নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বরেন্দ্রভূম থেকে জাহাঙ্গীর নগরঃ বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস, পর্ব ৯ (আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেলঃ ক্রান্তিকালের দিশারী)

১৯ শে এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:৩৫



চিত্র ১ঃ শিল্পী অনিতা দে'র তুলিতে কৃষ্ণলীলা পেইন্টিং

এক।
আর্নেস্ট বি হ্যাভেল গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টের দায়িত্ব নেন ১৮৯৬ সালের ৪ জুলাই। ১৯৫৪ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলায় স্থাপিত প্রথম সরকারী আর্ট স্কুলটির বয়স ততদিনে চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ এই চার দশকে বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চা মূলত ইউরোপীয় ক্লাসিক মডেলিং - ফিগার ড্রয়িং ইত্যাদি টেকনিককে আদর্শ বিবেচনা করেই বিদ্যায়তনিক কর্মকাণ্ড পরিচালন করেছে। হ্যাভেল যে সময়ে কোলকাতায় এসে পৌঁছান - তখন কোলকাতায় দুটো বিপরীত মুখী আদর্শিক স্রোতের প্রবাহ বিদ্যমান। বঙ্গে হ্যাভেলের আগমনের ঠিক একদশক আগে ভারতীয় কংগ্রেসের জন্ম। পরাধীন ভারতে স্বরাজের দাবীর আঁচ তখন অবিভক্ত বঙ্গের আমজনতার গায়ে। অপরদিকে, বেঙ্গল রেনেসাঁর গুরুদের হাত ধরে বাংলার শিক্ষিত জনসমাজ ছিল ইউরোপীয় জীবনচর্চার ব্যাপারে আগ্রহী, ইংরেজি সাহিত্যপাঠে বিমুগ্ধ এবং ব্রিটিশ রাষ্ট্রীয় চিন্তার মানবিকতায় অভিভূত। (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বপক্ষে জন স্টুয়ার্ট মিলের অন লিবার্টি প্রবন্ধের বিখ্যাত উক্তি - “If all mankind minus one, were of one opinion, and only one person were of the contrary opinion, mankind would be no more justified in silencing that one person, than he, if he had the power, would be justified in silencing mankind.” ) কাজেই, প্রাতিষ্ঠানিক চিত্রকলার শিক্ষাও যে হওয়া উচিৎ ইউরোপীয় কেতার আদলে, এ বিষয়ে কোন সংশয় কোলকাতার জনসমাজে ছিল না। হ্যাভেল এমন এক পরিস্থিতিতে কোলকাতায় আসেন এবং কোলকাতা সরকারী আর্টস্কুলের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথমেই প্রশ্ন তোলেন ইউরোপিয় শিল্পচর্চার অন্ধ অনুকরণে তৈরি এক প্রাচীন সিলেবাসে চার দশক ধরে বঙ্গের শিল্পকলার ছাত্রদের শিক্ষাদান নিয়ে। নানা বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হয়েও তিনি আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকেন অবিভক্ত বঙ্গের শিল্পকলার শিক্ষাকে ইউরোপীয় শিল্পরীতির অনুবর্তন থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতীয় শিল্প - পরম্পরার অভিমুখী করার।



চিত্র ২ঃ অন্তিমশয্যায় শাহজাহান - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দুই।

বঙ্গের শিল্পশিক্ষার প্রথম শিল্পাচার্য হেনরি হোভার লক, বা তারপর দায়িত্বে আসা উইলিয়াম জবিন্সের সাথে হ্যাভেলের একটা মৌলিক তফাৎ ছিল এ জায়গায় যে, হ্যাভেল কোলকাতা আর্ট স্কুলের দায়িত্ব নেবার আগে ১৮৮৪ সাল থেকে প্রায় এক দশকের বেশী সময় ভারতের মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই একদশক কালে তিনি আগ্রহ নিয়ে ভারতের শিল্পকলা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। ঘেঁটে দেখেছেন মুঘল , রাজস্থানি, ডেকান , পাহাড়ি এবং দক্ষিণ ভারতের আরও নানান আর্টফর্ম। এতে করে ভারতীয় শিল্পকলার যে আত্মিক দিকটি তার সম্মুখে প্রতিভাত হয়, তা লক - জবিন্স সহ আর কোন বিদেশী শিল্পগুরুর চোখে হয়ে ওঠে নি। লক - জবিন্সের সাথে হ্যাভেলের ব্যক্তিগত শিল্পদর্শনের বেশ খানিকটা দূরত্বও ছিল বলতে হবে।

