নদীয়ার ভাব পরিমন্ডলের মধ্যে বেড়ে ওঠা সাধন-ধারার অন্যতম প্রধান সাধক ফকির আবদুর রব ওরফে লবান শাহ গত কাল কুষ্টিয়াতে দেহ রেখেছেন। তিরোধানকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি বাংলার ভাবান্দোলনের চূড়ামণি দার্শনিক ফকির লালন শাহ'র সাক্ষাত শিষ্য ভোলাই শাহ'র ঘরের লোক। ভোলাই শাহ এর সরাসরি শিষ্য আরেক প্রখ্যাত সাধক কোকিল শাহ ছিলেন তাঁর দীক্ষা গুরু। গুরুর কাছে খেলাফত প্রাপ্তির পর থেকে তিনি লবান শাহ নামে পরিচিত হন। তার নিজস্ব আখড়াবাড়ি কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের খৈলশাকুন্ডিতে। যা জ্যোতিধাম নামে পরিচিত। প্রতি বছর দোলোৎসবের পরে সেখানে সাধুসঙ্গ হতো। এবারেও হবার কথা। সেমতো সবাইকে দাওয়াতও করে ছিলেন। আমাদের কয়েকজনেক অভিমান করে বলেছিলেন, তোদের একটারও কথার ঠিক নাই! আসবি আসবি বলস কিন্তু আসস না... তোদের দাওয়াত দিয়া কি লাভ? মনে মনে ঠিক করেছিলাম যত কাজই থাকুক, যাইকিছু হোক—এবার যাবোই সঙ্গের সময়টাতে। সাঁইজী এতটা মন খারাপ করেছে বুঝতে পারি নাই। কিন্তু এখন তিনি আর নেই...
লালনের প্রতিনিধিত্বশীল ঘরের মধ্যে লবান শাহের শিষ্য-ভক্ত-অনুরাগিদের ধারাটিই বর্তমানে সর্বাধিক পরিচিত ও প্রভাবশালী। বাংলা ১৪১৬ সাল অনুযায়ী কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন সাঁইয়ের ১১৯তম তিরোধান দিবস ছিল পহেলা কার্তিক। কুষ্টিয়া একসময় ছিল বৃহত্তর নদিয়া জেলার অংশ। নদীয়ায় যে ভাববিপ্লব ঘটিয়েছিলেন ‘তিন পাগল’ কুষ্টিয়া সেই নদীয়ারই প্রাণ। তিরোধান দিবসের অনুষ্ঠানে বরাবরের মতো উপস্থিত হতে তিনি ছেঁউড়িয়ায় সাঁইজির ধামে এসেছিলে।
কিন্তু খুব মনখারাপ করে আমাদের বললেন, তোরা যে কেন এখানে আসিস! নদীয়া তো এখানে আর নাই। এখানে নদীয়া আর খুঁজে পাবিনা। বোঝা যাচ্ছিল আখড়ার মেলা ও বাণিজ্যিক পরিবেশে তিনি মর্মাহত।
তখনও শরীর তেমন একটা ভালছিল না। এর আগে হার্টের সমস্যায় কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তিও হতে হয়েছিল। তবে ছিলেন বেশ হাসিখুশি ও প্রাণবস্ত। দূরদূরান্ত থেকে লালনের স্মৃতিধামে ছুটে আসা সাধু-গুরুদের সাথে দেখা করছিলেন, কথা বলছিলেন। আমাদের মতো তরুণ ও অল্প বয়সের লালন অনুরাগীদের তিনি আন্তরিকতার সাথে বুঝাচ্ছিলেন নানান তাৎপর্যপূর্ণ দিকগুলো। বলছিলেন, শ্রীচৈতন্য বা শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নদিয়ায় যে লীলা করে গিয়েছিলেন তার রাজনীতিক গুরুত্বের কথা। গণমানুষের পক্ষে জাতপাত, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদবিরোধী যে সংগ্রাম তখন শুরু করেছিলেন, সেটা আবার উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণের হাতে পড়ে উচ্চকোটির বর্গে উঠে গিয়ে কিভাবে নির্জিব হয়ে গেছে। বিশেষত, বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের সংস্কৃত ভাষায় শাস্ত্রচর্চায় টিকাভাষ্যে গৌরাঙ্গের শিক্ষা যে রূপ নিয়ে দাঁড়ায় সেটা আর গণমানুষের ধর্ম বা লড়াই হয়ে টিকে থাকে নি। দিনানুদৈনিকের লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেটা আধুনিক ইস্কনের রূপ নিয়েছে।
সুলতানি আমলে ইসলামের জাতপাতবিরোধী চৈতন্যের সংস্পর্শে যে বৈপ্লবিক রূপান্তরের সূচনা ঘটেছিল সেটাও ক্রমে ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু তিন পাগলের ‘আসল’ পাগল নিত্যানন্দ থেকে যান নদিয়ায়। অন্য ‘পাগল’ অদ্বৈতাচার্যকে কেন্দ্র করে ‘শান্তিপুর’ ভাবচর্চার আরেকটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু নদিয়ার গণমানুষের লড়াই ও তত্ত্বচর্চার মূল ধারাটি পুরো ধরে রাখা যায় নি। যতোটুকু এখন অবধি আছে তার ছাপ কিছুটা ফকির বয়াতিদের গানে ও সাধুগুরুদের জীবনযাপনের মধ্যে খুঁজলে পাওয়া যায়। আর জারিকৃত লড়াইয়ের চিহ্ন যার বদৌলতে টিকে আছে তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। তিনি এ বঙ্গ ছেড়ে যান নি। তাইতো তিনি দয়াল নিতাই: ''ধরো চরণ ছেড়ো না, দয়াল নিতাই কারো ফেলে যাবে না...''।
