নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বহু যাযাবর লক্ষ্যবিহীন, আমার রয়েছে পণ\nরঙের খনি যেখানে দেখেছি, রাঙিয়ে নিয়েছি মন।

অপ্রত্যাশিত হিমু

অপ্রত্যাশিত হিমু › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনের সবথেকে বড় স্বীকৃতি হচ্ছে—আত্মস্বীকৃতি।

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৪৫

জন্মাবার পর ডাক্তার নাড়ী কাটতে এসে আমাকে দেখার পর মাকে বলেছিল, "মারে, তোর একটা রাজপুত্র হইছে! যেমন গাট্টাগোট্টা শরীর, তেমনি রঙ!"

বড় হওয়ার পর যখন মাকে এমন বলতে শুনি, তখন খুঁজি রঙটা গেল কই?! নিজের লিকলিকে হাতের দিকে আগে একবার চোখ মেলে দেখে নিই—লাউয়ের ডগাও এর থেকে মোটা হয়!

ঘৃণা হয় তখন আমার নিজেকে দেখে। পালাতে ইচ্ছে করে এই দেহ ছেড়ে। হীনমন্নতা ঘিরে ধরে।

নিজেকে ঘৃণা করতে করতে বড় হইছি।

আমি কম কথা বলতাম বলে লোকেরা আমাকে বলত, "মিটমিটে শয়তান।"

কেউ আবার আরও জঘন্য শব্দ বেছে নিত। আমাকে ক্ষ্যাপাত। আমার নামটা ধরে ডাকত না। নিজেদের পছন্দসই নাম ধরেই ক্ষ্যাপাত। মারত আমাকে। আমি ভয় পেতাম ওদের।

আমি কিচ্ছু পারি না। আর সবাই কত কিছু পারে।

আমাকে ওরা দেখিয়ে দিত আমি কী কী পারি না। কেউ আমাকে একবারও বলে নি, "তোর পাহাড় ভালো লাগে? পাহাড়ে যাবি?"

কেউ একটা বাঁশের বাঁশিও হাতে দিয়ে বলে নি, "এটাই ফুঁ দিবি, তবেই বাজবে।"

ওরা আমার দুর্বলতাগুলো দিয়েই আমাকে চিনত। আমি লুকিয়ে রাখতাম নিজেকে। কারো সামনেই আর যেতাম না।

আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম আমি এমন কেন? ওরা কেন এমন করে? আমাকে মারে কেন? ক্ষ্যাপায় কেন ওরা? আমি তো ওদের কিচ্ছু ক্ষতি করিনি! আমাকে কেন খারাপ নাম ধরে ডাকে? আমার খারাপ লাগে না শুনলে?

আমি লজ্জায় শুধু ওদের সামনেই না, আর কারো সামনেই যেতাম না। আমার একাকিত্ব ওরা রোজ রোজ বাড়িয়ে দিত।

আমার মনে হত ওরা যা বলছে ওটাই আমি। সত্যিই তো আমি তো কিছুই পারি নে। কি রোগা একটা শরীর! ঘেন্না করে সবাই আমাকে। আমিও নিজেকে ঘেন্না করি, ওই ওদের মতোই।

যাদের সাথে পড়তাম, সবাই পড়াশোনায় কত ভালো! কেউ স্কুলের ফার্স্ট বয়, কেউ সেকেন্ড! কত ভালো খেলে! ডিবেট করে, গান করে! কত স্মার্ট ওরা! আর আমি কেন কিছু পারি নে?

