নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার জন্য ভালোবাসা।

গেছো দাদা

গেছো দাদা › বিস্তারিত পোস্টঃ

রম্য : সোহাগ !

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:৩২


আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আমরাই ছিলাম প্রথম গিনিপিগ , অর্থাত প্রথম ব্যাচ । কলেজে যখন ঢুকলাম তখন চারিদিকে সাজ সাজ রব , ইতিউতি বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে , সারাদিন ধরে মিস্ত্রিদের ঠুকুর ঠুকুর চলছে , প্রিন্সিপাল দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করছেন , পাশে সভাসদেরা দাঁড়িয়ে - দেখলেই মনটা আনচান আনচান করে উঠত । আহা , না জানি কত বড় রাজসূয় যজ্ঞের সামিল হতে যাচ্ছি ।
কলেজের পাশেই একটা ঝুপড়ি ছিল , ইঞ্জিনিয়ারিং পরিভাষায় তাকে বলা হত ঝুপ্স । ঝুপ্স হলো যে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ইন্টেগ্রাল পার্ট । কি না পাওয়া যেত সেখানে ? চা , সিগারেট, ডিম টোস্ট , বিভিন্ন ধরনের লেড়ো বিস্কুট , বাসী লাড্ডু , রংচটা কাগজের মোড়কে স্থানীয় বেকারির টিফিন কেক ।
এছাড়াও পাওয়া যেত বাবার পেসাদ । দু ধরনের পেসাদ থাকত । একটা হলো কাগজের ঠোঙ্গায় । মূল্য ধরিয়ে দিয়ে ,"কাকা , পেসাদ দাও " বললেই গুপ্ত স্থান থেকে ঠোঙ্গা বেরিয়ে পাচার হয়ে যেত । আর এক ধরন ছিল বিড়ি, তার কোড নেম ছিল "কার্গিল বিড়ি " (সেই সময় কার্গিল যুদ্ধ হচ্ছিল কিনা ) ।
কাকা , অর্থাত ঝুপড়ির মালিক , তার নাম গুরুপদ । আমরা গুঁফো কাকা বলে ডাকতাম , কারনটা সহজেই অনুমেয় । অবিকল বীরাপ্পনের মত একখানা গোঁফের মালিক তিনি , তফাতটা শুধু এই যে হাড় হিম করা চন্দনবনের রবিনহুডকে কেউ হাসতে দেখে নি । আমাদের কাকা কিন্তু সদা হাস্যময় । হিসেবের ব্যাপারে যে গুরুপদ কাকা খুব সতর্ক, তাও নয় । পাঁচ খানা সিগারেট নিয়ে চারখানার দাম দিলেও কোনো হুঁশ নেই। কাকার দোকানে পূর্ব বর্ণিত দ্রব্য বাদেও আরো কিছু জিনিস পাওয়া যেত । কোনো এক কালে ভদ্রলোক মিষ্টির দোকানে হালুইকর ছিলেন । সেই বিদ্যেটি জানার দরুন প্রায়শই বিকেলে মিষ্টি বা সিঙ্গারাও প্রস্তুত করতেন । নিমেষে সেগুলি শেষও হয়ে যেত ।
আমি বেশিরভাগ সময় চা এবং সিগারেটেরই খরিদ্দার। বাকি সব দ্রব্যে আমার তেমন আকর্ষণ ছিল না । হ্যাঁ , পেসাদ মাঝেমধ্যে চলত বটে , তবে ওই সিগারেট আর চায়েই আমি দিন গুজরাতাম । মাসিক খাতা ছিল , এবং সেই খাতা , দোকান এবং দোকানের টুকরো টুকরো কথা নিয়ে একটা গানও লিখেছিলাম , তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না ।
কমছে না সিগারেট খাওয়া , আর বাড়ছে সিগারেটের দাম
ধারের খাতাটা যায় বেড়ে , তবু চায়ের তুফানে নেই বিরাম
ক্লাস পালিয়ে , তোমার সাথে , খাটিয়াতে বসে কত গল্পগুজব
চায়ের ধোঁয়া , তাতে স্বপ্ন বোনা , তাতেই ডোবে স্বপ্নগুলো সব
চল পালাই , বল পালাবে কোথায় , যাবার তো একটাই স্থান
গুরুপদর চায়ের দোকান , চায়ের দোকান , চায়ের দোকান ।
কত ঘৃনা কত বিদ্বেষ , বয়ে চলে তারই কত রেশ
কত প্রেম কত ভালবাসা , প্রেম প্রতিবাদের ভাষা
তোমায় নিয়ে লেখা কবিতাগুলো ,
বিবর্ণ হয়ে তাতে জমেছে ধুলো
যদি কোনদিন ভুলে উল্টাই পাতা
