নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙ্গাল মস্তিষ্কের বি - উপনিবেশায়ন, নোকতা ২ঃ পাশ্চাত্য দর্শনের ঐতিহাসিক বেআদবি

১৪ ই মে, ২০২০ রাত ৩:০৪



এক।

কোথায় দাঁড়িয়ে এ আলাপের শুরু?

সমাজের পুঁজিপতিদের জন্যে না হলেও, চিন্তাশীল - অনুভূতিসম্পন্ন মানুষদের কাছে ২০২০ সালের প্রেক্ষিতে সবচে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন একটা সমাজব্যবস্থার তালাশ যা সর্বমত সহনশীল, যা মানুষের জৈবিক ও আচারগত বৈচিত্র্য, তথা কালচারাল প্লুরালিটি সংরক্ষণে সহায়ক। পুঁজির বিকাশের সাথে পুঁজিপতিদের শত্রুর বিচিত্রমুখিনতা আমাদের হয়রান করে। কখনো গায়ের রঙ, কখনো, ধর্মবিশ্বাস, কখনো ভৌগলিক অবস্থান, কখনো মনুষ্যপ্রজাতিকে অতিক্রম করে প্রকৃতি নিজেই দাঁড়িয়ে যায় পুঁজির বিকাশে শত্রু হয়ে। তখন প্রয়োজন দেখা দেয় নির্দিষ্ট বর্ণ - ধর্ম - সংস্কৃতির জাতিগোষ্ঠীর ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে তাদের ভূসম্পত্তির দখল, ক্ষেত্রবিশেষে সমুলে নাশ, বা এথনিক ক্লিন্সিং। সেইসূত্রেই কখনো প্রয়োজন পড়ে বিশাল বনভুমি কেটে ফেলবার, পাহাড় উড়িয়ে দিয়ে রাস্তা বানাবার। এমন এক অস্থির সময়ে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যসহ মানুষকে তাঁর সম্মান নিয়ে বাঁচতে দেয়ার লড়াই - প্রধান লড়াই, অন্তত পৃথিবীর বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কাছে। পুঁজির বিকাশের পীঠস্থান পাশ্চাত্য - তাঁর বৈজ্ঞানিক ,গানিতিক, যুক্তিবাদী দার্শনিক জীবনব্যবস্থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, তাদের উপনিবেশসমূহ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর থেকেই, নানা হেজিমনির মাধ্যমে তাদের প্রাক্তন কলোনি, তথা আমাদের সামনে একমাত্র অনুসরণযোগ্য জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করে।

তাদের বয়ান তৈরিতে সহায়তাকারী পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রোপ্যাগান্ডায়, পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক জীবনব্যবস্থার বিপরীতমুখী যেকোনো স্থানিক চিন্তাচেতনা ধারন, বা তার প্রচারের প্রচেষ্টাকেই চিহ্নিত করে মধ্যযুগীয় , পশ্চাৎপদি চিন্তার স্টেরিওটাইপে। প্রাক্তন কলোনিগুলোর দীর্ঘ লালিত সংস্কার ও ধর্ম যেহেতু পশ্চিমা দর্শনকে তাদের পূর্বের ঠগবাজির সাথে মিলিয়ে সন্দেহের চোখেই দেখবে, কাজেই শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক জীবন নয়, সাংবিধানিকভাবে সেকুলার হওয়াকেই পৃথিবীজুড়ে ভিন্ন ধর্ম - সংস্কৃতির মানুষে মানুষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একমাত্র পন্থা হিসেবে পশ্চিমা দেশের একশ্রেণীর "মুক্তমনা" তাত্ত্বিকরা বর্ণনা করেন। পৃথিবীর ম্যাপ খুলে বসলে দেখা যাবে, সাংবিধানিক ভাবে সেকুলার রাষ্ট্রের তালিকায় আছে অ্যামেরিকা , আছে রাশিয়া, আছে চীন, আছে আমাদের পার্শ্ববর্তি দেশ ভারতও। সেকুলার রাষ্ট্রসমূহের নামের সংক্ষিপ্ত তালিকা দেখার পর যুক্তি নির্ভর, বিজ্ঞানভিত্তিক সেকুলার সংবিধান মাত্রই ঘরে বাইরে মানবাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, - আপ্তবাক্যটি আপনার ঠোঁটের কোনে একফালি বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলছে কী?

পাঠক, আলোচনার শুরুতেই খোলাসা করি যে - আমার এ লেখাটি সংবিধান সেকুলার, বা ধর্মপরিচয়ভিত্তিক হওয়া উচিৎ কিনা , তা নিয়ে নয়। বরং "যুক্তি - বিজ্ঞান - আধুনিকতার" ট্যাগলাইনে বিগত প্রায় একশতক ধরে পাশ্চাত্য, এবং পাশ্চাত্য দর্শনের দার্শনিকেরা ঠিক কি তত্ত্ব ঔপনিবেশিক বঙ্গে প্রচার করেছে, এ ভু অঞ্চলের কোন কোন মূর্ত - বিমূর্ত বস্তু বা অনুভূতির প্রতিপক্ষ হিসেবে পাশ্চাত্য গণিত - যুক্তি ও জ্ঞানকে দাঁড়া করিয়ে দিয়েছে, এবং কীভাবে তাদের জ্ঞান অখণ্ডতা, এবং জ্ঞানের সর্বজনীন একমুখী ইতিহাসের তৈরি আপ্তধারণার বিরুদ্ধে টু শব্দটি উচ্চারণ করলেই অধিকাংশ সময় তাঁরা ফ্যাসিস্টদের মত গোঁড়া, পশ্চাৎপদ, মধ্যযুগীয় বর্বর হিসেবে স্টেরিওটাইপ করেছে , তাঁর একটি তত্ত্বতালাশ।

শুরু এবং শেষ বাদ দিলে আমার আলোচনা চারটি অংশে বিভক্তঃ

প্রথমত, ইউরোপীয় দর্শন ও তত্ত্বকে সর্বজনীন বলে প্রচার করবার ঐতিহাসিক তৎপরতার ছক নির্ণয়,
দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও দর্শনের আপ্তধারণা সমূহের মধ্যে যে পরস্পর বিরোধিতা আছে, তাঁর সূত্রান্বেষণ,
তৃতীয়ত, প্রাচ্যদেশীয় দর্শনের ব্যাপারে তাদের প্রচারিত বিভিন্ন ভ্রান্তধারণা খণ্ডন,
এবং চতুর্থত, তত্ত্ব কীভাবে পণ্যের আকারে আমাদের মাঝে সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়ন চালিয়ে যাচ্ছে, তাঁর মুখোশ উন্মোচন।


দুই।

ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস , না সর্বজনীন দর্শনের ইতিহাস?

রায়হান রাইনের 'বাংলার দর্শন, প্রাক উপনিবেশ পর্ব' বইয়ের সূচনাপর্ব পাঠপূর্বক আমরা জানতে পারি, উনিশ শতকের গোড়ার সময়কাল থেকে নিয়ে গত শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত পাশ্চাত্যে রচিত ইতিহাসের বইসমূহে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বেশ খোলামেলাভাবেই চোখে পড়ে।

এই টাইমফ্রেমের মধ্যেই যখন পাশ্চাত্যে - 'দর্শনের ইতিহাস' রচনার প্রথম প্রয়াস হাতে নেয়া হয়, ইউরোপের পণ্ডিতদের দেখা যায় পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসকেই সমগ্র পৃথিবীর দর্শনের সর্বজনীন ইতিহাস বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় রত অবস্থায়। তাঁরা দাবী করেন, ইউরোপেই সুসমঞ্জস্য চিন্তার প্রথম আবির্ভাব ও বিকাশ ঘটে। তাই তাঁরা দর্শনের ইতিহাসকে খ্রিস্টপূর্ব ও পরবর্তী ইতিহাসকে চারটি যুগে ভাগ করে তাঁর বিবরণকে বিশ্ব দর্শনের ইতিহাস বলে প্রচার করার চেষ্টা করেন। যদিও, এটা তাদের অজানা ছিল না যে, প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিক থেলিসের জন্মের আগেই প্রাচীন মিসরীয়দের মাঝে দার্শনিক চিন্তার একটি ধারা প্রবহমান ছিল , যার সম্বন্ধে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল ওয়াকেফহাল ছিলেন, এবং তাদের লেখার মাঝেও এ বিষয়গুলি এসেছে। অ্যারিস্টটল তার রচনায় মিসরীয় পুরোহিতদের পৃথিবীর আদি দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য যে তখন , এবং তারও প্রায় হাজার বছর আগে, ভারতীয় উপমহাদেশে বুদ্ধ, এবং বৈদিক বা বেদ - উপনিষদের দর্শন বিদ্যমান ছিল। হয়তো সরাসরি সংস্পর্শের অভাবে অ্যারিস্টটলের লেখায় তাঁর উল্লেখ নেই। কিন্তু দর্শনের ইতিহাসের আধুনিক রচয়িতারাও যখন জেনেও এ সত্যটি এড়িয়ে যান, তখন তাদের বর্ণবাদি দৃষ্টিকোন স্পষ্ট হয়।

ফ্রাঙ্ক থিলির মত পণ্ডিত ব্যক্তি তাই এমন বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যে - ষষ্ঠ শতকের গ্রিসের আয়োনিয়ানদের মধ্যেই প্রথম সুসমঞ্জস চিন্তার উদ্ভব। থিলির দর্শনের ইতিহাসের বইটির নামকরণেই তাঁর বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্ট। তিনি লেখেন পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস, কিন্তু বইটির নাম দেন - 'আ হিস্টোরি অফ ফিলসফি', বা দর্শনের ইতিহাস, যেটি দর্শনের এমন এক ইতিহাস, যাতে আমার - আপনার উপস্থিতি নেই, যাতে প্রাচ্যদেশীয় মানুষদের চিন্তার ইতিহাস সযত্নে এবং সুচতুরভাবে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। শুধু ভারতের না, দূর প্রাচ্যের চীন - জাপানের সমৃদ্ধ ইতিহাসও তিনি উহ্য রেখে বিশ্ব দর্শনের ইতিহাসের আলাপ চালিয়ে গেছেন। অথচ, জ্ঞানতাপস আবদূর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন আয়োজিত সিরিজ বক্তৃতামালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের চীনের দর্শন - রাষ্ট্রনীতি ও ইতিহাস সংশ্লিষ্ট এক বক্তৃতায় শুনেছিলাম - পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে নিজের সভ্যতার ব্যাপারে সবচে প্রাচীনকাল থেকে লিখিত ইতিহাসের বর্ণনা পাওয়া যায় চীনাদের মধ্যে। আবার পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বই - এ গ্লিম্পস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রিতে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত মহাচীন যে বারবার পাশের ছোট সাম্রাজ্যবাদী দেশ জাপানের দ্বারা শোষিত হয়েছে, তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে - চীনের গৌরব ও নির্ভরতার জায়গা ছিল তাদের সংস্কৃতি, তাদের দর্শনমুখী জীবন। ফলে তাঁরা ভায়লেন্সের পথ বেছে নেয় নি। পৃথিবীর আর কোন জাতির এত প্রাচীন, এত সমৃদ্ধ, এত বিস্তৃত ইতিহাসের আলোচনা লিখিত অবস্থায় নেই।

থিলির মত একই সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্ব দর্শনের ইতিহাস লেখার চেষ্টায় রত অবস্থায় পাওয়া যায় উইল ডুরান্ট, এফ. কপলেস্টন সহ আরও অনেক পণ্ডিতকেই।

তাদের এই প্রচেষ্টার ফসল ঘরে তুলতে তাদের বেগ পেতে হয় নি। আজকের বাংলাদেশে বসে নিজের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটু চিন্তা করে দেখুন - যারাই টুকটাক দর্শনের জ্ঞান কপচায়, তাদের মুখে কোন দার্শনিকদের নাম আপনি সবচে বেশী শোনেন? সক্রেটিস? অ্যারিস্টটল, প্লেটো? বা যারা আর একটু পড়াশোনা করার চেষ্টা করে, তাদের মুখে দেকার্ত, কান্ট , বা হেগেল? বা হাল আমলের নিটশে, বা অস্তিত্ববাদী দর্শনের সূত্র ধরেই জ্যা পোল সারত্রে? পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসকে বিশ্ব দর্শনের ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তাঁরা যে সফল - তাঁর প্রমাণ হচ্ছে এই যে - নিজেকে উন্নত চিন্তার অধিকার প্রমাণ করার চেষ্টায় রত অনেক ভুঁইফোঁড় বাঙ্গালীই হুটহাট এই পাশ্চাত্য দার্শনিকদের নাম ঝেড়ে , তাদের তথ্য অধিকাংশ সময়ে পরম্পরাহীনভাবে উপস্থাপন করে তর্কে প্রবৃত্ত হয়, এবং জিততে চায়। এভাবে স্মার্টনেসের সংজ্ঞায়ন হয়, এবং বাঙ্গালীর মাটির নীচে চাপা পড়ে যাওয়া নৃতাত্ত্বিক আত্মপরিচয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক পুনরাবিষ্কারের সম্ভাবনা প্রতিবার মাটির আরও এক মাইল নীচে চাপা পড়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ের দর্শনের ইতিহাস রচয়িতারা অবশ্য এ হীন কর্মকাণ্ড থেকে সরে এসেছেন। প্রসঙ্গতই এসে যায় জন শ্যান্ড, হ্যারলড টাইটাস, বা বার্টান্ড রাসেল ও তাদের দর্শনের বইয়ের নাম। ওয়েস্টার্ন অ্যাকাডেমিয়ায় এখন ভারতীয়, বা চৈনিক, বা মুসলিম দর্শনের ওপর আলাদা বিভাগ খোলা হয়েছে, যদিও সংখ্যায় তা অপ্রতুল। এর একটা কারণ রায়হান রাইন উল্লেখ করেন যে - ঔপনিবেশায়নের ফলশ্রুতিতে জন্ম এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোই দাঁড়িয়ে আছে কাঠামোগতভাবে লব্ধ ঔপনিবেশিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে।

তিন।

গণিত - যুক্তি - বিজ্ঞান এবং "আধুনিকতা" কালচারাল প্লুরালিটি সংরক্ষনে সক্ষম ?


