নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিক্ষক দিবস ২০২০ঃ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা - যেমনটা দেখেছি / দেখছি

০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:১২

ছাত্রছাত্রীদের থেকে প্রাপ্ত কিছু মেইল-ম্যাসেজের মাধ্যমে অবগত হয়েছিলাম যে গতকাল শিক্ষক দিবস। সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলাম যখন, তখন সহজেই চোখে পড়তো এসমস্ত এক একটা দিবস নিয়ে আমাদের অনলাইন উৎযাপনের ধুম। ম্যাসেঞ্জারের নোটিফিকেশনের জ্বালায় কান পাতা দায় হয়ে যেত। ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় না থাকার কারণে অনেক কিছুই চোখে পড়ে না। যেমন, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের যে ঘটনাটি নিয়ে আমাদের দেশ তোলপাড়, আমি তাঁর ব্যাপারে টেলিভিশনে সংবাদ থেকে জেনেছি। একটা অমানবিক ভিডিওর কথা শুনেছি। আমার মনে হয়, আমি বেঁচে গেছি ভিডিওটি আমার চোখে পড়ে নি বলে। রাতে ঘুম হত না।

আজ লেখাটি লিখতে বসেছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াই, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামার সেমেস্টারের ফাইনাল রেজাল্ট সাবমিট করবার পর। সম্পূর্ণ অনলাইনে রান করা একটি সেমেস্টার - আমাদের দেশের ইতিহাসে নতুন একটি ঘটনা। আমি বলবো অগ্রগতি। গত মাস চারেক যাবত অনলাইনে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকতা করে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা থেকে বলতে পারি, নির্ঝঞ্ঝাট ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে, আর শিক্ষক - শিক্ষার্থী , উভয়ই যদি পরস্পরের প্রতি সহানুভিতশিল হয়ে পরিবর্তিত একটি পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে চায়, এবং উভয়পক্ষের যদি শেখা - শেখানোর আগ্রহ থাকে, আচরণে পেশাদারিত্ব থাকে, তবে পুরো করোনাকাল জুড়েই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই অনলাইন এজুকেশন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। এবং তা কোয়ালিটি মেনটেইন করেই। কিন্তু এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে, কোন কিছু একবারে না বুঝলে বার বার বোঝানোর মত ধৈর্য থাকতে হবে, এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা - অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার ক্ষেত্রে সততা অবলম্বন করতে হবে। অবশ্য আগে থেকেই আমাদের অ্যাকাডেমিক কমেটির সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল যে, যেহেতু আমরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা মনিটর করতে পারছি না কাজেই আমাদের প্রশ্ন করতে হবে অ্যানালিটিক, যাতে ছাত্রছাত্রীদের নিজ বিচার বিবেচনা থেকে প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয়। এর মধ্যেও যে চিট করবার চেষ্টা হয় নি তা নয়, তবে প্লেজারিজম চেক করবার মত কিছু সফটওয়্যার বাংলাদেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবহার করছে। গুগল ক্লাসরুমও এই সুবিধা দিচ্ছে সীমিত পরিসরে। এবং বলা বাহুল্য, আমাদের এই করোনা কালের পড়াশোনার মূল হিরো গুগল স্বয়ং। গুগল মিট, গুগল ক্লাসরুম - ইত্যাদি অ্যাপ যদি গুগল ফ্রি করে না দিতো, ভার্সিটিগুলোর সহায়ক অ্যাপ কিনতে গুচ্ছের টাকা খরচ করা লাগতো।

