নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃঅভিমানে ভালবাসি

১২ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:১২

গাড়ির হর্ন শুনতে অতটা ভাল লাগে না। তবে রিকশার টুং টাং বেলের শব্দ কানে একটা শান্তি শান্তি ভাব দেয়। রাস্তার ধারের চটপটির দোকানটার পাশে বসে গত কয়েকদিন ধরেই রিকশার টুং টাং শব্দ শুনছে রাজ। খুব একটা খারাপ লাগছে না। চটপটির দোকানের লোকটা প্রতিদিনই জিজ্ঞেস করে, মামা চটপটি দিব?

- না , মামা।



প্রতিদিনই একই জবাব দেয় রাজ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখে। রিকশার চাকার ঘুরতে থাকা দেখে, হুড নামানো, হুড তোলা রিকশায় যাত্রী দেখে। আর একটু পর পর বিষণ্ণ হয়ে তাকায়, পথের দিকে। বিষণ্ণতা ঝেঁকে বসে আরও বেশী, যখন পাশের চটপটির দোকানে বসে, যুগল গুলো একে অপরের মুখে ফুচকা তুলে দেয়। কিংবা হাতের ভিতর হাত লুকিয়ে রিকশায় পাশাপাশি দুজন বসে থাকে। এই সময়টায় একজনের কথা মনে পড়ে খুব। কেন যেন মনে পড়ে। যার আশায় পথের দিকে বিষণ্ণ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার কথা। তার কথা মনে পড়লেই রাজ, ছোট করে বা বড় করে একটা মেসেজ করে তাকে। কখনও রিপ্লাই আসে, বেশীর ভাগ সময় আসে না। মেসেজ আর কলের মধ্যে এই একটা পার্থক্য। কেউ কল দিলে, কেটে দেয়া যায়। বুঝিয়ে দেয়া যায়, সে তার উপর বিরক্ত। তবে যার উপর বিরক্ত তার মেসেজ গুলোও মানুষ গুলো কেন যেন মন দিয়ে পড়ে। রাজ জানে, রাকাও ওর মেসেজ গুলো মন দিয়ে পড়ে। তবে রিপ্লাই না দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে, রাজের উপর বিরক্ত। চরম মাত্রায় বিরক্ত। আবার ভাবনা ভুলও হতে পারে। হয়ত মেসেজ গুলো পড়ে না রাকা। সত্যিই বিরক্ত রাজের উপর।

- আজ কি তোমার ক্লাস আছে? বাসা থেকে কি বের হবে? খাওয়া দাওয়া কি ঘরেই করবে, নাকি বাহিরে বান্ধবীদের নিয়ে খাবার প্ল্যান আছে?



ছোট মেসেজের জবাব আরও ছোট। রাকা লিখে পাঠিয়েছে, তোমার এতো কি দরকার?

- আসলে কোন দরকারই নেই। এমনি জানতে চাইলাম।

- দরকার না থাকলে, জানারও দরকার নেই।

- আচ্ছা।



রাজের গত কয়েকদিন ধরে কেন যেন রাকাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। প্রচণ্ড দেখতে ইচ্ছা করছে। যতটা দেখতে ইচ্ছা করলে, সব কাজ বাদ দিয়ে বাসায় আশেপাশে ঘুর ঘুর করে একটু দেখার জন্য। ঠিক ততটা। রাজ রাকার বাসার আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে না। বাসার কাছের চটপটির দোকানের পাশে বসে আছে। রাকা বাসা থেকে বের হলে, এই রাস্তা দিয়েই যাবে। নিজেকে বখাটে রকম কেউ লাগছে। সেটা ব্যাপার না। দেখতে পেলেই হল। রাকার এখন আর রাজকে দেখতে ইচ্ছা করে না, জানে রাজ। করবার কথাও না। হিসেব নিকেশ বদলে গেছে। অনেক বেশী বদলে গেছে। রাকা এখন রাজের কণ্ঠ শুনবার জন্য অস্থির হয়ে থাকে না। আবেগি হয়ে বাচ্চা মেয়ের মত আবদারের সুরে বলে না, একটু কথা বলবে আমার সাথে?

