নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- পনেরো)

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৩

পনের

জন্মনের হাটের ঘাটে রঘু তরণী নোঙর করলো মধ্যাহ্নের পর পর। মধ্যাহ্নভোজনের পর দাঁড়িদের একটু বিশ্রাম প্রয়োজন, আজ যাত্রা করলে চম্পানগরীতে পৌঁছতে রাত্রি হয়ে যাবে। তাই রাত্রি এখানে অতিবাহিত করে কাল ভোরবেলায় তারা যাত্রা করবে চম্পানগরীর উদ্দেশ্যে। হাটে প্রচুর মানুষ; কেউ যাচ্ছে, কেউ আসছে। তরণীতে আজই হবে গণিকাদের শেষ রাত্রি, গিরিকা চান আজ দধি-মিষ্ট সহযোগে পঞ্চ ব্যঞ্জনে ভোজনের আয়োজন করতে; তাই আহার-নিদ্রার পর অপরাহ্ণে তিনি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করার জন্য সুলোচনা, রঘু, বলাই আর ললিতকে সঙ্গে নিয়ে হাটে গেলেন। আজও শ্যাম আর সুকেতু রইলো তরণী পাহাড়ায়।

ঋষ্যশৃঙ্গ এখন অবুঝ বালকের ন্যায় ঘুমোচ্ছে, সেই মধ্যা‎হ্ন থেকে হাটে যাবার আগ পর্যন্ত গিরিকা এই কক্ষের মেঝেতে পশ্চাৎদেশ ঠেকিয়ে বকবক করছিলেন, তার বকবক শুনতে শুনতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে সে। শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক চোখে। কিশোরের ন্যায় কী সুন্দর নিষ্পাপ মুখশ্রী! মায়ামাখা মুখশ্রীর দিকে কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তার। ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাঁটা-চলা, কথা বলা, মৌনতা, চুম্বন-আলিঙ্গন সবকিছুতে এমন নিষ্পাপ-নিষ্কলুষতা বিদ্যমান যে সে কেবল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে অনন্তকাল! অথচ অনন্তকাল নয়, কালকের পর থেকেই হয়তো সে আর কখনোই দেখতে পাবে না ঋষ্যশৃঙ্গকে; আর দেখলেও দেখতে হবে দূর থেকে, নগরীর আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো! কথাটা মনে হতেই তার বুকের ভেতর দিয়ে যেন গঙ্গার বক্ষ ছুঁয়ে আসা শীতল বাতাস বয়ে গেল, হাহাকার উঠলো বুকের ভেতর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নানঘরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে কেশ পরিচর্যা করলো, মুখে হালকা প্রসাধন মেখে চোখে কাজল পরলো। ঋষ্যশৃঙ্গ পাশ ফিরে শোয়ায় উপাধান থেকে মাথাটা শয্যায় ঢলে পড়লে যাতে নিদ্রাভঙ্গ না হয় সে-জন্য খুব সতর্কভাবে মাথাটা পুনরায় উপাধানে তুলে দিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ’র মুখের ওপর ঝুঁকে স্থির হয়ে রইলো সে, তার তপ্ত নিশ্বাস পড়লো ঋষ্যশৃঙ্গ’র মুখে। আলতোভাবে ডান হাতের আদুরে স্পর্শ বোলালো ঋষ্যশৃঙ্গ’র কপালে, কপোলে, ওষ্ঠে। কপালে ও ওষ্ঠে মৃদু চুম্বন করলো। তার জলভরা চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ঋষ্যশৃঙ্গ’র কপোলে।

কক্ষের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে উমাকে ডাকলো শবরী, সে ভেবেছিল উমা হয়তো গিরিকার কক্ষে, কিন্তু কক্ষ থেকে উমার কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো উমা নেই, কোথায় গেল উমা!

শবরী একাই ছাদে উঠলো, সূর্য গঙ্গার বক্ষ থেকে কমলা রঙের উত্তরীয় টেনে নিয়ে ক্রমশ যেন ডুবে যাচ্ছে গঙ্গার বক্ষেই! পলকে পলকে আরামদায়ক বাতাস এসে আড় ভাঙছে শরীরে। শবরী ছাদের একপাশ থেকে আরেক পাশে হাঁটলো কিছুক্ষণ, তারপর গলুইয়ের কাছে বসে থাকা শ্যামের উদ্দেশে বললো, ‘ও দাঁড়ি, আমার সখি উমা কোথায় গেল?’

প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিব্রত মনে হলো শ্যামকে, বললো, ‘ওরা তো হাটের দিকে গেল।’

‘ওরা মানে?’
‘আজ্ঞে, আপনার সখি আর সুকেতু।’

আর কোনো প্রশ্ন করলো না শবরী, কেদারায় বসে গঙ্গাবক্ষের দিকে তাকিয়ে রইলো। ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতে আরোহণ করার দিনই সুকেতুর সঙ্গে উমার সখ্যতা তার চোখে পড়েছিল। দুজনের মাঝে যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা তার কাছে পরে স্বীকারও করেছে উমা। ত্রিযোজনব্যাপী পর্বত থেকে ফিরে এসে রাতে আহারের পর উমা আর সুকেতু তরণী থেকে নেমে অরণ্যের অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল। সে-কথা সে আর শ্যাম ছাড়া আর কেউ জানে না। তার কাছে কোনো কথাই গোপন করে না উমা, কেননা উমা জানে তার বিশ্বস্ত সখি সে, গিরিকার গর্ভজাত কন্যা হলেও উমার কোনো ক্ষতি হবে এমন কোনো কথা সে গিরিকাকে বলবে না। সুকেতু নাকি উমাকে বলেছে, ও যদি গণিকার জীবন পরিত্যাগ করে তবে তাকে বিয়ে করে সংসারী হবে সুকেতু, অঙ্গরাজ্য থেকে তাকে নিয়ে পালিয়ে চলে যাবে অন্য কোনো রাজ্যে। উমা সুকেতুর কাছে কিছুদিন সময় চেয়েছে।

