নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
প্রতিবছর এসএসসি এইচএসসি, ইউনিভার্সিটি/কলেজ ভর্তি বা বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট আসে, এবং তারপরের দিনই খবর আসে অমুক তমুক জায়গায় স্টুডেন্টরা আত্মহত্যা করেছে। এছাড়াও স্টুডেন্টদের আত্মহত্যার ঘটনা সমস্ত বছর জুড়েই ঘটে। একটি কারন প্রেমে ব্যর্থতা, তবে সবচেয়ে বড় কারন প্রত্যাশানুযায়ী রেজাল্ট না করতে পারে।
কার প্রত্যাশা?
বাবা মায়ের।
এখন ঘটনার একটু গভীরে ডুব দেয়া যাক।
আমি যে অফিসে কাজ করি সেখানে আমাদের কলিগদের সাথে অনেক বিষয়েই আলাপ হয়। আমার চাইনিজ কলিগের বাচ্চা মাত্র কয়েকমাস নিজে নিজে পড়েই SATএ near perfect রেজাল্ট করেছে। মায়ের গর্বের শেষ নেই, এবং অনুযোগও করছে "ও পড়তে চায় না। পড়লে আরও অনেক ভাল কিছু করতো। আমিও জোর করি না। জোর করলে যদি পড়ালেখাই ছেড়ে দেয়?"
"ও কি আইভিলীগে যাচ্ছে?"
"জানিনা। ও ওর মর্জি মোতাবেক চলে। তবে মনে হয় এপ্লাই করবে।"
পরবর্তী পাঠকদের জ্ঞাতার্থে, "আইভীলীগ" আমাদের "ছাত্রলীগের" কোন আমেরিকান শাখা নয়। আমেরিকার কিছু সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গ্রূপকে এই নামে ডাকা হয়। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেই পরবর্তীতে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বড় কোম্পানির সিইও, বা দেশের ও বিশ্বের নীতিনির্ধারক হয়ে থাকে। মানে হচ্ছে, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নেতৃত্ব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই দেন।
স্বাভাবিক কারণেই আমার মনে তখন সুপ্ত বাসনা জাগে, "আহারে, আমার ছেলেও যদি এমন হয়!"
ছেলের বয়স এখনও কম। স্কুলে যাওয়া আসা শুরু করেছে কেবল। আরেকটাতো এখনও শুধু নিজের নামই বানান করে লিখতে শিখেছে, বাকি কোন জ্ঞানই নেই। আমার চোখে এখনই হোয়াইট হাউজের গদির ছবি ভেসে উঠে।
তারপরে যত দিন যাবে, এই বাসনাকে আমি আলো বাতাস দিতে দিতে বিশাল মহীরুহে পরিণত করবো। একটা সময়ে টেরও পাব না আমার সুপ্ত বাসনা কবে আমার জেদে পরিণত হয়েছে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো আমার সন্তানের জন্য দুঃস্বপ্নে। যে আমি সন্তানের গায়ে সামান্য আঁচড় পড়লেও ছুটে যেতাম, সেই আমিই আমার সন্তানের উপর নিজের স্বপ্ন, নিজের জেদ ইত্যাদি চাপিয়ে দিয়ে ওর ব্যক্তিগত সুখ স্বপ্ন ইত্যাদি তছনছ করে দেই।
বলতেই পারেন, "আমিতো ওর ভালোর জন্যই করছি।"
তার আগে বলেন, আপনি নিজে কি খুব কষ্টে আছেন? আপনার চলছে না? তাহলে ওরও চলবে।
হ্যা, ছেলেকে অবশ্যই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাবো, অবশ্যই সব রসদ দিব, মোটিভেট করবো, টার্গেট সেট করে দিব, সবই করবো - কিন্তু অতিরিক্ত সাবধান থাকবো যেন ওর ফেইলোরে ওর এমন না মনে হয় যে ওর জীবন পুরোটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারেনি বলে আত্মহত্যা করে ফেলেছে এমন মেয়ে আমার পরিচিতের মধ্যেই আছে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, মেডিক্যাল ছাড়া কি দেশে আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না? এইভাবে মরে যেতে হলো?
কিন্তু ওর মনে তখন এইটাই গেঁথে আছে। ডাক্তার হতে না পারলে বেঁচে থেকে লাভ নেই।
আমি নিজে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছি? না। কিন্তু সন্তানকে সেটাই হওয়ার মিশন দিয়ে দিয়েছি। লজিক্যাল? মোটেই না। কিন্তু আমার জেদি মন আমাকে তখন বুঝাচ্ছে "হোসেন সাহেবের ছেলে যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে, আমার ছেলে কেন পারবে না?"
