নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বরেন্দ্রভূম থেকে জাহাঙ্গীরনগরঃ বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস, পর্ব ৮ ( হেনরি হোভার লক, অবিভক্ত বঙ্গের প্রথম শিল্পাচার্য)

১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৩:৪০



চিত্র ১ঃ নিওক্ল্যাসিকেল ঘরানার ছবি দ্যা ওথ অফ হোর‍্যাতি ( জ্যা লুইস ডেভিড)


ক্যালকাটা স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট প্রভূত সম্ভাবনার সাথে শুরু করবার পরেও মূলত অর্থাভাবে যখন আর সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না, তখন বাংলার বড়লাট সিসিলি বিডন এগিয়ে আসেন, বিদ্যালয়টিকে সরকার অধিগ্রহণ করে, এবং ২৯ জুন ১৮৬৪ তারিখ ইংল্যান্ড হতে আগত শিল্পশিক্ষক হেনরি হোভার লকের হাতে বিদ্যালয়ের দায়ভার অর্পণ করা হয়।

যে শিল্পধারার ধারক-বাহক ছিলেন হেনরি হোভার লকঃ

হেনরি হোভার লক সহ ভারতে যে সকল আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষগণের আগমন ঘটেছিল, তাদের সবাই ছিলেন লন্ডনের সাউথ কেনসিংটন মিউজিয়ামের স্কুল অফ ডিজাইনের চিত্রকলা বিভাগের ছাত্র। লন্ডনের এই আর্ট স্কুলটি খুব সতর্কতার সাথে নিওক্লাসিক - জর্জিয়ান আমলের শিল্পগুরু জশুয়া রেনলডস প্রবর্তিত পাঠ্যক্রম অনুকরণ করত। রেনলডসের পাঠ্যক্রম ছিল ক্ল্যাসিকাল, তথা রেনেসাঁর মডলিং- এর অনুগামী (চিত্র ১ লক্ষ্য করুন)। যদিও লক সহ ভারতে আগত অন্যান্য সকল শিল্পাধ্যক্ষগণ ভিক্টোরীয় আমলে অনুসৃত একাডেমীক শিল্পাদর্শ ও করণকৌশলই বহন করে নিয়ে আসেন এ উপমহাদেশে, খোদ ইংল্যান্ডের ফ্রি ল্যান্স আর্টিস্টরা কিন্তু ততদিনে ঝড় বইয়ে দিয়েছে ইউরোপের প্রচলিত শিল্পের জগতে।



চিত্র ২ঃ Slavers Throwing overboard the Dead and Dying, Typhon coming on (1840), জন টার্নার

ইংল্যান্ডের শিল্পীদের মাঝে রেনলডসের প্রভাব শেষ হয়ে তখন চলছে জন রাস্কিনের কাল। অ্যাকাডেমিক রীতির বদলে তখন টার্নারের ছবির (চিত্র ২) রোম্যান্টিক অভিব্যক্তিকে তখন সকলের সামনে বড় করে উপস্থাপন করছেন রাস্কিন (চিত্র ৩)। তার শিল্পভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডের চিত্রকলায় সূচনা হয়েছে প্রি র‍্যাফেলাইট আন্দোলন, বস্তুজগতকে ছাপিয়ে কাব্যময় মনোজগতে বিচরণ।



চিত্র ৩ঃ "Snow Storm: Steam-Boat off a Harbour's Mouth," 1842 by J.M.W. Turner

কোলকাতায় লকের শিক্ষাপদ্ধতির দর্শনঃ

রক্ষণশীল সাউথ কেনসিংটনের ছাত্র লকের প্রি র‍্যাফেলাইট ধারায় আগ্রহ ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল এদেশের তরুণদের ইউরোপীয় একাডেমীক শিল্পরীতিতে দক্ষ করে তোলা, এবং এ কাজে তার সততা ও নিষ্ঠার কোন অভাব ছিল না। ১৮৬৪ সাল থেকে নিয়ে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত , টানা আঠারো বছর কোলকাতা স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টের অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় তিনি আধুনিক অর্থে শিল্পশিক্ষা বলতে যা বোঝায়, বাংলায় তার ভিত্তি স্থাপন করেন।