সারা পৃথিবী জুড়ে গণিত - যুক্তি - বিজ্ঞান এবং আধুনিকতাকে এক লাইনে, একটা শ্লোগান আকারে প্রচার করা হয়। মিডিয়ায়, চায়ের টেবিলের আড্ডায়, ক্লাসরুমে, দেয়াল লিখনে। সাহিত্য , সঙ্গীত, চিত্রকলা, সিনেমা - ইত্যাদি বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিভিত্তিক পরম্পরা আছে। উদাহরণস্বরূপ, পাশ্চাত্যের ধ্রুপদ সঙ্গীত , এবং আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ধ্রুপদ সঙ্গীত। পরম্পরা ভিন্ন, প্রকাশ ভিন্ন, সবকিছুই ভিন্ন।

কিন্তু, গণিত , বা যুক্তিভিত্তিক যে বিজ্ঞানচর্চা আমরা করি - তা কি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্নভাবে চর্চিত হয়? চাইনিজ গণিত, বা ভারতীয় গণিত - বলে কিছু শুনেছেন, বা শুনে থাকলেও - প্র্যাকটিস করার সুযোগ হয়েছে কখনো?

৯৯ শতাংশ বাঙ্গালীর উত্তর হবে, না।

কাজেই, অন্তত এ একটা বিষয়ে আমরা প্রথমেই সম্মত হতে পারি যে, গণিত - গণিতের সূত্র ধরে যুক্তি - যৌক্তিক চিন্তার সূত্র ধরে বিজ্ঞান, এই চেইনের উৎসমুখ পাশ্চাত্যে? পশ্চিমা গণিতবাদ ও যুক্তি প্রক্রিয়ার যে একটা সর্বজনীন বস্তুনিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই।

এই প্রসঙ্গে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরবর্তী, এবং সর্বজনীনভাবেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হল - পশ্চিমা দর্শন যে গণিত, যুক্তি ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের স্বপ্ন আমাদের দেখায়, তা কী কালচারাল প্লুরালিটির পক্ষে যায়, না বিপক্ষে কাজ করে?


আর বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, এদেশে যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে পাশ্চাত্যের ধারাবাহিকতায় আসা বিজ্ঞানমুখিনতায় আত্মসমর্পণ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তাঁরা আমাদের ঠিক কি কি বস্তুর বিপরীতে বিজ্ঞানকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করান? আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃতি, এবং আমাদের মূল্যবোধের সীমারেখা নির্ণয় করবে বিজ্ঞান?

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের করায়ত্ত পৃথিবী কি ইউটোপিয়া, না ডিসটোপিয়া?


প্রথম প্রশ্ন, গণিত ও কালচারাল প্লুরালিটির প্রসঙ্গে আগে আসি। আলোচনা শুরু করি আর্নেস্ট ক্যাসিরারের নামক বিংশ শতাব্দীর এক প্রখ্যাত জার্মান কালচারাল ফিলসফারের আলোচনা দিয়ে। আর্নেস্ট ক্যাসিরারেরঃ দা লাস্ট ফিলোসফার অফ কালচার নামে, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এক বইয়ে ক্যাসিরারকে আমরা লক্ষ্য করি গণিতকে এমন একটি দৃষ্টিকোন থেকে দেখার, এবং ভাষার বিপরীতে তার টেন্ডেন্সিগুলো চিহ্নিত করবার চেষ্টায় রত অবস্থায়, যা গণিত এবং বিজ্ঞানের দিগ্বিজয়ী রথযাত্রার পেছনের চালিকাসূত্রকে তালাশ করে।

ক্যাসিরার বলেন -

"Language possesses no general principle of order. Each word has its own relatively limited radius of action, beyond which its force doesn't work. Language still lacks the means of combining several different spheres of signification into a new linguistic whole designated by a unitary form.This final achievement belongs to mathematical natural science. Number emerges as the indispensable instrument of unification, for it alone has the power to organize heterogeneous sensory impressions into homogeneous ordered series. How else, except by translation into numerical terms, can the red of the strawberries and the blast of a trumpet be rendered commensurable? Number is a kind of universal acid, by means of which the plurality of objects and properties is dissolved into a functional whole. "

প্যারাটির আক্ষরিক অনুবাদে যদি যাই, দেখা যাবে ক্যাসিরার বলছেন - ভাষার সুনির্দিষ্ট কোন ক্রমানুসার তৈরির সক্ষমতা নেই (যেমন ধরুন, ১ এর পর ২ আসে, ২ এর পর ৩, এরকম কোন শব্দের শৃঙ্খলাবদ্ধ স্রোত নেই) । প্রতিটি শব্দের অর্থ এবং তাৎপর্যের একটা নির্দিষ্ট গণ্ডি আছে , তাঁর বাইরে সে কাজ করে না। ভিন্ন ভিন্ন সিগনিফাইয়ারকে একটি নির্দিষ্ট স্রোতে প্রবাহিত করবার জন্যে ভাষার আরও দূর পথ অতিক্রম করা বাকি। এই কাজটি করবার জন্যে আবিষ্কার হয়েছে প্রাকৃতিক গানিতিক বিদ্যার। সংখ্যাতত্ত্বের জন্মই হয়েছে ইউনিফিকেশনের জন্যে কারণ, শুধুমাত্র সংখ্যারই সক্ষমতা রয়েছে হেটেরজেনাস স্নায়বিক অভিজ্ঞতাকে হোমোজেনাস ধারাবাহিকতায় সাজাবার। নইলে কিভাবেই বা একটা আপেল কতটুকু লাল, বা একটা বাঁশি কত জোরে বাজছে - এটাকে অঙ্কে / সংখ্যায় অনুবাদ করা যায়? সংখ্যা হচ্ছে সেই সার্বজনীন অ্যাসিড, যা বস্তুর বৈচিত্র্যকে গলিয়ে কর্মক্ষম একটা এককে পরিণত করবার ক্ষমতা রাখে।

সহজ করি যদি বলি, ভাষা, বাই ডেফিনেশন অ্যান্ড ফাংশান, তার সীমাবদ্ধতার কারণে কালচারাল প্লুরালিটির পক্ষে যায়। পৃথিবীজুড়ে তাই বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ভাষা ভিত্তিক সমাজ - সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু সমাজ বহুমুখী হলেও ভিন্নভিন্ন সংস্কৃতির লোকেদের একটা সাধারণ বিনিময় মাধ্যম তো লাগবে, না হলে পারস্পারিক লেনদেন হবে কি করে? ভাষার এই সীমাবদ্ধতার জায়গা থেকে জন্ম হয় সংখ্যাতত্ত্বের। সংখ্যার এমনি গুণ, যে তা যেকোনো রকমের প্লুরালিটিকে অ্যাসিডের মত গলিয়ে হোমোজেনাস আইডেন্টিটিতে পরিণত করতে পারে।

তাই এ বিষয়ে আমরা একমত হতে পারি যে - গণিত, তাঁর জন্মের সূত্র ধরেই কখনো সাংস্কৃতিক প্লুরালিটি বা ডাইভারসিটির পক্ষে যাবে না। এমনকি মানুষের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি পাঠেও গণিতের সক্ষমতা নগণ্য, প্রায় নেই বললেও ভুল হয় না।

উদাহরণ দিই - আপনার হাতে একহাজার টাকার দশটি নোট দিয়ে বললাম, গুনে বলুন কতোটাকা। আপনি দু'বার গুনে নিশ্চিত হয়ে বললেন, দশহাজার। আবার একটু পর আপনি বাইরে গিয়ে দেখলেন, আপনার অপেক্ষায় কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে ক'জন মানুষ। আপনি গুনে বললেন - দশজন মানুষ।

আমার প্রশ্ন হল, হাজারটাকার দশটি নোট যেমন শুধুই হাজার টাকার দশটি নোট, দশজন মানুষ কি সেই অর্থেই দশজন মানুষ?

উত্তর হল, না। এই দশ জন মানুষের প্রতি জনের একটি আলাদা গল্প আছে, ইতিহাস আছে, মন আছে, মনন আছে, সংস্কৃতি আছে, দুর্বলতা আছে, শক্তি আছে। এই দশজন মানুষ চাপের মুখে হয়তো একশো জন মানুষ। এই দশজন মানুষ, প্রণোদনার অভাবে হয়তো একজন মানুষও না।

আবার একজন মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় কতটুকু শব্দসীমা পর্যন্ত শব্দের উপদ্রব সহ্য করতে পারে, সে বিষয়ে একটা ধরাবাঁধা গাণিতিক লিমিট প্রযুক্তি আমাদের দেয়। কিন্তু মানুষের মুড , শারীরিক অবস্থা, অবস্থানের তারতম্যে তাঁর চে কম শব্দদূষণেও যে সে আধপাগল হয়ে যেতে পারে - এর উপর গণিতের আলোকপাত করার সক্ষমতা নেই।

কাজেই গণিতের কাজ সরলীকরণ, সামান্যীকরণ। সব সমস্যার সার্বজনীন টোটকা সমাধান দেয়া, যেটা ক্ষেত্রবিশেষে কাজে লাগে।

নৈতিকতা, বা মূল্যবোধ সৃষ্টিতেও গণিতের কোন ভূমিকা নেই।

কতটুকু ইউরেনিয়াম জমা করলে একটা পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব , তাঁর নিখুঁত সমাধান গণিত আপনাকে দিতে পারবে, টেকনিক আপনাকে বিজ্ঞান শিখিয়ে দেবে, কিন্তু তা যে কোন অবস্থায়ই মানুষের উপর ছুঁড়ে মারা উচিৎ হবে না - আপনার মধ্যে সেই নৈতিকতাবোধ তৈরির দায়ভার গণিত নেয় না।

একই দোষে দোষী বিজ্ঞানও। দোষটা আসলে ঠিক বিজ্ঞানের উপর দেয়া নয়, বিজ্ঞানকে যারা ঈশ্বরের স্থান দিতে চান, তাদের।

আপনি যদি বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী হন, আপনাকে বিশ্বাস করবেন মানুষ বাঁদরের একটা উন্নত শ্রেণীবিভেদ। হালের স্টার জিউইশ হোমোস্যাক্সুয়াল হিস্টোরিয়ান ইউভাল নোয়াহ হারারির বই পড়ে আপনি জানবেন যে মানুষের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসে বর্ণিত হয় হোমো রুডলফেনসিস, হোমো ইরেক্টাস এবং হোমো নিয়েন্ডারথ্যালেনসিসের চামড়া খসিয়ে মানুষের হোমো স্যাপিয়েন্স বা হোমো জিনধারীদের মধ্যে বিজয়ী গ্রুপে পরিণত হবার গল্প।

কিন্তু বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী আধুনিক মানুষ যখন চিড়িয়াখানার খাঁচায় আটকে রাখা বাঁদরকে দেখতে যায়, গিয়ে বাদাম ছুঁড়ে দেয়, বিবর্তনবাদ কিন্তু তার নৈতিকতার জায়গায় চাড় দিয়ে এ মূল্যবোধ তৈরি করার দায়িত্ব নেয় না যে - মিউটেশনের রেসে পরাজিত ভাইদের খাঁচার মধ্যে আটকে রাখতে নেই।

আলোচনার সার হচ্ছে এই যে, গণিত - যুক্তি ও বিজ্ঞানকে বাংলাদেশে, অথবা পৃথিবীর যেকোনো দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতিরূপ হিসেবে প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টার গোঁড়ায় গলদ আছে, কারণ তা কখনোই মানুষকে তার পেছনের হাজার বছরের সংস্কার সংস্কৃতি সহ পরিপূর্ণ এবং ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি আনরিডেবল প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে না।

এ ক্ষেত্রে খুব জোর দিয়ে এটা বলা প্রয়োজন যে বিজ্ঞানমুখীনতা বা প্রযুক্তি নির্ভরতায় আমাদের আপত্তি থাকার কথাই আসে না, কিন্তু যুক্তি , বিজ্ঞান, গণিত - ইত্যাদির মোড়কে কে বা কারা আমাদের কি ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করতে চাচ্ছে এ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি সতর্ক থাকতে হবে।

পাশ্চাত্যের গণিত ঔপনিবেশিকতার ছায়ামুক্ত?

পুনরায় ফিরে আসি রায়হান রাইনের কাছে, তিনি তাঁর 'বাংলার দর্শন, প্রাক উপনিবেশ পর্ব' বইয়ে বলেন -

"উপনিবেশ মেট্রোপলিটনের কর্তৃত্বের ভেতরে থাকে কেন্দ্রীভূতকরণ ও একীভবনের নীতি। এ নীতির নিগড়ে জল ঢালে যুক্তির
সামান্যীকরণ ও সার্বজনীনতার মিথ, এবং বস্তুনিষ্ঠতার ধারণা। পশ্চিমা জ্ঞান সার্বভৌম যুক্তির ধারণা দেয় এবং এটা বিশ্বাস করাতে চায় যে সরলীকরণ ও একীভবনের মধ্যেই সমাজের প্রগতি ও আলোকময়তা নিহিত আছে। প্রকৃতপক্ষে 'যুক্তি' - সার্বভৌম নয়, অভিজ্ঞতার পূর্বগামী বা প্রাকসিদ্ধ প্রক্রিয়াও নয়। যুক্তি প্রক্রিয়া যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে অনুমিত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় , তা সমাজ ও মূল্যবোধ থেকেই আসে। অন্যদিকে যে গণিতশাস্ত্র বস্তুনিষ্ঠতার ধারণা দেয়, সেই গণিতও মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয়। অ্যালেন জে বিশপ বলেন - পশ্চিমা গণিত সারাবিশ্বে সার্বজনীন হিসেবে গৃহীত হয়েছে এওং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের গোপন অস্ত্র হয়ে উঠেছে এ গণিত।"

গণিতকে নিছক একটি প্রতীকী ব্যবস্থা হিসেবে দেখা যায় কি? নাকি এর পলিটিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টালাইজেশন সম্ভব?

