নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রথো রাফি লেখালেখি গাণ্ডীব, অনিন্দ্য, শিড়দাঁড়া এবং দ্রষ্টব্যেই । মূলত কবিতা অন্তঃপ্রাণ তবে গদ্যও লিখেছি কিছু। অনুবাদেও আগ্রহ আছে। বই এখনো নাই। জন্ম: দক্ষিণ তারুয়া, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বসবাস ঢাকায়। প্রকাশনা সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ফ্রিল্যান্স কাজ করছি। [email protected]
সে-সময়ে নুড়ি পাথরের একটা গর্তের পাশেই থাকতাম আমরা। খুব একটা বড়ো না, দানবীয় যন্ত্র দিয়ে খোঁড়াটোরাও নয়, ছোট একটা গর্ত যা বানিয়ে কোন কৃষক হয়তো কিছু টাকা কুড়িয়েছে, বেশ কিছু বছর আগে। আসলে, গর্তটা এতোটাই অগভীর যে গর্ত খোঁড়ার অন্য কারণও থাকতে পারে বলে মনে হয়Ñ হয়তোবা বাড়ির ভিতটা গড়ে নেওয়া, যদিও বাড়িটা আর বানানো হয়নি।
আমার মা-ই জোর গলায় গর্তটার দিকে অন্যদের মানোযোগ টানতেন। ‘আমরা সার্ভিস স্টেশনের পুরোনো নূড়িপাথরের গর্তটার কাছেই থাকি,’ লোকজনকে বলতে পছন্দ করতেন তিনি, আর হাসতেন, কারণ তিনি বাড়িটার সাথে, রাস্তাটার সাথে-- স্বামীর সাথে-- আগে যে জীবন তিনি যাপন করেছিলেন তার সাথেÑ সবকিছুরই একটা যোগ তৈরি করে খুশি হতেন খুব। আমি বলতে গেলে খুব কমই মনে করতে পারি ওই জীবনটা। তার মানে, আমি ওই জীবনের কিছু কিছু অংশ বেশ পষ্টভাবেই মনে করতে পারি, তবে সংযোগসূত্রগুলো নয়, যা দিয়ে আপনি ছবিটা ঠিকঠাক দাঁড় করাতে পারতেন। শহরের বাড়িটার যেটুকু মনে করতে পারি তা হলো, আমার পুরোনো রুমের দেয়ালে টেডি বেয়ারের সাঁটানো পোস্টারটা। এই নতুন বাড়িতে, যা আসলেই একটা ট্রেইলার ছিলো, আমার আপু ক্যারো আর আমার চকচকে কোট ছিলো, একটা আরেকটার উপরে রাখা। আমরা যখন প্রথম উঠলাম ওখানে, আপু আমাদের পুরোনো বাড়িটা নিয়ে অনেক গল্প করতো, এটা ওটা আমাকে মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো। ঘুমোতে যাওয়ার সময়েই শে এভাবে কথা বলতো, আর প্রায়সময়েই আমাকে মনে করানোর ব্যর্থতা আর বিরক্তি নিয়ে ওর গল্প ফুরিয়ে আসতো। মাঝে মাঝে ভাবতাম, আমি বুঝি মনে করতে পারছি। তবে বৈপরিত্য তৈরি হওয়া কিংবা ভুল করার ভয়ে আমি মনে করতাম মনে করতে পারছি না।
ট্রেইলারে উঠে আসার সময়টা ছিলো গ্রীস্মের। আমাদের কুকুরটাও সঙ্গে ছিলো। ব্লিতজি। ‘ব্লিতজি এ জায়গাটা পছন্দ করে।’ আম্মুর কথাই ঠিক ছিলো। কোন্ কুকুর একবারে খোলা গ্রামদেশের তুলনায় শহরের রাস্তায় ছুটতে পছন্দ করে না, যেখানে কিনা এমনকি বড়ো বড়ো লন আর বড়ো বড়ো বাড়িও রয়েছে? মাদী কুকুরটা যে গাড়িটাই ওকে পার হয়ে যেতো তার প্রতিই ঘেউ ঘেউ করে উঠতো, আর কখনো কখনো বাড়িতে নিয়ে আসতো বেজি আর কোন গ্রাউন্ডহগ, যাদেরকে মারতে পারতো শে। প্রথম দিকে ক্যারো এ ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করতো, আর নিয়েল ওকে বোঝাতেন কাকুরের স্বভাব সম্পর্কে, ওদের জীবনচক্র সম্পর্কে, যে চক্রের ভেতরে কিছু কিছু জিনিসকে অন্য জিনিস খেয়েই বাঁচতে হয়।
‘কুকুরটা তার নিজস্ব খাবার পেয়েছে,’ ক্যারো যুক্তি দিলো। তবে নিয়েল বললেন ‘ধরো, ও পেলো না? ধরো আমরা সবাই একদিন হারিয়ে গেলাম এবং ওকে নিজের খাদ্য নিজেই খুঁজে নিতে হচ্ছে।’
‘আমিতো হারিয়ে যাচ্ছি না,’ ক্যারো বলতো, ‘আমিতো হারিয়ে যাচ্ছি না, আর আমি সবসময়েই এর দেখাশোনা করবো।’
‘তোমার কি তাই মনে হয়?’ বললেন নিয়েল, আম্মু এগিয়ে আসলেন ওনাকে থামাতে। নিয়েল সবসময়েই আমেরিকা আর এটম বোমা নিয়ে কথা পাড়তে মুখিয়ে থাকতেন। আর আমাদের মা সবসময়েই মনে করেন এ নিয়ে কথা বলার মতো বয়স আমাদের এখনো হয়নি। মা জানতেন না, কখন উনি এ প্রসঙ্গটি তুলেছেন, আমি ভেবেছিলাম উনি বুঝি একটা এটমিক বান নিয়েই আলাপ করছেন। আমি জানতাম, এ ধরনের ব্যাখ্যায় কিছুএকটা ভুল রয়েছে, তবে প্রশ্ন জিগ্যেস করার প্রস্তুতি ছিলো না আমার, আর হাসির পাত্র হতেও ইচ্ছে করছিলো না।
নিয়েল ছিলেন অভিনেতা। শহরে একটা পেশাদারী সামার থিয়েটার ছিলো একটা, সেই সময়ে এ বিষয়টা ছিলো নতুন, কেউ কেউ এ নিয়ে প্রসংশামুখর ছিলো আর অন্যরা এ নিয়ে শংকায় ভুগতো, এ হয়তো অভদ্রতার ভেতরেই গিয়ে পড়বে এমন একটা আশংকাও ছিলো তাদের। আমার মা আর বাবা থিয়েটারর সপক্ষের লোকজনই ছিলেন, আমার মা অনেক বেশি সক্রিয় ছিলেন, কারণ অনেক অবসর ছিলো তার। আমার বাবা ছিলেন একজন ইন্সসিউরেন্স এজেন্ট আর প্রচুর ঘুরে বেড়াতেন। ওই থিয়েটারেরই নানান ফান্ড সংগ্রহের স্কিম নিয়ে আমার মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং থিয়েটারের একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে খাটতেন। তিনি ছিলেন দেখতে সুন্দর আর বেশ তরুণ যাকে দেখামাত্র অভিনেত্রী ভেবে ভুল হয় অনেকেরই। মা একসময় অভিনেত্রীদের মতো সাজপোশাকও পড়তে লাগলেন। এ জন্য তিনি চাদর আর দীর্ঘ স্কার্ট আর দুলদুলানো নেকলেস পড়তে লাগলেন। চুল এলামেলো করে রাখতে শুরু করলেন, আর কোন ধরনের মেকাপ নেওয়াও বন্ধ করে দিলেন। অবশ্যই, আমি বুঝতে পারি নি, কিংবা এমনকি এ সময়েই বিশেষ পরিবর্তনটা চোখে পড়লো আমার। আমর মা-তো আমর মা-ই। তবে পরিবর্তনটা নিয়ে কোন সন্দেহই ছিলো না ক্যারোর। আর আমার বাবারও। যদিও, এসব ঘটনা থেকে থেকেই বাবার স্বভাবচরিত্র আর মাকে নিয়ে তার যে আবেগ সে-সম্পর্কে জানতে পারি। আমার মনে হয়, মাকে এসব বাঁধনহারা স্টাইলে কী সুন্দরই না দেখায় আর থিয়েটারের লোকজনের সাথে মা কী সুন্দরভাবেই না খাপ খাইয়ে নিয়েছেন ভেবে বাবা হয়তো গর্ব বোধ করতেন। পরে যখন এই সময়টা নিয়ে কথা বলতেন, তিনি বলতেন, শে সবসময়েই শিল্পের একটা প্রতিমূর্তি। এখন আমি কল্পনা করতে পারি, মা কতই না তিক্তবিরক্ত ছিলেন, কত সংকোচেই না থাকতেন আর মার থিয়েটার বন্ধুদের সামনে বাবা যখনই এই ঘোষণাটি দিতেন মা তার এই সংকোচ লুকিয়ে রাখতে কীভাবেই না হাসতেন।
যাইহোক, তারপরই ঘটনার একটা অগ্রগতি ঘটলো, যা আগেই দেখা সম্ভব ছিলো আর সম্ভবত তা-ই হয়েছিলো, তবে আমার বাবার পক্ষে তা দেখা সম্ভব ছিলো না। আমি জানি না, অন্য ভলান্টিয়ারদের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছিলো কিনা। আমি অবশ্যই জানি, যদিও তা আমি মনে করতে পারি না, আমার বাবা কেঁদেছিলেন আর সারাটা দিন বাড়িতে মায়ের পিছনে ঘুরঘুর করছিলেন, মাকে কোনভাবেই চোখের নাগালের বাইরে যেতে দিতে চাইছিলেন না, আর তাকে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করছিলেন। আর বাবাকে শান্ত করার জন্য কিছু বলার বদলে মা এমনকিছু বলছিলেন যাতে তিনি আরো কষ্ট পান। তিনি বাবাকে বললেন, শিশুটা নিয়েলের।
তিনি কি নিশ্চিত ছিলেন?