শবরী মনে মনে হাসলো এই ভেবে যে সুকেতু আর উমার বিবাহ হলে ভালই হবে। এ ক’দিনে সুকেতুকে দেখে তার মনে হয়েছে যে কিছুটা ডাকাবুকো স্বভাবের হলেও মানুষ হিসেবে সে খুব ভাল। মুখে যা বলে তা করেই ছাড়ে। সুকেতুর সঙ্গে উমাকে মানাবেও বেশ। দুজনের মনেও মিলবে, সুকেতু যেমনি ডাকাবুকো, তেমনি উমাও খোলতাই স্বভাবের।

শবরী জানে উমা আর সুকেতু বিবাহ করতে চাইলে তার মাতা উমাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইবেন না। বালিকা উমাকে মাতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নৃত্য-গীতসহ গণিকাবিদ্যায় পারদর্শী করে তুলেছেন, এখন উমা যুবতী, ওর পিছনে মাতা যে কড়ি খরচ করেছেন তা তুলে নেবার সময় এখন। তার ওপর সুকেতু অনার্য। আর্য-অনার্য বিবাহ যে একেবারে হয় না তা নয়, হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে আর্য পুরুষ অনার্য নারীকে বিবাহ করে। আর্য নারী আর অনার্য পুরুষে বিবাহ খুব কম হয়, হলেও সেই আর্য নারীর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না, সমাজচ্যুত হয় সে। পুরাকালে অনার্য দেবতা দেবাদিদেব শিব আর্য নারী সতীকে বিবাহ করেন। সেই নিয়ে কী মহাকাণ্ড! সতীর পিতা প্রজাপতি দক্ষ কিছুতেই তার জামাতাকে মেনে নেন নি, একবার তিনি এক যজ্ঞের আয়োজন করেন, অনেক দেবতাকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করলেও নিজকন্যা সতী এবং জামাতা শিবকে নিমন্ত্রণ করেন নি। তাতে সতী অপমানিত বোধ করেন, শিবের বারণ সত্ত্বেও তিনি যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে পিতার ‍মুখোমুখি হন। দক্ষ অতিথিদের সামনেই সতীকে তিরোষ্কার এবং অপমান করেন, শিবের নিন্দা করেন। পতিনিন্দা সইতে না পেরে সতী যজ্ঞের আগুনে আত্মবিসর্জন করেন। এই দুঃসংবাদ শুনে ক্ষুদ্ধ শিব তার সঙ্গীদের নিয়ে দক্ষালয়ে গিয়ে যজ্ঞশালা এবং যজ্ঞবেদী ধ্বংস করেন, তারা যজ্ঞগুরু ভৃগু’র দাড়ি ছিঁড়ে ফেলেন। শিব ত্রিশূল দিয়ে দক্ষের মাথা ছিন্ন করেন। পরে শিব যক্ষকে ক্ষমা করে দিয়ে তার ছিন্ন মাথার স্থলে একটি ছাগমুণ্ড স্থাপন করেন এবং যজ্ঞের অনুমতি দেন।

শবরীর ভারী অদ্ভুত লাগে, মানুষের কাটা মাথার স্থলে আবার ছাগমুণ্ড স্থাপন করে কিভাবে! কাটা আঙুলই জোড়া লাগানো যায় না, আবার মাথা! বিশ্বাস হয় না শবরীর, তার মনে হয় এ ঘটনাও নিশ্চয় ঋষ্যশৃঙ্গ’র মাথায় শৃঙ্গ থাকার মতোই ভিত্তিহীন জনরব!

শবরী ঠিক করেছে সুকেতু যদি সত্যিই উমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায়, তবে ওদের সুখের কথা ভেবে সে উমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

অন্ধকার নেমে এসেছে। গিরিকা এবং অন্যরা হাট থেকে ফিরেছে। গিরিকা নিজের কক্ষে বসে প্রদীপের আলোয় হাট থেকে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করতে কতো খরচ করেছেন আর কতো কড়ি অবশিষ্ট আছে কড়ি গণনা করে সেই করছেন, তাকে সঙ্গ দিচ্ছে সুলোচনা।

শবরী আর উমা চাঁদের আলোয় ছাদে বসে গল্প করতে করতে জাম খাচ্ছে, হাট থেকে অনেক জাম ক্রয় করে এনেছেন গিরিকা, সেই জাম ধুয়ে দিয়ে গেছে উলুপী। গিরিকা হাট থেকে ফেরার আগেই উমা আর সুকেতু তরণীতে ফিরেছে। সুকেতু হাট থেকে উমাকে সুক্ষ্ম কারুকাজ করা মৃৎ-হার এবং চুড়ি কিনে দিয়েছে, আড়ালে নিয়ে গিয়ে ভালবেসে এক গণ্ডা চুম্বন দিতেও ভোলে নি। উমা সে-সব কথাই চুপি চুপি বলছে তার প্রিয় সখি শবরীকে আর শবরী হেসে গড়িয়ে পড়ছে। একটু পর তাদের সঙ্গে যোগ দিলো সুলোচনা। কথায় কথায় রাক্ষসদের প্রসঙ্গ উঠতেই সুলোচনা বললো, ‘ভগবান বিষ্ণুর দিব্যি, আমি আর কোনোদিন পর্বতারোহণে যাবো না।’

উমা বললো, ‘কেন লো, রাক্ষসরা কি তোকে কিছু করেছে?’
‘তা না করুক, যা ভয় পেয়েছিলাম!’

‘রাক্ষসদের সর্দারের সঙ্গে তোর বিবাহ দিয়ে এলে ভাল হতো, সর্দারনী হয়ে সকলের ওপর খবরদারি করতে পারতি।’
‘রক্ষে করো বাছা, দরকার নেই আমার অমন সর্দারনী হওয়ার!’