রাইন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন পাশ্চাত্যের গণিতের সাথে জড়িয়ে থাকা কতিপয় মূল্যবোধঃ

প্রথমত, পশ্চিমা গণিত পশ্চিমা যুক্তিবাদিতার অনুপ্রেরণা দেয়, শক্তি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল করে, যুক্তিভিত্তিক হতে উদ্দীপনা জাগায় এবং যুক্তিবাদের পূর্ণতার স্বপক্ষে কথা বলে। (ভালো শুনাচ্ছে শুনতে)

দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা গণিত যে বিশেষ বস্তুনিষ্ঠতার ধারণা দেয়, সেটা জগতকে উপলব্ধি করার এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীতো বটেই, কিন্তু এই বস্তুনিষ্ঠতার দৃষ্টিকোণ নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। ( সন্দেহর শুরু। ঔপনিবেশিক মতলবের ঘ্রাণ পাওয়া যায় যায় অবস্থা।)

তৃতীয়ত, সর্বজনীনতা ও সাধারণীকরণের সুবিধা দেয় এই গণিত। এতে বস্তুকে প্রতিবেশ - পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিমূর্তভাবে স্থাপন করা হয়। অথচ কোন সংস্কৃতি যদি এমন বিশ্বাসে উপনীত হয়, যে কোন বস্তু চারপাশের অন্য বস্তুগুলোর সাথে আবশ্যিক সম্পর্ক নিয়েই অস্তিত্বশীল, তাহলে প্রতিবেশ পরিস্থিতি থেকে বিযুক্ত বস্তুর কোন অস্তিত্বই থাকে না। ( বস্তুর চারপাশের অন্যান্য বস্তুর সাথে আবশ্যিক সম্পর্কের ব্যাপারে নির্মিত একটা ব্লকবাস্টার হলিউড মুভি অ্যাভেটার। যদি রাইনের আলচনায় ফিরে আসি, এই স্থান থেকে পাশ্চাত্য গণিতের সর্বজনীনতার সাথে বৃহৎ বঙ্গের মানুষের বিরোধের সূত্রপাত।)

চতুর্থত, গণিতের সঙ্গে আছে ক্ষমতা, ও নিয়ন্ত্রণের যোগ। কারণ, প্রায়োগিক ও কৃৎকৌশলে ব্যবহৃত হয় গণিতের ধারণা, ব্যবহৃত হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, যা ভৌত ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। ( এই স্থলে এসে পাশ্চাত্য গণিতের ঔপনিবেশিক চেহারার মুখোশ উন্মোচন।)

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিমা গণিত এখন মোটামুটি পৃথিবীর একমাত্র গানিতিক ভাষা হিসেবে গৃহীত। পশ্চিমা গণিতের সর্বজনীনতার পেছনে এর সহজবোধ্যতা তো আছেই, সাথে আছে পশ্চিমা মূল্যবোধের সাথে সংশ্লিষ্ট সামান্যীকরণের এজেন্ডা, যা উপনিবেশিক, বা আমাদের বৃহৎ বঙ্গের সংস্কৃতিকে পরাভূত করতে সাহায্য করে।

কাজেই গানিতিক যুক্তি ও বিজ্ঞান সংজ্ঞাগত, বা প্রায়োগিক অর্থেও সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয়।

নিরপেক্ষ থাকা মানে মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা। বিজ্ঞানের অবস্থা বরাবরই রেডিক্যাল। হ্যাঁ, বা না। কিন্তু মানুষের অস্তিত্ব ও মূল্যবোধ, সংস্কার ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত সব ইস্যুকে হ্যাঁ বা না এ সীমিত করা যায় না। আমি যদি জিজ্ঞেস করি - মানুষ কি প্রাণী? উত্তর সরাসরি দেয়া যাবে না। আপনি জিজ্ঞেস করবেন - প্রাণী কোন অর্থে মিন করছেন?যদি প্রাণী বলতে পরিশীলিত অনুভূতিহীন জানোয়ার বলেন, মানুষ তা নয়। আবার কখনো কখনো এই মানুষের কাজ দেখেই মনে হয় যে সে নিম্নশ্রেণীর মুক - বধির জানোয়ারেরও অধম।

বার বার ফিরে আসছি একটি প্রসঙ্গে, স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছি যে - একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে আমাদের মূল লক্ষ্য কালচারাল ডাইভারসিটি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। যদি পৃথিবীব্যাপী (পাশ্চাত্য) বিজ্ঞানমুখী "আধুনিক" জীবনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে তার মূল লড়াইটা হবে, প্রথমত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দুর্বলের লড়াই, যাতে দুর্বল হারাবে তার ইতিহাস, তার পরিচয়, তার ধর্ম, তার সংস্কৃতি। আর যদি পৃথিবী থেকে মানুষের ধর্ম, মানুষের সংস্কৃতি, মানুষের ইতিহাস - ঐতিহ্য , সব গোঁড়া থেকে উপড়ে ফেলে বিজ্ঞানমুখী "আধুনিক" জীবন গড়া সম্ভব হয় ও, আমাদের মনে রাখতে হবে যে - তা পৃথিবী থেকে হিংসা, ঘৃণা, যুদ্ধ ইত্যাদি একদম ডিটারজেন্ট দিয়ে সাফ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। কারণ, যদিও একটা আপ্তবাক্য আমরা প্রায়ই শুনি যে - কেবল ব্লকহেডেড ধার্মিকরাই ভায়োলেন্ট, সত্য কথাটি হচ্ছে - মানুষ চারিত্রিকভাবেই ভায়োলেন্ট। সর্বময় শান্তি কেবল স্বর্গেই পাওয়া যাবে, যদি তা আদৌ দেখার সৌভাগ্য হয়।

এই যদি হয় আলোচনার কনক্লুশান, তবে আর বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিকতাকে মানুষের সংস্কারের বিরুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়া কেন? প্রযুক্তি ও মূল্যবোধ নিজ নিজ জায়গা থেকে আমাদের জীবনকে আরও ঋদ্ধ করে চলুক।

চার।

পাশ্চাত্য দর্শন ও দার্শনিকদের বেআদবি কন্টিনিউডঃ আল্পস পর্বতমালা থেকে প্রবাহিত সত্যের ধারা ও ম্যাডম্যাক্স ফিউরি রোড

পাশ্চাত্য দর্শনের আরও সাম্প্রদায়িক, ঔপনিবেশিক আপ্ত ধারণা হল -

১। দর্শনের একটি সর্বজনীন ইতিহাস আছে,
২। সত্যেরও অভিন্ন রূপ একটি , এবং
৩। বিভিন্ন দর্শনের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।


প্রচ্ছন্নভাবে এসকল ধারণা ইউরোপীয় দার্শনিকদের মধ্যে বরাবরই ছিল। পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকা মিসরীয়, কিংবা আরবী দার্শনিকরাও তা আদতে স্বীকার করেই নিয়েছিলেন। যেমন খোরাসানের দার্শনিক আল ফারাবি ভাবতেন, মহৎ দার্শনিকদের চিন্তা হবে পরস্পরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। রায়হান রাইন উল্লেখ করেন, ফারাবি চেষ্টা করেছিলেন দার্শনিকের সত্য আর ধর্মের সত্যের ভেতরকার বিরোধ দূর করতে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, দার্শনিকদের কেবল একটি সম্প্রদায় থাকবে, সেটা হবে সত্যাশ্রয়ী সম্প্রদায়। এইভাবে , নিজেদের দর্শনের ইতিহাসকে দর্শনের সর্বজনীন ইতিহাস বলা, বা সত্য - এবং জ্ঞানের একটি অভিন্ন রূপসূত্র থাকার বয়ান, মধ্যযুগের বাতিঘর বিবেচিত আরব দার্শনিকদের কাছে সেল করতে পারার বদৌলতে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস রচয়িতাদের আর নিজেদের এজেন্ডায় অগ্রসর হতে বাঁধা পেতে হয় নি।

"এনলাইটমেন্ট" পরবর্তী কার্তেসীয় যুক্তিবাদ জ্ঞানের সর্বজনীনতা ও অখন্ডতার ধারণাকে জোরালো করেছে, পরবর্তীকালে এ আপ্তধারণার বিকাশ ঘটেছে ইমানুয়েল কান্টের আলোকপ্রাপ্তির বয়ানের মধ্য দিয়ে। কান্ট জ্ঞানের সম্ভাব্যতার সাথে যুক্ত করেন বুদ্ধি ও সামান্যীকরণের ধারণা। এই মত অনুযায়ী অভিজ্ঞতার ওপর পৌরহিত্য করে বুদ্ধির তৎপরতা এবং যুক্তি - বুদ্ধির সক্রিয় ভূমিকার ফলেই সম্ভব হয়ে ওঠে জ্ঞান। জ্ঞানের সর্বজনীনতার ও অখণ্ডতা সংক্রান্ত এ তৎপরতা পশ্চিমা পণ্ডিতদের উৎসাহিত করেছে এমন একটি চিহ্নতত্ত্ব গড়ে তুলতে , যা দিয়ে মানবজ্ঞানের সমস্ত অঞ্চলকে ব্যাখ্যা করা যায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে গড়ে ওঠা কাঠামোবাদ (স্ট্রাকচারালিজম) নামে যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনটি গড়ে উঠে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিবিধ শাখার উপর প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে, তাও কিন্তু জ্ঞানের অখন্ডতার আপ্তধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। যুক্তির সার্বভৌমত্বের ধারণা এর গোঁড়ায় প্রোথিত।

এদিকে খোদ ইউরোপেই যুক্তির সার্বভৌমত্ব বা জ্ঞানের অখন্ডতার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। হালের উত্তর আধুনিকতা তো , খুব সরল করে বললে সেই কেন্দ্রহীনতাকেই লালনপালন করে।

প্রকৃতপক্ষে যুক্তি বা জ্ঞানের সর্বজনীনতার বয়ানটিই প্রশ্নসাপেক্ষ, কারণ যুক্তি বা জ্ঞান - কোনটিই সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ নিরপেক্ষ নয়।

যুক্তির অনুমিতির প্রধান ভিত্তিই হল অভিজ্ঞতার জগত, যা সংস্কৃতি নির্দিষ্ট। কাজেই আলোচনা যদি সার্বভৌমত্বের হয়, তবে তা থাকতে পারে যুক্তির নয়, কেবল চেতনার। উদাহরণস্বরূপ - অর্থবণ্টন ব্যবস্থা, মানুষের বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ধর্ম , মূল্যবোধের মধ্যে ঔচিত্য - অনৌচিত্য, শ্রেষ্ঠত্ব,অথবা কেন্দ্র - পেরিফেরির বিতর্ক সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই চলে এসেছ। কিন্তু তর্কে কোন সমাধা হয় নি, কারণ, কোন পক্ষের যুক্তিই ফেলে দেয়ার মত না। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতার জগত থেকে তৈরি তাঁর মূল্যবোধ, এবং মূল্যবোধের জায়গা থেকে তৈরি জীবনদর্শন, এবং সে দর্শনকে আড়াল করে রাখবার জন্যে তুলে রাখা যুক্তির দেয়াল প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ভিন্নভিন্নভাবে প্রাসঙ্গিক। কাজেই শুধু মাত্র মানুষের চেতনারই আছে নতুন আদর্শের মূল্য বিচার, গ্রহণ ও বর্জনের।

পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচারের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ফিগার, দীপেশ চক্রবর্তী তাই তাঁর প্রভিনশিয়ালাইজিং ইউরোপ গ্রন্থে ইউরোপের দার্শনিক ও তত্ত্বের প্রচার প্রসারকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে দেখান যে - কীভাবে , এবং কোন ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় 'যুক্তি'র দৌরাত্ম ইউরোপের বাইরে তাদের কলোনিগুলোতে "সার্বভৌমত্ব" ও "অখন্ডতা" র মোড়কে ইউরোপিয়ান দার্শনিকরা পাচার/প্রচার করেছে, এবং সাথে সাথে এও প্রচার করেছে যে - যুক্তিবাদের একমাত্র আবাসভূমি ইউরোপ।

এই যুক্তিবাদে আশ্রিত জ্ঞানকে যখন অখন্ড ও সার্বজনীন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, এবং গেলানো হয়, তখন সেই সার্বজনীনতার বিমূর্ত ফাঁদে পড়ে স্থানিক মূল্যচেতনা তাঁর বিশেষত্ব ও বৈচিত্র্য হারায়।

তাই তত্ত্বের সার্বজনীনতার ধারণা ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস রচয়িতারা সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার করে গেলেও, আমদানিকৃৎ তত্ত্ব ভিন্ন সংস্কৃতির সৃজনশীল কাজগুলিকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। এসব সৃষ্টিকর্মের ব্যাখ্যায় স্থানিক ভাবজগত থেকে সৃষ্টতত্ত্বই বরং কার্যকর। কাজেই জ্ঞান সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতা নির্ভর বলেই তা সর্বজনীন নয়, বরং শর্তনির্ভর।