পুরোই নিশ্চিত। তিনি সবকিছুরই খেয়াল রাখছিলেন।
তারপর কী ঘটলো?
আমার বাবা কান্না বন্ধ করলেন। তাকে কাজের ডাকে বেরিয়ে পড়তে হলো। মা আমাদের সবকিছুই বেঁধেছেদে নিলেন আর যে ট্রেইলারটা নিয়েল গ্রামেরও বাইরের এলাকায় দেখতে পেয়েছিলেন, নিয়েলের সাথে থাকতে সেখানেই উঠে এলেন মা। এ ঘটনার পরে মা বলেছিলেন যে তিনিও কান্নাকাটি করেছিলেন। তবে মা এও বললেন, তিনি অনেক তরজতাজা অনুভব করছেন। হতে পারে এই প্রথম তার জীবনে সত্যিকারভাবে তরতাজা অনুভব করলেন। তিনি অনুভব করলেন যেনো তাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়েছে। তিনি আবার নতুন করে তার জীবন শুরু করলেন। তার রূপা আর পোরসেলিন আর যতো সাজসজ্জার জিনিসপত্র ছেড়ে গেলেন তিনি, এবং এমন কি বুককেসের বইগুলোও ফেলে গেলেন। তার এখন বাঁচা দরকার, পড়া নয়। ক্লসেটে ঝুলানো জামাকাপড়, শো-ট্রিতে রাখা তার হাইহিল জুতো ফেলে গেলেন। ড্রেসারে রাখা হীরের আংটি, তার বিয়ের আংটিটাও। নাইটড্রেসটাও তাদের ড্রয়ারেই ফেলে গেলেন। যতো দিন আবহাওয়া উষ্ণ রইলো, তিনি আক্ষরিক অর্থেই নগ্ন হয়ে গ্রামের ভেতর ঘুরে বেড়ালেন।
তাতেও কাজ হলো না, কারণ যখন তিনি এমন করতেন ক্যারো তার কোটের ভেতরে গিয়ে লুকোতো আর এমনকি নিয়েলও বলে দিয়েছিলেন যে, এইসব বিষয় নিয়ে ওনার কোন মাথা ব্যথাই নেই।
***
তিনি এসব বিষয়ে কী ভাবলেন? নিয়েল। তার দর্শনটা ছিলো, যেমনটা উনি পরে বলেছিলেন, যাই ঘটুক না কেন মেনে নিতে হবে।
সবকিছুই উপহার। আমরা দিই আর আমরা নিই।
এমন করে কথা বলা লোকজনকে আমার সন্দেহ হয়, তবে আমি বলতে পারি না যে, আমার সন্দেহ করার অধিকার আছে।
উনি আসলে সত্যিকার অর্থে কোন অভিনেতা ছিলেন না। উনি অভিনয়ের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলেন মাত্র, উনি বললেন, একে একটা পরীক্ষা হিসেবেই নিয়েছিলেন উনি। নিজেকে নিয়ে উনি কী করতে পারেন তাই খুঁজে দেখতে। কলেজে ওনার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে, ‘ওডিপাস রেক্স’ এর কোরাসের দলের একজন হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। উনি তা পছন্দও করেছিলেনÑ নিজেকে ছেড়ে দেওয়া, অন্যদের সাথে নিজেকে মিশ খেতে দেয়া। তারপর একদিন, টরেন্টোর রাস্তায়, এক বন্ধুর কাছে ছুটে গেলেন, যে কিনা ছোটশহরের এক নতুন থিয়েটার কোম্পানিতে নিজের জন্য গ্রীস্মকালীন চাকরি খুঁজছিলেন। উনি এ কাজে গেলেন, যেহেতু আর কোনো উপায় ছিলো না, আর চাকরি পাওয়ার ভেতর দিয়েই তা শেষ হলো, অন্যজন অবশ্য তা পায়নি। উনি বাঙ্কো বাজাবেন। সময়ে সময়ে তারা বাঙ্কোর ভূতকে দৃশ্যমান করে তুলবেন, কখনো তুলবেন না। সে-বার তারা একটা দৃশ্যমান সংস্করণ চাচ্ছিলেন। আর নিয়েল এর জন্য আকারে একেবারেই সঠিক একজন লোক ছিলেন। একবারেই নিখুঁত আকারের। একেবারেই নিখাঁদ একটা ভূত।
যাইহোক, উনি আমাদের শহরেই ঘূরে বেড়ানোর কথা ভাবছিলেন, আমার মা ওনাকে বিস্মিত হওয়ার আগেই। উনি এরইমধ্যে ট্রেইলারটা লক্ষ্য করেছেন। থিয়েটারটাকে আধুনিক করে তোলার মতো মিস্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিলো ওনার, যা বসন্ত পর্যন্ত তার কাজের ভেতরেই লক্ষ্য করা গেল। আর বহুদিনই বাকি ছিলো বসন্তের, ঠিক যতোদিন বাকি আছে বলে ভাবতে পছন্দ করতেন উনি।
ক্যারোর এমনকি স্কুল পরিবর্তনেরও দরকার হয়নি। নুড়িপাথরের গর্তটার পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তার ছোট গলিটার শেষ মাথা থেকে স্কুল বাস ওকে তুলে নিতো। গ্রামের ছেলেপেলেদের সাথে ওকে বন্ধুত্ব করতে হলো, আর কিছু বিষয় ব্যাখ্যাও করতে হলো বছর-আগের শহরের ছেলেপুলেদের কাছে। তবে কোন সমস্যায় পড়েছিলো বলে আমি কখনোই শুনিনি।
পথের পাশে সবসময়েই ব্লিতজি তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকতো।