লালনের তত্ত্বচিন্তা, ভাব, ভক্তি, সেবা ও করণকর্মের বিষয়গুলো এভাবেই ব্যাখা করতে পারতেন খুব সহজ করে, প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে। বিশেষত, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নানান অনুমান I অস্পষ্ট ধারণার গোড়াটা তিনি খুব ভালোভাবে বুঝতেন। তাই বরাবার সর্তক করে দিতেন। বিরক্তও হতেন। আমরা যখন কথা বলছিলাম, সেসময় একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লোক এসে তার মুখে ধরে বসল, বলল আপনি কিছু বলেন। বেচারা ভেবেছিল উনি গদগদ হয়ে ফিরিস্তি দেওয়া শুরু করবেন। তিনি বললেন: ''এই ক্যামেরা সরা... কি জানতে চাস সেটা আগে বুঝ, তার পরে মাইনসেরে দেখাইস''। ছেলেটি আবারো প্রশ্ন করল: 'লালন সম্পর্কে কিছু বলেন। এইবার সাইজি দিলেন ধমক, বললেন: 'লালনরে আমি দেখি নাই, লোকমুখে শুনছি, শোনা কথা তোরে কি বলব...' । এখানে একটা নোক্তা দেই, সাঁইজী এভাবেই ভ্যবাচ্যাকা খাওয়া কথা দিয়ে শুরু করতেন। তবে এর মানে তিনি কথার কথা বলতেন তাও নয়। যেমন, এখানে তিনি বুঝাতে চাচ্ছিলেন বাক্য ও বাক্যার্থের সম্পর্ক বা সত্যাসত্য আসলে কিভাবে নির্ণিত হয় সেই দিকটা। কোনো বাক্য শুধু বাক্য আকারে কোনো সত্য ধারণ আদৌ করে কিনা সেটাই উস্কে দিচ্ছিলেন। যেমন, নবী যখন বলে এটা ঐশী বা পরমার্থিক সত্তার বাণী তখন তা বাক্যের গুণে নির্ণয় করার কোনো জো নাই। বরং এটা সম্পূর্ণতই নির্ভরশীল খোদ নবীর উপর বিশ্বাসে, নবীর নবীত্বে। তার দাবি সত্য আকারে স্বীকার করে নেওয়াই এর সত্যাসত্য বিচারের শর্ত। এখন লালন নিয়ে এই কথা বলার পেছনে তার ইঙ্গিতটা হলো গুরুরূপে যিনি আছেন, যিনি বলবেন বা অর্থ করবেন তার কর্তৃত্বের কর্তা সম্পর্ক আগেই নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ বা সত্যাসত্য নির্ণয়ের এই গুরুসূত্র ধরেই তিনি কথা বলছিলেন। হঠাৎ শুনলে অনেকেরই কানে জিনিষটা পৌঁছাবে না। খাঁটি দর্শনের স্বাধ সহজ কথোপকথনের মধ্যে কিভাবে উঠে আসে তার দুর্দান্ত নজির ছিলেন সাঁইজী। এটা বাংলার ভাবান্দোলনেরই শক্তির জায়গা। নিজের ভাষায় ভাবের আদানপ্রদানের জৌলুশ।
গত নয় বছর ধরে বছরে দুইবার অন্তত ছেঁউড়িয়ায় যাওয়া পড়ে। দোলে ও কার্তিকে। প্রতিবারই সাঁইজীর সাথে দেখা হয়েছে প্রতিবারই কিছুনা কিছু প্রশ্ন দিয়েছেন ভাবার জন্য। আর হাসতে হাসতে বলতেন: দেখি তোরা কি পড়াশুনা করস...। কসম, আমার কেতাবি বিদ্যা তার কিছুরই কূলকিনারা করতে পারে নাই। গিয়ে আবার তাকেই ধরেছি। অনেকেই দেখি আজকাল কুষ্টিয়ায় যায়, সেটা ভালো, আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু বিপত্তির জায়গা হলো গিয়ে যখন গাঁজার আসার খুঁজে। এই দ্রব্যটা ঢাকায় বসেই সেবন করা যায়, কষ্ট করে কুষ্টিয়া যাওয়ার তো কোনো দরকার নাই।
একবার তাকে জিগগেস করেছিলাম এই ব্যাপারটা। বললেন : বস্তুর উপর আসক্তি দিয়ে নেশাগিরি হয় সাধুগিরি হয় না। তিনি সাধনার ধারার সাথে যেকোনো ধরণের মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি লালনের নীতি কঠোরভাবে পালন করতেন। তবে এমনিতে, এটা করলে তাকে খারাপ বলা বা পাপ পুণ্যে কথা তোলা এই ধারার কাজ না।
দীর্ঘদিন থেকেই নবপ্রাণ আন্দোলনের সাথে তার ভাবগত যোগাযোগ। কুষ্টিয়ায় আসলে নবপ্রাণের আখড়াবাড়িতে উঠতেন। সেখানে সেবা নিতেন। সকালের গোষ্ঠগান ও সন্ধ্যার দৈন্যগানের
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১২:২৬