শুরুর দিকের এই সমস্ত খুচরো আলাপ সেরে এবার মূল প্রসঙ্গে ঢুকি। ব্লগার চাঁদগাজী সাহেব প্রায়ই ব্লগারদের দায়িত্ব নেস্ত করে দেন যে অমুকের অমুক বিষয়ে লিখতে হবে, তমুকের তমুক বিষয়ে লিখতে হবে। আমি মাস্টারি করি, এটা টের পাওয়ার পর আমার প্রায় পোস্টেই এসে তিনি মন্তব্য করেন - শিক্ষা নিয়ে লিখুন! ভাবলাম, আজ শিক্ষক দিবসের উসিলায় দু' চার কথা বলা যাক। বলার মত কথা তো আর কম জমে নি গত পাঁচ বছরে। তবে, আমার এই আলাপ সম্পূর্ণরূপে আমার জমা হওয়া অভিজ্ঞতার আলোকে। আমি পুরো বাংলাদেশী শিক্ষক কমিউনিটির হয়ে কথা বলছি না, কারন শিক্ষার স্তরভেদে, প্রতিষ্ঠান ভেদে আমাদের অভিজ্ঞতা একেকরকম।

একটা কথা আগে ক্লিয়ার করি। শিক্ষক - শিক্ষকতা - ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু মিথ প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে। যেমন - যে আর কোন পেশায় সুবিধা করতে পারে না, সেই কেবল শিক্ষকতায় আসে; অথবা, শিক্ষক মানেই দরিদ্রতায় ক্লিষ্ট, সততায় মহিমান্বিত এক সেমি মহামানব; শিক্ষক মাত্রই পরম পূজনীয় ইত্যাদি। এগুলো একধরণের মিথ। আরেক প্যাটার্নের প্রচলিত মিথ এরকম - শিক্ষকমাত্রই আজকাল দলকানা, রাজনীতিবিদদের পা চাটা, ছাত্রী দেখলেই তাঁদের চোখ চকচক করতে থাকে, তারা খালি প্রাইভেট পড়াতে চায়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আপনার আমার পেশা যাই হোক না কেন, আমাদের প্রথম পরিচয়, আমরা মানুষ। আর কোন মানুষই পুরোপুরি সাদা বা কালো চরিত্রের অধিকারী হন না। সাদা কালোর মাঝামাঝি একটা গ্রে এরিয়াতে অধিকাংশ সময় আমাদের চরিত্রের চলন। কাজেই কেউ শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হলেই যে তার দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হওয়া চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এমনটা নয়। তবে শিক্ষকদের থেকে সাধারণত মানুষ একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নিক আচরণ প্রত্যাশা করে। যেমন - সততা, সত্যবাদীতা, উত্তম চরিত্র, উত্তম বাচনভঙ্গী, বিনয়, ইত্যাদি। পেশাটার সঙ্গে লাগোয়া এই চাহিদার চাপে পড়েই অনেককে আস্তে আস্তে নিজেকে মডিফাই করতে হয় এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে। তবে সে পরিবর্তন হয় সে যে সমাজ ব্যবস্থায় বাস করে তার সমাজ বাস্তবতার ঘাত প্রতিঘাতে।

বাংলাদেশের শিক্ষক প্রজাতি, বাংলাদেশের আপাত পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ভিনগ্রহের প্রাণী না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা যেমন, বাংলাদেশের প্রশাসকরা যেমন, প্রতিরক্ষাবাহিনী যেমন, চিকিৎসকরা যেমন, আইনজীবীরা যেমন, ব্যবসায়ীরা যেমন, বাংলাদেশের শিক্ষকরাও তেমনি বাংলাদেশী শিক্ষক। কাজেই শিক্ষকের যে সংজ্ঞা আমরা পুঁথিপুস্তকে পড়েছি, বা যুগে যুগে সমাজে প্রচলিত যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শিক্ষকদের পরিচয়কে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, তাঁর অনুপাতে যদি বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশাটিকে বুঝতে চান, ভুল বুঝবেন। শিক্ষকতা পেশা বা পেশাজীবীদের তাতে খুব বেশী কিছু আসবে যাবে, এমনটা না।


