নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বার বার নিহত হব তোমার অবর্তমানে

যদি ঠাঁই দিলে তবে কেন আজ হৃদয়ে দিলে না প্রেমের নৈবদ্য

বিবাগী বাউল

ইদানিং জ্যোৎস্না দর্শনই হয়ে পড়ে আমার একান্ত জীবনদর্শন!!!

বিবাগী বাউল › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩ : সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার

২১ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:০৭

লিবারেল ডেমোক্রেসি পুঁজিতান্ত্রিক মতাদর্শের রাজনৈতিক হাতিয়ার হলেও এখানে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একটা জায়গা রাখা হয়েছে, কেননা লিবারেলিজম মানুষের ব্যক্তিগত বিকাশের জন্য নিজস্ব চিন্তা ও তৎপরতার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে।অবশ্য লিবারেলিজম এর স্বাধীনতা তত্ত্বের নানান ক্রিটিকও আছে তা এখানে আলোচনা করার সুযোগ নেই। লিবারেলিজমের এই প্রত্যয় ও ধারণার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সংবিধানও-চিন্তা, মতপ্রকাশ ও বাক স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও সুরক্ষাকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে গণ্য করে। কিন্তু রাডিক্যাল রাজনৈতিক মতাদর্শ তো দূরের কথা বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠী বর্তমানে এই লিবারেলিজমের বয়ানও আর অনুসরণ করতে রাজি নয়। বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার লিবারেল স্পেসও ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণ আরোপের পাশাপাশি রাষ্ট্রযন্ত্র এখন ফেসবুক, টুইটার এর মত সোশ্যাল মিডিয়ার এক্টিভিজমও সরাসরি রাষ্ট্রীয় ও আইনি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে চায়! সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে উঠা যে কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন -এর উদ্ভব ঠেকিয়ে দেয়াই এই নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।



সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩। তবে এই আইনের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার হরণের দায়ভার বিএনপি জামাত জোট সরকারেরও। ২০০৬ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকারই এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করে। বর্তমান সরকার মূল আইনকে ঠিক রেখে এই আইনের অধীনে বিবেচিত অপরাধকে জামিন অযোগ্য করে, পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের অবাধ ক্ষমতা দিয়ে আর শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে এই আইনটিকে আরও ভয়াবহ এবং নিপীড়নমূলক করে তোলেছে। জনগনের নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দেশের উভয় রাজনৈতিক ধারাই সক্রিয় এবং এক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক চরিত্র অভিন্ন । দেশের মূল ধারার এই দুই রাজনৈতিক শক্তিই গণতান্ত্রিক ও মৌলিক মানবিক অধিকার লঙ্ঘনে একের পর এক সীদ্ধান্ত নিয়ে রাষ্ট্রকে ক্রমেই নিপীড়নমূলক ও পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করছে। রাষ্ট্রকে নিপীড়নমূলক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক ধারার এই মেলবন্ধন হতাশাজনক! আমরা তথ্য প্রযুক্তি ব্যাবহার করে যে কোন সাইবার অপরাধের বিরোধী কিন্তু তার জন্য ভয়াবহ নিপীড়নমূলক এবং সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণকারী ধারা সংযুক্ত করে আইন প্রণয়ন করতে হবে কেন?



সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল প্রতিবাদ বন্ধ করাই কি মূল লক্ষ্য?

রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী নানান চুক্তি ও প্রকল্পের বিরুদ্ধে যেন জনগণের মাঝে কোন প্রতিবাদী মনোভাব জাগ্রত না হয় সেজন্য প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াকেও নিয়ন্ত্রণে আনার তাগিদ অনুভূত হতে থাকে শাসক গোষ্ঠীর মাঝে। সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল প্রতিবাদও সম্ভবত শাসকগোষ্ঠীর কাছে এখন অসহনীয় ঠেকছে। তিউনিসিয়া, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক গণআন্দোলনের দিকটি মাথায় রাখলে এই মিডিয়া নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগার মত যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের ভার্চুয়াল আন্দোলন সর্বদা ভার্চুয়ালই রয়ে গেছে, এটা কখনোই খুব একটা মাঠে গড়ায়নি। তাহলে শাসক গোষ্ঠীর এতো সোশ্যাল মিডিয়া ফোবিয়ার কারণ কি? তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, গত কয়েক বছরে দেখা গেল মূল ধারার মিডিয়া যখন নানান কারনে রাষ্ট্রীয় জুলুম- নির্যাতনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত গণমুখী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে তখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতন তরুণ সমাজ ছিল সোচ্চার, দেশ বিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী নানান কর্মকাণ্ডের তির্যক সমালোচনা করতে তারা কখনো কুণ্ঠিত বোধ করে নাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ জাগরণের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই যারা নানান ইস্যুতে যুক্তি, তথ্য-উপাত্তসহ তাদের মতামত ব্যক্ত করছে এবং এর ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন-নিপীড়ন ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়া একটা পটেনশিয়াল প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মার্কিন স্বার্থে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর , বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের উপর পেটেন্ট আগ্রাসন, সুন্দরবন বিধ্বংসী রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প, দেশের তেল গ্যাস এর উপর বহুজাতিক কোম্পানির মালিকানা নিরঙ্কুশ করে স্বাক্ষরিত পিএসসি মডেল-২০০৯/২০১২ অনুমোদন, সীমান্তে ভারতীয় হানাদার বিএসএফ কর্তৃক নির্বিচার বাংলাদেশের নাগরিক হত্যাযজ্ঞ, ক্রসফায়ারসহ নানান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেছে। এই ভার্চুয়াল আন্দোলন যেন কোন ক্রমেই সামাজিক আন্দোলনে রূপ না নেয় তার জন্যই এই কঠোর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের প্রণয়ন।



সোশ্যাল মিডিয়ায় বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা

‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন, ২০১৩, জনগণের মৌলিক মানবাধিকার এবং বাক স্বাধীনতা হরণ করবে বলে অনেক আইন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকারকর্মী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর মাধ্যমে অনলাইনে বা ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশ এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাধাগ্রস্ত হবে মারাত্মকভাবে কেননা মতামত প্রদানকারীকে সর্বদা তাড়া করে ফিরবে বিপজ্জনক ৫৭ ধারা যে ধারায় বলা হয়েছে , “কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সমপ্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ কাজে আগ্রহী হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ হবে একটি অপরাধ”। অর্থাৎ এই ধারায় সাইবার ক্রাইমকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার ফলে যে কোন ব্যক্তির যে কোন অনলাইন ভিত্তিক পোস্ট, মতামত, নোটকে অপরাধ হিসেবে অভিযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবেন যে কেউই। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, “এই আইনে অপরাধ সংঘটনের যে বর্ণনা দেয়া আছে তাতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ ৫৭ ধারায় এমনভাবে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে ইন্টারনেটে যে কোন কর্মকাণ্ডকেই এই আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েই আছে। এরকম একটি আইনে এতদিন যে রক্ষাকবচ (সেফগার্ড) ছিল এই সরকারের আনীত সংশোধনীর ফলে সেটিও উঠে গেছে। অর্থাৎ এতদিন মামলা করতে হলে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হতো। এখন আর অনুমতির প্রয়োজন লাগবে না”।