এখন আর বলে না, আমরা আজ সারারাত কথা বলব আচ্ছা? তোমার কি ঘুমে খুব সমস্যা হবে? কাল কি খুব জরুরী কোন কাজ আছে? আমার জন্য না হয় কষ্ট করলে।

না বলে কয়ে, হুট করে কাদা ময়লা মাড়িয়ে, সরু গলিটার ভিতর দিয়ে গিয়ে, রাজকে বলে না, বাসা থেকে নিচে নাম এখন। যা পরে আছ, তা পরেই। লুঙ্গী থাকলে লুঙ্গী, খালি গায়ে থাকলে সেভাবে। ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড সময় তোমার। আমার এক বান্ধবী তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে একটা বক্স আছে, নিয়ে দাও। দ্রুত।

কিছু না বুঝেই তাড়াহুড়া করে নিচে নেমে রাজ দেখে রাকার বান্ধবী না। রাকাই দাঁড়িয়ে। একটু মুচকি হেসে বলে, সারপ্রাইজ। কি করব? দেখতে ইচ্ছা করছিল। তোমার তো ইচ্ছা করে না দেখা করতে। আমিই আসলাম। নাও এই বক্সে মুরগী ভুনা আছে। আমি রান্না করেছি আজ। খারাপ হলেও খেতে হবে।



রাজ বোকার মত তাকিয়ে থেকে, হাত থেকে বক্স নিয়ে নেয়। রাকা রাজের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার লুঙ্গী এতো ময়লা কেন? ধুয়ে দাও না কতদিন?

- না আসলে, মেসে থাকি, ধুয়ে দেয়া হয় না।

- আজকেই ধুয়ে দিবে। এতো নোংরা ছেলে আমার খুব অপছন্দ। যাও মুরগী ভুনা নিয়ে ঘরে যাও। আমি চলে যাব।

- চলে যাবে?

- হ্যাঁ। দেখতে ইচ্ছা করছিল। দেখা তো শেষ।



রাজ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের মত রাকা চলে যায়। পাগলামি দেখে বোকা হয়ে চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে রাজ।

এখন আর এমন পাগলামি করে না রাকা। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে অনেক বড় হয়ে গেছে। এসব পাগলামি, ফালতু জিনিস বুঝে গেছে। নিজের ব্যাপারে অনেকটা বুঝে গেছে রাকা। তাই আর সময় দিতে ইচ্ছে হয় না রাজকে। তাই আর দেখতে ইচ্ছে হয় না, সারা রাত কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, কিংবা সেদিনের মত বলতেও ইচ্ছে হয় না, রাজ ভালবাসি অনেক। আমাকে ভাল বাসবে তো সবসময়?

রাজ এখনও ভালবাসে। অনেক বেশীই বাসে। ভালবাসা অপ্রয়োজনীয় একটা আবেগ। তবুও কেউ কেউ বুকের কোণে জমিয়ে রাখে এই অপ্রয়োজনীয় আবেগটা। কখনও কখনও অতিরিক্ত মাত্রায় প্রকাশ করে, সুখ পায়, দুঃখ পায়, এই অপ্রয়োজনীয় আবেগ ঘিরে।