যদি আপনার মেধা থাকে, ভিশন থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আপনি না খেয়ে মরবেন না। দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চাকুরেদের বেতন স্কেল সরকার রিভাইজ করেছে। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে চেষ্টা তদবির করে মাথা গোঁজার একটা জায়গাও জুটিয়ে ফেলতে পারেন। এছাড়াও - পারিপার্শ্বিক উপার্জনের সুযোগ থাকে, থিসিস সুপারভাইজ করে, পরীক্ষার পরিদর্শক ও খাতা দেখার দায়িত্ব পালন করে, পরামর্শকের ভূমিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায়ে অনুষদের শিক্ষকদের গাড়ির মডেল দেখলে তাক লেগে যেতে হয়, বাংলাদেশের বড়বড় সব অর্থকরি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শকরূপে তারা কাজ করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিনটি অলিখিত ক্যাটাগরি আছে। উক্ত ক্যাটাগরির প্রথম ধাপে পড়ে ইস্টওয়েস্ট - নর্থসাউথ - ব্র্যাক - আইইউবির মত প্রথমদিকে ওপেন করা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। ২০২০ সালে এসে এসমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একএকজন প্রভাষকের বেতন ছয় অংকের ঘরে হয় / হতে পারে। এরপরের ধাপে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আছে তাতেও শিক্ষকদের সম্মানি ঢাকা শহরে মধ্যবিত্ত জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্যে মোটামুটিভাবে যথেষ্ট। আর একদম নীচে আছে কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের নামে সার্টিফিকেট জাল বা বিক্রি করার অভিযোগ, স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে যারা - তাঁদের নানাভাবে মালিক পক্ষ এক্সপ্লয়েট করে। কর্মঘণ্টা লম্বা থাকে। অ্যাকাডেমিক কম, অফিশিয়াল কাজ বেশী থাকে। এই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বেশীদিন সাধারণত কাজ করেন না এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তারা পেপার পাবলিশ করে সুইচ করেন অপেক্ষাকৃত ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে, বা বাইরে পড়তে চলে যান।

শিক্ষার্থী - শিক্ষকের সম্পর্ক বদলে গেছে। আগের মত নেই। বিশেষত পাবলিক আর প্রাইভেট ভার্সিটির কালচারে ব্যাপক তফাৎ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলাম এক দশক আগে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের বাঘা বাঘা শিক্ষকদের কোন করিডোর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখলে আমরা চেষ্টা করতাম পাশের কোন করিডোর দিয়ে বের হয়ে যেতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আধা ঘণ্টা চিন্তা করতাম দরজায় নক করবো কি করবো না। জাহাঙ্গীরনগরের ইংরেজি বিভাগের আমার এক প্রিয় শিক্ষক মাশরুর শাহিদ হুসেইন স্যার। ওনার সঙ্গে ওনার বাসায় গিয়ে কথা বলা হল একদিন, দুপুর বারোটা থেকে বেলা তিনটা। আমি যখন উঠি, স্যার বললেন - তিনি খেয়াল করেছেন এই তিনঘণ্টায় আমি একবারের জন্যেও সোফায় পীঠ লাগিয়ে হেলান দিয়ে বসি নি। সোফাতেই বসেছিলাম, তবে ঠায় সোজা হয়ে বসেছিলাম। আমি স্যারকে বলেছিলাম যে, আমি ওনাকে , ওনার কর্মময় জীবনকে শ্রদ্ধা করি বলেই হয়তো সোজা হয়ে বসেছিলাম পুরোটা সময়। ব্যাপারটা প্ল্যান করে করেছিলাম এমন নয়। শিক্ষকদের প্রতি এই সম্মান আমার বিলট ইন একটা ব্যাপার।

কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমার এই আচরণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আশা করতে পারেন না। বা, করতে পারেন, তবে তাতে কষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। নানারকম অসঙ্গত আচরণের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়। কখনোবা আমাদের কলিগদের কারোর অশিক্ষকসুলভ আচরণই তারা প্রশ্রয় পায়। ঢালাওভাবে একদিকে দোষারোপ করে লাভ কি। অপরদিকে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্র এখনো অনেকটা আগের মতোই।

আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ কীভাবে শিক্ষকদের দেখে, এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। নিজের পরিবারের কেচ্ছা যদি বলি, আমার মা বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েন্ট ডিরেক্টর পদে রিটায়ার করেছেন। ঢাকা শহরে তার নিজের একটা ছ' তালা দালান আছে। এবং একজন নারী হয়ে তার এতদূর আসা , এর পেছনে কোন অসততা, বিশেষ কারো সাহায্য কিছুই নেই। আমার বাবা সাংবাদিকতা পেশায় ছিলেন। উনি ভাবের জগতের মানুষ। আমার ভেতরে শিল্প সংস্কৃতির বীজ একটু একটু করে বুনেছেন তিনি। কিন্তু সংসারের রুঢ় বাস্তব দিকটা সামলেছেন আমার মা। তিনি এখনো আমাকে সরকারী চাকরির জন্যে চেষ্টা করতে বলেন। আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও এই ব্যাপারটা দেখেছি। আমার পেশা আমাকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা দিলেও - সরকারী চাকুরে এবং চাকরির প্রতি তাঁদের আলাদা মোহ। আর সমাজে এখন জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা। এতে শিক্ষকরা নিজ পেশাগত দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করে কীভাবে আলাদা জায়গা করে নেবে, আমি বুঝে উঠতে পারি না।

তাহলে সবকথার শেষ কথা, আমার শিক্ষকতা জীবন নিয়ে মূল্যায়ন কি? নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসেই কথা বলছি যেহেতু।

সত্য বলতে, আমার জীবনটাই কেটেছে, কাটছে একটা রোমান্টিকতার ঘোরে। ছাত্র জীবনে যখন সকাল আটটায় ক্লাস থাকতো, আর সাতটার বাসে উঠে সাড়ে সাতটার মধ্যে শুনশান কলাভবনে প্রবেশ করতাম, আমি একা একা গিয়ে দাঁড়াতাম আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের জন্যে বরাদ্দ রুমের বন্ধ দরোজার সামনে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কায়সার হক, ফকরুল আলম, শওকত হুসেইন, খোন্দকার আশরাফ হোসেন। দরজার উপর শস্তা নেমপ্লেটের মধ্যে ওনাদের নাম তারার মত জ্বলজ্বল করতো। আমি ওনাদের দরজার উপরে হাত রাখতাম। ওনাদের নেম প্লেটের উপর হাত বুলাতাম। সকালের বাঁকা রোদ ঝুলে থাকতো ডিপার্টমেন্টের বারান্দায়। আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম ডিপার্টমেন্টের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ত্রস্তপদে বুদ্ধদেব বসু, ডিপার্টমেন্টের করিডোর রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন শামসুর রাহমান আর সৈয়দ শামসুল হক, দেশের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত মুখে আলাপ করছেন মুনির চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আর খান সরোয়ার মোর্শেদ। টিএসসিতে নতুন কোন নাটক নামানো যায়, সে নিয়ে আলাপ করছেন রামেন্দু মজুমদার। আবুল মাল আবদুল মুহিত হয়তো ব্যাস্ত, এখনি ছাত্রদের একটা মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে জড়ো হবেন। বেনজির আহমেদ হয়তো তার ক্লাসের টেক্সট বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে ঝালিয়ে নিচ্ছেন তার সাধারণ জ্ঞান। দু' দশক পর তিনি নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশ পুলিশকে। তারপর, যখন চোখ খুলতাম, টের পেতাম যে আমি বিচ্ছিন্ন কেউ নই। আমি এই সোনালী একটা প্রজন্মের ধারাবাহিকতার সন্তান। আমার একশো বছরের পুরনো একটা লেগেসি আছে।