দর্শনের এই সর্বজনীন ইতিহাসের ধারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতে আমরা দেখতে পাই আমাদের বঙ্গীয় দর্শনে, বঙ্গের মাটিতেই। সর্বজনীন দর্শন, অখন্ড সত্য ইত্যাদি ধারণা দর্শনের জগতে বহুদিন ধরে বধ্যমুল থাকলেও আমরা দেখতে পাই - জগত, পরিস্থিতির বদল, জ্ঞেয়বস্তুর বদলের সাথে জ্ঞাতার নিজেরও পরিবর্তন। জ্ঞানের বদলে যাওয়া, বা দেখার বস্তুর অনিত্যতা জ্ঞাতাকেও পাল্টে দেয়। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুর পাল্টানোর সূত্রে পাল্টে যায় জ্ঞান। কাজেই দর্শন ( বঙ্গীয় পরিভাষায়) কোন ধ্রুব বিষয় হতে পারে না। শ্রী অরবিন্দ তাই জ্ঞানের বিবর্তনের পথ ও গতিমুখকেই "দর্শন" - এর মতই আলাদা করে পাঠ/ অনুসন্ধানের বিষয় বলে মনে করতেন। এই প্রসঙ্গে আরও স্মরণে রাখা প্রয়োজন, বুদ্ধের অনিত্য জগতেও চূড়ান্তভাবে সত্য বলে কিছু নেই। সত্যমাত্রই সাংবৃতিক ভাবে সৃষ্ট।

২০১৬ সালে এই রোজার সময়েই দেখেছিলাম ম্যাডম্যাক্স ফিউরি রোড মুভিটা। পোস্ট অ্যাপোকেলেপটিক ওয়ার্ল্ডে ওয়ারলর্ডদের কাছে থাকে সুপেয় পানির মালিকানা। পানির প্রবাহের স্রোত যেহেতু একটাই, এবং সেটাও তাঁর কুক্ষিগত, কাজেই বাকিদের দাসের মত ব্যাবহার করতে তাঁর বেগ পেতে হয় না।

পানির একটি মাত্র উৎসের মত জ্ঞানেরও একটি মাত্র উৎস বলে দাবী করা জ্ঞানরাজ্যের টিরেনিক্যাল ওয়ারলর্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত কাউকে কি আমরা বাংলাদেশের মাটিতে খুঁজে পাবো না?

পাঁচ।

প্রাচ্যদর্শনকে বিশ্বদর্শনের ইতিহাস থেকে ছেঁটে ফেলার বেআদবির পেছনে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস রচয়িতাদের অভিযোগগুলো কি ছিল?

গ্রীক ফিলসফির ইতিহাস রচয়িতা ডব্লিউ টি স্ট্যাস পাশ্চাত্যের সে পণ্ডিতদের একজন, যিনি পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসকে বিশ্ব দর্শনের ইতিহাস বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। স্ট্যাস কোন যুক্তি ছাড়া পৃথিবীর বৃহত্তম অংশের দর্শনকে এক কথায় খারিজ করার মত জ্ঞানপাপ করেন নি। তিনি নির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ প্রাচ্যের দর্শন চর্চা নিয়ে করেছেন -

তার প্রথম অভিযোগ ছিল, প্রাচ্যের দর্শন ধর্মীয় ও ব্যাবহারিক প্রয়োজনের থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারে নি। অ্যারিস্টটলের বরাতে তিনি বলেন - জ্ঞানকে প্রয়োজনের উর্ধে উঠতে হবে , আর এর শেকড়ে থাকবে গভীর বিস্ময়। অর্থাৎ, দর্শনের জন্ম হবে বিস্ময় থেকে , প্রয়োজনের থেকে নয়।

দ্বিতীয় অভিযোগে তিনি বলেন, অবস্থানগত দিক দিয়ে এ দর্শন মানব - উন্নয়নের মূলধারার বাইরে, ভৌগলিক ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দ্বারা এটা বিচ্ছিন্ন।

তার তৃতীয় অভিযোগ ছিল, প্রাচ্যে দর্শনচর্চার কোন পোক্ত ভাষা নেই। কারণ প্রাচ্যে দর্শনচর্চার ভাষা কাব্যিক, এদিকে ইউরোপে যেকোনো সিরিয়াস জ্ঞানমূলক আলোচনার ভাষা গদ্যের অবলম্বনে হয়।

প্রথম অভিযোগটিকে আদতে অভিযোগ হিসেবেই ধরা যায় না, এবং একই সাথে এই অভিযোগটি প্রমাণ করে, পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস রচয়িতারা প্রাচ্যের সংস্কৃতির কতটা ভুল পাঠ করেছিলেন। রায়হান রাইন বলেন - প্রাচ্যের দর্শনের উদ্ভবের পেছনে মূল প্রেষণা যুগিয়েছে জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজন। এ কারণেই তা জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত। মানুষের জীবনে কোন কাজে আসে না, এমন 'শুদ্ধ তত্ত্বচিন্তা' র প্রচেষ্টা এ অঞ্চলে হালে পানি পায় নি বললেই চলে। আর এজন্যে নিজেদের দোষ দেয়া চলে না।

বৈদিক সংস্কৃতি, গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস থেকে নিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রাচ্য - মধ্যপ্রাচ্য - দূরপ্রাচ্যে যত জীবনদর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে উক্ত অঞ্চলের সংস্কৃতি থেকে, জৈবিক প্রক্রিয়ায়, এবং মানুষের জীবনের সমস্যা সমাধা করার উদ্দেশ্যে। এবং তাদের প্রায়গিকতা আছে বলেই সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে উক্ত জীবন দর্শনে বিশ্বাসী মানুষদের উপস্থিতি।

দ্বিতীয় যে অভিযোগ, প্রাচ্যের দর্শন মানব উন্নয়নের মূলধারার বাইরে, উপনিবেশবাদী চিন্তার মত এ চিন্তার মধ্যেও কলনিয়াল - কলোনাইজডের অ্যানালজিতে কেন্দ্র - প্রান্তের বাইনারি উপস্থিত। আর এমন ভাবনার পেছনে কাজ করে জ্ঞানের ইতিহাসের অখণ্ডতার ধারণা, এবং সর্বোপরি 'আমরাই শ্রেষ্ঠ' , এমন জৈবিক বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গী

তৃতীয় অভিযোগ, দর্শন চর্চার ভাষা গদ্যই হতে হবে - এমন আপ্তধারণাও , যদি আমরা আমাদের বঙ্গীয় দর্শনচর্চার রূপ বুঝি, তাহলে বোঝা যাবে যে এই লেন্সে আমাদের মাপা যাবে না। বঙ্গে দর্শনের চর্চা হয়েছে আলাপ বাহাসের সূত্র ধরে। আর বাহাসের ভাষা পদ্য। হালের কবির লড়াইয়ের কথাই স্মরণ করা যাক।

আর পদ্যের মধ্যে গভীর দর্শন থাকতে পারে না, এ ধারনাও ভুল।

লালন ফকিরের জনপ্রিয় একটি গানের কিছু অংশ উল্লেখ করি -

"তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে
ওরে, তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে
ওরে মন, নদে এসে
তোরা কেউ...
তোরা কেউ...
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে"

ছোটবেলায় বাউলের মত ঘুরে ঘুরে নেচে গেয়ে গেয়েছি এই গান। তখন বুঝি নি অথচ এখন বুঝে দেখি লালন ফকিরের এ গানের মধ্যে লুকিয়ে আছে আমাদের নদীয়ার ভাবের সুদীর্ঘ ইতিহাস। এ তিন পাগল কারা প্রশ্নের জবাবে লালন গানে বলেন - ও সে চৈতে নিতে অদ্বে পাগল নাম ধরেছে’।

লালনের গানের এই সূত্র ধরেই নদিয়ার পথে গমন করে আমরা জানতে পারি - নদিয়ার তিন পাগল ছিলেন শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ এবং অদ্বৈতাচার্য। আমরা জানতে পারি - শ্রীগৌরাঙ্গ/ শ্রীচৈতন্য নদিয়া ছেড়ে বৃন্দাবন চলে যান, কেউ বলেন জ্ঞানের আভিজাত্যে, কেউ বলে উচ্চবর্ণের গরিমায়, কেউ বলে ক্ষমতার পাকেচক্রে পড়ে। অদ্বৈতাচার্য থেকে গিয়েও জীবনপাত করেন গৌরাঙ্গের তত্ত্বালোচনায় , এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভাবের মূর্ছনায় আপ্লুত হয়ে। ফরহাদ মজহার, তার ভাবান্দোলন বইয়ে উল্লেখ করেন যে নিত্যানন্দ গৌরাঙ্গের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বৃন্দাবনে চলে যান নি, নিছক তত্ত্বালোচনায় বা ভাবের আবেশে আপ্লুত হয়ে থাকেন নি, বরং বাংলার বামুন - চণ্ডাল - চামার - মুচির মধ্যে থেকে গিয়েই জাতপাতবিরোধী আন্দোলনে একনিষ্ঠ হন। যেমন ভাবে আবিষ্ট লালন তাঁর আরেক গানে বলেন - 'দয়াল নিতাই কারো ছেড়ে যাবে না' ।

এই নিত্যানন্দ, বা নিতাই , লালনের তিন পাগলের এক পাগল তাই বাংলার বাউলদের কাছে এত প্রিয়। বাউল গানে অহরহ তাঁর উপস্থিতি -

'হরি নাম গেয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই ...'

অথবা

'আমার নিতাই চাঁদের বাজারে, গৌর চাঁদের দরবারে / একমন যার সেই যেতে পারে'

নিত্যানন্দের অনুসারীদের মধ্যে হতদরিদ্র মুসলিমরাও ছিল, ফলে বাংলার দর্শন কীভাবে আমাদের অঞ্চলে এথনিক ভ্যারাইটির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতের জন্যে অন্তত কাজ করে গিয়েছিল প্রত্যক্ষ, বা পরোক্ষ ভাবে, তা আমরা নিশ্চিত রূপে জানি। কেবল পদ্যের ভাষা বলেই এই অঞ্চলের দর্শন চর্চার ভাষাকে হেয় করে দেখাটা পাশ্চাত্যের ঔদ্ধত্যেরই বহিঃপ্রকাশ।

ছয়।

তত্ত্ব, নাকি পণ্য?

আমরা কী কখনো নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছি, তত্ত্ব একটা পণ্যের মত বেচাবিক্রি সম্ভব কিনা?

'জ্ঞান' - আর 'ক্ষমতা' এই দুই শব্দকে র‍্যানডমলি ইন্টারচেইঞ্জ করে ব্যাবহার করলেও যে পাপ হয় না, এই আলাপ আমাদের সামনে সবার আগে নিয়ে আসেন মিশেল ফুঁকো। পাশ্চাত্য কিভাবে জ্ঞানকে তত্ত্বাকারে প্রচার করে নিজেদের ক্ষমতার পেরিফেরি ক্রমাগত বাড়িয়ে গেছে, সেটা হাড়ি উল্টে দেখিয়ে পাশ্চাত্যের জ্ঞানকাণ্ড ধুতি ধরে টান দিয়ে খুলে দেয়ার মহৎ কাজটিও তিনি করেন। তত্ত্ব কিভাবে পলিটিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টালাইজেশনের হাতিয়ার হতে পারে, বা তত্ত্ব প্রচার প্রসারে হাজার মাইল দূরে বসেও কিভাবে ঔপনিবেশিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাওয়া যেতে পারে, এ আলাপ মিশেল ফুঁকোর দ্বারা শুরু করলেই সবচে ভালো হত, কিন্তু রচনা কলেবরে বড় হয়ে চলেছে বলে বাদ দিচ্ছি। ফুঁকোর কর্মপরিধি এবং আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিকিকরণ নিয়ে পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে লেখার ইচ্ছা আছে।

যাক, আপাতত রায়হান রাইনের কাছ থেকে ধার নিয়ে বলা যায়, যেটা তিনি আবার বারবারা ক্রিশ্চিয়ানের বরাতে বলেন -

"তত্ত্বজগতে পশ্চিমের আধিপত্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য যেমন পশ্চাৎপট হিসেবে কাজ করেছে, তেমনি 'তত্ত্ব' নিজেই হয়ে উঠেছে এক শক্তিশালী পণ্য। জ্ঞানজাগতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে কে গ্রহণযোগ্যতা পাবে আর কে পাবে না, তাঁর নির্ধারক হয়ে ওঠে এই পণ্য।"

উল্লেখ্য, তত্ত্ব নামের এই পন্যের আন্তর্জাতিকীকরনে জ্ঞান ও যুক্তির সর্বজনীনতার ধারণা অনন্য ভূমিকা পালন করে। এ পন্যের ভোক্তাদের মধ্যে ঐ সর্বজনীনতার ধারণা ইতিমধ্যে তৈরি করা হতে থাকে। ফলত উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীরা 'তত্ত্ব' নামক পণ্যের সহজ ভোক্তা হয়ে ওঠে। জ্ঞানকে অখণ্ড ও সার্বজনীন মনে করার কারণে তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপীয় দর্শনের পরিভাষা দিয়ে বাংলার দর্শনকে বুঝতে চেষ্টা করে। ফলে এই রকম প্রশ্নের উদ্ভব হয় যে - দেহাত্মবাদ কি ভাববাদ, না বস্তুবাদ। এটা কি জ্ঞানতাত্ত্বিক, নাকি অধিবিদ্যক?