রাকা হয়ত আর ভালবাসে না। বাসলে এভাবে ভুলে থাকতে পারত না। সেদিনের মত অমন ব্যবহার করে, দূরে চলে যেতে পারত না। ভুল এতোটা বেশী ছিল না। অপরাধ এতোটা ছিল না। তবুও কত সহজে সম্পর্ক ভেঙে দিল। কয়েক বার কল করল সেদিন রাজ। কথা বলতে ইচ্ছা করছিল তাই। রাকা ধরে নি। বার বার কেটে দিল। টানা প্রায় ৫০ বারের উপর কল, বেশীর ভাগ সময় ধরল না, মাঝে মাঝে কেটে দিল। এরপর প্রায় চার ঘণ্টা মোবাইল বন্ধ। এই সময়টা মনে হচ্ছিল রাজের দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস আটকে আছে কোথাও, মোবাইলটা না খুললে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণা শেষে চার ঘণ্টা পর যখন রাকা মোবাইল খুলল তারপর থেকে ওয়েটিং । প্রায় ২০ মিনিটের মত। এই সময়টা আরও বেশী যন্ত্রণার ছিল। বুকের ভিতরের চিন চিন ব্যথাটা হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছিল অনেক। সূক্ষ্ম ব্যথাটা মনে হচ্ছিল, পাগলা কুকুরের কামড়ের মত। যেই কামড়ের যন্ত্রণায়, রাজ নিজেও পাগল হয়ে গেছে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, প্রচণ্ড রাগে, একটা মেসেজ করল রাকাকে। রেগে থাকলে মানুষের কথার ঠিক থাকে না। এটা বলা উচিৎ না। এমনটা করা ঠিক হবে না, এই ভাবনা আসে না। রাগের সময় মানুষের ভিতরের মানুষটা ঘুমিয়ে যায়। জেগে উঠে ভিতরের পশুটা। পশুটা ভাল কাজ করে না। পশুটা ভাল কথাও বলে না। মেসেজের কথা গুলোও ভাল ছিল না। রাজের ভিতরের পশুটা, রাকাকে অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিল। রাগ মিটাল। কেন এমন করবে কারণ ছাড়া রাজের সাথে রাকা? সমস্যা থাকলে ছোট করে একটা মেসেজ দিয়ে জানাতে পারে। কল কেটে দিল। না কেটে একটু ধরে বলতে পারে, একটু সমস্যা। অন্য কারও সাথে ২০ মিনিট কথা বলল, রাজের সাথে ১ মিনিট বলতে পারল না। মোবাইল বন্ধ করে রাখলে রাজের অস্থির লাগবে তাও বুঝল না রাকা। এমন করে রাজকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে, একবারের জন্যও ভাবল না রাকা। রাগ হতেই পারে রাজের। রাগের প্রকাশও করল। মেসেজ দিয়ে একটু হালকা লাগছে নিজেকে। পশুটার অনেক ভাল লাগছে। মেসেজ দেবার একটু পরেই রাকা রিপ্লাই দিল। রাজের মেসেজের তুলনায় অনেক ছোট করে।

" তুমি আমাকে কখনও বুঝ নি। বুঝবেও না। আমার তোমার সাথে থাকা সম্ভব না। আসলেই সম্ভব না। এমন খারাপ ভাষার মেসেজের পর তো কখনই নয়। আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। আমি কেন আজ সারাদিন এমন করলাম, তাও তোমাকে বলব না। তার আর কোন প্রয়োজন দেখছি না। বাই। এখন থেকে তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। "



সেই থেকে সত্যিই বদলে গেল রাকা। ভালবাসার জায়গাটায় কেন যেন এড়িয়ে চলা, অবহেলা, কিংবা অনেকটা ভালবাসাহীনতা দখল করে নিল। রাজ যত করেই চাইত রাকার সাথে যোগাযোগ করতে, রাকা এড়িয়ে চলত। যত করে চাইত ভালবাসার কথা বলতে, রাকা ফিরিয়ে দিত। যত করে বলত, ভুল হয়েছে, রাগের মাথায় ওসব বলেছি। রাকা নিশ্চুপ থেকে দূরে সরিয়ে দিত। রাজ ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছে, রাকা বুঝতে পারে না। পারবেও না।



রিকশায় টুং টাং শব্দ বেজে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে রিকশা চলে যাচ্ছে একের পর এক। রাজ সেসব দেখছে। দেখতে দেখতেই হঠাৎ সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কাউকে দেখে। যার জন্য চটপটির দোকানের পাশে কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করছে, তার জন্য। রাকা এদিকেই আসছে। রাজ একটু না দেখার ভান করে অন্য দিকে তাকাল। গাছের পাতার দিকে তাকাল। রাকা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এখানে কি করতেছ?