আমি নিজ ইচ্ছায় শিক্ষকতায় এসেছি। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে সরকারী সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নেবো, এই চিন্তায় নয়। বরং আমি আমার লেগেসি চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম বলে। বুদ্ধিবৃত্তিকতার আলোকিত এক লেগেসির অংশ আমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে হলে সাধারণত ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে হয়। আমি ফার্স্ট হতে পারি নি। প্রথম তিনজনের মধ্যে ছিলাম। তৃতীয় অবস্থানে।
যাই হোক, শিক্ষকতার শুরু হল ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের ইংরেজি বিভাগ থেকে। তারপর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে। মধ্যখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা, জার্নালে প্রকাশিত শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ক আর্টিকেলের সূত্রে।

শিক্ষক কম ভেবে নিজেকে কোচ ভাবতে পছন্দ করি। আমার গুরুস্থানীয় শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা ক্রিটিকাল দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। আমি চেষ্টা করি ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ রেখে তাঁদের সাহায্য করতে। কারো ভেতরে কোন প্রতিভা থাকলে অনুপ্রেরণা উৎসাহ জুগিয়ে তার স্ফুরনে সহায়তা করতে। একদিন কি খিটখিটে বুড়ো মাষ্টার হয়ে যাবো? কে জানে! তবে, সে দিন যদি আসেও, তা যেন আরও অনেক পরে আসে।

শিক্ষকতা পেশায় মনের তাকিদে আছি, এবং এই পেশা আমাকে সৎউপায়ে যে উপার্জনের সুযোগ দিয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ, আমি খরচ করে শেষ করতে পারি না। আমি জানি আমার উপার্জনের একশোভাগ অংশ হালাল, আর এই উপলব্ধির যে কি আনন্দ, কি গৌরব, যে হালাল উপার্জন করে শুধু মাত্র সেই বুঝতে পারে।

মনের আনন্দে পড়ছি, লিখছি, গান লিখছি, সুর বসাচ্ছি, গান গাইছি, কনফারেন্সে যোগ দিয়ে পেপার প্রেজেন্ট করছি, জার্নালে লেখা ছাপা হচ্ছে। আমার প্যাশনের সঙ্গে কোন কম্প্রোমাইজ আমার পেশাগত কারণে করা লাগে নি।

শিক্ষক দিবসে বাংলাদেশে বর্তমান ইউনিভার্সিটি লেভেলের শিক্ষকদের কিছু ইস্যু নিয়ে খিচুড়িমার্কা এই আলোচনা শেষ করছি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের খুব পছন্দের কিছু শিক্ষকদের ছবি শেয়ার করবার মাধ্যমে, আমার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে যাদের ভূমিকা অপরিসীম। পিতামাতার পর, যাদের ক্লাসরুমে আমার দ্বিতীয় জন্ম।



ছবি ১ঃ আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচে প্রিয় শিক্ষক, প্রফেসর ফকরুল আলম স্যার। বর্তমানে স্যার ইউজিসি অধ্যাপক। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ইংরেজি অনুবাদক। (ছবি - ২০১৫ সাল)


ছবি ২ঃ ইংরেজি বিভাগে আমার শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের কান্ট্রি ডিরেক্টরের বাসায় এক প্রোগ্রামে (২০১৫ সাল)


ছবি ৩ঃ ডঃ আহমদ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বিখ্যাত শিক্ষক। আমারো শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, আমার চাচা। ব্লগার ইমন জুবায়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ওনারও খুব পছন্দের শিক্ষক কামাল চাচা। কামাল চাচার দীপেশ চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে করা পিএইচডি অভিসন্দর্ভঃ রাইজ অ্যান্ড ফল অফ মুসলিম লীগ ইন পাকিস্তান, যেটা ইউপিএল থেকে পাবলিশ হয়েছে, আমি সেটা বাংলায় অনুবাদ করেছি।( ২০১৫ সাল)



ছবি ৪ঃ আমার তৃতীয় বই, আয়াজ আলীর ডানার কপি হাতে কামাল চাচা (২০১৬ সাল)