এসব পারিভাষিক শব্দের খাঁচায় দেহাত্মবাদকে পোরার বদলে যদি তাঁরা দেখতে চেষ্টা করতেন যে কীভাবে প্রাচীন কাল থেকে এ অঞ্চলের সংস্কৃতিতে দেহকে অর্থপূর্ণ করা হয়েছে, কীভাবে দেহের অনুষঙ্গে জগতকে বুঝতে চাওয়া হয়েছে, কীভাবে এর সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে ভাষাকে, এবং কীভাবে এঁকে সমস্ত ভাবসত্তার আধার হিসেবে দেখা হয়েছে তাহলেই হয়তো দেহাত্মবাদের প্রকৃত তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

তত্ত্বীয়গত ভাবে যারা মানসিক ঔপনিবেশিকতার দাস হয়ে গেছেন, তাঁরা এখন বাংলার দর্শনের মধ্যে প্লেটো , হেগেল, বা নিটশেকে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছেন, অথবা রাসেল বা জা পল সারত্রেকে খুঁজতে গিয়ে ব্যার্থ হয়েছেন।

ফলে তত্ত্ব, বা থিওরিও যে দিনের শেষে আর এক পুঁজিবাদী পণ্যই, যা পাশ্চাত্য দর্শনের সার্বজনীনতার হেজিমনি ছড়ায়, এটা মেনে তারপর পাশ্চাত্য দর্শনের পাতা উল্টাতে হবে। তুলনামূলক পাঠ যে অসম্ভব, তা নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পাশ্চাত্য দর্শনের পরিভাষায় আমাদের বঙ্গীয় দর্শনের পাঠ নিতে গেলে আমাদের ক্রমাগত আত্ম - অস্বীকার এবং আত্মধিক্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পাশ্চাত্য দর্শনের সার্বজনীনতার প্রচারকদের ইচ্ছেও অবশ্য ওটাই।

সাত।


আশাবাদী সমাপনের পথেঃ করনীয় কি?

আমার পূর্বের আলাপ খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশের 'মুক্তমনা' সম্প্রদায়কে আমি সবসময় 'কোট আন কোট' - 'মুক্তমনা' বলে অভিহিত করি। তার অনেক কারণ আছে। সে আলাপ এখন থাক, কিন্তু আমার এ দীর্ঘ আলাপের একদম সমাপ্তিলগ্নে এসে বাংলাদেশের এক প্রকৃত মুক্তমনার উল্লেখ করতে চাই, 'বেআদবির জয় হোক' শীর্ষক প্রবন্ধে যিনি ক্রমাগত আমাদের সাম্রাজ্যবাদ - জোতদার - জমিদার শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া ঝুঁকিয়ে সেলাম ঠোকার বৃত্তিকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিলেন।

অধ্যাপক ডঃ আহমদ শরীফ বলেন -

"আমাদের আদব - কায়দায় সৌজন্য রয়েছে শাহ - সামন্ত যুগের নিয়ম - নীতির, রীতি রেওয়াজের ঐতিহ্য ও আদল। যিনি প্রভু তিনি তো বটেই, যিনি শ্রদ্ধেয় , ভক্তিভাজন, মান্য তিনিও দেবতুল্য ও পূজ্য।"

এই প্রভু শ্রেণীর লোকেদের তিনি শ্রেণীকরণ করেন 'হোয়াইট কলারধারী' । তিনি সাদা কলারের এই অভিজাত লুটেরা শ্রেণীর কলার চেপে ধরে বেআদবি করতে বাংলাদেশের মানুষদের আহ্বান জানান এই ভাষায় -

"এ বেআদবির অপর নাম নতুন। চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে গোড়ায় নতুনের ধারক থাকে নগণ্য কয়জন, মধ্যে তাঁর বাহক হয় অসংখ্য, পরিণামে সর্বজনীন হয়ে স্থিতি পায় নতুন। স্বাধিকার স্বপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার গরজেই গণমানবকে বেআদব হতে হবে। অতএব বেআদবি প্রগ্রতির লক্ষণ, আত্মচেতনার অভিব্যক্তি, বিদ্রোহের বীজ, বিপ্লবের সংকেত, নতুন সমাজসংস্কৃতির পূর্বাভাস। তবে প্রসার হোক বেআদবির, জয় হোক বেআদবের।"

তবে নতুন চিন্তা, নতুন কর্ম বলতেই যে 'মুক্তমনা' ধর্মবিদ্বেষ, বা মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতি বা পরিচয়কে কেটে ফেলার ঘ্রাণ খুঁজে পাচ্ছেন, তাদের আশায় গুড়ে বালি। আহমদ শরীফ বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন না, তিনি ছিলেন রিক্রিয়েশনের পক্ষে। তার কর্মময় জীবনই সে প্রমাণ বহন করে। নিজে মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যের ওপর থেকে ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে মুসলিম সাহিত্যের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালিয়ে তিনি বের করেছেন আদি - মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঙ্গালী মুসলমানদের অবদান কতটুকু। অতীতের উপর ভিত্তি করে নতুন পরিচয় বিনির্মাণ ছিল তাঁর শিক্ষা, আমরাও যেন আজ মুক্তচিন্তা বলতে সেই চিন্তাকেই বুঝি - যা আত্তীকরণ সেখায়, বিচ্ছিন্নতা নয়। মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে যারা পরিকল্পিতরূপে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়, তাদের জন্যে আহমদ শরীফকে অতিক্রম করে হুমায়ূন আজাদ কেন বারবার নেতার আসনটি অধিকৃত করেন, বাংলার মানুষের সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এ নিয়ে আলাদা একটা লেখা লিখবো একদিন।

প্রাসঙ্গিকভাবে এও মনে রাখা প্রয়োজন যে - অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের সকল কিছুই বর্জন করা কাম্য নয়। এ ধরণের হার্ডলাইন অবস্থান অন্ধ জাতীয়তাবাদ উসকে দিতে পারে। পাশ্চাত্য যে আজ সুদীর্ঘকালের উপনিবেশিক শাসনের ফলে বিজ্ঞানে প্রযুক্তিতে অগ্রসর, তাতে কোন সন্দেহ তো নেই। সেতো আমাদের দাদা - পরদাদার ঘামের শ্রমের বিনিময়েই তৈরি।

তাই আমাদের পাশ্চাত্যের জ্ঞানজগতকে গ্রহণ করতে হবে আমাদের নিজস্ব যুক্তিবোধের আলোকে। যারা তা না করে পাশ্চাত্যের দর্শন , তাদের সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানভিত্তিক 'আধুনিক' জীবনের অন্ধঅনুকরণ - আমাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতি , ভাষা, ধর্ম সবকিছুকেই রিপ্লেস করে আমাদের উন্নততর একটা অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে যারা প্রচার করে, (বুঝে হোক, বা না বুঝেই হোক), পোস্ট কলোনিয়াল লিটারেচারের ট্রিনিটির ব্রহ্মা, হোমি ভাবা, সেই শ্রেণীর বুদ্ধি (পর) জীবীদের "মিমিক ম্যান" বলে চিহ্নিত করেন। যারা নিজের ঔপনিবেশিক প্রভুর অন্ধ অনুকরণ করে, পুরোপুরি তাদের মত হতে চায়, ফলে নিজের অজান্তেই "মিমিক্রি" করে, এবং দিনের শেষে নিজের স্বকীয়তাও হারায় তো বটেই, প্রভুর শ্রেণীতেও কখনোই উত্তীর্ণ হতে পারে না।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান, এবং ভারতীয় উপমহাদেশের দাসখত রচনাকারীদের অন্যতম, থমাস ম্যাককাউলির সেই ঔরসজাত সন্তানদের চিহ্নিত করা আজ প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা মনে করে , এখনো বাংলাদেশে পাশ্চাত্য জ্ঞান, নির্দ্বিধায়, বিনাবিচারে, বিনা সংশ্লেষণ - বিশ্লেষণে এমন একটি 'আধুনিক' শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে -

“ who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect”


মন্তব্য ২৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মে, ২০২০ রাত ৩:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্ট টি মন দিয়ে পড়লাম। কিছুটা বুঝলাম। তবে এ পোষ্টে মন্তব্য করার মতো জ্ঞান আমার নেই। তাই চুপ থাকলাম।

১৪ ই মে, ২০২০ বিকাল ৪:২৫

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: রাজীব ভাই , সাত নং পয়েন্ট থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে মোটামুটি একটা আইডিয়া দাঁড় করানো যাবে আমার এই লেখার গতিপ্রকৃতির ব্যাপারে। আপনার সহজ সরল অনুভূতির প্রকাশে শ্রদ্ধা জানাই।

২| ১৪ ই মে, ২০২০ ভোর ৪:৪১

নেওয়াজ আলি বলেছেন: লুটেরা এখনো লুটপাটে ব্যস্ত । আহমদ শরীফের আমলে ডিজিটাল আইন ছিলো না। এখন সত্য বলতে গেলেই হাতকড়া ।

৩| ১৪ ই মে, ২০২০ ভোর ৪:৫৯

নতুন বলেছেন: যে কোন সমাজই তারদের নিজেদের সবকিছুই সবার উপরে দেখাতে চাইবে। পশ্চিমারা সেটা সফলতার সাথে করতে পেরেছে।

কিন্তু সেটা অনুসরন করার সম্পূন দায় ব্যক্তির। আমাদের সমাজে অনেকেই্ আছেন যারা পশ্চিমাদের অন্ধঅনুকরন করেন এবং নিজেদের ঐতিয্য ভুলে যায়।

অনেক বড় লেখা, এবং কিছুটা টেনে লম্বা করার মতন মনে হয়েছে। :)

১৪ ই মে, ২০২০ বিকাল ৪:৪৮

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: মন্তব্যে ধন্যবাদ।

লেখাটি বড় , তাঁর কারণ হচ্ছে - বাংলাভাষায় লিখে লিখে, যে সকল নাস্তিকের মুখোশধারী ইসলামোফোবের দল সাধারণ মুসলমানদের বরাবর ইসলাম বনাম বিজ্ঞান বাইনারির অস্বস্তিতে ফেলতে চেষ্টা করে চলেছে, তাদের সম্ভাব্য সকল দৃষ্টিকোন থেকে বোঝানো যে, যে বিজ্ঞানকে , যে গণিত ও যুক্তি নির্ভর জীবনব্যবস্থাকে তাঁরা বাংলাদেশের সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় - সেই বিজ্ঞান বা গাণিতিক যুক্তি, তাঁর জন্মসূত্রেই কালচার ইনসেনসিটিভ, এবং কালচারাল প্লুরালিটিকে ভেঙ্গে চুরে আমাদের পাশ্চাত্যের দাসত্বমুখীন করার হেজিমনি ছড়াচ্ছে, যেখানে ২০২০ শালের পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে আমাদের সবচে বড় চ্যালেঞ্জ কালচারাল প্লুরালিটি রক্ষা করা। এবং খুব স্পষ্ট করে উক্ত নাস্তিকতার মুখোশধারী ইসলামোফোবদের এই প্রশ্ন করা যে - বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনকে তাঁরা আমাদের সংস্কৃতি , ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতিস্থাপক হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছেন কিনা। যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাদের চিকিৎসা কি হবে, সেটা এই বড় লেখাটিতে উল্লেখ করা আছে।

আর আমি আপনার এই মতের সাথে একমত নই যে ২০২০ সালের প্রেক্ষিতে কে কোন জীবনদর্শন বেছে নেবে, সে সিদ্ধান্ত নেবার পূর্ণ এখতিয়ার তাঁর রয়েছে। আমরা যা চাই, বা যা বিশ্বাস করি বলে মনে করি, তা আসলেই আমরা চাই/বিশ্বাস করি, নাকি কোন অশুভশক্তি আমাদের প্রভাবিত করে চাইয়ে বা বিশ্বাস করিয়ে নেয়া হচ্ছে - নিজেকে এ প্রশ্নটি করার সময় এসেছে। আপনার ফেসবুকের পাতায় উপস্থিত বিজ্ঞাপন, আপনার ইউটিউবে ভিডিওর সাজেশন লিস্ট থেকে নিয়ে কোন কাজটিকে স্মার্টনেসের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হবে, আর কোন পরিচয়ের, কোন চিন্তার অধিকারী হলে আপনাকে বিনা আলোচনায় মধ্যযুগীয় বর্বর বলে স্টেরিওটাইপ করা হবে - এটার একটা ম্যাপিং হয়ে আছে। ম্যাপিংটা পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদীদের প্রোপ্যাগান্ডা, আর বাংলাদেশে ব্লগসাইটগুলোতে সে ম্যাপিং এর প্রচার প্রসারের দায়িত্বে আছে বৈজ্ঞানিক জীবনের টোটকা সমাধানদাতা নাস্তিকের মুখোশধারী ইসলামোফোবের দল।

আপনি আপনার মন্তব্যের দ্বারা খুব দীর্ঘদিন ধরে প্রোথিত জটিল একটি সমস্যার সরলিকরণ করলেন। এভাবে সমস্যার আমূল সমাধান হবে না।

ভেবে দেখার অনুরোধ। শুভকামনা।

৪| ১৪ ই মে, ২০২০ সকাল ৯:১৯

ছায়াময় বলেছেন: ভালো হয়েছে। চালিয়ে যান। মনে হয় এধরনের লেখা ছোট করতে চাইলেও সম্ভব হয় না।

১৪ ই মে, ২০২০ বিকাল ৪:৪৯

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

৫| ১৪ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:১৭

নতুন বলেছেন: দৃস্টিভঙ্গীর উপরে সবকিছ নিভ`র করে।

সহজ করে দেখলে জিনিসটা সহজ, কঠিন করে দেখলে কঠিন।

আর নাস্তিকের মুখোশধারী ইসলামোফোবের এটা একটা জটিল কথা :)

কিছু মানুষ আছে যারা ধম`বিদ্ধেষী সেটা মানি এরা খুবই বাজে টাইপের মানুষ, হিংসাত্তক এবং বাজে ভাবে মানুষকে আক্রমনই এদের হাতিয়ার। এটা জীবনে এক রকমের ফ্রাস্টেসন থেকেই মনে হয় এমনটা করে থাকে।

কিন্তু পশ্চিমের ইসলামো ফবিয়ার চেয়ে বেশি ইসলামের অনুসারীদের মাঝে পশ্চিমাদের প্রতি হিংসা।

ইন্টারনেটে বা বত`মানে মানুষকে নিয়ে যেটা হচ্ছে সেটা বড় ধরনের অপরাধ। মানুষের তথ্যকে এখন ব্যবসায় ব্যবহার হচ্ছে ইন্টারনেটে। এর মুলে আছে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্য। ইসলামোফবিয়া না।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বের মানুষের সাথে ইন্টারেক্টের অভিঙ্গতা থেকে বলতে পারি মানুষ ইসলামের পেছনে লেগে নাই। বরং ইসলামের কিছু অনুসারীরাই নিজেরাই এক রকমের ডিলিমাতে ভোগে আর তারা সব কিছুতেই ইহুদী নাসারার ষড়যন্ত্র খুজে পায়।

১৫ ই মে, ২০২০ রাত ১২:০১

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: প্রথমত, 'সহজ - জটিল' এত সহজে ইন্টারচেইঞ্জেব্লি ব্যাবহার করা যায় কী?