লক বা জবিন্সের মতই হ্যাভেলও ছিলেন লন্ডনের সাউথ কেনসিংটন আর্টস্কুলের ছাত্র। ওখান থেকে একাডেমিক রীতিতে চিত্রশিক্ষা অর্জন করে তিনি তেলরঙে কিছু নিসর্গচিত্র (ল্যান্ডস্কেপ) আঁকেন, কিন্তু তার অঙ্কনে মেকানিক্যাল পারফেকশান তাকে পরিতৃপ্তি এনে দেয় না। তিনি বোঝেন , তার ছবিগুলোতে প্রাণের অভাব রয়েছে। ঠিক একই সময়ে, উনিশ শতকের শেষভাগে শিল্পী জন রাস্কিনের অনুসারীরা (বিশেষত গ্যাব্রিয়েল দান্তে রসেটি, এবং এডওয়ার্ড বার্ন জোন্স) , এমনকি উইলিয়াম মরিসের মত পরম্পরাজাত ব্রিটিশ কারুশিল্পের পুনরুজ্জীবনপন্থীরাও ব্রিটিশ রয়্যাল একাডেমী নির্ধারিত শিল্পাদর্শের প্রতি অনাস্থাজ্ঞাপন করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই হ্যাভেল চলে আসেন ভারতের মাদ্রাজে, এবং প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলায় আধ্যাত্মবাদ এবং ব্যক্তিমানসের যথার্থ মিশেল খুঁজে পেয়ে তৃপ্ত হন। এদিকে গোটা ইউরোপ তখন যে কেতার শিল্পচর্চা - শিল্পশিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করছে, কোলকাতা আর্ট স্কুলে তখনও অন্ধের মত জশুয়া রেনলডসের প্রচলিত শিল্পাদর্শের চর্চায় ন্যাস্ত দেখে হ্যাভেল কষ্ট পান, এবং তড়িৎ তার বদল ঘটানোর চেষ্টা করেন। কোলকাতা আর্ট স্কুলের দায়িত্ব নেয়ার এক বছরের মধ্যেই স্কুলের পঞ্চবার্ষিকী রিপোর্টে (১৮৯৩ - ১৮৯৭) তাকে লিখতে দেখা যায় -

'সকল শিল্পের ভিত্তিস্বরূপ যে ডিজাইন, তার শিক্ষা সম্পুরনভাবে অবহেলিত হয়েছে; এবং ড্রয়িং ও পেইন্টিং এর সাধারণ শ্রেণীগুলোতে আগাগোড়া চল্লিশ বছরের পুরনো ইংরেজ প্রাদেশিক শিল্পরীতিই অনুসৃত হয়েছে। ব্যবহারিক জ্যামিতি, কারিগরি রেখাঙ্কন ও পরিপ্রেক্ষিত (পারস্পেক্টিভ ড্রয়িং) শেখানো হয় নি। প্রাচ্য কলাশিল্প হয়েছে অবহেলিত; আর তার ফলে ভারতীয় ছাত্ররা ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে।'