ছবি ৫ঃ প্রফেসর ডঃ শওকত হুসেইন স্যার। ঢাবির ইংরেজি বিভাগের সবচে পণ্ডিতম্মন্য, এবং জনপ্রিয় শিক্ষকদের একজন। আমার দুর্ভাগ্য যে ওনাকে আমি সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পাই নি। ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলে স্যারকে আমার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ও বস হিসেবে পাই। কলিগ হয়েও ছাত্রের মত আগ্রহ নিয়ে স্যারের ক্লাস করতাম মাঝে মাঝে। এমনি এক ক্লাস শেষে একদিন। (ছবিঃ ২০১৬ সাল)



ছবি ৬ঃ আমার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা তাসনিম সিরাজ মাহবুব ম্যাম। মাতৃস্নেহে আমাদের পড়িয়েছেন। ম্যামের সঙ্গে আমার একটি জয়েন্ট পেপার আছে। সেই পেপারের উপর সেমিনার দেয়ার পর , আমার আর ম্যামের প্রেজেন্টেশন শেষে।



ছবি ৭ঃ জাতীয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার, আমাদের ইংরেজি বিভাগের ইমিরিটাস অধ্যাপক। আমার প্রথম বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিয়ে আমাকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। পেছনে নিয়াজ জামান ম্যাডাম। ঢাবির ইংরেজি বিভাগের আর একজন লিভিং লেজেন্ড (ছবি ২০১৪ সাল)



ছবি ৮ঃ ইংরেজি বিভাগের আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ফেরদৌস আজিম ম্যাডামের সঙ্গে। ২০১৪ সালে আমার প্রথম কনফারেন্স পেপার প্রেজেন্টেশনের সময় তিনি আমার সেশন চেয়ার ছিলেন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগ ম্যামের তত্ত্বাবধানে তৈরি।



ছবি ৯ঃ ২০১৬ সালের পাঠচক্রে, আমার শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, এবং বুলবুল সারওয়ার স্যারের সঙ্গে। বুলবুল স্যারের ছেলেকে আবার চারুকলায় আমার ছাত্র হিসেবে পেয়েছি।


ছবি ১০ঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শেষ দুবছর স্টুডেন্ট মেন্টর হিসেবে কাজ করবার পর সার্টিফিকেট নিচ্ছি ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মিস বারবারার কাছ থেকে, পেছনে আমার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা তাসলিম আইরিন আইভি ম্যাম, ও মুনাসির কামাল ম্যাম।



আর এই শেষ ছবিটা আমার এক ক্লাসরুমের। ফল ২০১৯ সেমিস্টারের শেষ ক্লাস নিতে যাবো যেদিন, রুমে ঢুকে দেখি শিক্ষার্থীরা এই ওয়াল পেপার দিয়ে রেখেছে মনিটর জুড়ে। (ছবিঃ ২০১৯ সাল)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৬

চাঁদগাজী বলেছেন:



আপনার গান শুনেছি, ভালো লাগেনি।

করোনার আগে, নতুন সেমিষ্টারে নতুন সেকশনে, ১ম ক্লাশ আপনি কিভাবে শুরু করতেন?

০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৬

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ভালো প্রশ্ন স্যার। প্রথম ক্লাসটা মূলত আইস ব্রেকিং সেশন। শিক্ষার্থীদের কয়েকটা ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করতাম। তাঁদের স্কুল কলেজ, কে কোথা থেকে এসেছে, ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকে না কি মেসে। একটা বিষয়ে লেকচার একজন শিক্ষক কয়েকটা লেয়ারে দিতে পারে, কিন্তু তার আগে তার জেনে নেয়া প্রয়োজন যে তার পার্টিকুলার সেকশনের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের সোশ্যাল, এজুকেশনাল - ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন। তাহলে সে অনুপাতে পরের ক্লাসের ম্যাটেরিয়াল, লেকচার সাজাতে সুবিধা হয়।

অনেকেরই মন ভাঙ্গা থাকে সাধারণত পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের সাবজেক্টে পড়ার সুযোগ না পাওয়ায়। সেই জায়গাটুকু মেরামত করার চেষ্টা থাকে। এখন যেখানে পড়ছে সেখান থেকেও কত ভালো ভালো অবস্থানে যাওয়া সম্ভব সেটা আলোচনা করি।