আমি সারা দুনিয়া হাতড়ে উত্তর খুঁজতাম।

তারপর একদিন কেউ যেন বহুদূর থেকে বলল, "Know Thyself." নিজেকে জানো। দুইটা শব্দ। কিন্তু খুব অদ্ভুত শোনালো। আগে কখনো শুনি নি।

আমি বললাম, "আমাকে বলে দাও কী করে জানব? আমি নিজেকেই তো জানতে চাই। আমাকে কেন ক্ষ্যাপাই ওরা? জানব আমি। বলে দাও।"

কিন্তু কিচ্ছু বলে দিল না। চলে গেল।

আমি উত্তর খুঁজছিলাম, কিন্তু পাই নি।

আর আরেকদিন বলল, "Be Yourself." তুমি তুমিই হও। আমি তো আমিই। তাই তো এত ঘেন্না নিজের উপর। আমি আর আমি হতে চাই নে।

কিন্তু গলা আরও মোটা করে সে বলল, "এতেই তোমার মুক্তি।"

আমি তখন বললাম, "তবে বলে দাও কি করে আমি আমিই হব! আমি সব শুনব। আমাকে বলে দাও।"

কিন্তু এবারও কিচ্ছু বলে দিল না। আমি চিৎকার করে উত্তর চাইলাম। আমাকে বলল না কিচ্ছু। যেমন এসেছিল তেমন চলে গেল।

দুচোখ বেঁয়ে কি তখন জল পড়ছিল আমার? কি জানি, মনে নেই।

আমিও জোরে দম নিয়ে বুক ফুলিয়ে ফোলা ফোলা ঠোঁটে তাকে শুনিয়ে দিলাম, "ঠিক আছে, ব্যাপার না। আমি নিজেই উত্তর খুঁজে নিব।"

আমি হাঁটতে লাগলাম। অনেক অনেক হাঁটলাম। হাঁটতে পারি আমি অনেক। পা ব্যথা হয় না। ব্যথা সব মনে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা গলিতে চলে এলাম। গলির মাথায় একটা ঘর। অন্ধকার। আমি হেঁটে হেঁটে গেলাম ওই ঘরের দুয়ারে।

দরজা হাট হয়ে খোলা আছে। ভিতরটা অনেক বড় মনে হল। কিন্তু খুব একটা আলো নেই। অনেকগুলো চোখ চারিদিকে। তারা হাসছে। মনে হল যেন এদের আমি চিনি।

আরে এরা তো তারাই যারা আমাকে ক্ষ্যাপাত! আমাকে মারত এরাই। হ্যাঁ, এরাই তো।

আমাকে না পেয়ে ওরা আবার কাউকে ক্ষ্যাপাতে শুরু করেছে?

দেখলাম সেই অন্ধকার ঘরের শেষ মাথায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কেউ একটা বসে আছে। একটা বাচ্চা ছেলে। ও কাঁদছে। ওর মুখ দেখি না কেন? ও কেন হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে আছে? ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

একবারও মুখ তুলছে না। আমি হেঁটে গেলাম ওর কাছে। ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। আমি ছাড়া এখানে আর কেউ নেই ওর। সবাই ওকে ক্ষ্যাপাচ্ছে। ওকে কি ওরা মেরেছে?

আমি ডাকলাম ওকে। শুনল না।

আমি ওর সামনে বসে পড়লাম। ওর মাথায় হাত দিলাম। তাও মুখ তুলল না। কাঁদছে তো কাঁদছে।

নিশ্চয় অনেক মেরেছে ওকে। অনেক ক্ষ্যেপিয়েছে। আর ও এখনো ভয় পাচ্ছে। পালাতে চাই ও?

আমি বললাম, "তুমি যাবে আমার সাথে?"

ও মুখ তুলল না। আমি আবারো বললাম, "ওরা আর মারবে না তোমাকে। আমি দেখব তোমাকে।"

এবার সে মুখ উঁচু করল। কি অদ্ভুত! কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো লাল টকটকে করে ফেলেছে। নাক মুখ এখনো ফোঁফাচ্ছে। ওর চোখ দুটো যেন চেনাচেনা লাগে।

ওই চোখে কি ভতর্সনা? আমি নিজেকেই পারি নে ওদের হাত থেকে বাঁচাতে। একে কী করে বাঁচাব?

ওর ওই চোখ ঠোঁট আমার কেন এত চেনাচেনা লাগে?? এ তো কত ছোট আর আমি কত বড়। আমি চাইলেই পারি ওকে বাঁচাতে। কিন্তু ওকে বুঝাই কী করে?

আমি বললাম, "আমার বন্ধু হবে?"