মায়ের গাড়ি ছিলো না বলে আমি কিন্ডারগার্টেনে কখনোই যেতাম না। তবে অন্যকাউকে ছাড়া কাজ করতে অসুবিধা হতো না আমার। ক্যারো যখন ঘরে ফিরতো, ও হলেই আমার চলে যেতো। আর আমার মা প্রায়সময়েই একটা ফূর্তিফূর্তিভাবের মাঝে ডুবে থাকতেন। ওই শীতে তুষার পড়তে শুরু করলে, মা আর আমি একটা স্নোম্যান তৈরি করলাম আর তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘একে কি আমরা নিয়েল নামে ডাকতে পারি?’ আমি বললাম, ঠিক আছে। এরপর আমরা অনেক ঢিল ছুঁড়ে মারলাম ওটাকে ফানি করে তুলতে। তারপর ঠিক করলাম আমরা যখন নিয়েলের গাড়ি আসবে আমি ঘর থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে যাবো এবং স্নোম্যনটার দিকে হাত তুলে ওনাকে বলবো, ‘নিয়েল এখানে, এখানে নিয়েল!’ আমি তা করেছিলাম, তবে নিয়েল গাড়ি থেকে পাগলের মতো বেরিয়ে এলেন, আর আমাকে ইশারা করলেন, উনি দৌড়ে আমাকে পেরিয়ে যেতে পারবেন।
এ ছিলো দুর্লভ মুহূর্তগুলোর একটা যখন নিয়েল বাবা হিসেবে নিজের ভূমিকাটুকু পালন করেছিলেন।
শীতের ওইসব ছোট দিনগুলো আমার কাছে নিশ্চয় অদ্ভুত ঠেকে থাকবে। শহরে, আলো আসে সন্ধ্যা হলে। তবে শিশুরা এসব পরিবর্তনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে আমি আমাদের অন্য বাড়িটা নিয়েও ভাবতাম। আমি ওবাড়িটাকে পুরোপুরি মিস করতাম না, কিংবা ওখানে আবার বসবাস করতে চাইতামও না-- আমি ভেবে শুধু বিস্মিত হতাম, ওই বাড়িটা কোথায়-যে মিলিয়ে গেলো! নিয়েলের সাথে মায়ের সুখের সময় রাতের ভেতরেও গড়ালো। আমি যদি জেগে উঠতাম এবং বাথরুমে যেতে হতো আমার, মাকে ডাকতে হতো। তিনি আনন্দের সাথেই বেরিয়ে আসতেন, তবে তাড়াহুড়ো করে বের হতেন না, গায়ে কাপড়ের টুকরোটাকরা বা একটা স্কার্ফ জড়িয়ে নিতেনÑ সাথে একটা সুগন্ধ জড়িয়ে থাকতো, যার সাথে আামি পরিচিতই ছিলাম, যাকে আমি মোমের আলো আর সঙ্গীতের সাথে মিশিয়ে ফেলেছিলাম। আর ভালবাসার সাথে।
***
কিছু একটা ঘটেছিলো, তবে ততটা নিশ্চত নই, তবে আমি সে-সময়ে ততটা চেষ্টাও করি নি বিষয়টা বুঝতে। ব্লিতজি, আমাদের কুকুরটা, ততটা বড়ো নয়, তবে শে ততটা ছোটও নয় যে, ক্যারোর কোটের পকেটে এঁটে যাবে। আমি জানি না, কিভাবে এটা সম্ভব করলো ও, ক্যারো। একবার নয়, দুইদুইবার ঘটিয়েছিলো ব্যাপারটা। স্কুল বাসে ক্যারো তার কোটের ভেতরে কুকুরটাকে লুকিয়ে ফেললো, এবং তারপর, এটাকে নিয়ে সরাসরি স্কুলে যাওয়ার বদলে, ও ব্লিতজিকে আমাদের শহরের পুরোনো বাড়িটাতেই নিয়ে গেলো, বাড়িটা আসলে একটা ব্লকের চেয়েও কম দূরত্বে ছিলো। ওখানেই আমার বাবা কুকুরটাকে পেয়েছিলো, শীতকালীন রোয়াকের মাঝে, যেটা তালবদ্ধ ছিলো না, যখন ব্যাক্তিগভাবে তিনি তার লাঞ্চ সারতে বাড়িতে এসেছিলেন। বড়ো বিস্ময়ের বিষয়, ওখানে ও পৌছাতে পেরেছিলো, গল্পের ভেতরে একটা কুকুরের মতোই ও কিনা বাড়ি যাওয়ার পথটা খুঁজে পেলো। ক্যারো সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ ও অস্থির হয়ে ওঠেছিলো, আর দাবী করলো, সারা সকাল ও কুকুরটাকে ওখানে দেখেনি। তবে তখনই ও দেখার চেষ্টা আরেকবার করতে গিয়ে ভুল করলো, হতে পারে এক সপ্তাহ পর, আর এবারই, যদিও বাসে, কিংবা স্কুলে তাকে সন্দেহ করার কেউই ছিলো না, তবে মা ঠিকই ওকে সন্দেহ করলেন।
আমি মনে করতে পাারি না বাবাই ব্লিতজিকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন কিনা। ট্রেইলারে বাবাকে আমি কল্পনা করতে পারি না, বা ট্রেইলারের দরজায় কিংবা ট্রেইলারে আসার পথে তাকে আমি কখনো দেখেছি বলে কল্পনাও করতে পারি না। হয়তো নিয়েলই শহরের বাড়িতে গিয়ে থাকবেন আর ওটাকে কুড়িয়ে এনে থাকবেন। এর মানে কিন্তু এ নয় যে এটা কল্পনা করা আমার পক্ষে বুঝি বেশি সহজ।
সারাক্ষণই ক্যারো অসুখী ছিলো বা নানান ছক কষে বেড়াতো, এমনটা যদি বুঝিয়ে থাকি, তাহলে সেটাও সত্যটা নয়। যেমনটা আমি বলেছি, ও আমাকে এসব বিষয়ে কথা চালাতে বাধ্য করতো, রাতে, শোয়ার বিছানায়। তবে ও সবসময়েই এমনটা দাবী করতো তা নয়। খারাপ ব্যবহার করা তার ধাতে ছিলো না। ভালমানুষির ছাপ বজায় রাখার মতো দক্ষতা ওর প্রায় ছিলোই না। লোকে ওকে পছন্দ করছে তা দেখতে ও পছন্দ করতো; আপনি যাকে বলেন আনন্দফূর্তি তার আশায় রুমের ভেতরে কোলাহল করতেই বরং পছন্দ করতো। আমি যতোটা ভাবতাম তার চেয়ে বেশি ভাবতো ও।
আর মায়ের মায়ের পেছন পেছন সেই সবচেয়ে বেশি ঘুরঘুর করতো, এখন এমনটাই ভাবি আমি।
কুকুরটার সাথে ও কী করেছে তা নিয়ে কিছু খোঁজখবরও করা হয়ে থাকবে নিশ্চিত। আমার মনে হয় আমি এর কিছুটা মনেও করতে পারবো।
‘আমি একটা কৌশল হিসেবে তা করেছিলাম।’
‘তুমি কি তোমার বাবার কাছে যেতে চাও, থাকতে চাও তার সাথে?’