ছলকিয়ে ওঠে স্মৃতি প্রেমের ব্যথা
সেই প্রেম শুরু আর শেষ যেখানে
আজও বসে সেখানে গেয়ে যাই গান
গুরুপদর চায়ের দোকান , চায়ের দোকান , চায়ের দোকান ।
অত্যন্ত কাঁচা হাতের লেখা কবিতা , কিন্তু সদ্য আঁতেল হয়ে ওঠার সবরকম মালমশলা মজুদ । ইস গানে মে রোমান্টিসিজম হ্যায় , লেঙ্গি খাওয়ার গল্প হ্যায় , নিজেকে আধুনিক দেবদাস প্রমান করার সব রকম প্রচেষ্টা হ্যায় - অর্থাত যাকে বলে ফুল জমজমাট গান । খুব প্রচলিতও হয়েছিল বন্ধুমহলে ।
অবশ্য গানটির সুরকার এবং রূপকার স্রেফ এই অধম নয় । আমার আর এক দোসর ছিল , তার নাম সোমনাথ । কাকিমার ভাষায় - জগাই মাধাই । কাকিমা , অর্থাত গুঁফো কাকার সহচরী , সহধর্মিনী এবং সহকর্মিনীও বটে । কাকিমার আমার প্রতি একটু দুর্বলতা ছিল , কারণ আমার মুখের আদল নাকি তার এক মৃত সন্তানের মত । এবং সেই জন্য আমার ওপর একটু বাড়তি নজরও ছিল । আদর করে আরেকটা নামও দিয়েছিল কাকিমা - খেপা । প্রায়শই অনুযোগ করত ,"খেপা তুই সারাক্ষণ সিগারেট আর চা খেয়েই কাটিয়ে দিবি ? হোস্টেলে কিছু খাস ? "
আমি মিটিমিটি হাসছি ।
- খাই গো কাকিমা , খাই । সব খাই ।
- ঘোড়ার ডিম খাস । আয় , আমার সাথে দু মুঠ ভাত খাবি আয় । সারাক্ষণ খালি ধোঁয়া আর ধোঁয়া । সিরিঙ্গে চেহারাখানা কেমন বানাইছিস দেখ ?
কাকিমার এই আদরের ভাগ আমার দোসর সোমনাথও পেত । সোমনাথ এবং আমি দুজনেই দুর্গাপুরের ছেলে । রুমমেট , একই ডিপার্টমেন্ট , একসাথে বাড়ি যাই , একসাথে ছুটি কাটিয়ে ফিরি , একই সিগারেট ভাগাভাগি করে ফুঁকি । আমাদের দুর্গাপুরের ছেলেদের বৈশিষ্ঠ্য খানিকটা এরকম - আমরা মফস্বল কিংবা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ছেলেদের মত সহজ সরল নই , আবার কলকাতার পাবলিকদের মত অল্পবয়সী সর্ববিশারদও নই । মোটের ওপর খানিক দো-আঁশলা প্রডাক্ট বলতে পারেন । সোমনাথ এবং আমার একটা অদ্ভূত জুটি ছিল । দুজনেই সমান লম্বা , রোগা ছিপছিপে চেহারা , পরনে ট্রেডমার্ক জিন্স আর টি-শার্ট এবং ক্লাসের ফাঁকে দুজনের ঠোঁটেই সর্বদা আগুন । দুজনেই দুজনের কথা চট করে বুঝতে পারি এবং একজন কিছু বললে ফেলতে না ফেলতেই অন্য একজন তার একখানা ধরতাই ধরিয়ে দেবে । অর্থাত আমরা সার্থকনামা জগাই-মাধাই জুটি ।
সোমনাথ আর আমার একটা যৌথ ধারের খাতা ছিল কাকার দোকানে । কেনাকাটা মোটামুটি একসাথেই হত , তাই মাসের শেষে ভাগাভাগি করেই ধার মেটাতাম । আমার একটা অন্য ব্যবস্থাও ছিল । হত কি , সপ্তাহ দুয়েক বাড়ি না গেলে আমার মা মাঝে মাঝেই হানা দিতেন কলেজে । কিছুই না , কলেজের সময় টুক করে একবার ঢুঁ মেরে যাওয়া আর কি । ছেলে কেমন আছে , এই দেখতে । মানে মায়েরা যেমন হয় ।মা মাঝে মাঝেই এরকম হানা দিত অতর্কিতে । হয়ত গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছি , এমন সময় দেখি মা বাস থেকে নামছে । হাতে ব্যাগ (অবধারিত ভাবে কিছু খাবার দাবার ) ।
খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে , ব্যাগ হস্তান্তরিত করে যাওয়ার আগে মা আরেকটি কাজ করত । গুরুপদর হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলত ," গুরুপদ দা , ওকে প্রতিদিন দুধটা দেবেন তো নিয়ম করে । হোস্টেলে কি খায় না খায় তার ঠিক নেই ।"