কোলকাতা আর্ট স্কুলে চলে আসা এতদিনের এই শিক্ষাপদ্ধতির প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যেই নতুন রেগুলেশনের মাধ্যমে আর্ট স্কুলের পাঠ্যক্রমকে ঢেলে সাজান। তিনি সমস্ত শিল্পশিক্ষাকে দু'ভাগে ভাগ করেন - ১।কারুশিল্প বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট, এবং ২। চারুশিল্প বা ফাইন আর্ট। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ঢাকায় যখন আর্ট কলেজ চালু হয়, তখনও, প্রাথমিকভাবে এই দুটি ডিপার্টমেন্ট নিয়েই তা যাত্রা শুরু করে। একটা ব্যতিক্রম ছিল যে, হ্যাভেলের কারুশিল্প বিভাগের অধীনে প্রাচ্যশিল্প বা ওরিয়েন্টাল আর্ট শেখানোর ব্যাবস্থা চালু হয়, যেটা একটি আলাদা ডিপার্টমেন্ট হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় প্রায় দু'দশকের মত সময়কাল পরে চালু হয়। অপরদিকে ফাইন আর্ট ডিপার্টমেন্টে ইউরোপীয় চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির আধুনিকায়নেও হ্যাভেল মনোযোগী হন।



চিত্র ৩ঃ বুদ্ধ ও সুজাতা - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৩.
বাঙ্গালী পরিবর্তন পছন্দ করে না। ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। গুরুসদৃশ মানুষ, কিংবা জাতিগোষ্ঠীর চিন্তাধারাকে প্রশ্ন করতে পারে না। স্বরাজ আন্দোলনের সার্থকতা, এবং তৎপরবর্তি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে বারবার বক্তৃতা ও রচনায় উঠে এলেও, আত্মপরিচয়ের গর্বে গর্বিত হয়ে স্রেফ বাঙ্গালিয়ানায় ভর দিয়ে দাঁড়াতে কুণ্ঠা বোধ করে। বাঙ্গালীর এ ব্যাধি নতুন নয়। বহু পুরনো।

হ্যাভেলের মত একজন বিদেশী শিল্পশিক্ষক এসে যখন প্রচার করা শুরু করলেন যে ফিরে তাকানোর মত, বুকে জড়িয়ে ধরবার মত, মাথায় তুলে রাখবার মত গৌরবাজ্জল এক শিল্পাদর্শ এই ভারতীয় উপমহাদেশেই আছে, সে কথা হজম করবার মত লোকের অভাব পড়ে কোলকাতায়। মজার বিষয় হচ্ছে, হ্যাভেলের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ আসে তার আর্ট স্কুলের ছাত্রদের মধ্য থেকেই।

হ্যাভেল যখন আর্টস্কুলের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাচ্যদেশীয় কলাশিল্পের ওপর প্রাথমিকভাবে জোর দেয়া শুরু করলেন, ছাত্রদের মধ্যে একধরনের অসন্তোষ পরিলক্ষিত হল। হ্যাভেল যখন কারু ও প্রাচ্যদেশীয় শিল্পকলা বিভাগের জন্যে মাসিক বেতন কম ধার্য করলেন - তখন সেই অসন্তোষ হ্যাভেলের বিরুদ্ধে ছাত্রদের সংগঠিত করে তুলল। জনসাধারনের মধ্যে এই অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লো যখন হ্যাভেল আর্ট স্কুল সংলগ্ন আর্টগ্যালারি থেকে ইউরোপীয় ভাস্কর্য এবং চিত্রের অনুলিপি সরিয়ে তা ভারতীয় পরম্পরাগত কারু ও চারুশিল্পের নিদর্শন দিয়ে ঢেলে সাজালেন। দেশীয় পত্রপত্রিকাগুলি এই মর্মে তার বিরুদ্ধে সরব হল যে - হ্যাভেল বঙ্গীয় শিল্প শিক্ষার্থীদের ইউরোপীয় কলাশিল্প শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে তাদের এবং এদেশের কলাশিল্পের চর্চার ভবিষ্যৎকে ধ্বংসসাধনে নিমগ্ন।