আমার বিশ্বাস তা জিগ্যাস করা হয়েছিলো, আর আমার বিশ্বাস ও না-ই বলেছিলো।
আমি ওকে কিছুই জিগ্যেস করিনি। ও যা করেছিলো তা আমার কাছে অবাক কিছু মনে হয়নি। সম্ভবত ছোট ছেলেপিলেদের বেলা এমনই করা হয়ে থাকেÑ অদ্ভুত ক্ষমতাধর বয়স্ক শিশুরা যা করে থাকেন, বিশেষ বা আলাদা কিছু মনে হয়নি।
***
একটা খুঁটির উপরে রাখা টিনের বাক্সে আমাদের মেইলগুলো জমা হতো, রোডের শেষমাথায়। আমি ও আমার মা প্রতিদিনই হেঁটে ওখানে যেতাম, বিশেষত যদি ঝড়ঝঞ্ঝা না থাকতো, যেতাম আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে তা দেখতে। আমার দিবাকালীন ঘুম থেকে ওঠার পরেই এটা করতাম আমরা। কখনো এটা ছিলো সারাদিনে একমাত্র আমাদের বাইরে যাওয়া। ভোরে, শিশুদের টেলিভিশন শো দেখতামÑ কিংবা আমি যখন দেখতাম, তিনি তখন পড়তেন। (তিনি বহুদিন যাবত এ অভ্যাস ছাড়তে পারেন নি।) লাঞ্চের জন্য আমরা কিছু টিনজাত খাবার গরম করে নিতাম। তারপর আমি ঘুমের ভেতরে তলিয়ে যেতাম, তিনি আরো কিছুক্ষণ পড়ার চেষ্টা করতেন। শিশুটা সহ তিনি তখন বেশ বড়োসরো আকারের হয়ে ওঠেছেন, শিশুটা তার পেটের ওদিক ওদিকে নড়েচড়ে উঠতো, তাই শিশুটিকে অনুভব করতে পারতা আমি। এর নাম ব্র্যান্ডি হওয়ারই কথা ছিলোÑ এরইমধ্যে ব্র্যান্ডিই হয়েও গিয়েছিলো সে-- হোক ও ছেলে কিংবা মেয়ে।
গলি ছাড়িয়ে একদিন আমরা যখন মেইলের খোঁজ করতে গেলাম আর মেইল বাক্স থেকে খুব একটা দূরে নয়, আমার মা তখনই আমাকে থামতে বললেন আর নিজেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
‘থামো,’ আমাকে বললেন তিনি, যদিও টু শব্দটিও করি নি আমি, কিংবা তুষাষের মধ্যে আমরা বুট দিয়ে শাফলিং গেমও খেলিনি।
‘আমাকে চুপ করিয়ে দিলে,’ বললাম আমি।
‘শশ, ফিরে আসো।’
‘আমরাতো মেইলটা পাইনি এখনো।’
‘কিচ্ছু ভেবো না। শুধু হাঁটো।’
তারপরেই আমরা ব্লিতজিকে খেয়াল করলাম, যে কিনা সবসময়ে আমাদের সাথে থাকতো, ঠিক সামনেই, না হয় পেছনে, সেখানে ও ছিলো না আর। রোডের বিপরীত পাশে, মেইলবাক্স থেকে কয়েক ফুট দূরে, আরেকটা কুকুরকে দেখতে পেলাম।
আমরা ঘরে ফেরামাত্রই মা থিয়েটারকে ফোন করলো, আমরা ব্লিতজিকে ভেতরে নিয়ে এলাম, ও আমাদের ফেরার অপেক্ষায় ছিলো। কেউ উত্তর দিলো না। তিনি স্কুলে ফোন করলেন। কাউকে অনুরোধ করলেন যেনো সে বাস ড্রাইভারকে বলে ক্যারোকে একেবারে ঘরের দরজায় নামিয়ে দিয়ে যায়। ঘটনা দাঁড়ালো, সে তা করতে পারবে না, গলিটাকে শেষবার পরিস্কার করার পর থেকে এখনো তুষার পড়ছে। তবে সে লক্ষ্যরাখবে যতোক্ষণ না ও ঘরে পৌঁছায়। ওই সময়ে কোন চিতার দেখা পাওয়ারই কথা নয়।
নিয়েল বলতে চাইলেন, ওখানে একটা চিতাও নেই, ছিলো না কখনো। আর যদিবা থাকেই, বললেন উনি, এটা আমাদের জন্য কোন বিপদেরই কারণ হবে না, যেহেতু শীতঘুমে ওটা সম্ভবত খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্যারো জানালো যে চিতাদের শীতঘুমের ব্যাপার নেই। ‘আমরা এ সম্পর্কে স্কুলে জেনেছি।’
আমাদের মা নিয়েলকে একটা বন্দুক আনতে বললেন।
‘তুমি কি ভাবো আমি বন্দুক যোগার করতে যাচ্ছি, আর ছুটে যাবো, আর খুবই দরিদ্র মা চিতাটিকে গুলি করবো, যে কিনা পেছনের ঝোপেঝাড়ে একদঙ্গল ছানাপোনার অধিকারী হয়েছে, আর তাদের প্রাণপণ রক্ষার চেষ্টা করছে, যেমন করে তুমি তোমারগুলোকেও রক্ষার চেষ্টা করছো?’ উনি শান্ত গলায় বললেন।
ক্যারো বললো, ‘মাত্র দুটো। ওরা একসাথে কেবল দুটো ছানারই জন্ম দেয়।’
‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমিতো তোমার মাযের সাথে কথা বলছি।’
‘তুমি তা জানো না,’ আমার মা বললেন। ‘তুমি জানো না ওটার কোনো ক্ষুধার্ত শাবকটাবক আছে কিনা।’
আমি কখনোই ভাবিননি মা ওনার সাথে এভাবে কথা বলেছেন।
উনি বললেন, ‘স্বাভাবিক হও। আমাদের একটু ভাবা দরকার। বন্দুক খুব ভয়ংকর একটা জিনিস। আমি যদি যাই, আর একটা বন্দুক যোগাড়ও করি, তাহলে আমি কী বলবো? যে ভিয়েতনাম তাহলে ঠিক? তাহলে আমিও বলা যায় ভিয়েতনামে গিয়েছিলাম?’