এমতাবস্থায় আমি নিজের কিছু মত উপস্থাপন করতে চাই। একাডেমীক রীতির সাথে জনপ্রিয় ধারার শিল্পচর্চার যে লড়াই, তা আমাদের বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসেও পরিলক্ষিত হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন নিজে আজীবন রিয়েলিস্ট বা বাস্তববাদী ধারার চিত্রাঙ্কন করেছেন। কিন্তু চারুকলার প্রথম - দ্বিতীয় - তৃতীয় ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের শিল্পচর্চার প্রথম দশকেই অ্যাবসট্র্যাকশন, বা বিমূর্ত চিত্রকলার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। অনেকেই উল্লেখযোগ্য, তবে এই বাস্তববাদ - বিমূর্তবাদ কোল্ড ওয়ারে জয়নুল আবেদিনের বিপরীতে শিল্পী আমিনুল ইসলাম এবং শিল্পী মুর্তজা বশীরের ভূমিকা ব্যাপক। তাদের দুজনের স্মৃতিকথাতেই জয়নুল আবেদিনের বিমূর্তায়নের প্রতি সন্দিঘ্ন দৃষ্টিভঙ্গীর বর্ণনা ফুটে ওঠে।

আবার একাডেমীক ঘরানার বাইরে একটা নিজস্ব নাইভ স্টাইলে গড়ে ওঠা শিল্পী এস এম সুলতানকেও চারুকারু কলা প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সেনানীদের অনেকেই পছন্দ করতেন না, সুলতানের রীতি ঠিক পাশ্চাত্য একাডেমীক রীতির সাথে মেলেনা বলেই। মজার বিষয় এই যে, সুলতান নিজেও আবার বিমূর্ত চিত্রকলা পছন্দ করতেন না, চিত্রকলা বিমূর্তায়নের প্রবণতাকে উল্লেখ করতেন গিমিক তৈরির প্রচেষ্টা হিসেবে।

যাই হোক, একাডেমিক শিল্পরীতি আর শিল্পরীতি ভাঙ্গার শিল্পরীতির মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। কিন্তু একজন একাডেমিক হিসেবে আমার অভিমত হল, নিয়ম না জেনে নিয়ম ভাঙ্গতে চেষ্টা করলে সে চেষ্টা আলোর মুখ দেখে না। আমরা আবার লকে ফেরত আসি।
ভারতবর্ষে লকের দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে বোঝা যায় যে তিনি কখনোই ভারতীয় ছাত্রদের ইউরোপীয় চিত্রকলার অন্ধ অনুসরণকারী করে তুলতে চান নি। কোলকাতা আর্ট স্কুলের দায়িত্ব নেবার দু'বছরের মাথায় তার লেখা একটি সরকারি প্রতিবেদনে তার মন্তব্য -

'আমার ইচ্ছা বাংলার আর্ট স্কুলের ছাত্ররা একদিকে যেমন ক্যালিমাকাস, অ্যাপোলোডোরাস, ঘিবারটি, ও সানসোভিনো থেকে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে শিক্ষা নেবে, তেমনি তারা তাদের পূর্বপুরুষদের প্রশংসনীয় আলংকারিক শিল্পের গঠন ও অনুপুঙ্খের বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করবে।'

কোলকাতা স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টের প্রথম ইংরেজ অধ্যক্ষ হেনরি হোভার লকের এই আদর্শ ও দর্শন আমাদের ব্রিটিশদের কেবল শত্রুপক্ষ, এবং একপক্ষীয় লুণ্ঠন প্রবণ জাতি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতাকে দ্বিধাগ্রস্থ করে তোলে।