শবরী বললো, ‘যাই বলিস, পর্বতারোহণে দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। রাক্ষসদের সম্পর্কে কতো মন্দ কথাই না শুনেছি এতোদিন! অনার্য রাক্ষসরা অসভ্য, কদর্য ভক্ষণ করে, তারা প্রচণ্ড আর্য বিদ্বেষী, আর্যদের পেলেই তারা হত্যা করে, আর্যদের সম্পদ এবং নারী লুণ্ঠন করে, এরকম আরো কতো কথা। শৈশবে খেতে না চাইলে মাতা ভয় দেখিয়ে আমায় বলতেন, “ওই যে রাক্ষস আসছে, রাক্ষস এসে সব কেড়ে খেয়ে ফেলবে কিন্তু!” আর আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে মাতার কাছে ছুটে এসে খেয়ে নিতাম। আমি দুষ্টুমি করলেই মাতা বলতেন, “ওই যে রাক্ষস ধরলো!” ভয় পেয়ে ছুটে এসে মাতাকে জড়িয়ে ধরতাম।’

উমা বললো, ‘আমার ক্ষেত্রেও তাই হতো। আমার ঠাকুমা আর মাতা ভয় দেখাতেন। বলতেন রাক্ষসদের ইয়া বড়ো শরীর, বড়ো বড়ো দাঁত, বিশাল হাতের লম্বা-লম্বা নখ দিয়ে ওরা মানুষের পেট চিঁড়ে খায়; ওরা নরমাংস খাদক!’

‘অথচ ওরা আমাদেরই মতো মানুষ, পার্থক্য কেবল গাত্রবর্ণ আর মুখশ্রীর গড়নে। আমাদের সমাজে কেউ মন্দ আচরণ করলেই তার আচরণকে রাক্ষসাচার বলে আখ্যা দেয় সকলে। যেন যতো অন্যায়-অনাচার রাক্ষসেরাই করে, আমরা আর্যরা ধোয়া তুলসী পাতা!

বড়োদের মুখে দেবতাদের কতো অন্যায় আচরণের কথা শুনেছি, দেবরাজ ইন্দ্র অহল্যাকে ধর্ষণ করেছেন, ঋষিদের তপস্যা নষ্ট করার জন্য দেবতারা ছলনা করে স্বর্গের বারাঙ্গনাদের মর্তে পাঠান সে-কথাও কারো অজানা নয়। আর আর্যাবর্তের পুরুষদের অপকর্ম তো নিত্যদিনই কানে আসে, চোখের সামনে দেখতে পাই আর্য পুরুষদের কদাকার আচরণ। অথচ যতো দোষ রাক্ষসদের!’

সে-দিন পর্বত থেকে ফেরার পথে রাক্ষসরা ওদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের জন্মনে, সর্দারের কাছে। রাক্ষসরা ধারণা করেছিল তারা হয়তো আর্যদের গুপ্তচর, রাক্ষসদের আবাস সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে এসেছে। আর্যদের সম্পর্কে রাক্ষসদের এই সতর্কতা কিংবা ভয়ের কারণ হলো পূর্বে আর্যরা এই রাক্ষসদের বাস্তুচ্যূত করেছিল, রাক্ষসদের বসতি ছিল আরো উত্তর-পশ্চিমে। যুদ্ধ-নিপুণ আর্যরা অন্যায় যুদ্ধ করে সেখান থেকে ওদের পূর্বপুরুষদেরকে বিতাড়িত করেছিল। বাস্তুচ্যূত রাক্ষসরা তখন নিচের দিকে নেমে এসে কেউ পাহাড়ে, কেউবা আরো নিন্মভূমিতে অর্থাৎ সমতলে বসতি গড়েছিল। ওদের গোত্রের নিজস্ব নাম থাকলেও আর্যদের মাধ্যমে ওরা রাক্ষস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এখনো কোথাও কোথাও আর্যদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে যুদ্ধে অনিপুণ নিরীহ ভূমিপুত্র রাক্ষসরা।

শবরীরা রাক্ষস সর্দারকে জানায় যে তারা আর্যদের গুপ্তচর নয়, নয় স্বর্গের বারাঙ্গনাও, তারা অঙ্গরাজ্যের অতি সাধারণ মানুষ। ভিন রাজ্যের আত্মীয়বাড়ি থেকে ফেরার পথে পর্বতারোহণের সখ হওয়ায় তারা এখানে এসেছে। শবরীরা তিনজন ব্যতিত রঘু, শ্যাম, সুকেতু আর উলুপী অনার্য; মুখের গড়ন আলাদা হলেও তাদের গাত্রবর্ণ রাক্ষসদের মতোই কালো। তারাও রাক্ষসদের কাছে অনুনয়-বিনয় করে বলেছে যে কন্যারা কোনো গুপ্তচর নয়, তারা অতিশয় ভালো মানুষ, ভাল মানুষদের ক্ষতি করা অনুচিত। রাক্ষস সর্দার তাদের কথা বিশ্বাস করেছে। তারপর সর্দাদের আদেশে রাক্ষস নারীরা সুস্বাদু পাকা শ্রীফল, জল আর শ্রীফলের খোলায় এক প্রকার বুনো বৃক্ষের বাকল দিয়ে প্রস্তুত মদ্য দিয়ে তাদেরকে আপ্যায়ন করেছে। রাক্ষস নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরেই কোনো বস্ত্র ছিল না; নিন্মাঙ্গে পশুচামড়ার পরিচ্ছদ থাকলেও উর্ধাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত; তবু তারা বেশ স্বচ্ছন্দেই চলাফেরা করছিল সকলের সামনে। আর রাক্ষস শিশুরা ছিল সম্পূর্ণ উলঙ্গ। ইচ্ছে মতো তারা মাতার বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুগ্ধ পান করছিল। পানাহারের পর রাক্ষস সর্দারের নির্দেশ অনুযায়ী অন্যান্য রাক্ষসরা ওদেরকে ফেরার পথে এগিয়ে দিয়েছে। রাক্ষসদের আন্তরিক আপ্যায়নে রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছে শবরী।