‘তুমিতো আমেরিকান কেউ নও।’
‘তুমি আমাকে রাগিও না।
কমবেশি এসব কথাই ওনারা বলেছিলেন। আর উনি কোন বন্দুক যোগাড়ে যাবেন না এমন কথাতেই আলাপ ফুরিয়ে গিয়েছিলো। আমরা আর চিতাটাকেও দেখতে পাইনি, যদি তা আদৌা চিতাই হয়ে থাকে। আমার মনে হয়, মা মেইল আনতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন, যাইহোক আমার এও মনে হয়, মা এতো মোটাসোটা হয়ে উঠেছিলেন যে এটা করা তার জন্য আর আরামদায়ক ছিলো না।
তুষার ভুজবাজির মতোই কমে গেলো। গাছগুলো তখনো পত্রহীন, নগ্ন, আর ভোরে ক্যারোকে তার কোট গায়ে দিতে বাধ্য করতো মা, তবে ও স্কুলের পরে ওর পিছনে তা হেঁচড়ে নিয়ে ঘরে ফিরতো।
মা বললেন শিশুটি সম্ভবত যমজ হবে। তবে ডাক্তার জানিয়েছিলেন, তা নয়।
যমজ কল্পনার পক্ষ নিয়ে নিয়েল বললেন, ‘খুবই, খুবই ভালো।’
‘ডাক্তারা কী জানে।’
নুড়িপাথরের গর্তটি তুষারগলা পানি আর বৃষ্টিতে টুইটুম্বুর হয়ে উঠলো। তাই ক্যারোকে এর পাড় ঘেষে তার স্কুল বাস ধরার পথে উঠতে হয়। এটা ছিলো একটা ছোট্ট হ্রদ, সুস্থির, আর পরিচ্ছন্ন আকাশের নিচে তা ঝলমল করতো। ক্যারো খুব একটা আশা না রেখেই জিগ্যেস করলো গর্তটাতে আমরা খেলতে পারি কিনা।
মা আমাদের এ নিয়ে কোনরকম পাগলামো করতে বারণ করেছিলেন। ‘এ নিশ্চিত বিশ ফুট গভীর হবে।’ বললেন তিনি।
নিয়েল বললেন, ‘দশ ফুটও হতে পারে।’
‘ঠিক পাড়ের কাছগুলোতে তাও হবে না।’
মা বললেন, হা নিশ্চয়ই তা ছিলো। ‘এ কেবল নিচে তলিয়ে গেছে।’ বললেন তিনি। ফর ফাক’স সেইক, সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যাওয়ার মতো ব্যাপার এটা নয় । এ থেকে শুধু দূরে থাকবে তোমরা।’
তিনি বেশ ঘনঘনই ‘ফাক’ কথাটা বলতে লাগলেন, নিয়েলের চেয়েও বেশি বেশি, আর অনেক বেশি রাগী গলায়। ‘আমাদের কুকুরটাকেও কি এ থেকে দূরে রাখবো?’ তাকে ও জিগ্যেস করলো।
নিয়েল বললেন যে, সেটা কোন সমস্যাই নয়। ‘কুকুররাতো সাঁতারই কাটতে পারে।’
***
এক শনিবার। ক্যারো খেয়াল করলো ‘বন্দুত্বপূর্ণ জানোয়ারটা’ আমার সাথেই আর মন্তব্য করলো যে একে নষ্ট করে ফেলছি। সোফায় বসে নিয়েল মিথ্যে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, মা ও তার যৌথ বিছানায় তা ফাঁশ হয়ে গেলো। উনি ওনার পছন্দের সিগারেট টানছিলেন, যেখানে কাজ করতেন ওখানে তা টানা সম্ভব ছিলো না, তাই সপ্তাহান্তের ছুটিতেই তা টানতে হতো। ক্যারো কখনো কখনো তাকে বিরক্ত করতো, অনুরোধ করতো ওকে একটা সিগারেট টেনে দেখার সুযোগ দিতে। একবার ওকে একটা সুযোগও দিয়েছেলেন উনি, তবে ওকে বলেছিলেন ও যেনো মাকে তা না বলে।
আমি ওখানে ছিলাম, যদিও, এমনটাই বললাম আমি।
চাপা উত্তেজনা ছিলো, যদিও তা ততটা চেঁচামেচি ছিলো না।
‘তুমি কি জান, এখানে দ্রতই ওসব শিশু ওনার হবে.’ আমাদের মা বললেন, ‘আর কখনোই না।’
‘আর কখনোই নয়,’ নিয়েল একমত হলেন।
‘তাহলে, কী এসে যায় উনি যদি ওদেরকে কি বিষ কি রাইস ক্রিসপির গুমুতও খাওয়ায়?’
প্রথম দিকে আমরা বাবার দেখা পাইনি একেবারেই। তারপর, খ্রিস্টমাসের পর, শনিবারের দিনগুলোর জন্য পরিকল্পনা আঁটা হতে থাকলো। মা আমাদেরকে সবসময়ে জিগ্যেস করতো, আনন্দপূর্ণ একটা সময় আমরা কাটাতে চাই কিনা। আমি সবসময়েই বলতাম হ্যাঁ। আর আমি তা-ই বোঝাতে চাইতাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম যদি মুভি দেখতে চাই, কিংবা হিউরন হ্রদে ঘুরতে যাই, কিংবা কোন রেস্তোরায় খেতে যাই, তার মানেই হলো আনন্দপূর্ণ সময় কাটানো। ক্যারোও তা-ই বলতো, তবে এমন একটা ভঙ্গিতে যার মানে হলো, এটাতো আমাদের কারো মায়েরই মাথা ব্যথার বিষয় নয়। তখন আমার বাবা কিউবা গেলেন শীতের ছুটিতে ( আমার মা এ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন বেশ বিস্ময়ের সাথেই, হতে পারে সমর্থন দানই) আর ফিরলেন দীর্ঘ জ্বরজারি নিয়ে, যা তার ঘুরতে যাওয়াটাকেই বাদ দিতে বাধ্য করে। বসন্তে আবার যাত্রা করা হতে পারে বলে অনুমান করা হলো, তবে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি।
টেলিভিশনটা বন্ধ করার পর, ক্যারো আর আমাকে বাইরে ছুটাছুটি করতে যেতে দেয়া হলো, যেমনটা মা বলেছিলেন, যাও খোলা হাওয়ায় ঘুরে আসো। আমরা কুকুরটাকেও সাথে নিয়েছিলাম।
যখনই ঘর থেকে বের হলাম, প্রথমেই আমরা স্কার্ফগুলো খুলে ফেললাম, যেগুলো মা আমাদের গলায় পেঁচিয়ে দিয়েছিলেন, আর এগুলোকে মাটিতে হেঁচড়াতে দিলাম। (ঘটনা হলো, যদিও আমরা হয়তো দুটো বিষয়কে এক করে দেখিনি, তার গর্ভধারণের পর দিন যতোই পার হচ্ছিলো ততই সাধারণ একজন মায়ের মতো আচরণ করার দিকেই ঝোঁকছিলেন তিনি। অন্তত, স্কার্ফের ব্যাপারটা নিয়ে যদি ভাবি, এগুলোর আর দরকার হতো না কিংবা আমাদের নিয়মিত খাওয়ারও দরকার হতো না। তবে হেমন্তে যেমন হওয়ার কথা ঠিক ততটা এলোমেলো হয়ে উঠার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়নি তা।) ক্যারো আমাকে জিগ্যেস করলো আমি কী করতে চাই, আর আমিও বলেছিলাম, জানি না। ওর দিক থেকে তা ছিলো একটা বলার জন্য বলা, আর আমার দিক থেকে তা ছিলো একেবারে সত্য কথা। যাইহোক, কুকুরটাকেই আমাদের পথ দেখানোর সুযোগ করে দিলাম, আর ব্লিতজির ইচ্ছে ছিলো সামনে এগিয়ে যাওয়া আর নুড়িপাথরের গর্তটাতে উঁকি দেওয়া। বাতাস পানির উপরদেশকে চাবকে ছোটছোট ঢেউয়ে রূপ দিচ্ছিলো। আর দ্রতই আমাদের ঠাণ্ড লাগতে শুরু করলো, তাই স্কার্ফগুলো গলায় জড়িয়ে নিলাম আবার।
ডোবাটার পাড় ঘেষে আমরা কতক্ষণ ঘুরাঘুরি করেছিলাম আমাদের মনে নেই, কারণ জানতাম যে আমাদেরকে ট্রেইলার থেকে দেখা যাবে না। কতক্ষণ পর, আমি বুঝতে পারলাম যে আমাকে কিছু নির্দেশ মানার কথা বলা হচ্ছে।
আমাকে ট্রেইলারে ফিরে যেতে হয়েছিলো, মা আর নিয়েলকে কিছুএকটা বলতে হলো।
কুকুরটা-না পানিতে পড়ে গেছে।
কুকুরটা পানিতে পড়ে গেছে, আর ক্যারো ভয় পাচ্ছে ও হয়তো ডুবেই যাবে।
ব্লিতজি। ডুবে গেছে।
ডুবে গেছে।
আসলে ব্লিতজি পানিতে ছিলো না।
ওটা ডুবতেই পারে। আর ওটাকে বাঁচাতে চেয়ে ক্যারো ঝাঁপিয়ে পড়তেই পারে।
আমার বিশ্বাস, আমার এখনো কিছু দ্বিমত আছে, যে বিষয়গুলোর সাথে তিনি একমত ছিলেন না, আপনিও না, এ ঘটতে পারে, তবে তা ঘটেনি। আমি এও স্বরণ করতে পারছিলাম, নিয়েল বলেছিলেন, কুকুররা ডুবে না।
যেমনটা আমাকে বলা হয়েছিলো ঠিক তাই করতে ক্যারো আমাকে নির্দেশ দিলো।
কেন?