সদাহাস্যময় গুরুপদকাকা নব্বই ডিগ্রী মাথা হেলিয়ে বলত -" হ্যাঁ বৌদি , আপনি একদম চিন্তা করবেন না । ওকে আমি রোজ দুধের ব্যবস্থা করে দেব ।"
মাকে ফিরতি বসে তুলে দিয়ে অবশ্য তার পরেই আমার কাকার দোকানে এসে হুকুম - "কাকা , আগের মাসের দুশো টাকা কেটে নিও । আর এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক দাও এখন ।"
এই কাকার সাথে আমার আরেক ধরনের ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল ।
মাঝে মাঝেই গভীর রাতে হোস্টেলের বাইরে আমার ডাক পড়ত । সীমন্ত !! ও সীমন্ত !! (উচ্চারণ বিভ্রাটে কাকা বা কাকিমা কেউই আমায় সুমন্ত্র বলে ডাকতে পারত না ।)
গভীর রাত হলেও আমি এবং সোমনাথ দুজনেই নিশাচর প্রাণী । হয়ত ছাদে বসে গুলতানি মারছি কিংবা অন্য কারুর রুমে বসে আড্ডা । তাই ডাক পড়লেই নেমে আসতাম ।
- কি হলো কাকা ? কি হলো ?
- তোমার কাকিমা আমায় ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না ।
কারণটা সহজেই অনুমেয় । কাকা কারনবারি সেবন করতে গিয়ে একটু রাত করে ফেলেছে , তাই কাকিমা এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান দিয়েছেন ।
আমি বলি , " কি আর করবে ? আজ না হয় আমার বেডেই শুয়ে যাও । কাল সকালে যাবে খন ।"
- না না । ও তোমাদের ওই লুহার খাটে আমি শুতে লারব । তুমি চল , তুমি গিয়ে কাকিমাকে বলবে । ও শুধু তোমার গলা শুনলেই দরজা খুলবে ।
- শোনো কাকা । উইদাউট ধান্দা , আমি আমার বাবারও কেউ নই । তোমাকে ঘরে ঢুকিয়ে এলে আমি কি পাব ?
- লক্ষীটি । এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক দেব । পয়সা নেব না ।
- চল ।
অগত্যা আমি এগোলাম , কাকা পিছু পিছু ।
কাকিমার দোকান কাম লাগোয়া ঘরে ঠক ঠক করেই আমি বলি -"কাকা । আছ নাকি ?"
দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো -" না নেই । কেন ?"
- কাকিমা । আমি সীমন্ত গো । দরজা খোল না । সিগারেট শেষ হয়ে গেছে ।
- এখন হবে না যা । কাল সকালে এসে নিবি ।
- প্লিজ কাকিমা । এত রাতে কোথায় পাব ? দাও না গো।
কাকিমার দয়ার শরীর । একটু গজগজ করতে করতে বলে " দাঁড়া । রাতবিরেত নেই । সারদিন শুধু সিগারেট আর সিগারেট । "
দরজা খুলল , তারপর অবধারিত ভাবে যা হয় । সুরুত করে কাকা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল আর আমি হতভম্ব কাকিমা কিছু বোঝার আগেই সিগারেটের প্যাকেট খানা ছোঁ মেরে নিয়েছি , পাছে কাকিমা মত বদলে ফেলে ।
- পয়সা দিলি না যে ?
- ওটা কাকা দেবে । আমার সাথে কথা হয়ে গেছে ।
- হতচ্ছারা । এই সাঁট করে রাতে আমাকে দরজা খোলালি ?
পেছন থেকে কাকার হুঙ্কার শোনা যায় , " ছেড়ে দাও । আমি কাল ওর সাথে বুঝে নেব । "
পরেরদিন দোকানে যথারীতি সদাহাস্যময় কাকা , কিন্তু কাকিমার আমাকে দেখেই হুঙ্কার ।
- কালকে সাঁট করে আমার ঘরে ওকে ঢোকালি কেন ?
- আহা কাকি , রাগো কেন? তোমার ঘরের লোককেই তো ঘরে ঢোকালাম ।
- তুই জানিস , কাল রাতে আমার ওপর কেমন রাগারাগি করেছে ? গায়ে হাতও তুলেছে ।
এতক্ষণে কাকার গলা শোনা যায় ।
-আহা , খালি হাত তোলাটাই বলছ । কত সোহাগ করি , সেটা বল না ?
মুহুর্তে কাকিমার মুখ লজ্জায় লাল ।
- কি কথার ছিরিই বটেক ? ছেলের সামনে মুখের আগল নেই গা ? :-0
(পুরোনো লেখা।)