এদিকে ঘুম ভাঙতেই চমকে উঠলো ঋষ্যশৃঙ্গ! সন্ধ্যা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই উলুপী কক্ষে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে, প্রদীপের আলোয় প্রথমেই ঋষ্যশৃঙ্গ’র দৃষ্টিতে পড়লো কক্ষের ছাদ। ধড়মড় করে উঠে বসে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো কক্ষের চারপাশ, কক্ষের এককোনে দীপাধারের ওপর শিখায় মৃদু উল্লোল তুলে প্রদীপ জ্বলছে, কক্ষটি আশ্রমের কক্ষের মতো নয়। সে কি আশ্রমে নেই? অথচ স্বপ্ন দেখেছে আশ্রমে শুয়ে আছে সে। প্রচণ্ড ঝড় বইছে, ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে কুটীরের একটা চালা, আরেকটার নিচে চাপা পড়েছে সে। অন্যদিকে তার পিতাশ্রীও কুটীরে নেই, তিনি আহার সংগ্রহ করতে গিয়ে অরণ্যের মধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ে চিৎকার করছেন সাহায্যের জন্য। গৃহচাপা পড়ে সে পিতাশ্রীর আর্তচিৎকার শুনতে পারছিল কিন্তু শত চেষ্টাতেও কিছুতেই উঠতে পারছিল না।

এমন সময়েই ঘুম ভাঙলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র। কক্ষের চতুর্দিকে দৃষ্টি বুলাতে বুলাতে ক্ষণকাল পরেই তার মনে পড়লো যে সে তো আশ্রম ত্যাগ করে প্রেয়সীর সঙ্গে চলে এসেছে রতিব্রত পালন করার জন্য। এখন সে তার পিতাশ্রীর নিকট থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। পিতাশ্রী কি সত্যিই কোনো বিপদে পড়েছেন, নইলে এমন দুঃস্বপ্ন দেখলো কেন সে? পিতাশ্রীর জন্য বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো তার। তার মনে পড়লো পিতাশ্রীর ছায়াতলে বেড়ে ওঠা কুটীরের দিনগুলোর কথা, মনে পড়লো তার শৈশবের এক ঝড়ের কথা।

তখন পিতাশ্রীর কাছে শাস্ত্রশিক্ষা এবং ধ্যান ব্যতিত বালক ঋষ্যশৃঙ্গ’র সময় কাটতো মৃগ এবং বানরদের সঙ্গে খেলা করে। পিতাশ্রী ব্যতিত অন্য কোনো মানুষও সে দেখে নি। দেখেছে কেবল বনের পশু-পাখি, পোকামাকড়, অজস্র বৃক্ষ, বক্ষে শীতল জলধারা বয়ে চলা ঝিরি আর স্রোতস্বিনী নদী কৌশিকীকে। ফলে সে কোনো মনুষ্য খেলা খেলতে জানতো না। পিতা যখন আহারের সন্ধানে বাইরে যেতো, তখন সে পাখিদের উড়তে দেখে নিজের দুই হাত দু-দিকে প্রসারিত করে একা একাই দৌড়ে ‘পাখি উড়া’ খেলতো। মৃগরা লাফিয়ে উঠে যেভাবে দাড়িম্ব কিংবা অন্যান্য বৃক্ষের পাতা ভক্ষণ করতো, সেও সেভাবে লাফিয়ে বৃক্ষের পাতা ছিঁড়ে মুখে পুরে চিবোনোর ভঙ্গি করে ফেলে দিতো। আর সে মজা পেতো বানর খেলা খেলে। বানরেরা যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে গিয়ে ফল ছিঁড়ে খেতো, সেও আঙিনা আর দেহলীতে আমলক কিংবা করমচা ছড়িয়ে রেখে বানদের অনুকরণ করে লাফিয়ে লাফিয়ে সেগুলো খুঁটে খুঁটে খেতো। বানরেরা যে রকম একে অন্যের সঙ্গে খুঁনসুটি করতো, সেও সেভাবে খুঁনসুটি করার চেষ্টা করতো বানরদের সঙ্গে! বেশ কয়েকবার বানরের আঁচড়ে তার হাত ছড়ে গিয়েছিল। দু-একদিন আশ্রমে ফিরে বিভাণ্ডক আড়ালে দাঁড়িয়ে পুত্রের এই খেলা দেখে পুলকিত হতেন, মনে মনে হাসতেন। পুত্রের সহজাত খেয়াল আর খেলা তিনি ভঙ্গ করতে চাইতেন না, পুত্রকে বিব্রত না করে তিনি কখনো কখনো অনেকক্ষণ আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকতেন।

মৃগদের সঙ্গেও তার দারুণ ভাব ছিল। সে তো বেড়ে উঠেছে মৃগদুগ্ধ পান করে আর মৃগশাবক ও বানরদের সঙ্গে খেলা করতে করতেই। উর্বশী তাকে রেখে যাবার পর বিভাণ্ডক তার পোষ্যতুল্য মৃগীর দুগ্ধ দোহন করে মৃৎপাত্রে জ্বালিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গকে পান করাতেন।
ঋষ্যশৃঙ্গ মৃগ’র গলা জড়িয়ে ধরে, নিজের হাত লেহন করাতো, কখনো কখনো আশ্রমের পথের পাশ থেকে ঘাস ছিঁড়ে এনে মৃগশাবকদের আহার করাতো।