আমি হয়তো তা বলেছিলাম, কিংবা ওসবকিছু না মেনেই ওখানে আমি কেবল দাঁড়িয়েই ছিলাম, আর ধীরস্থিরভাবে অন্যকোন বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করছিলাম।
আমার মনের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি ব্লিতজিকে ও টেনে নিচ্ছে এবং ওটাকে ছুঁড়ে দিচ্ছে, যদিও ব্লিতজি চেষ্টা করছে তার কোট আঁকড়ে থাকতে।
তখন উৎসাহিত করার পর, ক্যারো উৎসাহিত হলো পানির দিকে ছুটে যেতে। ছুটাছুটি, ঝাপঝাপি, এরইমধ্যে হঠাৎ ও নিজেকে পানিতে ছুঁড়ে দিলো। তবে তারা যখন পানিতে পড়লো, একের পর আরেকজন, তখন পানি ছিটকে ওঠার যে শব্দটা হয়েছিলো তা আমি মনে করতে পারি না। ছোট আকারের কি বড়ো আকারের, কোনটার ঝপাৎ-শব্দই মনে করতে পারি না। বস্তুত ততক্ষণে আমি ট্রেইলারের দিকে ফিরে গিয়েছিÑ আমি অবশ্যই এমনটাই করেছিলাম।
যখন আমি এর স্বপ্ন দেখি, আমি সবসময়েই ছুটতে থাকি। আর আমার স্বপ্নে ট্রেইলারের দিকে আমি ছুটি না, বরং ফিরে নুড়িপাথরে গর্তটার দিকেই ছুটে যাই। আমি দেখতে পাই ব্লিতজি এদিক ওদিক ঝাঁপটাচ্ছে, আর ক্যারো ওটার দিকে সাঁতরে চলেছে, তোড়জোড় করে সাঁতার কাটছে, ওটাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। আমি তার হালকা বাদামী চেকের কোটটা দেখতে পাই, আর চেকের স্কার্ফটা, আর তার সফল গর্বিত মুখটা, আর লালচে চুলগুলো যাদের বাঁকখাওয়া শেষমাথা জলের স্পর্শে এসে ঘন কালো হয়ে আছে। যা আমার করা দরকার তা হলো, দেখে চলা আর খুশি হওয়া-- আমার আর কিছুই করার ছিলো না, আসলেই।
আমি আসলেই যা করেছিলাম, ট্রেইলারের দিকে একটু বাঁক নিয়েছিলাম। আর যখন সেখানে পৌঁছালাম, আমি বসে পড়লাম। যেনো ওখানে আরেকটা রোয়াক বা বেঞ্চ রয়েছে, যদিও আসলে ট্রেইলারে এসবের কিছুই নেই। আমি বসে পড়লাম, আর পরে কী ঘটে তার অপেক্ষায় রইলাম।
আমি তা জানতাম, কারণ তা একটা বাস্তব ঘটনা। যাইহোক, আমার পরিকল্পনাটা কী ছিলো, কিংবা আমি কী-বা ভাবছিলাম তা আমি জানি না। আমি অপেক্ষা করছিলাম, হয়তো নাটকের পরবর্তী অংকটা দেখতে, ক্যারোর নাটকের। কিংবা কুকুরটার। আমি জানি না আমি ওখানে মিনিট পাঁচেক বসেছিলাম কিনা। এর বেশি? কম? খুব একটা ঠাণ্ড ছিলো না।
আমি একবার এ বিষয়ের একজন পেশাদার লোকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম এবং মহিলাটি আমাকে বোঝালোÑ একবার, শে বোঝাতে পারলোÑ আমি অবশ্যই ট্রেইলারের দরজাটাই খোলার চেষ্টা করছিলাম। আর দেখতে পেয়েছিলাম ওটা তালাবদ্ধ। তালাবদ্ধ কারণ নিয়েল এবং আমার মা সঙ্গম করছিলেন ভেতরে, আর কোন ধরনের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে তাই দরজাটা বন্ধ করে রেখেছিলেন। আমি যদি দরজায় কড়া নাড়তাম ওনারা হয়তো রাগ করতেন। কাউন্সেলর আমাকে এমন একটা উপংসহারে নিয়ে আসতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। আর আমিও তুষ্ট। তবে অল্প সময়ের জন্যই। তারপর আমি তা আর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি ভাবতেই পারি না, ওনারা দরজাটা তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। কারণ একবারতো ওনারা দরজা বন্ধ করেননি, আর ক্যারোওতো ভেতরে গিয়েছিলো, আর ওর মুখের দিকে চেয়ে হাসাহাসিও করেছিলেন ওনারা।
হয়তোবা নিয়েল বলেছিলেন, কুকুররা পানিতে ডুবে না। যার অর্থ ক্যারোর কুকুরটাকে উদ্ধার করারই প্রয়োজন নেই। তাহলে ও নিজেই ওর খেলাটা সেরে উঠতে পারে নি। কত কত খেলা, ক্যারোর সাথে।
আমি কি ভেবেছিলাম ও সাঁতার কাটতে পারে? নয় বছর বয়েসে, অনেক ছেলেমেয়েই সাঁতার কাটতে পারে। আর আসলে এর মানে হলো গ্রীস্মের আগে ও একটা উপদেশ পেয়েছিলো, তবে তখনইতো আমরা ট্রেইলারে চলে এসেছিলাম, তারপর আর কোন নির্দেশই ও পায়নি। ও হয়তো ভেবে থাকতে পারে, ও ঠিকঠাকই চালিয়ে যেতে পারবে নিজেকে, আর আমিও হয়তো ভেবেছিলাম, ও যাই চাক না কেন তা ও করতে পারবে।
কাউন্সেলর ইঙ্গিত করলেন, আমি হয়তো ক্যারোর নির্দেশ পালন করতে করতে অসুস্থই হয়ে পড়েছিলাম, তবে এ চিন্তাটা আমার মাথায়ও এসেছিলো। যদিও, এ চিন্তাটা মনে হয় না ঠিক। আমি যদি বড়ো হতাম, হয়তো ঠিক হতো। ওই সময়টাতে, আমার জগতটাকে পূর্ণ করে তুলতে তখনোতো আমি ওকেই চাইতাম।
কতক্ষণ আমি ওখানে বসেছিলাম? বলা যায়, বেশিক্ষণ না। এও হতে পারে, আমি কড়া নেড়েছিলাম। কয়েক মুহূর্ত পরে। এক বা মিনিট দুই। যেটাই হোক, আমার মা, কোন কারণে, দরজাটা খুলেছিলেন, কোন কারণ ছাড়াই। একটা অনুভূতি আর কি।
পরের ঘটনা, আমি ভেতরে ঢুকলাম। আমার মা নিয়েলকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, চেষ্টা করতে লাগলেন কিছুএকটা বোঝাতে। উনি উঠে দাঁড়ালেন। আর ওখানেই দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে কথা বলতে লাগলেন, খুব আলতো করে, খুবই যতœ করে মাকে ধরলেন, আর অনেক শান্তনা দিলেন। কিন্তু মা-তো সেসবের কিছুই চাচ্ছিলেন না, আর ওনার কাছ থেকে সরে গিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন, আর দরজাটা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। উনি মাথা নাড়াতে লাগলেন, ওনার খালি পায়ের দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ওনার বিশাল আর দেখতে-অসহায় পায়ের পাতাগুলোর দিকে।
আমি মনে করি, উনি ওনার গলায় একটা অস্পষ্ট দুঃখের গুঞ্জরন তুলে আমাকে কিছুএকটা বলেছিলেন। অবাকই লাগছিলো।
এর বাইরে আর কিছুই বলতে পারছি না আমি।
