাজউদ্দিনের শক্ত অবস্থানের জন্য সেটি সফল হয় নি।

এই চলচ্চিত্রের একটি মিছিলের দৃশ্যের জন্য রাশেদ খান মেননের সহযোগীতায় পুরান ঢাকা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত লম্বা হয়ে যায়। এভাবেই এই চলচ্চিত্রটি হয়ে দাঁড়ায় এদেশের আপামর জনসাধারণের প্রাণের কথার প্রতিচ্ছবি।

আজ ২০১২ সালে বসে একটা কথা ভাবতে হচ্ছে খুব কষ্ট নিয়ে। বাংলাদেশের বুকে চলচ্চিত্রের সবচেয়ে আলোকিত অধ্যায় যে বা যারা রচনা করেছিল তাঁদের প্রতি কোন দায় কি এদেশ ও জাতি বহন করেছে! না করেনি। এই চলচ্চিত্রের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে জহির রায়হান, খান আতা, রওশন জামিল, রোজি, ব্ল্যাক আনোয়ার সহ আরো অনেককে। যারা আছেন তাঁদের মাঝে শ্রদ্ধেয় আনোয়ার হোসেন আজ বয়স্কজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে সারাদিন কাটান বিছানায়। আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্র প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। নায়ক রাজ্জাক এখনো চলচ্চিত্রের সুদিন নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। আফজাল চৌধুরী শুধু স্মৃতিতেই রেখেছেন সেই দিনগুলি। শওকত আকবরের কোন খোঁজ আমি জানি না। এছাড়া সুচন্দা সহ আরো অনেকে আজ জীবনের নানা দায়িত্ব নিয়ে কর্মব্যস্ত। এ জাতির কি উচিৎ নয় এদের প্রতি একটা সম্মান জানানো? অন্তঃত যারা জীবিত আছেন তাঁদের একটা সম্মাননা দেয়া? নাকি এ জাতি সব সময়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখবে পুরোপুরি দুটি দলে ভাগ হয়ে না গেলে গুণীরা এ দেশে সম্মান পায় না।

আমি শতভাগ বিশ্বাস করি যে, জহির রায়হান বেঁচে থাকলে বর্তমান সময়কে নিয়ে ‘জীবন থেকে নেয়া -২,৩’ এভাবে সিক্যুয়েল বানাতেন। আমাদের আজকের রাজনৈতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতি কোনভাবেই আজ আর ইয়াহিয়া আইয়ুব খানদেরকে প্রতিযোগীতায় রাখছে না। তাদেরকেও করছে পরাজিত। অধিকারহীনতা মানুষকে আজ শোষণে আর লাঞ্ছনায় নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংশের শেষ সীমায়। আর সেদিনের মতো আজো কিছু পদলেহনকারী অপ্রগতিশীল দলীয় বুদ্ধিজীবি, যারা সিনেমার কিছু না জেনেই সেন্সর বোর্ডে বসে থাকে শুধুমাত্র দলীয় তাবেদারীর পুরস্কার হিসেবে। তারা ছবিটিকে আটকে দিতেন সেই ১৯৭০ সালের মতো। কারণ সময় বদলেছে, কিন্তু আমাদের চরিত্র সেই একই রকম রয়ে গেছে। মাঝে আছে শুধু একটি স্বাধীন দেশ। আমাদের সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা এবং আমাদের আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আজ এত প্রকটভাবেই সেই ৭০ এর কথা মনে করিয়ে দেয় যে, সেন্সর সদস্যরা নিজেদের মোসাহেবগিরি দেখাতে গিয়ে প্রথমে ‘হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ’ আর পরে ‘দেবদাস’ ছবিটি সেন্সর বোর্ডে আটকে দিয়েছে। আর তার কারণটা এতই লজ্জাজনক যে, আমি নিশ্চিত সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা কোন ভদ্র পরিবেশে সেই কারণটি বলতে পারবেন না মানুষের ঠাট্টার পাত্র হবেন বলে, নীচুতা প্রকাশ পাবে বলে। সেই সাথে আফজাল চৌধুরীর একটা কথা জানিয়ে শেষ করবো। কথাটা হলো: ‘যদি জহির আজ বেঁচে থাকতো তবে আজকের চলচ্চিত্র আর এফডিসির চেহারা দেখে নিশ্চিত আত্মহত্যা করতো। ৪০ বছর আগে যেরকম ভাল স্টুডিওতে সে কাজ করেছে, যত রকম সুবিধা পেয়েছে সেখান থেকে তার কিছুই আজ নেই। আজকের দিনটি তাঁকে দেখতে হয়নি, সে সৌভাগ্যবান।’

তথ্যসূত্র: ইন্টারভিউ (আমজাদ হোসেন এবং আফজাল চৌধুরী) এবং ইন্টারনেট

বি.দ্র.: লেখাটি 'সাপ্তাহিক কাগজ' এ প্রকাশিত হয়েছিল
৪২টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×