ঋষ্যশৃঙ্গ শুধু যে খেলা আর আপন খেয়ালেই মেতে থাকতো তা নয়, শাস্ত্রশিক্ষায়ও সে খুব মনোযোগী ছিল। বালক বয়সেই অনেক শ্লোক সে মুখস্ত করে ফেলেছিল। ধ্যানে বসলে কোথায় যেন হারিয়ে যেতো! আশ্রমের আঙিনার ঝরাপাতা পরিষ্কার করে আশ্রম গুছিয়ে রাখতো। হিংস্র জীব-জন্তুর সাথে সাক্ষাৎ হতে পারে বলে পিতাশ্রী তাকে একা একা নদী এবং ঝিরিতে যেতে নিষেধ করেছিলেন, তাই সে কখনোই একা নদী এবং ঝিরিতে যেতো না, পিতাশ্রীর সঙ্গে ঝিরিতে যেতো স্নান এবং পানীয় জল সংগ্রহ করতে। তবে তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স থেকে সে একাই যেতো ঝিরিতে।

শৈশব-বাল্যকালে পিতাশ্রীর সঙ্গে ঝিরিতে নেমে শীতল জলের সাথে খেলায় মেতে উঠতো সে। পিতাশ্রী তার গাত্র মার্জন করে ঘড়ায় জল ভরে মাথায় ঢালতেন, তারপর নিজে গাত্র মার্জন করে স্নান শেষে পুত্রের গাত্র মুছিয়ে দিতেন। পিতাপুত্র কুটীরে ফিরে কিছুক্ষণ ধ্যান করার পর প্রথমে আশ্রমের পশুপাখিদের আহার করাতো, তারপর নিজেরা আহার করতো।

ঋষ্যশৃঙ্গ মাঝে মাঝেই তার পিতাশ্রীর সঙ্গে দুষ্টুমি করতো; আসলে লুকোচুরি খেলতো, যদিও খেলার নাম সে জানতো না। এমনকি তার পিতাশ্রীও তাকে লুকোচুরি খেলা শেখায়ও নি কখনো। পিতাশ্রীকে বাইরে থেকে আশ্রমে ফিরতে দেখলেই সে কোনো বৃক্ষের আড়ালে অথবা অন্য কোথাও লুকিয়ে পড়তো, পিতাশ্রী এসে তাকে ডেকে সাড়া পেতেন না। চিন্তিত হয়ে তার নাম ধরে ডাকতেন আর এদিক-সেদিক খুঁজতেন। আচমকা সে হুঙ্কার ছেড়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে পিতাশ্রীর সামনে আসতো। তখন পিতা-পুত্র দুজনেই একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে হেসে উঠতো। প্রথমদিন পুত্রকে হারানোর ভয় পেলেও পরবর্তীতে পুত্রের সঙ্গে এই লুকোচুরি খেলা বেশ উপভোগ করতেন বিভাণ্ডক। ইচ্ছে করে বেশি সময় ধরে খুঁজতেন পুত্রকে, দেখলেও না দেখার ভান করতেন পুত্রের আনন্দটুকু দেখার জন্য। তারপর পুত্র যখন হুঙ্কার ছেড়ে বেরিয়ে আসতো, তখন তিনি ভয় পাবার ভান করতেন। মিথ্যে ভীতসন্ত্রস্ত পিতাশ্রীকে দেখে বালক ঋষ্যশৃঙ্গ হেসে কুটিকুটি হতো। পুত্রের মুখের হাসি সুখের বাতাস হয়ে বইতো বিভাণ্ডকের হৃদয়ে। তিনি পুত্রের এইসব খেলা দেখতেন আর ভাবতেন, মানুষ যতো জন-বিচ্ছিন্নই থাকুক না কেন, যা কিছু মানুষের সহজাত স্বভাবের অংশ, কোনো না কোনোভাবে তার কিছু কিছু মানুষের মধ্যে প্রকাশ পাবেই।

একদিন গ্রীষ্মের অপরাহ্ণে বালক ঋষ্যশৃঙ্গ দেহলীতে কুশাসনের ওপর গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে ছিল। তার মাথার লম্বা কেশ চূড়ো করে বাঁধা, পরনে চীর, উন্মুক্ত গৌড়বর্ণ শরীরের ঊর্ধ্বাংশে কেবল উপবীত। শরীর একেবারে স্থুল নয়, আবার শীর্ণও নয়। হঠাৎ আবির্ভুত হওয়া প্রবল বাতাসের শন শন শব্দ আর শরীরে উড়ে আসা ছিন্নপত্রের মৃদু আঘাতে ঘুম ভেঙে গেল তার। উঠে ব্যস্ত হাতে কুশাসনটা গুছিয়ে ঘরে রেখে এসে দেহলীতে দাঁড়ালো, অতঃপর আঙিনায় নেমে বাতাসের তোড়ে অবনত বৃক্ষরাজি আর আকাশের দিকে দৃষ্টি মেললো। কিছুতেই সে ঠাহর করতে পারলো না এখন অপরা‎হ্ণ, সন্ধ্যা, নাকি রাত্রি? এমনিতেই আশ্রমের চারপাশের ঘন বৃক্ষরাজির কারণে অপরা‎হ্ণেই হুট করে সন্ধ্যা নেমে আসে। আর শীতের দিনে তো বেশিরভাগ দিন সূর্যের মুখ দেখাই যায় না! অন্যান্য ঋতুর চেয়ে সন্ধ্যাও নেমে আসে অনেক আগে।