পরিচিত কারো জ্বর হলে যেমন আপনি রেসপন্স করেন, আরে রেস্ট নে, যা হওয়ার দেখা যাবে, কারো ক্যান্সার হলেও কি একই রেসপন্স করেন? তখন সহজ করে ভাবলেই ক্যান্সার আর জ্বর ট্রিটমেন্ট এক হয়ে যাবে? নাস্তিকের মুখোশধারী ইসলামোফোব কারা - এটা এ ব্লগে যে সামান্য সময়ও দিয়েছে , এমন যে কেউই জানে। আমার ধারণা আপনিও জানেন, আমি কাদের কথা বলছি। এদের উপস্থিতি একজন লে ম্যান মুসলিম হিসেবে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। তাদের উদ্দেশ্য করেই বললেন, না কাদের উদ্দেশ্য করে বললেন , কে জানে - কিন্তু ধর্মবিদ্বেষ যারা ছড়ায় , তাঁরা যে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর মতই গর্হিত অপরাধী - এই ব্যাপারে আপনার আমার ঐক্যমত আমাকে আনন্দিত করে। এদের টেন্ডেন্সিগুলো চিহ্নিত করা , এদের কীভাবে ডিল করতে হবে - তার ব্যাপারে মতামত দেয়া, আমার নিজের মানসিক শান্তির জন্যে একটা জরুরী ব্যাপার। দেখলাম এই বিষয়েও আপনি একমত যে - চাইলেও এখন আর মানুষ স্বাধীনভাবে নিজের পরিচয় তৈরি করে নিতে পারছে না। তার উপর ইনফ্লুয়েন্স কাজ করে।

কিন্তু নেটের তথ্য সংগ্রহ করা খালি মুনাফা লাভের জন্যে? মুনাফা লাভের জন্যে কলোনি তৈরি করা লাগে, মূর্ত বা বিমূর্ত। দমন পীড়ন চালানো লাগে। এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচে পীড়িত জনগোষ্ঠী কারা? নিজ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই দমন পীড়নের স্বীকৃতি লাভের উপায় কি? হিটলারের ইহুদী নিধনের আগে যে প্রোপ্যাগান্ডা ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয়েছিল, বা জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ পড়া থাকলে আপনার সাথে আলোচনা করতে সুবিধা হত। আপনি যদি টেকনিক্যাল লাইনের প্রফেশনাল হন - আমার আর্গুমেন্ট বুঝতে আপনার কষ্ট হবে। যেমন আপনার ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনের প্রায় কিছুই আমি হয়তো বুঝব না।

১৫ ই মে, ২০২০ রাত ১২:০৭

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: দ্বিতীয়ত, আপনি বললেন, পশ্চিমের ইসলামোফোবিয়ার চেয়ে বেশি ইসলামের অনুসারীদের মাঝে পশ্চিমাদের প্রতি হিংসা। কিছু পরে বললেন, মানুষের সাথে মিলেমিশে আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। যাদের সাথে মিশেছেন - তাঁরা যদি পশ্চিমা লে ম্যান হয়, তবে আপনার এই অনুসিদ্ধান্তকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে নেয়ার কিছু নেই। কারণ ইস্ট/ ওরিয়েন্টকে কীভাবে দেখা হবে, সে সংক্রান্ত পলিসিমেকার লে ম্যানরা না।

আমি যখন একজন ইংরেজি ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য, তত্ত্ব ও কালচারাল স্টাডিজের শিক্ষক - গবেষক হিসেবে পড়ি, পড়াই বা লিখি - আমি পাশ্চাত্যের রিটেন লিটারেচারে এবং ভিজুয়াল মিডিয়াতে - ওরিয়েন্টালাইজড করার এবং ইসলামোফোবিয়া ছড়ানোর প্রচুর ইলিমেন্ট পাই। এই সমস্ত ডকুমেন্ট প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাথায় 'আদারিং' এর আইডিয়া ঢুকিয়ে রাখে। এগুলো সরল সমস্যা না। এগুলো মুখোমুখি ফেইস করার মত সমস্যা। পলিটিক্যালি, এবং আকাডেমিক্যালি। আমি অ্যাকাডেমিক্যালি ডিল করছি, কারণ, এটা আমার প্রফেশন।

বললেন যে - ইসলামের কিছু অনুসারীরাই নিজেরাই এক রকমের ডিলিমাতে ভোগে আর তারা সব কিছুতেই ইহুদী নাসারার ষড়যন্ত্র খুজে পায়।

মুসলমানের ডিলেমা আছে। তাদের কারো কারো ডিলেমা ইহুদী নাসারা নিয়েই। কিন্তু চিন্তাশীল বাঙ্গালী মুসলমানদের ডিলেমা কমে যায়, যখন তাঁরা দেখে যে - বাংলাদেশী মুক্তমনারা মানবাধিকারের নামে যে চিন্তা চেতনার প্রচার প্রসার চায়, আপনার মতে "ইহুদী নাসারা" যারা, পাশ্চাত্যের সেই রাইট উইং পলেটিশিয়ানরাই সে সকল অধিকারের দাবী দাওয়ার কট্টর সমালোচক। তখন চিন্তাশীল বাঙ্গালী মুসলমানদের হাতে পপকর্ণ নিয়ে বসে পড়লেই হয়।

সবশেষে আশা রাখি, আমার উপরের রচনাটিকে আপনি ডিলেমায় ভোগা মুসলমানের ইহুদী নাসারাদের ষড়যন্ত্র খোঁজার উপলক্ষ্য হিসেবে সরলীকরণ করেন নি।

আবারো শুভকামনা।

৬| ১৪ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:৪৬

ইব্‌রাহীম আই কে বলেছেন: জানিনা প্রাসঙ্গিক কিনা, তবে-

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমরা যেভাবে মনস্তাত্ত্বিকতার শিকলে বাঁধা পড়েছি, সেটা অতিক্রম করা দূর্ভেদ্য প্রাচীরের চেয়েও কঠিন। প্রতিনিয়ত স্মৃতি ভ্রংশের মাধ্যমে তারা যেভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে সেখান থেকে বের হওয়া এজন্য অসম্ভবপর যে, মানুষ মাত্রই স্মৃতি লালন করতে ভালোবাসে এবং নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চায় যতক্ষণ না তার উপর কোনো দায়িত্বভার কাঁধে পরছে এজন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে এমনভাবে চালিত করছে যাতে আমাদের না কোনো দায়িত্বভার কাঁধে নিতে না হয়, না অতীতের স্মৃতিচারণে পূর্বপুরুষদের গৌরবান্বিত ইতিহাসকে পর্যালোচনা করে নিজেরা গৌরবের সহিত এগিয়ে যাওয়ার কোনো ফুরসত পাই!

১৫ ই মে, ২০২০ রাত ১২:১২

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: যদি অনুধাবনের জায়গা থেকে লিখে থাকেন, যা লিখেছেন , তা প্রাসঙ্গিক তো বটেই , এমন স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী কারো সাথে পরিচিত হওয়ায় আনন্দের।

ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা।

৭| ১৫ ই মে, ২০২০ রাত ১:১২

নতুন বলেছেন: যদিও কাজের ক্ষেত্র বত`মানে আলাদা কিন্তু একসময়ে ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে পড়াশুনা শেষ করেছিলাম বিদ্যাপাঠে। খুব ভালো লাগলো জেনে আপনি এখনো সাহিত্য চচায়ই আছেন।

আমার অবশ্যই পশ্চিমা পলিসি মেকারদের সাথে উঠাবসা নেই। :) কিন্তু বিশ্বের প্রায় সব দেশের সাধারন দের সাথে মেশার ব্যপারটা পেশাগত তাই আমাদের সাধারন মানুষ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাধারন মানুষের ধারনায় একটা পাথ`ক্য দেখতে পাই।

সেটা হলো আমাদের ইসলামী চেতনাবোধ ধারীদের পশ্চিমা জুজু এবং জেলাসী যেটা বিশ্বের অন্য জাতিতে খুবই কম।

বেশির ভাগ পাবেন ভারতীয়, পাকিস্তানীদের ভেতরে। আর এই উপমহাদেশের মানুষের ধারনা অনেকটাই একই রকমের।

আমেরিকার পলেসি মেকাররা তাদের সমাজ্রবাদ টিকিয়ে রাখতে সদা সচেস্ট সেই হিসেবে তারা বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালায়।

ইসলামের ধারনায় কিন্তু রাস্টক্ষমতায় যাবার জন্য অনেক আলোচনা্ আছে। তাই যখন রাস্ট করাআয়ত্ত করার চেস্টাকে ইসলামী অনুসারীরা ইসলামের উপরে আঘাত বলে মনে করে।

আমেরিকার এই আগ্রাসন ক্ষমতা এবং সম্পদের জন্য। এদের এপ্রোচ ভিন্ন দেশে ভিন্ন, মুসলিম দেশে মুসলিমদেরই তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।

সম্রাজ্যবাদের এই আচরন প্রতিরোধ করতে হবে একত্রিত হয়ে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে। এই রকমের কোন পদক্ষেপ আমি কোন মুসলমান সংখ্যাগরিস্ট দেশেই দেখিনি।

১৫ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:৩১

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: আনন্দের বিষয় যে গঠনমূলক কথাবার্তার দ্বারা আপনার আর আমার চিন্তাধারার মোটামুটি কাছাকাছি একটি বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের সাবকন্টিনেন্টের মুসলমানদের একাংশ পাশ্চাত্যকে সন্দেহের চোখে দেখার একটা মূল কারণ তো এই যে, কলোনিয়াল পিরিয়ডে এ অঞ্চলে সবচে বেশী বঞ্চিত হয়েছিল মুসলমানরাই। এটা ঐতিহাসিক সত্য। সে পারস্পারিক অবিশ্বাস এবং সন্দেহের একটা ধারাবাহিকতা এখনো চলে আসছে, বাংলাদেশের মাদরাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায়, এবং অর্থোডক্স মুসলিমদের মধ্যে, যেমন কিনা তা আছে পাশ্চাত্যের পলিসিমেকারদের মধ্যেও। যদিও পাশ্চাত্য থেকে আসা সকল তথ্য - তত্ত্ব পাশ্চাত্যের বলেই খারিজ করার মানসিকতাটা সমর্থনযোগ্য নয়, তা উগ্র জাতীয়তাবাদ উস্কে দেয়ার সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু সতর্কতার সাথে গ্রহণ করা জরুরী।

ঐ সতর্ক চোখ তৈরির প্রয়াস আমার এ সিরিজ। প্রথম পর্ব ছিল উপনিবেশের ইতিহাস নিয়ে, এই পর্ব গেলো একটু তাত্ত্বিক আলোচনা নির্ভর, পাশ্চাত্যের জ্ঞানের ফ্লো কীভাবে এখনো তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রোপ্যাগান্ডা ছড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে, পরের তিনটি পর্বে থাকবে পাশ্চাত্যের প্রাচ্য/ ওরিয়েন্ট হয়ে বাঙ্গালী মুসলিম স্টেরিওটাইপ করার যন্ত্রকৌশল, অর্থোডক্স এবং লিবারেল মুসলিমদের মধ্যে মতের পার্থক্য কমিয়ে আনা যায় কীভাবে, এবং সবশেষে, ২০২০ সালের প্রেক্ষিতে ইসলামোফোবিয়া এবং (আহমদ ছফা যে অর্থে বাঙ্গালী মুসলমান শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন সেই অর্থে) বাঙ্গালী মুসলমানদের করনীয়।

১৫ ই মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০১

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: আপনার অজ্ঞতার চাদর, বিশ্বাস/কুসংস্কারে ঢাকা মানুষ লেখাটি পড়লাম। এখানে আপনি অজ্ঞতার চাদর - বিশ্বাস (ধর্ম বিশ্বাস) অর্থে - কুসংস্কার ইত্যাদি শব্দকে সমার্থক বিচারে পাশাপাশি বসিয়ে শব্দগুলিকে ব্যবহার করেছেন। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে কুসংস্কার বলে চালিয়ে দেয়াটা আমি ব্লাসফেমি বলে মনে করি।

এছাড়াও লেখার মধ্যে যখন ধর্মীয় ক্রুসেডের কথা এসেছে, মুসলিম - খ্রিস্টানদের রক্ত পিপাসার কথা এসেছে, আইসিস আল কায়দার কথা এসেছে, কিন্তু পাশের দেশ ভারতের ধর্মীয় উন্মাদনাকে পুঁজি করে কীভাবে এখনো কীভাবে মুসলমানদের কোনঠাসা করে রেখেছে, তা নিয়ে অন্তত দু' একটা লাইন আসা উচিৎ ছিল প্রাসঙ্গিকভাবে। আসে নি।