****
আমার মা নিজেও জলে ঝাপিয়ে পড়লেন না। তিনি এই আঘাতে লেবারের পেইনেও চলে যাননি। আমার ভাই, ব্রেন্ট, অন্ত্যেষ্টীর এক সপ্তাহ কি দশদিন না পেরোনো পর্যন্ত জন্মায় নি, আর সে ছিলো গর্ভের পুরো মেয়াদ শেষ করা একটা শিশু। জন্মের জন্য অপেক্ষা করতে তিনি কোথায় ছিলেন আমি জানি না। আসলে, তাকে হয়তো কোন হাসপাতালেই রাখা হয়েছিলো, আর এ ঘটনার প্রেক্ষিতে তাকে যতোটা সম্ভব ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিলো।
আমি অন্ত্যেষ্টির দিনটা বেশ ভালো করেই মনে করতে পারি। খুবই স্নিগ্ধ আর আয়েসি এক মহিলা, আমি জানতাম না-- তার নাম জোসি-- আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেলো। আমরা দোলনাতে চড়লাম আর একধরনের ডলস হাউজ, ভেতরে ঢোকার পক্ষে তা আমার জন্য যথেষ্ঠই বড়ো ছিলো, তার ভেতরে ঘুরে দেখলাম, আর আমার পছন্দের লাঞ্চও খেয়েছিলাম, তবে তা আমাকে অসুস্থ করার জন্য পরিমাণে যথেষ্ট ছিলো না। জোসিকে আমি পরে বেশ ভালো করেই জেনেছিলাম।
তিনি ছিলেন বাবার বন্ধু, কিউবাতে তার সাথে বন্ধুত্ব হয়, আর ডিভোর্সের পরে, তিনি আমার সৎমায়ে পরিণত হন, তার দ্বিতীয় স্ত্রীতে। আমার মা সেরে উঠলেন। তাকেতো সেরে উঠতেই হতো। ব্রেন্টকে দেখাশোনার জন্য তাকে দরকার ছিলো আর, অধিকংশ সময়েই, আমাকেও। আমি বিশ্বাস করি, যখন তিনি এই বাড়িতেই আবাস গাড়লেন, আর বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দেয়ার কথা ভাবলেন, তখন থেকে বাবা আর জোসির সাথেই আমি থাকতাম। ব্রেন্ট তার উঁচু চেয়ারে বসার মতো যথেষ্ট বড়ো না হওয়া পর্যন্ত ওর সাথে আমার থাকার বিষয়টা আমি অবশ্য স্মরণই করতে পারি না।
আমার মা থিয়েটারে তার পুরোনো দায়িত্বে ফিরে গেলেন। প্রথম দিকে তিনি হয়তো আগে যেমন ছিলেন তেমনভাবেই কাজ করছিলেন, একজন ভলান্টিয়ার হিসেবে, তবে আমার স্কুলে পড়ার সময়টাতে তিনি একটা সত্যিকারের চাকরিও পেয়েছিলেন, বেতনসহ, আর বছর ব্যাপী দায়দায়িত্বও ছিলো তার। তিনি ছিলেন বাণিজ্য ব্যবস্থাপক। অনেক উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে থিয়েটারটাও টিকে গেলো, আর ওটা চলছে এখনো ।
নিয়েল অন্ত্যেষ্টিতে বিশ্বেস করতেন না, তাই তিনি ক্যারোর অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। তিনি কখনোই ব্রেন্টকে দেখেননি। তিনি একটা চিঠি লিখলেন-- আমি এটা অনেক অনেক পরেই কেবল দেখতে পেয়েছিলাম-- বলা হলো, যেহেতু বাবা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন না উনি, সেহেতু শুরুতেই ওনার আত্মসমর্পন করা ভালো। আমি কখনো ব্রেন্টকে ওনার কথা বলিনি, কারণ, ভাবতাম যে তা হয়তো মাকে আশাহতই করবে। তাছাড়া ব্রেন্টও বলা যায় এককেবারেই ওনার মতো হয়নি-- নিয়েলের মতো-- আর মনে হতো, আসলেই, অনেকটাই আমার বাবার মতো, আমি সত্যিই ভাবতাম, মায়ের গর্ভধারণ করার এই সময়টার মধ্যে এমন কী ঘটলো। আমার বাবাও কখনো কিছু বলেননি এ নিয়ে, আর বলবেনও না। তিনি ব্রেন্টের সাথে তেমন আচরণই করেন যেমন আমার সাথে করে থাকেন। তবে তিনি তেমন ধরনেরই লোক যে কোন না কোনভাবে এ কাজটা করবেনই।
বাবা আর জোসির কোনো ছেলেপিলে ছিলো না। তবে আমি মনে করি না, এ নিয়ে তাদের কোনরকম মাথাব্যথা ছিলো। জোসিই একমাত্র লোক যে কিনা ক্যারোকে নিয়ে কথা পাড়তো, আর এমনকি তা নিয়ে যে প্রায়ই কথা পাড়তো তা অবশ্য নয়। তিনি অবশ্যই বলেছিলেন, বাবা আমার মাকে দায়িত্বশীল করে তোলেননি। তিনি বলেছিলেন, যখন আমার মা তার জীবনে আরো সুখ চেয়ে উড়তে চাইছিলেন, তখন তার উচিত ছিলো মাটিতে নিজের পা-ধরে রাখা। তার প্রয়োজন ছিলো একটা ঝাঁকি খাওয়া, দরকার ছিলো, আর তিনি একটা ঝাঁকুনিও খেলেন। এ নিয়ে দুঃখিত হয়ে কোন লাভই নেই। এই ঝাঁকুনি খাওয়া ছাড়া, তিনি কখনোই জোসির দেখা পেতেন না, আর তাদের দুজনে এখন এতোটা সুখীও হতে পারতেন না।
‘কোন দুইজন?’ আমি হয়তো বলে ফেলতাম, বাবাকে বিভ্রান্ত করতেই, আর তিনিও তখনি বলতেন, ‘জোসি, অবশ্যই জোসি।’
আমার মাকে তখনকার সময়টা নিয়ে স্মরণ করানো সম্ভব নয়, আর আমি এসব নিয়ে তাকে বিরক্তও করতে চাই না। আমি জানি, গলির যেখানে বাস করতাম আমরা, সেখানেই চলে গিয়েছিলেন তিনি, আর দেখতে পেলেন জায়গাটা কেমন বদলে গেছে। এখন যেসব প্রচল বাড়িঘর দেখতে পান, অফলা জমিজমার উপরেই এসব গড়ে উঠেছে। মা তা উল্লেখ করলেন একটু হতাশার সুরেই, এসব বাড়িঘরই তার এ মেজাজটা গড়ে দিয়েছে। আমি নিজেও গলিটার শেষ মাথাটাতে গিয়েছিলাম, আর কাউকেই তা বলিনি। বাজে যা কিছুই পরিবারে ঘটুক এইসব দিনে, আমার মনে হতো একটা ভুল হচ্ছে কোথাও।
এমনকি নুড়িপাথরের গর্তটা যেখানে, এখন সেখানেও একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার নিচের অংশটাও ভরাট করা হয়ে গেছে।
আমার একজন পার্টনার আছে, রুথান, যে কিনা ছোট্ট আমার চেয়ে, তবে আমি ভাবি, শে আমার চেয়েও কিছুটা বুদ্ধিমান। কিংবা আমার ভুতটা তাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে অন্তত বেশি আশাবাদী শে। আমি কখনোই নিয়েলের নাগাল পাবো না, নাগাল যদি না-ই পাই, এর কারণ আসলে ওটারই প্রভাব। অবশ্যই, দীর্ঘদিন ধরে আমার কোন উপায়ই ছিলো না ওনাকে নাগাল পাওয়ার, আর পাওয়ার চিন্তাও আমার মাথায় ছিলো না। উনিই শেষপর্যন্ত আমার কাছে লিখলেন। অভিনন্দন জানিয়ে ছোট্ট একটা নোট, বললেন, এলামনাই গেজেটে আমার ছবি দেখার পরই এটা লিখেছেন। এলামনাই গেজেটে চোখ বুলিয়ে উনি কি দেখেছিলেন তা আমি অনুমানও করতে পারিনি। আমি শুধু ওইসব একাডেমিক একটা অনার্স অর্জন করেছি, সীমিত লোকজনের মাঝেই তা কোন অর্থ বহন করে, এদের বাইরে বলা যায় এ কোন তাৎপর্যই বহন করে না।
উনি বড়জোড় পঞ্চাশ মাইল দূরে থাকতেন। যেখানে আমি পড়াতাম, সেখান থেকে। আমি যেখান থেকে কলেজে যেতাম সে জায়গা থেকেও একই দূরত্বে। আমি অবাক হতাম, উনি হয়তো সেসময়ে ওখানেই ছিলেন। খুব কাছে। ওনার কি কোন স্কলার হয়ে উঠেছিলেন?