ঋষ্যশৃঙ্গ’র মনে পড়লো মধ্যা‎হ্ন আহার শেষে সে শাস্ত্র আওড়াচ্ছিল। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে তা তার মনে নেই, কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে তাও সে বুঝতে পারছে না। তাই তখন ঘোর সন্ধ্যা নাকি রাত্রি ঠাহর করতে পারছিল না কিছুতেই। কিন্তু সন্ধ্যা কিংবা রাত্রি যদি হয় তবে পিতাশ্রী কোথায়? পিতাশ্রী এখনো ফেরেন নি কেন? যেখানেই থাকুন পিতাশ্রী তো সন্ধ্যার আগেই ফেরেন। তবে কি পিতাশ্রীকে বাঘ কিংবা ভাল্লুকে ধরলো? তার ছোট্ট মনে নানান রকম দুর্ভাবনা উঁকি দিলেও সে ভেঙে পড়লো না বা কাঁদলো না, কেননা পিতাশ্রী তাকে শিখিয়েছেন শত বিপদের মাঝেও চিত্তের দুর্বলতা প্রকাশ না করতে, অস্থির না হয়ে স্থির থাকতে, ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। তাই শান্ত চিত্তে এবং দৃষ্টিতে সে বনের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা আশ্রমে ফেরার সরু পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু অন্ধকার নেমে আসায় বেশিদূর পর্যন্ত ঠাহর করা যাচ্ছিল না। তবু সে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু পিতাশ্রীকে দেখতে পেল না। চিৎকার করে ‘পিতাশ্রী…পিতাশ্রী…’ বলে কয়েকবার ডাকলেও তার ডাকের বিপরীতে কোনো সাড়া মিললো না। আঙিনায় বেশিক্ষণ দাঁড়াতেও পারলো না সে, বাতাস আরো আগ্রাসী আর বৃষ্টি শুরু হওয়ায় দেহলীতে উঠে পিতাশ্রীর মঙ্গল কামনায় ইষ্টমন্ত্র জপ এবং বরুণদেবকে স্মরণ করতে লাগলো, যাতে তার পিতাশ্রী আশ্রমে না ফেরা পর্যন্ত বরুণদেব বর্ষণ বন্ধ রাখেন।

কিন্তু বরুণদেবের বুঝি আর তর সইলো না অথবা ক্ষুদ্র বালকের আকুতি তার কানে পৌঁছুলো না! শুরু হলো প্রবল বৃষ্টি আর আর বজ্রনাদ। বিদ্যৃৎ চমকের তীব্র আলোয় ক্ষণে ক্ষণে আলোকিত হয়ে উঠলো আশ্রম এবং বৃক্ষরাজি। বাতাসের দাপটে আনত বৃক্ষরাজি যেন ভেঙে পড়বে কুটীরের ওপর! মৃগ আর বানরেরা ভীত হয়ে দেহলীর কোনের দিকে জড়সড় হয়ে বসে রইলো। দেহলীতে বৃষ্টির ছাঁট আর বাতাসে তীরের বেগে ছিন্ন পত্র ছুটে আসায় সে কুটীরে প্রবেশ করে কপাট ধরে দাঁড়ালো।

আঙিনার পাশের দাড়িম্বগাছটি বাতাসে আছাড়ি-পিছাড়ি করছে আর বিদ্যুৎ চমকের আলোয় চকচক করে উঠছে পাতা এবং দাড়িম্ব ফলগুলো। গ্রীষ্মে বেশি দাড়িম্ব ফলে না, খুব বেশি হলে দশ-বারোটি। কিন্তু বর্ষায় গাছভর্তি দাড়িম্ব ফুল আসে আর আশ্বিন-কার্তিকের দিকে দাড়িম্ব’র ভারে নুয়ে পড়ে গাছটি। ঝড়ের দাপটে প্রায় মাটিতে নুয়ে পড়েছে গাছটি।

না, পিতাশ্রীর দেখা নেই। কুটীরের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কেবল ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে। এখন যদি সন্ধ্যা হয় তবে তো ঘরে প্রদীপ জ্বালতে হবে, সান্ধ্য আ‎‎হ্নিক করতে হবে। কিন্তু অগ্নি সে জ্বালবে কী করে? অরণি এবং মন্থ ব্যবহার করে সে তো অগ্নি জ্বালতে পারে না, পিতাশ্রী পারেন। তবু একবার চেষ্টা করে দেখতে চাইলো সে, বিদ্যুৎপ্রভায় খুঁটিতে ঝোলানো অরণি আর মন্থ হাতে নিলো, এরপর মাটির প্রদীপ আর গাছের বাঁকলের অতি সুক্ষ্ম আঁশ নেবার পর কুটীরের কপাট বন্ধ করে বসলো মেঝেতে। অতঃপর হাতরে হাতরে বালুর পাত্র থেকে এক চিমটি শুষ্ক বালু অরণির ছিদ্রে রেখে মন্থ ঢুকিয়ে নরম হাতে মন্থন করতে লাগলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার দু-হাতের তালু গরম হলেও অরণি-মন্থ আশানুরূপ তপ্ত হলো না। তবু আশাহত না হয়ে আবার দু-হাতে মন্থন করতে লাগলো। ওদিকে বাইরে তুমুল কামুক ঝড় শংকরনৃত্যের তাণ্ডব চালাতে শুরু করলো!

ঋষ্যশৃঙ্গ অরণি-মন্থ’র সাথে যুঝতে লাগলো। তার অশক্ত হাতের মন্থ বারবার অরণিচ্যূত হলো, আর সে অন্ধকারে হাতরে পুনরায় অরণির ছিদ্রে মন্থ প্রবেশ করিয়ে ঘুরাতে লাগলো। অরণি-মন্থ কিছুটা গরম হলো বটে কিন্তু কিছুতেই অগ্নি জ্বালাবার মতো তপ্ত হলো না। হাতের তালু গরম হলো, ব্যথা করতে শুরু করলো কোমল হাত, তবু সে হাল ছাড়তে রাজি নয়। পিতাশ্রী তাকে বলেছেন, ‘বৎস, সবকিছুতে তোমাকে পারদর্শী হতে হবে, এমনভাবে নিজেকে তৈরি করো যেন আমি না থাকলেও তুমি চলতে পারো।’ অতএব পিতাশ্রীকে আজ দেখিয়ে দিতে হবে যে সে অরণি-মন্থ ঘর্ষণ করে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করতে পারে। ওদিকে ঝড়ের দাপট ক্রমান্বয়ে যেন বাড়ছে, কপাটের ওপর আছড়ে পড়ছে বাউণ্ডুলে বাতাস। এমন সময়ে কপাটে করাঘাতের শব্দ হলো, ‘বৎস ঋষ্যশৃঙ্গ, দ্বার খোলো, দ্বার খোলো বৎস…!’