আপনার প্রিয় পোস্টের তালিকায় একদম সাম্প্রতিক সময়ে ইসলাম সংক্রান্ত দু' তিনটি লেখা যুক্ত হয়েছে। অথচ একটু পেছনে গেলেই দেখা যায় - প্রচণ্ড রকমভাবে তথ্য বিকৃত , বা ভুল পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে উপস্থিত তথ্যে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো লেখা আপনার প্রিয় পোস্টের তালিকায় জ্বলজ্বল করছে।

আমি আপনাকে জাজ করছি না। আদর্শিক জায়গায় এত বিপদজনক বৈপরীত্য নিয়ে কীভাবে ব্লগে ১৪ বছর কাটিয়ে দিলেন, তা আমাকে অবাক করে, এবং আপনার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের সবারই কিছু শেখার আছে বলে আমি মনে করি।

আপনার জন্যে আন্তরিক শুভকামনা, আবারো।

৮| ১৫ ই মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪২

নতুন বলেছেন: প্রিয় পোস্টে আমি রাখি যেই সব পোস্টে আলোচনার বিষয় থাকে অথবা তথ্যমুলক ব্লগ গুলি। এটা আমি ব্যবহার করি ব্লগুলি সংরক্ষনে রাখার জন্য পরে আবার দেখা যাবে সেই অথ`। তার মানে এই না যে সব গুলি আমি পছন্দ করি বা আমার মতামতের সাথে সম্পূ`ন মিলে।

আর ধম`কে আমি কুসংস্কারের সাথে রেখেছি কারন বেশির ভাগ ধামিকই অন্ধ অনুসারী মাত্র। এবং আমি ব্যক্তিগত ভাবে ধামিক না। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে মানুষ অনেক সময় বিভিন্ন বিষয়ে অজ্ঞ থাকে। যেটাকে আমি অজ্ঞতার চাদর বা shroud of ignorance বলি।

বিশ্বের ইতিহাসে দেখা যায় মানুষ বিভিন্ন সময়ে এই shroud of ignorance এ ঢাকা ছিলো। দীঘ`দিন অনেক মানুষ এই shroud of ignorance এর নিচে অনেক কাজ করেছে যেটা এখনার সময়ে কুসংস্কার এবং অমানবিক বা ভুল বলেই সবাই মানে। বিশ্বের অনেক ধম`ই আগে লক্ষ লক্ষ অনুসারী ছিলো এবং এখন সেটা নেই কারন তারা বুঝতে পেরেছে তাদের ঐ ধমের চেয়ে নতুন আরেকটা ধম` বা ধম` ছাড়াই তারা বাচতে শুরু করেছে।

আর আমি মনে হয়না ব্লগ লেখক হতে পেরেছি এই ১৪ বছরে বরং আমি আসলে একজন পাঠক মাত্র। এখানে অনেকের লেখা পড়া যায় এবং বত`মানে এখন ব্লগে আসা একটা নেশার মতন।

১৬ ই মে, ২০২০ রাত ১:৩০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ১।
আপনার মন্তব্যের সূত্র ধরে জানা গেল আপনি ধার্মিক নন। এ ডিক্লারেশনের পরে আপনার এ লেখার পীঠে প্রথম মন্তব্যটি আর সরলভাবে নেয়ার উপায় নেই। এ লেখাটি, যার প্রতিটা লাইন তার পূর্ববর্তি লাইনের সমন্বয়ে এগিয়েছে, যার প্রতিটি দাঁড়ি - কমা - সেমিকোলন গুরুত্বপূর্ণ, আপনি তার পীঠে প্রথম মন্তব্যে দাবী করলেন - "বেশী বড় লেখা, অনেকটা টেনে লম্বা করা হয়েছে মনে হচ্ছে।" সাথে ছিল দায়সারা গোছের খুচরো দু' একটা অনুযোগ, যা পেছনের আলাপেই মিটে গেছে।
হয়তো আপনার কাছে নয়, কিন্তু এ প্রামাণ্য লেখাটি আজ না হোক আজ থেকে পাঁচবছর, দশ বছর পরে হলেও কারো জন্যে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সেই পাঠককে আপনি "হুদাই টাইনা আলাপ বাড়াইছেন" - এর মত ভুল তথ্য দিয়ে মিসলিড করাটা অনুচিত হয়েছে, যেহেতু তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব/দর্শন, প্রাথমিকভাবে আপনার আগ্রহের জায়গাই নয়।

১৬ ই মে, ২০২০ রাত ১:৩৩

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ২।

ধর্ম - কুসংস্কার - অন্ধ অনুসরণকে আপনার কাছে সমার্থক মনে হয় বললেন।

ধর্ম ( আব্রাহামিক রিলেজিয়ন) মানুষকে অন্ধ অনুসারী বানায়? যদি বানায়, তাহলে কোন কোন বিষয়ে তা প্রশ্নাতীত সাবমিশন দাবী করে?
নাকি অন্ধ অনুসরণ মানুষের অন্যতম চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য?
মানুষের ইতিহাস আমাদের কি শিক্ষা দেয়?

ফেসবুকের হালের ট্রেনড '#শাড়িতে নারী' থেকে নিয়ে, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়লে ডিগ্রীর ভ্যালু বেশী হবে, বড় হয়ে কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেবে, কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করবে - এসমস্ত ইস্যু নিয়ে আপনার পরিচিত ক'জন মানুষ ক্রিটিক্যাল চিন্তা করে? ক' জন মানুষ তার সমাজ সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসে? সামাজিক নিরাপত্তার ঝাঁকের কই হওয়া, বা অন্ধ অনুসরণ করার অভ্যাস মানুষের রক্তে প্রোথিত।

দ্বিতীয়ত, আব্রাহামিক রিলেজিয়নে কোন কোন বিষয়ে প্রশ্নাতিতভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলা হয়?
আল্লাহ, রাসুল, ফেরেশতা, মৃত্যুর পরের জীবন, ফেইট।
লক্ষণীয় যে এগুলো কিছুই ফিজিক্যাল / পৃথিবী সংশ্লিষ্ট বিষয় না।

পৃথিবী গোল না থালার মত চ্যাপ্টা - এটা নিয়ে কোরআনের মূল বাহাস না। একদম শুরুতে ব্যক্তিমানুষের আত্মোপলব্ধি এবং আত্মউন্নয়ন, এবং তারপর সামস্টিক উন্নতি ইসলামের প্রাইমারী কন্সারন। জ্ঞানচর্চা করে সৃষ্টির রহস্য নিজের মত উদ্ঘাটন করার সুযোগ ইসলামের শুরু থেকেই ছিল। এখনো আছে। ফেইথের সিস্টেমটা কীভাবে কাজ করে, এটা ফেইথের ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকে বোঝা একদমই সম্ভব নয়। আর এটা না আত্মপলব্ধির জায়গা থেকে না বুঝে ধর্ম - কুসংস্কার - অন্ধ অনুসরণকে এক লাইনে চালিয়ে দেয়া নৈতিক অপরাধ।

৯| ১৬ ই মে, ২০২০ রাত ১:৪০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ৩।
আপনি পাশ্চাত্যমুখিন বিজ্ঞানের ন্যারেটিভে বিশ্বাস আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। কিন্তু যেহেতু উল্লেখ করেছেন আপনি ইংরেজিতে পড়াশোনা করা, কাজেই ধরে নেয়া যায় আপনি বিজ্ঞানী নন। আপনি কারো লেখা পড়ে বিজ্ঞান বুঝেছেন। যে গল্পের ছলে আপনাকে বিজ্ঞান বুঝিয়েছে, তিনি আবার কোন বিজ্ঞানীর একাডেমীক লেখা অনুবাদ করেছেন। সেই বিজ্ঞানী আবার তার গবেষণার জন্যে তার সরকারের অর্থ অনুদানের মুখাপেক্ষী। কাজেই দিনের শেষে আপনিও তো ঐ পুঁজির মালিকের অন্ধ অনুসারীই হলেন। সে বিজ্ঞান - প্রযুক্তি - আধুনিকতার যে ন্যারেটিভ যেভাবে গেলাচ্ছে, আপনি তাই গিলছেন।

মানুষের ইতিহাস কখনো ঈশ্বর শূন্য ছিল না। বর্তমান বিশ্বে নাস্তিকের ঈশ্বর বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের ঈশ্বর পুঁজিপতিরা। কাজেই নাস্তিকের পৃথিবীও ঈশ্বরবিহীন না, পুঁজিপতিরা তার ঈশ্বর ।

প্রশ্ন হল - ২০২০ সালের প্রেক্ষিতে মুসলমান - ইহুদী - খ্রিস্টানদের আকাশে থাকা ঈশ্বর, নাকি নাস্তিকের পুঁজিবাদী ঈশ্বর - কোন ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা বেশী হিংস্র? - গত একশো বছরের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন, দুটো বিশ্বযুদ্ধ, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার, জৈব - রাসায়নিক মারনাস্ত্রের ব্যাবহার হয়েছে, হয়ে চলেছে- ধর্মের নামে, না পুঁজির নামে?

শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

১০| ১৬ ই মে, ২০২০ রাত ২:৩৬

নতুন বলেছেন: লেখক বলেছেন: ১।
আপনার মন্তব্যের সূত্র ধরে জানা গেল আপনি ধার্মিক নন। এ ডিক্লারেশনের পরে আপনার এ লেখার পীঠে প্রথম মন্তব্যটি আর সরলভাবে নেয়ার উপায় নেই। এ লেখাটি, যার প্রতিটা লাইন তার পূর্ববর্তি লাইনের সমন্বয়ে এগিয়েছে, যার প্রতিটি দাঁড়ি - কমা - সেমিকোলন গুরুত্বপূর্ণ, আপনি তার পীঠে প্রথম মন্তব্যে দাবী করলেন - "বেশী বড় লেখা, অনেকটা টেনে লম্বা করা হয়েছে মনে হচ্ছে।" সাথে ছিল দায়সারা গোছের খুচরো দু' একটা অনুযোগ, যা পেছনের আলাপেই মিটে গেছে।
হয়তো আপনার কাছে নয়, কিন্তু এ প্রামাণ্য লেখাটি আজ না হোক আজ থেকে পাঁচবছর, দশ বছর পরে হলেও কারো জন্যে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সেই পাঠককে আপনি "হুদাই টাইনা আলাপ বাড়াইছেন" - এর মত ভুল তথ্য দিয়ে মিসলিড করাটা অনুচিত হয়েছে, যেহেতু তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব/দর্শন, প্রাথমিকভাবে আপনার আগ্রহের জায়গাই নয়।


লেখাটা বেশি বড় হয়ে গেছে বলেছি কারন এখন বড় লেখা মানুষ পড়তে চায় না। আর অনেকটা টেনে লম্বা করা হয়েছে কারন এটা হয়তো আপনার স্টাইল। আপনি কথাগুলি একটু গভীর করে এবং অলংকরন দিয়ে উপস্থাপন করতে চান।

এটা আমার একটা অবসারভেসন ছিলো।

ব্লগে বা কম্পিউপরের পদায় মানুষ বড় লেখা পড়তে চায়না। এটা মানুষকে জিঙ্গাসা করলেই বুঝতে পারবেন। অনেকেই ছাপার লেখা বই পড়বে কিন্তু স্কীনে বড় লেখা পড়তে চায় না।


ধর্ম - কুসংস্কার - অন্ধ অনুসরণকে আপনার কাছে সমার্থক মনে হয় বললেন।
ধর্ম ( আব্রাহামিক রিলেজিয়ন) মানুষকে অন্ধ অনুসারী বানায়? যদি বানায়, তাহলে কোন কোন বিষয়ে তা প্রশ্নাতীত সাবমিশন দাবী করে?
নাকি অন্ধ অনুসরণ মানুষের অন্যতম চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য?
মানুষের ইতিহাস আমাদের কি শিক্ষা দেয়?


ধর্ম - কুসংস্কার - অন্ধ অনুসরণ এই সবগুলিই বড় একটা মিল হলো সবগুলিই কিন্তু বিশ্বাসের উপরে স্থাপিত। সবাই টিকে থাকে বিশ্বাসের ভীতের উপরে। প্রশ্ন করলেই কুসংস্কার, অন্ধ অনুসরন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই কারনেই ধম` প্রথমেই বিশ্বাস স্হাপন করতে বলে এবং বিশ্বাসে অনড় থাকাকেই ইমানদার মনে করে। তাই এই তিনের মাঝে অনেক মিল পাবেন।


আপনি পাশ্চাত্যমুখিন বিজ্ঞানের ন্যারেটিভে বিশ্বাস আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। কিন্তু যেহেতু উল্লেখ করেছেন আপনি ইংরেজিতে পড়াশোনা করা, কাজেই ধরে নেয়া যায় আপনি বিজ্ঞানী নন। আপনি কারো লেখা পড়ে বিজ্ঞান বুঝেছেন। যে গল্পের ছলে আপনাকে বিজ্ঞান বুঝিয়েছে, তিনি আবার কোন বিজ্ঞানীর একাডেমীক লেখা অনুবাদ করেছেন। সেই বিজ্ঞানী আবার তার গবেষণার জন্যে তার সরকারের অর্থ অনুদানের মুখাপেক্ষী। কাজেই দিনের শেষে আপনিও তো ঐ পুঁজির মালিকের অন্ধ অনুসারীই হলেন। সে বিজ্ঞান - প্রযুক্তি - আধুনিকতার যে ন্যারেটিভ যেভাবে গেলাচ্ছে, আপনি তাই গিলছেন।

যেহেতু আমি বিজ্ঞানী নই এবং অনুবাদ বা ইংরেজী পড়ে বিজ্ঞান জেনেছি তাই সেটা পুজিবাদের অন্ধ অনুসরন হলে আরবের না হয়ে, আরবী, হীব্রু না জেনে যারা ধমে`র অনুসরন করে তারা কি পক্ষপাতিত্বহীন?