এমতাবস্থায় স্কুলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রণদাপ্রসাদ গুপ্তের নেতৃত্বে একদল ছাত্র কোলকাতা আর্ট স্কুল ত্যাগ করে জুবিলি আর্ট একাডেমী প্রতিষ্ঠা করে। ইউরোপীয় কলাশিক্ষার প্রতি অকুণ্ঠ ভক্তি রাখা প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব , যেমন - কাশিমবাজারের মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী এবং কোলকাতার আরও প্রভূত ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের অর্থসাহায্যে পরবর্তী তিনদশক ধরে এই আর্ট স্কুল মহাসমারোহে অবিভক্ত বঙ্গের বুকে ইউরোপীয় ক্লাসিক চিত্রকলার আদর্শে তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে শিল্পকলার শিক্ষা বিতরণ করে। এও উল্লেখ্য যে, জুবিলি আর্ট একাডেমী থেকে শিক্ষা লাভ করে অনেকেই পরবর্তীতে বিখ্যাত শিল্পীতে পরিণত হন। এসকল ঘটনার ঘনঘটায় হ্যাভেল নিজের মত ব্যক্ত করে বলেন -

'আমি অ্যান্টিক ক্লাস তুলে দিয়ে ভারতীয় শিল্পকে শিক্ষার ভিত করে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনরবিন্যস্ত করেছিলাম। এই পরিবর্তনের ফল হয়েছিল সাংঘাতিক। বাঙ্গালিরা স্বভাবগত ভাবে রক্ষণশীল ... দলে দলে ছাত্ররা স্কুল থেকে বেরিয়ে যায়, ময়দানে জনসভা করে ও সরকারের কাছে আমার বিরুদ্ধে গণসাক্ষরিত প্রতিবাদ পত্র দেয়; এই সঙ্গে "প্রগতিশীল" সংবাদপত্রগুলি আমার বিরুদ্ধে অগ্নু্দগার করতে থাকে।'

এ সবকিছুর ডামাডোলে অস্বস্তিতে থাকা ব্রিটিশ সরকার কোলকাতা আর্ট স্কুলের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্তটি নেয়, সেখান থেকে আমাদের বাঙ্গালী শিক্ষা মন্ত্রনালয় সংশ্লিষ্টদের শেখার আছে। সরকারী কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন যে হ্যাভেলের নতুন পদক্ষেপগুলো তাদের মনঃপূত নয় , কিন্তু আর্টস্কুলের শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে পূর্বে তারা যেভাবে তার অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বিবেচনা করেছেন, এবারো তাই হবে। অর্থাৎ , জনগনের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে একজন শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে চালাতে চান - সরকার তাকে সেভাবেই প্রতিষ্ঠান চালাতে দেন। এদিকে সরকারের মনঃপূত হয়নি শুনেও হ্যাভেল থোড়াই কেয়ার করেন, বরং নবোদ্যমে ঢেলে সাজান কোলকাতা আর্ট স্কুল।



চিত্র ৪ঃ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত অভিসারিকা চিত্রের আদলে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত স্ট্যাম্প

৪।
আর্নেস্ট বি হ্যাভেলের সাথে ঠাকুর বাড়ির অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় হওয়াটা বাংলার শিল্পকলার ইতিহাসে এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা।

রবীন্দ্রনাথের ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন কেবল নিজের শিল্পকলার একটা ভাষা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে তিনি আঁকলেন বৈষ্ণব পদাবলীর অবলম্বনে কৃষ্ণলীলা সিরিজ। এই কৃষ্ণলীলা সিরিজের কাজ দেখার সূত্রেই হ্যাভেল - অবনের দেখা হয় ১৮৯৭ সালে, এবং ভারতীয় শিল্পশিক্ষার পথের ব্যাপারে দুজনের অভিন্ন মতাদর্শের ফলে সৃষ্টি হয় এক অটুট বন্ধুত্বের বন্ধন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ্যাভেলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, এবং হ্যাভেল খুব স্নেহ ভরে তাকে নিজের চ্যালা বলে উল্লেখ করতেন। ১৮৯৭ সাল থেকে নিয়ে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে অবনীন্দ্রনাথ , হ্যাভেলের কাছ থেকে মুঘল চিত্রকলার পাঠ নেন। শিল্পকলার ইতিহাসের সাধারণ পাঠক হিসেবে একজন ইংরেজের কাছে থেকে বাংলার শিল্পকলা চর্চার ইতিহাস বদলে দেবে, এমন একজন শিল্পীর পরম্পরাজাত মুঘল চিত্রকলার শিক্ষা নেয়ার ঘটনাটি আমাকে মুগ্ধ করে। আপনাকে করে না, প্রিয় পাঠক?