হেনরি হোভার লকের পাঠ্যসূচি/সিলেবাসঃ

লক প্রবর্তিত সিলেবাস অবিভক্ত বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রশিক্ষায় অনুসৃত প্রথম ইউরোপীয় সিলেবাস। তিনি তার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করেন -

১/ রেখাঙ্কন,
২/ চিত্রাঙ্কন,
৩/ মডেলিং বা মৃৎকর্ম,
৪/ কারুধর্মী নকশা
৫/ লিথোগ্রাফি,
৬/ কাঠখোদাই ,
৭/ ফটোগ্রাফি

এই সিলেবাস তিন বা চার বছরে ডিপ্লোমা কোর্স আকারে শিক্ষার্থীরা সম্পন্ন করতেন। এই সিলেবাসকে ভেঙ্গে শেখান হত -

১/ বুনিয়াদী রেখাঙ্কন,
২/ মুক্তহাতে উচ্চমানের রেখাঙ্কন,
৩/ মুক্তহাতে আলোছায়ার সাহায্যে অঙ্কন,
৪/ যন্ত্রাদির সাহায্যে জ্যামিতিক নকশা,
৫/ বুনিয়াদী রঙ্গিন চিত্রাঙ্কন,
৬/ রঙে উচ্চমানের চিত্রাঙ্কন,
৭/ মডেলিং বা মাটির মূর্তি রচনা,
৮/প্রাথমিক নকশা,
৯/ যন্ত্রাদির নকশা,
১০/ লিথোগ্রাফি,
১১/ কাঠখোদাই ও
১২/ ফটোগ্রাফি বা আলোকচিত্র।

বাংলায় শিল্পকলার বিস্তারে হেনরি হোভার লকের অবদানঃ

বড় প্যারাগ্রাফে লেখার বদলে এই বিষয়টি পয়েন্ট আকারে আলোচনা করা যাক, যাতে লকের অবদানগুলো বোঝা এবং মনে রাখা সহজ হয়।

প্রথমত, লক আগমনের পর ঢিলেঢালা বাঙ্গালীয়ানা ত্যাগে ছাত্রদের বাধ্য করেন এবং পুরো স্কুলকে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার আবর্তনে আনেন। শিক্ষাবর্ষ ও শিক্ষাশ্রেণী বিভক্তিকরণ, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে সঠিক সময়ে ও নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। মেধাবী ছাত্রদের লালনে ও উৎসাহ প্রদানে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন।

দ্বিতীয়ত, লকের এক সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনের সারির ছাত্রদের ছাত্র - শিক্ষক এবং পরবর্তীতে পূর্ণ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা। এতে করে তার ছাত্রদের গুণগত মানের ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পায়, এবং ছাত্রদের মধ্যেও কর্মচাঞ্চল্য ও নিজেদের প্রমাণ করার স্পৃহা দেখা দেয়।

তৃতীয়ত, ছাত্রদের নিয়ে লক গভর্নমেন্ট হাউজ বা রাজভবনের দরবার হলের অভ্যন্তর অলঙ্করণের কাজ সম্পূর্ণ করেন। এছাড়াও, রাজেন্দ্রলাল মিত্র বিরচিত অ্যান্টিকুইটিস অফ ওড়িশা (দুই খণ্ড, ১৮৭৫, ১৮৮৮) এবং বুদ্ধগয়া (১৮৭৮) , জে ফেয়েরার রচিত দি থানাটোফিডিয়া অফ ইন্ডিয়া (১৮৭২) নামক ভারতীয় সর্প বিষয়ক প্রামাণ্য গ্রন্থের সচিত্রকরণের কাজে তার ছাত্রদের নিয়োগ করেন। এছাড়াও লকের দুই ছাত্র মেডিকেল কলেজের জন্যে ৪৩৩টি অস্থিবিদ্যাসংক্রান্ত ছবি একে দিয়ে তখনকার চিকিৎসাবিদ্যা প্রসারে সাহায্য করেন।