দিনের শেষে ইসলামও কি রাস্টক্ষমতার জন্য চেস্টা করছেনা? যদিও সেটা শুরুটা সৃস্টিকতার উপরে বিশ্বাস আনতে বলা থেকে শুরু হয়।

ধম` এবং পুজিবাদ দুটোই ক্ষমতার জন্য মানুষকে আবিস্ট করার চেস্টা করে। যত বেশি মানুষকে এক মতে আনা যায় উপরের নিয়ন্ত্রকেরা ততবেশি ক্ষমতাশালী হয়।

পলিসিমেকারেরা ধম` এবং অন্য সব মতবাদকে তাদের ক্ষমতার জন্যই ব্যবহার করে। সাধারন মানুষ কেউ ধমে`র আফিমে বা অন্য কোন বাদ/ইজমে বুদ হয়ে থাকে।

১৬ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:০৪

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ১।
আমার আপত্তি ছিল আপনার "টেনে লম্বা করা হয়েছে" ফ্রেইজটুকু নিয়ে। লেখার আর্গুমেন্ট না বুঝে "টেনে লম্বা করা হয়েছে" - বলা মিথ্যাচার।

আব্রাহামিক রিলেজিয়ন যে সমস্ত বিষয়ে আনকন্ডিশনাল সাবমিশন চায় - তার কোন কিছুই ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড রিলেটেড না, সেগুলো মানুষের স্পিরিচুয়াল জায়গার কাজ, এবং দিনশেষে মানুষকে পৃথিবীর মানুষরূপী যত ঈশ্বর আছে, অন্তত আত্মিকভাবে তার থেকে মুক্তি দেয় বলে যে ব্যাখ্যা ওপরে দিলাম ওটাও আপনি মনে হয় না আপনি বুঝেছেন। কারণ, যেটা আগেই বলেছি, ফেইথের ভেতরে না থেকে ফেইথ কীভাবে কাজ করে সেটা বোঝা মুশকিল।

১৬ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:১৫

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ২।

বাংলাদেশের ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকরা বুঝেশুনেই হোক, বা না বোঝার কারণেই হোক একটা ভুল তথ্য প্রচার করে বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানদের সে ট্র্যাপে ফেলতে চান , তা হল - ইসলাম আরবের ধর্ম - আরবের সংস্কৃতি না বুঝে ইসলাম বোঝা যাবে না। এই ভুল ধারণার চিরতরে নিরসন দরকার।

বাংলাদেশে যে খ্রিস্টান বা মুসলমানরা আছে, তাঁরা বাঙ্গালী খ্রিস্টান বা মুসলমান। বাঙ্গালী মুসলমানের মূল কাজ বাংলাদেশে কীভাবে ইসলাম এসেছে, এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশে ইসলাম কীভাবে কাজ করছে, কীভাবে অন্য সব ধর্ম ও বর্ণের বাঙ্গালীর সাথে মিলেমিশে থাকা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করা। আরবের মুসলমানদের দোষ, গুণ, সংস্কৃতি কিছুই বাঙ্গালী মুসলমানদের মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে না। যদি আরবের মুসলমানদের দোষ বাঙ্গালী মুসলমানদের কাঁধে এসে পড়ে, আপনাদের এ দাবী অনুযায়ী, উইঘুর আর মায়ানমারে বৌদ্ধরা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালানোর জন্যে বাঙ্গালি বৌদ্ধরাও দায়ী, আপনাদের কথার সূত্র ধরেই কাশ্মীর, শাহিনবাগ, এবং সারা ভারত জুড়ে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখার জন্যে বাংলাদেশের হিন্দুরাও দায়ী, জর্জ বুশ ইরাকে আফগানিস্তানে নিরীহ মানুষ হত্যা করার জন্যে আপনাদের কথা অনুযায়ী বাংলাদেশের খ্রিস্টানরাও দায়ী। কিন্তু তা, না! আমরা জানি যে অঞ্চলের লোকের দোষ গুণ, সে অঞ্চলের লোকেদের মধ্যেই বর্তাবে। আরবের সমস্যা তাই বাঙ্গালীর সমস্যা না। মিডল ইস্টের জঙ্গিবাদের প্রসারণে তাই আমাদের বাঙ্গালী মুসলমান হিসেবে সতর্ক হতে হবে, কিন্তু তাদের ম্যাসাকারের দায়ভার নেয়ার ঠ্যাকা বাঙ্গালী মুসলমানের নেই। পথভ্রষ্ট কিছু মৌলবাদী এদেশে যদি থাকে, তবে তা যারা ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ান, বা ছড়ানোর পৃষ্ঠপোষকতা দেন , তাদের কারণেই।

বাংলাদেশের মুক্তমনা সম্প্রদায়ের আদিগুরু, ডঃ আহমদ শরীফ, যাকে আমি আসলেই শ্রদ্ধা করি, দেখুন তিনি কি বলেন -

"উপমহাদেশের মুসলিমদেরও জানা আবশ্যিক যে তাদের প্রায় সবাই দেশজ মুসলিমের বংশধর। তাঁরা ইরানী তুর্কী মঘল আফগান শাসকের জাতিগোষ্ঠী নয়। ওদের নিন্দা প্রশংসা গাঁয়ে না মাখাই শ্রেয়" (কালের দর্পণে স্বদেশ, পৃষ্ঠা ৭৮)

এজন্যেই বার বার বলি। বুদ্ধিবৃত্তিক সততা প্রয়োজন। বাংলাদেশের "মুক্তমনা" সম্প্রদায়ের মত ভণ্ড আমি খুব কম দেখেছি।

বাঙ্গালী মুসলমান কোরআনের ইন্টারপ্রিটেশন থেকে এ অঞ্চলে ইসলামের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় হবে। আপনারা যারা ধর্মবিদ্বেষের আড়ালে যারা ইসলামবিদ্বেষ ছড়ান, তাদের উচিৎ বাঙ্গালী মুসলমানের পরিচয় কীভাবে দাঁড়াবে, সে ব্যাপারে মন্তব্য করা বন্ধ করা।

আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার আচরণ কেমন হবে, এ ব্যাপারে আপনি আপনার পাশের বাড়ির লম্পটের পরামর্শ নেন? বাঙ্গালী মুসলিম কেন ভণ্ড ইসলামবিদ্বেষীদের ইসলাম সংক্রান্ত পরামর্শ নিতে যাবে?

১৬ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:২০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ৩।
ইসলামে রাষ্ট্রক্ষমতারো বহু আগে আত্মউন্নয়নের কথা বলেছে। যেহেতু ইসলাম একটা লাইফস্টাইল, কাজেই ইসলামে রাজনীতি কিরূপ হবে, সেটা নিয়েও মন্তব্য আছে। থাকাটা দোষের কিছু না।

কিন্তু ইসলামবিদ্বেষীরা তাদের প্রচারের হেডলাইন বানায় - "ইসলামী রাজনীতি" এবং তার মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে অশান্তি ছড়ায়, আর একজন সাধারণ বাঙ্গালী মুসলিমকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে - ইসলাম মানে আগে মানুষ হিসেবে নিজেকে উন্নত করা।

ইসলামে আত্মউন্নয়ন আর রাজনীতি - কোনটার গুরুত্ব আগে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত মনে হয় নিজেকে মুসলিম দাবী যারা করে, তাদেরই নিতে দেয়া উচিৎ।

৪।
ধর্ম মানুষকে আবিষ্ট করে রাখে বললেন। ধর্মকে মার্ক্সের বরাতে আফিমের সাথে তুলনা করার প্রচেষ্টা আজকে নতুন না। কিন্তু মার্ক্স কোন প্রেক্ষিতে ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করেছেন, তা সম্পূর্ণ না জেনে আধাখেঁচড়া মন্তব্য করা ঠিক না। পুঁজিবাদী শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস এবং কষ্ট ভুলে থাকার মন্ত্র হল ধর্ম, এই ছিল মার্ক্সের মন্তব্য -

"Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people" ।

ধর্মকে খালি আফিম বলে চালিয়ে মার্ক্সের নাম নেয়াটা বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা।



১৬ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:২২

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ৫।
পলিসিমেকাররা ধর্মকে ক্ষমতার জন্যে ব্যবহার করে বলে সাধারণ মানুষকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়াটা সমাধান? আপনারা যারা ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করা লেখা লিখে চলেছেন, বা এধরণের লেখার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাঁরা তো পলিসিমেকারদের নিয়ে দাঁতভাঙ্গা কিছু লিখছেন না, বা তাদের কট্টর সমালোচনা করছেন না, আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার - পাশের দেশের বিজেপি পুরো উপমহাদেশের সবচে উগ্র ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল, তাদের বিরুদ্ধে আপনাদের একটা লাইন আজ পর্যন্ত লিখতে দেখিনি, অথচ উপমহাদেশে ধর্মীয় সংঘাত এড়াতে হলে সবার আগে এই দলটিকে উগ্রতার পৃষ্ঠপোষকতা করা বন্ধ করতে হবে।

আপনারা যারা ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার নামে কেবল ইসলামের বিরুদ্ধে লেখেন, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে এজন্যে প্রশ্ন থেকেই যায়।

মন্তব্যের সূত্র ধরে প্রতিমন্তব্যে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। লেখাটি নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন। নইলে ধরে নেবো, হয় কিছুই না বুঝে নিজের প্রিজাজমেন্টের জায়গা থেকে কথা বাড়িয়েছেন, অথবা, আমার সাথে আপনি একমত।

শুভকামনা, এবং পুনরায় শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার প্রার্থনায়।

১১| ১৬ ই মে, ২০২০ ভোর ৫:৪২

নতুন বলেছেন: ধন্যবাদ শুভকামনার জন্য।

আশা করি আপনার চোখের চশমা খুলে ধম`,পুজিবাদ, সম্রাজ্যবাদ মানুষ নিয়ে যেই খেলাগুলি খেলেযাচ্ছে সেই বিষয়গুলি নজরে আসবে কোন এক ভবিষ্যতে।

১৬ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:২৯

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: মোটামুটি একটা লম্বা সময় ব্লগে আমিও কাটিয়েছি, তাই কে কোনমত পথের মানুষ, তা চিনতে সময় লাগে না। ইসলামবিদ্বেষ যারা ছড়ায়, যারা কোন কার্যকারণ ছাড়া ২০০ কোটি মানুষের সম্মানের পাত্র রাসুল (সঃ) কে নিয়ে নোংরা বাক্য উচ্চারণ করে, তাদের পোস্টে গিয়ে কারা খেজুরে আলাপ করে, তাদের মতের সাথ ঐক্যমত্য প্রকাশ করে, তাদেরও সবাই চেনে।

আমার দিক থেকে শেষকথা এই, আমি ইসলামকে বা কোন ধর্মকে ডিফেন্ড করার জন্যে লিখছি না। আমার সেই যোগ্যতা নেই। আমি কালচারাল স্টাডিজের ছাত্র। ধীরে ধীরে একটা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচয় সন্ত্রাস কীভাবে কি কৌশলে ছড়ানো হয়, এটা নিয়ে মন্তব্য করবার মত আমার প্রফেশনাল দক্ষতা আছে। বাংলাদেশের ব্লগে কীভাবে সাধারণ বাঙ্গালী মুসলিমের বিরুদ্ধে পরিচয় সন্ত্রাস ছড়ানো হচ্ছে, এটা নিয়ে আপাতত লিখছি। ধর্মের নাম নিয়ে যারা খেলা খেলছে - তারাও বাঙ্গালী মুসলমানের শত্রু, তাদেরও সুপথে আসার আহ্বান জানিয়ে আগেও লিখেছি, ভবিষ্যতে যখনই প্রয়োজন পড়ে লিখবো। বাঙ্গালী সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন না হওয়ার জন্যে যতটুকু লেখা সম্ভব হয় লিখবো, আর আল্লাহ না করেন, এমন কিছু হলে রাস্তায় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করবো তাদের অধিকারের জন্যে। এটাই বাঙ্গালী মুসলমানের পরিচয়।

১২| ২৩ শে মে, ২০২০ রাত ৮:১৫

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: জাতিগত আত্মানুসন্ধানের শেকড় খোঁজার সফল প্রেরণা হয়ে উঠুক এ প্রচেষ্টা।

গণিত, যুক্তি আর আধুনিকতার মিশেলে তত্ত্বকে পণ্য বানিয়ে ব্রান্ডিং করে আমাদের যে মন- মগজ ধোলাই হয়েছে
বিগত শত বৎসরে এত সহজে তা উপড়ানো কঠিন হবে বৈকি।
তাছাড়া এ মাটির মিমিক ম্যানরাতো রয়েছেই শিখন্ডি হয়ে। যাদের আবার রয়েছে পূজির লাগামছাড়া নিয়ন্ত্রন।
যা একে অন্যের পরিপূরক হয়ে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করছে নিয়ত। শেকড় সন্ধানীরা যেখানে বিপ্রতিপে অবস্থান করছে।
একটা তাত্ত্বিক গান, কবিতা বা প্রবন্ধের বই ছাপানোর পয়সা যাদের ঘটে নেই।

তবু আশার বীজ ছড়িয়ে পড়ুক হাটে মাঠে ঘাটে। প্রকৃতির নিত্যতায় বেড়ে উঠুক চেতনার প্রকৃত মেলবন্ধন ধারন করে।
একদিন সাম্রাজ্যবাদী সকল কূট-কৌশল পরাজিত হবেই।

++++


২৪ শে মে, ২০২০ দুপুর ২:২৬

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো , কথা বলা - খুব একটা মেইনস্ট্রিম বিষয় না। লড়াইটা ক্ষেত্রবিশেষে হাওয়ার সাথে, ক্ষেত্রবিশেষে পাহাড়ের সাথে। আপনি ভালো থাকুন। শুভকামনা আপনার প্রতি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.