বাই এনি চান্স, যদি ঐ ছেলের বাপ বা মা আমার সামাজিক স্ট্যাটাসের নিচের কেউ হয়ে থাকে, তাহলেতো কথাই নেই। জেদের সাথে তখন ইগো এসে যুক্ত হবে।
"ওবামার মা ফুডস্ট্যাম্প নিয়ে (সরকারি সাহায্য, শুধু গরিবরাই পায় - ভদ্রভাষায় ভাতা বলতে পারেন, সরকারি ভিক্ষাও বলতে পারেন) যদি ওকে প্রেসিডেন্ট বানাতে পারে, আমার ছেলে কেন নয়?"
আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের ব্রেনের সব অংশ সবার সমানভাবে কাজ করেনা। কারোর স্মৃতিশক্তি মারাত্মক, কারোর উপস্থিত বুদ্ধি দারুন, কারোর ক্রিয়েটিভ লাইনে বুদ্ধি খেলে, কারোর কিছুতেই কিছু হয়না। কেউ মাইলের পর মাইল দৌড়াতে পারে, কেউ জন্মগত কারণেই হুইলচেয়ারে। এছাড়া নানান ক্যাটাগরির অটিজমতো আছেই। It's ok, আমরা সবাই আলাদা আলাদা বলেই আমাদের সবাইকেই সবার প্রয়োজন হয়। চিন্তা করেন, সবার বুদ্ধি সমান, সবাই ডাক্তার হয়ে গেছেন। ডাক্তারদের যখন বাড়ি বানাবার প্রয়োজন হবে, ইঞ্জিনিয়ার পাবেন কই? বা সবাই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলে অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাবেন কাকে দিয়ে? সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, তাহলে চাল ডাল মাংস ইত্যাদি কিনবে কোত্থেকে?
টাকা কামানোই যদি আপনার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলেতো আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েঞ্জারাই লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে। সেজন্যতো খুব বেশি শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভাল কন্টেন্ট ক্রিয়েট করতে পারলে লজ্জারও কিছু নেই।
সমাজে মান সম্মান ইজ্জতের কথা যদি বলেন তাহলে কোন জাতীয় ক্রিকেটার, কোন তুখোড় অভিনেতা, জেনুইন সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রেটি - সমাজে কি উনাদের ইজ্জত কম? সৎভাবে খেতে, কামাই করে নিজের সংসার চালিয়ে নিচ্ছে, অন্যের হক মারছে না, অন্যের কাছে হাতও পাতছে না - এরচেয়ে বেশি আর কিছুর কি প্রয়োজন আছে?
এই যে বাচ্চাগুলি মারা গেছে, এখন কি ওদের অভিভাবকদের কষ্ট হচ্ছে না? মনে হচ্ছে না যদি পড়ালেখা না করে গবেট হয়ে রিক্সাও চালাতো, তবুওতো বেঁচে থাকতো! আমার সব সন্তান আমার জানাজার নামাজ পড়ছে, আমাকে নিজ হাতে কবর দিচ্ছে, এরচেয়ে বেশি সুখ কি আর কোন বাবা মায়ের আছে?
তাই কিছুদিন পরেই যখন আমার চাইনিজ কলিগ আমাকে বলবে "আমার ছেলে আইভীলীগ গ্র্যাজুয়েট - তোমার ছেলে কোত্থেকে পাশ করেছে?"
আমার তখন সত্যটাই বলা উচিত "ও হাইস্কুলের পরে আর পড়াশোনা করতে পারেনি। ওর লেখাপড়ার ব্রেনই নাই। সারাদিন গিটার নিয়ে থাকে, মিউজিক ভালবাসে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা ব্যান্ড গড়ে তুলেছে। শুনেছি। কেউই তেমন আহামরি ট্যালেন্টেড না। ভবিষ্যৎ নেই। তবে ও সুখে আছে।"
বা তেমনই কিছু একটা বললাম যা আমার 'ব্যর্থ' ছেলে করছে।
কথাগুলো বলায় আমার কি ইজ্জত চলে গেল? কার কাছে গেছে? ইজ্জত যদি এতই অভিমানী হয়ে থাকে, তাহলে সে চলে গেলেই ভাল। আর কখনই যেন এমুখো না হয়। আমার কাছে এটাই ইম্পরট্যান্ট যে আমার সন্তান সুখে আছে, এবং বেঁচে আছে।
©somewhere in net ltd.