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিজের মত করে গড়েপিটে নেবার, এবং তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্যে হ্যাভেলের চেষ্টার অন্ত ছিল না। কোলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সংশ্লিষ্টতা তো এক্ষেত্রে এক নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছেন, অবনীন্দ্রনাথের ব্যক্তিপ্রতিভাও হ্যাভেলকে অবনের উপর বিশ্বাসস্থাপনে সাহায্য করেছে। ফলশ্রুতিতে হ্যাভেলের উদ্যোগে আয়োজিত গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের চিত্রকলা প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয় ভারতীয় পরম্পরাজাত পদ্ধতিতে অঙ্কিত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পদ্মাবতী' ও 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' সিরিজের কিছু ছবি। পরবর্তীতে হ্যাভেলের উদ্যোগেই ১৯০২-০৩ সালে দিল্লীর রাজকীয় প্রদর্শনী 'দিল্লী দরবার' - এ অবনীন্দ্রনাথের তিনটি ছবি প্রদর্শিত হয়, এবং তন্মধ্যে তেলরঙে আঁকা অন্তিমশয্যায় শাহজাহান ছবিটি (চিত্র ২) পুরস্কৃত হলে সরকারী - বেসরকারি মহলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খ্যাতি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯০২ সালে একবছরের ছুটি নিয়ে হ্যাভেল লন্ডনে ফেরত যান এবং সেসময় লন্ডনের বিখ্যাত 'দি স্টুডিও' পত্রিকায় ভারতীয় চিত্রকলার উপর একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যার আলোচনার একটা বড় অংশ ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলা। এই প্রবন্ধে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটো ছবি - 'বুদ্ধ ও সুজাতা' (চিত্র ৩) এবং 'অভিসারিকা' (চিত্র ৪) ছাপা হয়।

দেশে ফিরে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত হ্যাভেল পূর্ণোদ্যমে কোলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষকতায় নিয়োজিত থেকে নিজে যে চেতনার ধারক - বাহক ছিলেন , তার অনুকরনে বঙ্গের চিত্রশিক্ষার সেবা করে যান। এবং, মানসিক অস্থিতিশীলতার বশবর্তী হয়ে চিরতরে ভারত ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যাবার আগে তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কোলকাতা আর্ট স্কুলের উপাধ্যক্ষ্যের পদে নিয়োগ দিয়ে যান। হ্যাভেলের এই দূরদর্শী সিদ্ধান্তে অবিভক্ত বঙ্গের চিত্রকলার আকাশে এমন নতুন এক দিগন্তের দেখা মেলে, যার হাত ধরে উঠে আসেন পরবর্তীতে সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু , এবং আমাদের জয়নুল - কামরুল - সফিউদ্দিন সাহেবের প্রিয় শিক্ষক হাকিম মোহাম্মদ খান।

আর্নেস্ট বি হ্যাভেল এবং অবিভক্ত বঙ্গে আধুনিক শিল্পকলার সূত্রপাত সংক্রান্ত এ আলোচনার সমাপ্তি এভাবে টানা যাক যে - একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু পড়ানো নয়, বরং তিনি যে আদর্শে আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী - তার প্রকৃত ধারকবাহক ছাত্র তৈরি করে যাওয়া। হ্যাভেল এই কাজটি যথার্থভাবেই করেছিলেন। তার প্রমাণ হল এই যে - হ্যাভেলের কর্মকাণ্ডের শত বৎসর পরে এসেও বাংলার চিত্রকলার ইতিহাসে তিনি প্রাসঙ্গিক থাকছেন। যেকোনো শিল্প ইতিহাসবেত্তার বইয়ে হ্যাভেলের নামে একটি চ্যাপ্টার, নিদেনপক্ষে একটা অনুচ্ছেদ থাকছেই। অন্যদিকে তার বিরোধী যারা ছিলেন, শুধুমাত্র হ্যাভেলের প্রসঙ্গেই তাদের আলোচনা হয়। নতুবা ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম এখন ধুলোমলিন।