আমার গান আপনার ভালো লাগে নি জেনে আমার খারাপ লাগলো না, কারন কাজটা আমি নিজে উপভোগ করি। সর্বোপরি, পরিচিত মানুষজনের কাছ থেকে সোজা সাপটা মন্তব্য ভালোই লাগে। আশা করি আপনার শরীর আগের চে ভালো।

২| ০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১১:৩৯

রাজীব নুর বলেছেন: আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর আলতাফ। স্যারের বাড়ি রাজশাহী কিন্তু উনি থাকেন ফরিদপুর।

০৭ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১০:৩২

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: আলতাফ স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা। ওনার সুস্বাস্থ্য, সুন্দর জীবন, ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

৩| ০৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৩:০৫

চাঁদগাজী বলেছেন:


ধন্যবাদ, আমি দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগছি।
আপনার শুরুটা খারাপ নয়; তবে, আমি ফুল-টাইম চাকুরীর ফাঁকে ফাঁকে আজীবন পড়ায়েছি; আমি ১ম ক্লাশে চা/কফি, কুকি/ডোনাট নিয়ে যেতাম, পড়ালেখার পুরো সেমিষ্টারের একটা প্রিন্টেড ম্যাপ তাদের হাতে দিতাম; এবং ভালো গ্রেইড দেয়ার প্রস্তাব করতাম।

০৭ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১০:৪৫

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: আপনি কোন লেভেলের শিক্ষার্থীদের পড়াতেন? কি বিষয়ে?

পুরো সেমেস্টারের ম্যাপকে বলে কোর্স আউটলাইন। ওটা আমরাও নিয়ে যাই। প্রথম ক্লাসেই স্টুডেন্টদের হাতে হাতে কোর্স আউটলাইন পৌঁছে দেয়া সব শিক্ষকের অফিশিয়াল দায়িত্ব। আর গ্রেডিং এর ব্যাপারে আমাদের স্টুডেন্টদের একটা ভুল ধারণা আছে যে - শিক্ষক তার মর্জিমত গ্রেডিং করে (হয়তো কেউ কেউ করে, আমার জানা নেই, বা এমন কোন শিক্ষককে আমি চিনি না)। এমনকি পুরো সেমেস্টার জুড়ে কন্সট্যান্ট ভালো পারফর্ম করবার পরে একজন শিক্ষার্থী এ গ্রেড পেলেও দেখেছি এসে আমাকে ধন্যবাদ দেয় ওকে এ গ্রেড 'দেয়ার' জন্যে। মানে, অনেকেরই এই কনফিডেন্সটুকু নাই যে গ্রেড আসলে সে নিজ যোগ্যতা মোতাবেক পেয়েছে, কেউ ওকে দিয়ে দেয় নাই। আমি সেমেস্টারের প্রথম দিকে এই ভুল ধারণা ভাঙ্গার চেষ্টা করি, এবং বোঝানোর চেষ্টা করি - যে যার পরিশ্রমের ফসলই ঘরে তুলবে। কাজেই, ভালো গ্রেড দেয়ার প্রস্তাব নয়, বরং - যে যার পরিশ্রম মোতাবেক ফলাফল করবে, গ্রেডিং এর ব্যাপারে আমার পরামর্শ থাকে এরকম।

আপনার সুস্থ্যতার জন্যে প্রার্থনা করবো। নিজের যত্ন নেবেন আশা করি।

৪| ০৭ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:২১

চাঁদগাজী বলেছেন:




আমি ব্যাচেলর লেভেলে পড়ায়েছি ( আবার বহু মাষ্টার্সকে কন্টেনিউইং এডুকেশনের অধীনে ট্রেনিং দিয়েছি)। আমার ১ম শিক্ষকতা ছিলো হাই স্কুলে (৩ মাস)।

০৭ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:৫০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: জানলাম। ফিরে এসে মন্তব্য করবার জন্যে ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.