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ৮:৩৯

কামাল১৮ বলেছেন: কারগিল যুদ্ধের সময় ছাত্র,তবে তো দাদু হবার কথা না।তবে কি ইচড়ে

১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:১৫

গেছো দাদা বলেছেন: ও হো হো ! আপনি দাদা বলতে কি "দাদু" বুঝেছেন ? =p~
আমাদের এখানে দাদা বলতে "elder brother" বোঝায় ।

২| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ৮:৪৭

কামাল১৮ বলেছেন: পুরনো লেখা হলেও ভালো লাগলো।কতো স্মৃতিআছে কলেজ জীবনের।সেসব মনে হলেও ভালো লাগে।

১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:১৭

গেছো দাদা বলেছেন: এক কাজ করুন। আপনিও লিখে ফেলুন। আমি পড়তে চাই।

৩| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৫৫

বাকপ্রবাস বলেছেন: পড়ছিলাম, ভাল লাগছিল, এমন লেখা পেলে মনে হয় রবিন্দ্রযুগে আমি কলকাতায় ঘুরছি, হেস্টিংস আমার মামা আছে, হেঁটে খিদিরপুর বাজার মনে হয় সেদিকটায় ঘুরে বেড়াচ্ছি

১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:১৯

গেছো দাদা বলেছেন: আবার ভারতে আসার জন্য আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাই।

৪| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:৫৩

প্রামানিক বলেছেন: নষ্টালজিক হয়ে গেলেম

১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:২১

গেছো দাদা বলেছেন: আমিও লেখার সময় নষ্টালজিক হয়ে গেছিলাম। ধন্যবাদ দাদা।

৫| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:৪৯

বিজন রয় বলেছেন: সুপার্ব!!

১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:২২

গেছো দাদা বলেছেন: ধন্যবাদ দাদা।

৬| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ৩:১৬

কামাল১৮ বলেছেন: আমরা বাবার বাবাকে দাদা বলি।

১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:১৯

গেছো দাদা বলেছেন: ও। আমরা বাবার বাবাকে ঠাকুরদা/দাদু বলে ডাকি।

৭| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:৫০

রাজীব নুর বলেছেন: আমি শিবরাম চক্রবর্তীর ভক্ত।
তাই আপনার রম্য গুলোও আমাকে আনন্দ দেয়।

১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:২১

গেছো দাদা বলেছেন: শিবরাম চক্রবর্তী একজন নমস্য মানুষ ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.