রাজ কিছুই বলল না। গাছের পাতার দিকেই তাকিয়ে রইল। এমন একটা ভাব ধরল, যেন কথা শুনে নি। রাকার কোন কথাই কানে আসে নি। রাকা আবার বলল, আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি রাজ।



রাজ একটু মিথ্যে মিথ্যে চমকে যাবার মত ভাব করে বলল, আরে তুমি? কেমন আছ? এখানে?

- ভাল আছি। আমার বাসা এখানে, আমি তো এখানেই থাকব। তুমি এখানে আসছ কেন?

- ও তোমাদের বাসা এখানে?

- কেন তুমি জানো না?

- জানতাম, ভুলে গেছি।

- তুমি আমার বাসার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতেছ কেন? আমি আরও দুই তিন দিন দেখছি তোমাকে। আমি বলছি না তোমার সাথে দেখা করব না।

- আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসছি, কে বলল?

- তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো নি?

- না।

- তাহলে কিসের জন্য আসছ?

- এমনি ঘুরতে ঘুরতে চলে আসলাম।

- প্রতিদিন ঘুরতে ঘুরতে চলে আসো?

- হ্যাঁ। আসলে ব্যাপারটা হল, এই মামার ফুচকা অসাধারণ লাগে। তাই প্রতিদিন ওনার ফুচকা খেতে আসি।

- তাই?

- হ্যাঁ।

- তার মানে আমার সাথে দেখা করতে আসো নি এখানে?

- না।

-সিউর তুমি?

- হ্যাঁ।

- আচ্ছা, থাক। আমি যাই।

- কই যাও? একটু কথা বলি।

- তোমার সাথে কিসের কথা? তোমার সাথে আমার কিছু আছে নাকি? আর তুমি তো আমার সাথে দেখা করতে আসো নাই। আসলে একটা কথা ছিল।

- তোমার সাথেই দেখা করতে আসছি।

- মিথ্যা বলবা না।

- মিথ্যা না। সত্যি কথা। দেখতে ইচ্ছা করছিল অনেক। তাই গত কয়েকদিন ধরে এখানে বসে থাকি।

- কেন? আমার সাথে কি তোমার?

- আমি তোমাকে ভালবাসি।

- বাস না। বাসলে কখনও ঐ ধরণের মেসেজ আমাকে পাঠাতে না।

- সরি তো আমি। অনেক রাগ উঠে গেছিল তাই। জানো, আমার প্রতি রাতে অনেক কষ্ট লাগে। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে।

- করুক। তাতে আমার কি? আমি তো অনেক সুখে আছি। তাই না?

- তুমি তো আমাকে মনেই কর না।

- হুম সেটাই। মনে করি না বলেই, কষ্ট পাই, কান্না করি।



রাজ চুপ করে রাকার দিকে তাকাল। এরপর মাথা নিচু করে বলল, আমিও তো কষ্ট পাচ্ছি। সেদিন তুমি যদি ছোট করে একটা মেসেজ দিতে, তাহলে এসবের কিছুই হত না। আমি ইচ্ছা করে রাগ করিনি। তুমি গ্রামে যাবার পর থেকে আমার সাথে ভাল করে একটু কথাও বলতে না। তার উপর সেদিন, সারাদিনে কথা বললে না। মেসেজের কোন রিপ্লাই দিলে না। আমার কেমন লাগছিল একবার বুঝতেও চাচ্ছিলে না। এরপর রাখলে মোবাইল অফ করে। তখন আরও রাগ হচ্ছিল। মোবাইল খোলার পর তুমি ওয়েটিং এ। সেই অবস্থায় মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। পাগল পাগল লাগছিল, তাই......।