চতুর্থত, ১৮৭৩ ও ১৮৭৯ সালে কোলকাতায় সর্বভারতীয় চারুকলার প্রদর্শনী আয়োজন সংগঠনের গুরুদায়িত্ব পালন করেন লক।

পঞ্চমত, নিজের ছাত্রদের কাজ বহিঃবিশ্বে বিবিধ প্রদর্শনীতে পাঠানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জোগানোর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেন লক। তারই ফলশ্রুতিতে ১৮৭১ সালের মাদ্রাজের সর্বভারতীয় শিল্পকলার প্রদর্শনী এবং ১৮৭৩ সালে লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে কোলকাতা স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টের ছাত্রদের কাজ প্রদর্শিত হয়।

ষষ্ঠত, কোলকাতার প্রথম স্থায়ী শিল্প প্রদর্শনশালা, তথা আর্ট গ্যালারী প্রতিষ্ঠিত হয় লকের প্রচেষ্টায়। বড়লাট নর্থব্রুক ও ছোটলাট রিচারড টেম্পেলের সহযোগিতায় ১৮৭৬ সালে আর্ট স্কুল সংলগ্ন ১৬৪-৬৫ বউবাজার স্ট্রিটে এই আর্ট গ্যালারী প্রতিষ্ঠিত হয়। জনসাধারণের মধ্যে শিল্প সচেতনতা তৈরি এবং আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থীদের সমকালীন বিবিধ ফলিত শিল্পকলা বিষয়ক শিক্ষাদান ছিল উক্ত আর্ট গ্যালারী প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক লক্ষ্য। এই আর্ট গ্যালারীর প্রতিষ্ঠা বিষয়ক এক সরকারী প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন -

'এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হল এ দেশীয় তরুণদের ইউরোপের প্রাচীন ও বর্তমান কালের শিল্প ও মানুষ সম্পর্কে ধারণা দেয়া; ইউরোপের শিল্পের দুর্বল নকল করতে শিখুক সে জন্যে নয়, বরং এর থেকে ছাত্রেরা ইউরোপের শিল্পের সাদৃশ্যধর্মিতার রচনাপদ্ধতি শিখে নেবে এবং সেই পদ্ধতিতে নিজেদের দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য, সৌধস্থাপত্য, নৃ -বৈচিত্র্য ও জাতীয় পোশাক-আশাক আঁকবে।'

এ থেকেই বোঝা যায় , ইউরোপীয় চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির অন্ধ অনুকরণে নিজের শিক্ষার্থীদের প্রবৃত্ত করার কোন ইচ্ছাই লকের ছিল না। তার ইচ্ছা ছিল, তার শিক্ষার্থীরা কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নিয়ম শিখবে, এবং মুক্তচেতা হয়ে পরবর্তী জীবনে সে নিয়ম ভেঙ্গে নিজের একটা স্টাইল তৈরি করবে।

লকের প্রথম পর্বের কৃতি ছাত্রবৃন্দঃ

লকের হাতে তৈরি অধিকাংশ ছাত্রই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাক্ষর রেখে গেছেন। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় দু'জনের কথা - যাদের কৃতিত্ব তাদের জীবৎকালকেও অতিক্রম করে গেছে। তারা হচ্ছেন শ্যামাচরণ শ্রীমানী এবং অন্নদাপ্রসাদ বাগচী। তারা দুজনেই লকের হাতে শিল্পশিক্ষা অর্জনের পর লকের অনুমতিক্রমে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান শুরু করেন