এখানে বলা হয়েছে অনলাইনে কারও কোন মতামত বা স্ট্যাটাস যদি কেউ সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় পড়লে , দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন তাহলে তাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এটা অত্যন্ত দুর্বল আইনী সংজ্ঞায়ন এবং একই সাথে চরম বিভ্রান্তিকর। ইন্টারনেট ইউজকারি কী করে নিশ্চিত হবেন তাঁর মতামত কেউ দেখলে, শুনলে কিংবা পড়লে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হবেন না? কিসের মাপকাঠিতে এর বিচার করা হবে? নীতিভ্রষ্টতা এবং অসৎ হওয়া এসবের সুনির্দিষ্টকরণের অভাব এই ধারার অপপ্রয়োগের সুযোগ তৈরি করবে। আর কেউ নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হলে নৈতিকভাবে তার নিজের দায়ও আছে, সেক্ষেত্রে তার বিচারও হবে কিনা? কর্পোরেট মিডিয়া অনবরত ভোগবাদী ও বস্তুবাদী কনজুমার কালচার পুনরুৎপাদন করে যেভাবে নাগরিকদের নীতিভ্রষ্ট এবং অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ করছেন সে ব্যাপারেও সরকার কি কঠোর আইন প্রণয়ন করবেন কিনা, নাকি বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানির বৃহৎ পুঁজির কাছে নতজানু হয়েই থাকবেন! এছাড়া সংবাদপত্রের অনলাইনে বা ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রকাশ বা সম্প্রচার করা কোন কিছু মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলেও ৭-১৪ বছরের জেল হবে! কোন তথ্য মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর হবে তা কিভাবে কে ঠিক করবে? দুনিয়া জুড়ে তথ্য নিয়ে নানান গ্রুপের সাথে দ্বন্দ্ব সংঘাত হাঙ্গামা তো আছেই, এক পক্ষ নিজের তথ্য সত্য ধরে নিয়ে বাকিগুলোকে মিথ্যা বলবে আর বাকি সব পক্ষ মেনে নিবে? তাহলে তো সবাইকে এই আইন অনুযায়ী ১৪ বছর করে জেলে যেতে হবে! ধরেন, সিরিয়ায় কে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করল এটা নিয়েই তো তাবৎ দুনিয়া দুই ভাগ হয়ে গেল। তাহলে কোনটা সত্য? অশ্লীল আর মানহানিকর প্রত্যয়তো আরও বিভ্রান্তিকর! রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েই তো দেশের বিশেষজ্ঞরা দুই ভাগ হয়ে গেল। এখন এই প্রকল্পের পক্ষের বিশেষজ্ঞদের তথ্য সত্য ধরে নিলে তো আইসিটি আইন অনুযায়ী বিপক্ষের সবার জেলে নিক্ষেপ করা উচিত! তাই এসব দিক বিবেচনায় এই আইনের নির্বিচার অপপ্রয়োগের সমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা এর রাজনৈতিক অপব্যবহারের দিকটি যার মাধ্যমে সরকার তার বিরোধী রাজনৈতিক মতামত প্রদানকারী শক্তিশালী এবং প্রভাব বিস্তারকারী অনলাইন ইউজারদের বিরুদ্ধে মামলা আরোপ করে বিরুদ্ধ মত দলনের কাজে একে হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করতে পারে। এইতো কিছু দিন আগেই এই আইনের ভিত্তিতে ফেইসবুক ইউজার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল বিভাগের শিক্ষক একেএম ওহেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়, গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারও করে। অনেকের মতে অনলাইনে বর্তমান সরকারের নানান কর্মকাণ্ডের তুমুল সমালোচনা করায় তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে যদিও মামলা করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। একই রকমভাবে আগামীতে বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় আসলে আওয়ামী লীগের প্রতি সংবেদনশীল জনপ্রিয় অনলাইন যোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও সরকার বিরোধিতার অপরাধে (!) এই আইনের ভিত্তিতে মামলা দায়ের হতে পারে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে এই প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাইবার অপরাধ দমন। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ দরকার, কিন্তু এই আইনে এই অপরাধ প্রতিরোধের যে ধারা যুক্ত করা হয়েছে তা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহারকারীদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডেও ভীতির সৃষ্টি করবে এবং ফলে স্বাধীন মতামত প্রকাশের পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, “এই আইন আপনাকে ইন্টারনেটে ব্লগিং বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে বারণ করছে না। কিন্তু যখন আপনি একাজগুলো করতে যাবেন তখনই আপনার মনে এক ধরনের ভীতি কাজ করবে। ওই ভীতি কাজ করা বা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করাটাই তো বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী। বাক স্বাধীনতার মত যেসব মৌলিক অধিকার আছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমার মধ্যে কি ধরনের ভীতি কাজ করছে। আমি তো মনে করি এই আইনে এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে যা আমাদের বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করছে”। এই আইনের ৫৭ ধারায় অপরাধের অস্পষ্টতা , সুনির্দিষ্টকরণের অভাব এবং হালকা অপরাধেও ভয়াবহ শাস্তির বিধান রাখা, সর্বোপরি বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের সুযোগ রাখা এবং এই অভিযোগে গ্রেফতারকৃত আসামীর জামিন না পাওয়া এই সব কিছু মিলিয়েই সাইবার ক্রাইম দমনকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে নানান ইস্যুতে নাগরিকদের প্রতিবাদী ভার্চুয়াল ভূমিকা প্রতিরোধ করার আশঙ্কা আছে, ব্যাপকভাবেই আছে! ৫৭ ধারা অনুযায়ী সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের জুলুম নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেয়া স্ট্যাটাস বা নোট রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মকর্তারা দেখলে বা শুনলে ভাবতে পারেন এতে তাদের মানহানি ঘটতে পারে , আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে পারে কিংবা , রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনায়কদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। আবার সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেয়া স্ট্যাটাসকে সমাজপতিরা, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেয়া পোস্টকে রাজনৈতিক নেতারা তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া বা মানহানি ঘটার অভিযোগে পোস্টদাতার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে এবং বিনা ওয়ারেন্টে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে জামিন না দিয়ে লঘু পাপে গুরুদণ্ড দিতে পারবে! যদি তাই হয় তাহলে এই সমাজে আমরা যে প্লুরালিজমের বলি, আমরা যে গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলি তা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে! এসব আমাদের আশংকার কথা, আমরা চাই এই আশংকা যেন ভুল প্রমাণিত হয়! তবে বাংলাদেশের সমাজ আর রাষ্ট্রে বিরুদ্ধ মত অবদমনের যে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তাতে এ ধরনের আশংকাই বাস্তবে সত্য হয়ে থাকে! অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বিরোধী মতামত দমনের কাজে এই আইনের অপপ্রয়োগ দেশের মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজ, তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী এবং অনলাইন সাংবাদিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করবে।সাইবার অপরাধ দমনের নামে এই আইনের অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার হলে নাগরিক সমাজের মত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে আর রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে নাগরিক সমাজের নানান শ্রেণীর নানান মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা বাংলাদেশকে সরাসরি একটা নিয়ন্ত্রনবাদী রাষ্ট্রে পরিনত করবে যা আমাদের কারও জন্যই কল্যাণকর হবে না!