ওই নোটটার উত্তর দেয়ার ইচ্ছে প্রথম দিকে আমার ছিলো না। তবে রুথান বললো, আমার উত্তর দেয়ার কথা ভাবা উচিত। তারই পরামর্শের ফল, আমি ই-মেইল পাঠালাম একটা। আর ব্যবস্থাও নেয়া হলো। ওনার শহরে ওনার সাথে আমাকে দেখা করতে হলো, ইউনিভার্সিটি ক্যাফেটেরিয়ার মতো নিরাপদ একটা পরিবেশে। আমি নিজেকে বললাম, যদি ওনাকে অসহ্য মনে হয়-- আমি ঠিক জানতাম না এর কী মানে করবো-- আমি শুধু এ ব্যাপারটার দিকে এগিয়েই যেতে পারতাম।
উনি সাধারণত যতোটা খাটো ছিলেন, তার চেয়েও খাট হয়ে গেলেন, পরিণত বয়সে এসে, ছোটকাল থেকেই আমরা যা ওনার সম্পর্কে স্মরণ করতে পারি আরকি। ওনার চুল পাতলা হয়ে গেছে, আর ওনার মাথার চারপাশে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। উনি আমাকে এক কাপ চা খাওয়ালেন। উনিও চা খাচ্ছিলেন।
জীবন ধারণের জন্য কী করেন উনি?
উনি বললেন, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে উনি ছাত্রদের নির্যাতন করে থাকেন। এছাড়া, ওদের রচনাসূহ লিখতেও সহায়তা করেন। কখনো কখনো, আপনি হয়তো বলবেন, উনিই ওসব রচনাগুলো লিখে দেন। অবশ্যই, তিনি একটু রেগে গেলেন।
‘এ মিলিয়নিয়ার হওয়ার কোন পথই নয়, তোমাকে নিশ্চিত করেই তা বলতে পারি।’
উনি একটা পরিত্যক্তস্থানে বসবাস করতেন। কিংবা আধো পরিত্যাক্ত কোন এক জায়গাতেই। উনি তা-ই পছন্দ করতেন। সালি এনে তিনি পোশাকের সন্ধান করতেন। তাও ঠিকই ছিলো।
‘আমার আদর্শের সাথে বেশ মানায়।’
আমি তাকে এর কোনটার জন্য অভিনন্দন জানাইনি। তবে, সত্য বলতে কি, আমার বিশ্বাস হয় না, উনি আমাকে আদৌ দেখার আশা করেছিলেন।
‘যাইহোক, আমি মনে করি না আমার জীবন-যাপনের ধরনটাও আকর্ষণীয় কিছু। আমি ভাবছি, তুমি হয়তো জানতে চাও ঘটনাটা কীভাবে ঘটলো আসলে।’
আমি বুঝতে পারছিলাম না কিভাবেইবা এ কথাটা ওনার কাছে পাড়বো।
‘আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম,’ বললেন তিনি, আর, তার ওপর, আমি সাঁতার জানা কেউ নই। আমি যেখানে বেড়ে উঠেছি সেখানে-যে অনেক সুইমিংপুল ছিলো তা নয়। আর আমিও কিন্তু তাহলে ডুবে মারতাম। এইটাই কি তুমি জানতে চাও না?’
আমি বললাম, আমি যাকে নিয়ে ভাবছি উনি সেই লোক নন।
তারপর তিনি তৃতীয় কেউ হয়ে দাঁড়ালেন, যাকে জিগ্যেস করলাম, ‘ক্যারোর মনেইবা কী ছিলো বলে আপনি মনে করেন?’
কাউন্সেলরতো বলেছিলেন, আমরা তা জানতে পারবো না। ‘যেমনটা ও নিজেও জানতো না, জানতো না কী ও চাইতো। মনোযোগ কাড়া? আমি মনে করি না ও নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিলো। ওর কতটা মন খারাপ হয়েছিলো তার প্রতিই কি মনোযোগ কাড়তে চাওয়া?’
রুথান বললো, ‘ও যা চায় তা তোমার মা মেনে নিক, তাই চাইছিলো কি? তোমার মা আরো সাজুগুজু হয়ে উঠুক, আর তোমার বাবার কাছেই ফিরে যাক?’
নিয়েল বললেন, ‘এ কোন ঘটনাই নয়। হয়তো ও ভেবেছিলো, ও যতোটা পারতো তার চেয়েও বেশি জোরে ছুটাছুটি করতে পারবে। হয়তো ও জানতো না অতি-শীতের কাপড়চোপড় কীভাবেইবা পাওয়া যেতে পারে। কিংবা কেউ হয়তো সামনে ছিলো না ওকে সাহায়্য করার।’
উনি আমাকে বললেন, ‘তোমার সময়টা অপচয় করো না। তুমি ভাবছো না তাড়াহুড়ো করে আর এসব বলে আসলে কী হবে, ভাবছো কী? নিজেকে দোষী করার চেষ্টা করো না কি?’
আমি বললাম, উনি যা বলছেন আমি তা ভেবে দেখেছি, তবে তা নয়।
‘আসলে সুখী হওয়াই ব্যাপার,’ উনি বললেন। ‘তা যাই হোক না কেন। চেষ্টা অন্তত করো। তুমি পারবে। তা ক্রমেই সহজ থেকে সহজতর হয়ে আসবে। পরিস্থিতি নিয়ে কিছুই করার থাকে না। তুমি বিশ্বেস করতেই পারবে না, এ কতটা ভালো। সবকিছু মেনে নাও, আর তাহলেই দুঃখ দূর হয়ে যাবে। বা দুঃখটা হালকা হয়ে যাবে, যাইহোক, আর জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে, তুমি তাই হয়ে উঠবে।’
এখন তাহলে বিদায় নিই।
বুঝতে পারলাম, উনি কি বলতে চাইলেন। এই করাই ঠিক আসলে। তবে আমার মনের ভেতরে, ক্যারো ঠিকই পানির মাঝে ছুটাছুটি করে চললো আর নিজেকে ছুঁড়তে লাগলো, যেনো বিজয়া বেশে, আর আমি থমকে রয়েছি, অপেক্ষায় রইলাম ও আমাকে ওর কাজকারবার ব্যাখ্যা করবে বলে, অপেক্ষায় রইলাম পানি ছিটকে উঠার। *
****শেষ****
২| ১৫ ই মার্চ, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪১
রথো রাফি বলেছেন: শে আসলে যেখানে স্থী বাচক শুধু সেখানেই ব্যবহার করা হয়েছে! আর বলাই বাহুল, পুংবাচকে সে।
©somewhere in net ltd.
১| ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৯
মাহী ফ্লোরা বলেছেন: চমত্কার। আপনি অনুবাদ করেছেন? পুরো লেখায় সে শে হয়ে আছে! ঠিক করে নেবেন। শুভকামনা