প্রথমে উল্লেখ করা যাক শ্যামাচরণ শ্রীমানীর কথা। শ্রীমানীর পারদর্শিতা ছিল কাঠখোদাই, লিথোগ্রাফি ও জ্যামিতিক রেখাঙ্কনে। কিন্তু তিনি পরবর্তীতে বিখ্যাত হন তার স্বাদেশীকতার জন্যে। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় শিল্পকলা বিষয়ক নিয়মিত বক্তৃতা ও নিবন্ধ লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তার প্রকাশিত বই - 'আর্যজাতির শিল্পচাতুরি' নামক গ্রন্থটি বঙ্কিমচন্দ্র থেকে নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর - সকলের নিকট সমাদৃত হয়। এই সংক্ষিপ্ত পুস্তকে তিনি ভারতীয় শিল্পীদের ইউরোপীয় চিত্রকলার অন্ধ মোহ থেকে বের হয়ে এসে ভারতীয় ভাবাদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে শিল্প নির্মাণে আহ্বান জানান।

অপরদিকে অন্নদাপ্রসাদ বাগচীর কর্মক্ষেত্র ও অবদান ছিল আরও বর্ধিত পরিসরে। পূর্ববর্তি অনুচ্ছেদে লক তার ছাত্রদের নিয়ে যে পুস্তক সমূহের চিত্রায়নের কাজ করেন, তার চিত্রক ছিলেন মূলত অন্নদাপ্রসাদ বাগচী। সাপের ছবি আঁকার জন্যে তাকে জীবন্ত সাপের সম্মুখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা লাগতো।

১৮৭৮ সালে তিনি আর্ট স্কুলের আরও চারজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কোলকাতার বউবাজারে 'ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও' প্রতিষ্ঠা করেন , যা ছিল চিত্রকলার ইন্ডাস্ট্রি তৈরির প্রথম সচেতন প্রয়াস। এ ক্ষেত্রে স্মরণীয় যে, ১৯৪৮ সনে ঢাকায় চারুকলা প্রতিষ্ঠা হবার পর তার প্রধান দুটো বিভাগের একটি ছিল ফাইন আর্টস , অপরটি ছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস। অন্নদাপ্রসাদের উক্ত আর্ট স্টুডিও অবিভক্ত বঙ্গের আদি অ্যাডফার্মের নিদর্শনও বটে। এই আর্ট স্টুডিও থেকেই পরবর্তীতে বহু বাঙ্গালী মনীষীর প্রতিকৃতিচিত্র মুদ্রিত হয়ে বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।

১৮৮০ সনে লক যখন তাকে পূর্ণকালীন শিক্ষকতার জন্যে তার আর্ট স্কুলে ডেকে পাঠান তখন অন্নদাপ্রসাদ তার আর্ট স্টুডিওর স্বত্ব সম্পূর্ণরূপে তার সহকর্মীদের দিয়ে এসে শিল্পশিক্ষায় মনোনিবেশ করেন এবং ১৯০৫ সাল পর্যন্ত একটানা উক্ত আর্ট স্কুলে শিক্ষকতা করে অবসরে যখন যান, ততদিনে এক প্রতিষ্ঠানবিশেষে পরিণত হন।

হেনরি হোভার লকের অধ্যায়ের পরিসমাপ্তিঃ

২৪ সেপ্টেম্বর ১৮৮৫ সালে, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে হেনরি হোভার লকের মৃত্যু ঘটে। ততদিনে তিনি আধুনিক শিল্পকলায় বাঙ্গালী শিল্পীদের প্রথম প্রতিনিধিদের গুরুপদে অধিষ্ঠিত থেকে 'মহাত্মা' আখ্যা লাভ করতে পেরেছিলেন। তার মৃত্যুর পর স্মারকগ্রন্থে লেখা হল -

'তিনি যখন স্কুলে প্রথম পদার্পণ করেন ... তখন কামার, কুমার, ছুতার প্রভ্রিতি শ্রমজীবী শ্রেণীর লোক ভিন্ন ভদ্রবংশীয় সন্তানগণ এখানে শিক্ষালাভ করিতে বড় অগ্রসর হইত না। ... এখন এই বিদ্যালয়ে সদ্বংশীয় ও শিক্ষিত বালকগণের সংখ্যা দিন দিন বাড়িতেছে।'