কি আশ্চর্য! উত্তর না দিয়ে ও খানিক হাসল। কি জ্বালাময়ী হাসি ওর! আমি চিনি এই হাসি। এই হাসি কার? এই হাসি কার?

আমি বললাম, "আর কেউ তোমাকে ক্ষ্যাপাবে না। আমি থাকতে কেউ কিচ্ছু বলবে না তোমাকে। তুমি ছুঁটে বেড়াবে তোমার ইচ্ছে মত। তুমি কবিতা বলবে। তুমি গল্প লিখবে। তুমি পাহাড়ে যাবে। তুমি চাইলে মরুভূমির দেশে পিরামিড দেখতে যাবে। তুমি সাগরের নীল দরিয়ায় অজানায় হারাবে। যাবে তুমি?"

ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আমাকে বিশ্বাস করে না ও। আমি যেন মরিয়া হয়ে বললাম, "আমি প্রতিজ্ঞা করছি কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না তোমায়। দেখো আমি কত বড়। কত শক্তি আমার।"

কি আশ্চর্য! আমি শব্দগুলো বলছি আর আমার দেহে মনে যেন ঠিক অতটাই শক্তি অনুভব করছি। কোথায় ছিল এরা এতদিন? আমি জানতামই না!

ও উঠে দাঁড়াল। একটা মলিন হাসি ওর মুখে। আমি ওর হাত ধরে হাঁটতে লাগলাম।

চারদিকে তাকিয়ে ওই হাসির মালিকদের বললাম, "তোমরা ওকে আর কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না। আমি ছাড়ব না তবে তোমাদের। তোমরা জানো না আমার কত শক্তি। তোমাদের ভাবনার বাইরে।"

ওই অন্ধকার ঘর ছেড়ে বাইরে পা বাড়ালাম। দু পা আরও সামনে দিতে দেখি আমার হাতে ওই বাচ্চাটার হাত নেই।

এই তো ছিল। কই গেল? পিছনে তাকিয়ে দেখলাম ওই ঘরটাও আর নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!

আমার বুকে খুব ভারী ভারী ঠেকতে লাগল। আর তারপরই বুঝলাম আমি উত্তর পেয়ে গেছি। সব উত্তর জেনে গেছি আমি।

জানেন ওই বাচ্চাটা কে ছিল? ও যে আমিই ছিলাম। আমার ভেতরের ছোট্ট বাচ্চাটা যে এতদিন ভয়ে কাঁপত। আর আমি চিনতেই পারি নি। ওর ওই লাল চোখ দুটো আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে আমি লড়তে পারি।

আমি নিজেকে দেখে এসেছি। লোকেদের ক্ষ্যাপানোর ভয়ে সারাক্ষণ ভীত থাকতাম আমি, ঠিক যেমন ওই বাচ্চাটা ভয়ে কাঁপছিল।

লোকেরা মারবে বলে আমি ওদের থেকে লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু আমি ওই বাচ্চাটাকে মার খেতে দিতে চাইনি। তবে এতদিন কী করে দিলাম?

আমি আবার হাঁটতে লাগলাম। চোখ বেঁয়ে দুফোঁটা জল কি পড়ল আমার? না, ওই বাচ্চাটার জন্য না, আমার নিজের জন্য?

আমি জোরে চিৎকার করে বললাম—আমি চিনে গেছি নিজেকে। আমি আমিই হব। আমি যা পারি না তা তোমরা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছ, উপকারই করেছ তোমরা আমার। এবার আমি তোমাদের দেখিয়ে দিব আমি কি কি পারি। আমি পিরামিডে যাব।

ওই না পারাগুলো আমি পাল্টাতে পারব না। ওটাই তো আমি। ওই না পারাগুলো নিয়েই আমার আমি তৈরি। আমি মেনে নিয়েছি আমাকে। আমি কুৎসিত? আমি ভয়ংকর? আমাকে তোমাদের ভালো লাগে না? আমি আর পরয়া করি নে তোমাদের।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২৫

রাজীব নুর বলেছেন: কঠোর হওয়া ভালো না।
সবাইকে ভালোবাসতে শিখুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.