অরণি-মন্থ ফেলে দ্রুত উঠে দ্বার খুলে দিলো ঋষ্যশৃঙ্গ। বিদ্যুৎ চমকের আলোয় ঝড়ে বিধ্বস্ত পিতাশ্রীর মুখের কিয়দংশ দেখতে পেলো সে। বিভাণ্ডক দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে ফল-মূলের কাপড়ের পুটলিটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে দ্বার বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন, ‘বৎস, তুমি কি ভয় পেয়েছিলে?’

‘না পিতাশ্রী, আমি ভয় পাই নি। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আপনার জন্য।’

অন্ধকারে পিতা-পুত্র কেউ কাউকে দেখতে পেলো না, কেবল একজন আরেকজনের কথা শুনতে পেলো।

‘আমার জন্য কখনো দুশ্চিন্তা করবে না বৎস, যদি আমি ফিরে না আসি তবে যেনো রেখো আমি ঈশ্বরের কাছে চলে গেছি। তখন তুমি তোমার মতো করে চলবে।’

বিভাণ্ডক একখণ্ড শুষ্ক বস্ত্র দিয়ে শরীর এবং মাথার জল মুছে পরিধেয় ভেজা চীর বদলে শুষ্ক চীর পরিধান করলেন। বাইরে ঝড়ের দাপট আরো বেড়েছে। শো শো শব্দে বৃক্ষরাজি যেন ভেঙে পড়তে চাইছে কুটীরের ওপর। পিতা-পুত্র শয্যায় পাশাপাশি বসে ঝড় থামার অপেক্ষা করতে লাগলো।

আরো কিছুক্ষণ তাণ্ডব চালানোর পর ঝড় থামলো, বৃষ্টিও বন্ধ হলো। পিতাপুত্র দুজনই বাইরে বেরিয়ে এলো। পরিষ্কার আকাশ আর চারিদিকে আলো দেখে ঋষ্যশৃঙ্গ অবাক হয়ে বললো, ‘পিতাশ্রী আমি তো ভেবেছিলাম রাত্রি হয়ে গেছে।’

‘এখন অপরা‎হ্ণ বৎস, আকাশ অত্যাধিক মেঘাবৃত থাকায় অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছিল, রাত্রি হতে এখনো ঢের বাকি।’

প্রকৃতি সবকিছু যেন একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। আঙিনায় রাজ্যের ঝরাপাতা আর ছোট ছোট ফল ছড়িয়ে আছে, বৃক্ষের শাখা ভেঙে পড়ে আছে যত্রতত্র। দুটি পাখি আহত হয়ে নড়া-চড়া করছে কিন্তু উড়তে পারছে না, একটি পাখির প্রাণবায়ু চিরতরে বেরিয়ে গেছে। মৃগ আর বানরেরা দেহলী থেকে আঙিনায় নেমে শরীর ঝাড়া দিচ্ছে। আঙিনার পাশের দাড়িম্ববৃক্ষটি প্রায় ভূমিতে নুয়ে পড়েছে। পিতা-পুত্র সব ফেলে আহত পাখি দুটির শুশ্রূষায় মন দিলো।

ঝড়ের দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠার পর ঋষ্যশৃঙ্গ’র মনে পড়লো বাল্যকালের সেই ঝড়ের কথা। পিতাশ্রী, আশ্রম, আশ্রমবানর এবং মৃগদের কথা মনে পড়তেই হৃদয়ে পীড়া অনুভব করলো সে, তার কেবলই মনে হতে লাগলো যে পিতাশ্রী সারা অরণ্য তন্ন তন্ন করে তাকে খুঁজছেন আর উচ্চস্বরে ডাকছেন। তাকে না পেয়ে পিতাশ্রী যেমনি পীড়া অনুভব করছেন তেমনি আশ্রমমৃগ আর বানররাও দীর্ঘক্ষণ তাকে না দেখে পীড়া অনুভব করছে। পিতাশ্রী, আশ্রম, আশ্রমমৃগ আর বানরদের প্রতি প্রবল মায়ায় হুহু করে উঠলো তার বক্ষের ভেতর, যেনবা শীতল বাতাসের ঝাঁপটা বয়ে যাচ্ছে বক্ষের ভেতর দিয়ে। অশ্রু গড়িয়ে নামলো তার অধর বেয়ে। আর তখনই কানে ভেসে এলো শবরী, উমা আর সুলোচনার হাস্যধ্বনি। শয্যা থেকে নেমে কক্ষের বাইরে গিয়ে সে শবরীকে ডাকতে লাগলো, ‘প্রেয়সী, প্রেয়সী, তুমি কোথায়? শীঘ্র এসো।’

তৎক্ষণাৎ ছাদ থেকে নেমে ঋষ্যশৃঙ্গ’র সম্মুখে এলো শবরী। রাত্রি হলেও ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় শবরীর মুখ প্রায় স্পষ্ট দেখতে পেলো ঋষ্যশৃঙ্গ। এগিয়ে গিয়ে শবরীর হাত ধরে মিনতির সুরে বললো, ‘প্রেয়সী, আমি আশ্রমে ফিরে যেতে চাই।’

শবরী অবাক হয়ে তাকালো ঋষ্যশৃঙ্গ’র দিকে। ঋষ্যশৃঙ্গ’র অধরের অশ্রুধারাটি অবশ্য দেখতে পেল না সে। বললো, ‘কেন তপোধন, আমরা কি না জেনে তোমাকে কোনো পীড়া দিয়েছি?’