লকের ছাত্রদের গুরুভক্তির ব্যপারে কিঞ্চিত সন্দেহ থেকে যায় , যখন অবিভক্ত বঙ্গের প্রথম এই শিল্পাচার্যের কোন অঙ্কিত চিত্র বা ফোটোগ্রাফ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলার চিত্রকলার ইতিহাসের এক ক্ষুদ্র পাঠক হিসেবে আমার কষ্ট হয়। লকের একটি ছবি যদি এই লেখায় যুক্ত করা যেত, তবে লেখাটি সর্বাংশে পূর্ণতা পেত।

লক পরবর্তী আর্ট স্কুলঃ

হেনরি হোভার লকের দেহাবসানের পর দীর্ঘ ১১ বছর কোলকাতা স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টের হাল ধরে রাখেন অধ্যক্ষ উইলিয়াম জবিন্স এবং সহকারী অধ্যক্ষ অলিন্টো গিলারডি। তাদের হাতে অবিভক্ত বঙ্গের চারু ও কারুকলা শিক্ষায় প্রভূত অগ্রগতির পর ১৮৯৬ সালে উক্ত বিদ্যালয়ের দায়ভার গ্রহণ করেন আরনেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল। হ্যাভেলকে নিয়ে সাজানো হবে পরবর্তী পর্ব।

ঋণস্বীকারঃ
১। বাংলার চিত্রকলা - অশোক ভট্টাচার্য (ক্যালকাটা বাংলা আকাদেমি)
২। আমার জীবন ও অন্যান্য - মুর্তজা বশীর (বেঙ্গল বুকস)
৩। আমিনুল ইসলাম - বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী
৪। আদমসুরত - তারেক মাসুদ
৫। ভারতের চিত্রকলা - অশোক মিত্র, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড (আনন্দ পাবলিকেশনস)
৬। Jacques-Louis David Artworks
৭। 10 MOST FAMOUS PAINTINGS BY J.M.W. TURNER
৮। 5 Ways John Ruskin Shaped the Art World Today
৯। Joshua Reynolds: the overlooked master who revolutionised British art

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:০৮

নেওয়াজ আলি বলেছেন: মনোমুগ্ধকর ,অনন্য, ,

১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:২২

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ নেওয়াজ ভাই।

২| ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:২৮

বিজন রয় বলেছেন: এত গুছিয়ে লেখার সময় পান কিভাবে?
ধন্যবাদ এত প্রশ্রিমের জন্য।

যদিও আপনার কাজ শিক্ষা নিয়ে........!

অসাধারন!

১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৭

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: আপনার সুন্দর মন্তব্যে ধন্যবাদ, জনাব বিজন রয়।
আপনার প্রশ্নের মাঝেই উত্তর আছে। যেহেতু আমার কাজই শিক্ষা নিয়ে ...

আমার এই লেখাগুলো ব্লগের সাধারণ পাঠকদের জন্যে নয় যদিও। শিল্পকলার ইতিহাসের ছাত্র - শিক্ষক এবং আগ্রহী ব্যক্তিরা খুঁজে খুঁজে পড়েন আমার এ লেখা। এই ধারাবাহিকের পেছনের পর্বগুলোতে গেলে পাঠকের সংখ্যা অবাক করে দেয়। এ পাঠক ব্লগের সাধারণ ব্যবহারকারীরা নন।

যদি এই ব্লগের সার্ভার ক্রাশ না করে তবে আজ থেকে একশো বছর পরেও অনলাইনে আমার বাংলার শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ক এ ধারাবাহিক লেখাগুলো আগ্রহী পাঠক খুঁজে খুঁজে পড়বেন বলে আশা রাখি।

ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইল আপনার প্রতি।

৩| ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:১৫

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো।

আপনি একজন ভালো ব্লগার।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.