লঘু পাপে গুরু দণ্ডঃ মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করবে এই আইন

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০১৩ এ এমনভাবে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে যার ফলে অনলাইন ভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মতামত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০০ ধারা অনুযায়ী প্রিন্টেড কোন কিছুর মাধ্যমে বা অন্য কোন উপায়ে কারও মানহানি করলে বা কুৎসা রটালে শাস্তি হবে সর্বোচ্ছ ২ বছরের জেল কিন্তু অনলাইনে কারও লেখায় যদি প্রমাণিত হয় মানহানি বা কুৎসা রটনা করা হয়েছে তাহলে তার শাস্তি হবে সর্বনিম্ন ৭ বছর এবং সর্বোচ্ছ ১৪ বছরের জেল সাথে ১ কোটি টাকার জরিমানা। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৪৭ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কোন দাঙ্গা, সহিংসতা বা রায়টে যোগদান করলে শাস্তি হবে সর্বোচ্ছ ২ বছরের জেল কিন্তু অনলাইনে কেউ যদি এমন কিছু প্রকাশ করে যার ফলে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে কিংবা ঘটানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় তাহলে তার শাস্তি হবে সর্বনিম্ন ৭ বছর এবং সর্বোচ্ছ ১৪ বছরের জেল সাথে ১ কোটি টাকার জরিমানা। আপনি যদি অন্য কারো কম্পিউটারে তার অনুমতি ব্যাতিরেকে প্রবেশ করেন বা অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে সহায়তা করেন তাহলে আপনার ৭ থেকে ১৪ বছরের জেল হতে পারে। ২০০৬ সালের আইনে ন্যূনতম সাজার বিষয়টি ছিলো না, সর্বোচ্চ সাজার বিষয়টি (অনধিক ১০ বছর, এই শাস্তিও লঘু পাপে গুরু দণ্ড) উল্লেখ ছিল। ফলে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী যে কোন ধরনের দণ্ড প্রদানের ক্ষমতা আদালতের ছিলো। ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসের ফলে কারো মানহানি হয়েছে প্রমাণিত হলে মানহানির পরিমাণ অনুযায়ী সেই পরিমাণ শাস্তি দেয়াই ন্যায়বিচারের দাবি। মানহানি কতটুকু হয়েছে সেটি তো আদালতের বিচার্য বিষয়। কিন্তু এই আইনে ন্যূনতম সাজা ৭ বছর উল্লেখ করে দিয়ে কোর্টের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। কারণ কাউকে যদি সাজা দিতে হয়, তাহলে তাকে ৭ বছর সাজা দিতে হবে। ন্যূনতম সাজার বিধান করে নাগরিকদের এক ধরনের অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে।