ঋষ্যশৃঙ্গ দু-দিকে মাথা নাড়লো, ‘না প্রেয়সী, তোমরা আমাকে প্রয়োজনের অধিক সমাদর করেছ, কোনো পীড়া দাও নি আমাকে। কিন্তু আমি পিতাশ্রীর জন্য হৃদয়ে ভীষণ পীড়া অনুভব করছি। পিতাশ্রীও নিশ্চয় আমার জন্য দুশ্চিন্তা করছেন।’

অসম্ভব জেনেও শবরী ছলনার আশ্রয় নিলো, ‘তোমার পিতাশ্রী সুবিখ্যাত ঋষি, তপশ্চর্যায় সিদ্ধিলাভ করেছেন। তিনি নিশ্চয় যোগবলে তোমাকে দেখছেন, তাই তিনি কোনো দুশ্চিন্তা করছেন না। তুমিও তাঁর জন্য কোনো পীড়িত হ’য়ো না, তিনি নিশ্চয় মঙ্গলময় আছেন।’

‘তবু আমি ফিরে যেতে চাই প্রেয়সী। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি এই ভাসমান আশ্রম আমাদের আশ্রমের কাছে ফিরিয়ে নিতে বলো।’

‘রাতেরবেলা নদীপথে ভালো দেখতে পাওয়া যায় না, পথ ভুল হয়, যাত্রায় বিপদের আশঙ্কাও থাকে, আমাদের এই ভাসমান আশ্রম ডুবেও যেতে পারে। তাছাড়া তোমার ব্রত সম্পন্ন হয় নি। ব্রত সম্পন্ন না করে ফিরে গেলে তোমার অকল্যাণ হবে, অকল্যাণ হবে মানবজাতির।’

‘আমরা আশ্রমে ফিরে একসঙ্গে ব্রত পালন করবো।’

‘তা হয় না তপোধন। তোমাদের আশ্রম রতিব্রত পালনের উত্তম স্থান নয়। তুমি আমাদের আশ্রমে চলো, তারপর তোমার পিতাশ্রীকেও আমাদের আশ্রমে আনার ব্যবস্থা করবো।’

দুজনের কথোপকথন শুনে উমা আর সুলোচনা কাছে এলো, গিরিকাও ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, ঋষ্যশৃঙ্গকে কক্ষে এনে শয্যায় বসিয়ে সকলে মিলে নানা কথার ছলনায় তাকে ভোলানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই ভোলানো গেল না তাকে। শেষে রঘুকে ডেকে আনা হলে সে রাত্রিবেলা নদীপথে যাত্রার বিপদাশঙ্কা শতগুণ বাড়িয়ে বললো, কিন্তু তাতেও ঋষ্যশৃঙ্গ আশ্রমে ফিরে যাবার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে অবুঝ বালকের মতো জেদ ধরলো।

উপায়ান্তর না দেখে শবরী সকলের উদ্দেশে বললো, ‘তোমরা সবাই বাইরে যাও।’

কৌতুহলী চোখে সকলেই তাকালো শবরীর মুখের দিকে। শবরী তার মাতার চোখে দৃষ্টি রেখে বললো, ‘যাও তোমরা, আমি দেখছি।’

সকলে ঘর থেকে বেরোলে শবরী কপাট বন্ধ করে দিলো। কপাট বন্ধ করার শব্দে সকলেই ঘুরে দাঁড়ালো, জ্যোৎস্নাজ্বলা বন্ধ কপাট ক্ষণকালের জন্য অবস্থান করলো সকলের নির্নিমেষ কৌতুহলী দৃষ্টির কেন্দ্রে।


(চলবে.......)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০৬

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা। আসলে এটা শুধু উপন্যাস নয় এটা ইতিহাস।

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৯

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

২| ২০ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:৩৮

শুভ_ঢাকা বলেছেন: কিছু বলার ভাষা আমার জানা নেই। মন্ত্রমুগ্ধ আমি। অসাধারণ লেখার ক্ষমতা আপনি অর্জন করেছেন।

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১১:৫৮

মিশু মিলন বলেছেন: এভাবে বললে লজ্জা পাই! ধন্যবাদ।

৩| ২১ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১২:১২

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:


মুগ্ধ হয়ে পাঠ করলাম ।

পতি নিন্দা সইতে না পেরে সতি যজ্ঞের আগুনে আত্মবিসর্জন করেন । এই কথার
পুর্বাপর বিররন সুন্দর হয়েছে।

শবরীর ভারী অদ্ভুত লাগে, মানুষের মাথার স্থলে আবার ছাগমুন্ড স্থাপন করে কিভাবে !কাটা আঙ্গুলই
জোড়া লাগানো যায়না,আবার মাথা! বিশ্বাস হয়না শবরীর,তার মনে হয় এ ঘটনাও নিশ্চয়ই ঋষ্যশৃঙ্গের
মাথায় শৃঙ্গ থাকার মতোই জনরব!

দেব দেবী, মুনি ঋষির অলৌকিক ও অলীক কল্পকাহিনীর উপর শবরীর সঠিক উপলব্দির একটি
সুন্দর প্রকাশ উঠে এসেছে লেখাটিতে ।

পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।

২১ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১২:৫০

মিশু মিলন বলেছেন: আপনি গভীর মনোযোগী পাঠক, আপনার পাঠ-প্রতিক্রিয়া আমাকে ভীষণ উৎসাহিত করে। ধন্যবাদ।

৪| ২১ শে অক্টোবর, ২০২০ ভোর ৪:৫৮

আনমোনা বলেছেন: পুরানের কিছু ঘটনা আপনার কল্পনায় নতুন হয়ে উঠছে।

মুগ্ধ হয়ে পড়ছি আপনার এই উপন্যাসটি।

২১ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:০৪

মিশু মিলন বলেছেন: অনুপ্রাণিত হচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.