লন্ডনে ফেরত গিয়েও , প্রবল মানসিক অসুস্থতার মাঝে হ্যাভেল লিখে গিয়েছেন ভারতীয় শিল্পকলার বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় প্রামাণ্য সব প্রবন্ধ। শিল্পকলার শুদ্ধতার প্রতি হ্যাভেলের এ আন্তরিক ভালোবাসা আমাদের মধ্যেও প্রবেশ করুক।

ঋণস্বীকারঃ
১। বাংলার চিত্রকলা - অশোক ভট্টাচার্য (পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমি)
২। ভারতের চিত্রকলা - অশোক মিত্র , দ্বিতীয় খণ্ড ( আনন্দ পাবলিকেশনস)
৩। কামরুল হাসান - বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী
৪। সফিউদ্দিন আহমেদ - বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি
৫। On Liberty - John Stuart Mill (Penguin Classics)

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৩:৩১

নেওয়াজ আলি বলেছেন: Excellent

২০ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৯:৫৩

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ১৯ শে এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৪৪

রাজীব নুর বলেছেন: অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর পোষ্ট।

২০ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৯:৫৩

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ১৯ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:৫৭

শের শায়রী বলেছেন: দারুন একটা সিরিজ চালাচ্ছেন, কয়েকটা পড়ছি, আগে মন্তব্য করা হয়ে ওঠেনি, ছোট্ট একটা অনুরোধ একটু কষ্ট হলেও প্রতিটা লাষ্ট পর্বে আগের পোষ্ট গুলোর লিঙ্ক দিয়ে দিলে ভালো হত।

শুভেচ্ছা জানবেন।

২০ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:০৬

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: মন্তব্যে ধন্যবাদ, জনাব শের শায়রী।

আপনি অনেক পরিশ্রম করে এক একটা লেখা তৈরি করেন। আপনার ধীশক্তি আমাকে মুগ্ধ করে। আপনার জন্যে শুভকামনা।

একটা গল্প বলে শেষ করি।

আমার এলাকার বাজার থেকে বাসায় ফেরার পথে দু' তিনটে ঘেয়ো কুকুর থাকে। যখনি কেউ হাতে বাজারের থলি নিয়ে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় - কুকুরগুলো কম - বেশী তাদের পিছু নেয়। ব্যাগ শোঁকে। একটু পর তুমুল স্বরে ঘেউ ঘেউ করা শুরু করে।
প্রথম প্রথম অসহায় লাগতো। ভয় পেতাম। হুশহাশ শব্দ করে তাড়ানোর চেষ্টা করতাম। একদিন কামড়ে একটা প্যাকেট রেখে দিয়েছি আমার হাত থেকে।

পরে আবিষ্কার করলাম, যদি আমি ওদের ঘেউ ঘেউ এর জবাব না দিই - ওরা কিছুদূর পেছনে পেছনে আসে, কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন রেসপন্স না পেয়ে চলে যায়। আমার কাছে কুকুরকে জবাব দেয়ার চে' বাজার বাসায় পৌঁছানো বেশী প্রয়োজন।

প্রিয় শের শায়রী, আসা করি আমার এই অভিজ্ঞতা আপনার ব্যক্তিগত জীবন, এবং ব্লগিয় জীবনে কাজে আসবে।

৪| ২১ শে এপ্রিল, ২০২০ ভোর ৪:১২

শের শায়রী বলেছেন: পছন্দ হইছে আপনার গল্প। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.