এই আইনের অধীনে অপরাধসূমহ অজামিনযোগ্য এবং আমলযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হতো। কিন্তু ২০১৩ সালের আইনে অপরাধ আমলযোগ্য হওয়ায় আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা ও তাঁর জামিনের অধিকার হরণ করা আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের চেতনার পরিপন্থী। অভিযোগ তোলামাত্র বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেপ্তার করা ও জামিনের অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করার বিধান মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং চরম অগণতান্ত্রিক।এই আইনে পুলিশকে যে অসীম ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা পুলিশকে আরো বেপরোয়া করবে। পুলিশ চাইলে যে কাউকেই এই আইনে মামলা দিয়ে দীর্ঘকাল কারাগারে রাখতে পারবে।



এই আইন সংবিধান বিরোধী

চিন্তা, ভাব প্রকাশ, মতামত প্রকাশ এবং বাক স্বাধীনতা বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। সংবিধানের ৩৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল”। ৩৮(২) অনুচ্ছেদ এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধেরসাপেক্ষে-

-(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং

-(খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল”। যেহেতু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন বাক স্বাধীনতা খর্ব করছে সেহেতু আইনটি সংবিধান বিরোধী। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে এই আইনের ৫৭ ধারা সংবিধান বিরোধী। এই আইন সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকার বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের চেতনার পরিপন্থি বলে এই আইনের দণ্ডবিধি সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬(১) ধারায় বলা হয়েছে এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। ২৬(২) ধারায় বলা হয়েছে,রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। সংবিধানের এই ধারা অনুযায়ী ৩৮ ধারার বিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন অসাংবিধানিক এবং এই আইনের ৫৭ ধারা বাতিলযোগ্য।



আমরা সাইবার ক্রাইম দমনে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পক্ষে এবং তা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য আবশ্যকও। আমরা অবশ্যই মনে করি অসৎ বা অশুভ উদ্দেশ্যে কম্পিউটারের তথ্য নষ্ট করা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন ছাড়া তথ্য পাচার করা, অন্যের কম্পিউটার ব্যবস্থায় অনধিকার প্রবেশ, অশ্লীল বা মানহানিকর তথ্য, ছবি প্রকাশ করা ইত্যাদি অপরাধ অবশ্যই বিচারযোগ্য। কিন্তু বিদ্যমান আইনে সাইবার অপরাধের অস্পষ্টতা , সুনির্দিষ্টকরণের অভাব এবং হালকা অপরাধেও ভয়াবহ শাস্তির বিধান রাখা, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের সুযোগ রাখা এবং গ্রেফতারকৃত আসামীর জামিন না পাওয়া এইসব কিছুই আইনটিকে কালাকানুনে পরিণত করেছে বলে এই আইন দেশের নাগরিকদের মৌলিক নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে বলে অনেকেই মত দিয়েছেন। সাইবার অপরাধের সংজ্ঞা ও তার দণ্ডবিধি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের সাথে যেন কোনক্রমেই সাংঘর্ষিক না হয় সে দিকে দৃষ্টি রেখেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা দরকার ছিল। আমরা এই নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করে পাবলিকের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষা করার দাবি জানাই। বিদ্যমান আইন থেকে বাক স্বাধীনতা হরণের ৫৭ ধারা বাতিল, ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশের গ্রেফতার ক্ষমতা প্রত্যাহার, বিবেচিত অপরাধকে জামিনযোগ্য করা এবং অপরাধের শাস্তির পরিমাণ ন্যায়সঙ্গত করে নতুন দণ্ডবিধি প্রণয়ন করে নতুন করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়নের দাবি জানাই।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:১১

কাজী মামুনহোসেন বলেছেন: সংশোধন করা হোক।

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৫:২২

বিবাগী বাউল বলেছেন: অনেক দিন পর ব্লগে ফিরলাম, তাই জবাদ দেয়া হয় নাই। ভাল থাকবেন

২| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৪৩

সাদরিল বলেছেন: সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে উঠা যে কোন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন -এর উদ্ভব ঠেকিয়ে দেয়াই এই নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।

সহমত

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৫:২৩

বিবাগী বাউল বলেছেন: ধন্যবাদ সাদরিল ভাই

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.