- তোমার কাছে আমি এতো কিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুমি কখনও আমাকে বুঝ নি, বুঝবেও না। তোমার বোঝা উচিৎ ছিল, আমি ইচ্ছা করে অমন করছি না। অবশ্যই কোন সমস্যা আছে। সেদিন সকাল থেকে আমার আম্মু, মারাত্মক অসুস্থ। তাকে নিয়ে টানাটানি। আমার মা আমার সবচেয়ে আপন মানুষ। কাছের মানুষ। আম্মুর ঐ অবস্থায় নিজের মাথার ঠিক নেই। এই অবস্থায় আবার তোমাকে মেসেজ দিব। আমার মোবাইল ছিল আমার ছোট ভাইয়ের কাছে। ও মোবাইল কেটে দিচ্ছিল। এরপর ও ই বন্ধ করে রাখছে। মোবাইল অন করে আব্বুর সাথে কথা বলছি। আম্মু তখন হাসপাতালে। আব্বু চট্টগ্রাম থেকে আসছে, সে জন্য। আব্বুকে বলছিলাম, না আসলেও চলবে। আম্মুর অবস্থা ভাল এখন। আমি আব্বুর সাথে কথা শেষেই তোমাকে কল দিতাম। কিন্তু তুমি ঐ মেসেজ দিলে। মেসেজ দেখে, রাগ হল খুব। কেউ আমাকে খারাপ কথা বললে, আমার লাগে খুব। আমি তোমার কাছ থেকে ঐ মেসেজ কখনই আশা করি নাই।



রাজ নিষ্প্রভ চোখে থাকে রাকার দিকে। বুঝতে পারছে ভুল হয়েছে, বুঝটা আরও আগেই এসেছিল। কথা খুব খারাপ জিনিস। একবার বের হয়ে গেলে, আর ফেরত আনা যায় না। খুব করে ইচ্ছা করে রাজের, সেদিনের মেসেজের কথাগুলো ফিরিয়ে নিতে। বুকের ভিতর একটা বোবা বেদনা গুমরে গুমরে কাঁদছে। বেদনাটা কথা বলতে চাচ্ছে, বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে রাকাকে সত্যি ভুল হয়েছে।

রাজ তবুও একটু শান্ত ভাবে বলতে লাগল, আমি জানি আমি অপরাধ করেছি। অনেক বড় অপরাধ। ওভাবে আমার মেসেজ দেয়াটা ঠিক হয় নি। তোমাকে আমি মেসেজে কোন খারাপ কথা বলি নি। নিজেকেই বলছি। মাফ পাবার যোগ্য আমি না জানি। তবুও মাফ চাচ্ছি। আমি তোমাকে ভালবাসি রাকা। আমার কষ্ট পেতে আর ভাল লাগছে না।

- আমিও ভালবাসি। ভালবাসব। তবে কখনও ফিরে আসব না। কখনই না। দূর থেকে ভালবেসে কষ্ট পাব, তবুও না। আসি আমি।

- রাকা প্লিজ।



রাকা কথা শুনল না। হন হন করে হাঁটতে লাগল। পিছন থেকে বার কয়েক ডাক দিল রাজ। শুনল না রাকা। কিংবা শুনেও না শোনার ভান করল। রাজ বুঝতে পারল, ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। হয়ত আর কখনও ফিরবে না। রাজ ভালবাসবে দূর থেকে, রাকা ভালবাসবে দূর থেকে। এই ভাবেই চলবে। জীবন তো চলেই, হয়ত কাউকে সাথে নিয়ে। কিংবা কাউকে হারিয়ে। বা দূরে অনেক দূরে থেকে কারও জন্য হৃদয়ে অনুভব নিয়ে। অথবা কখনও, মিথ্যে রাগের , মিথ্যে ঘৃণার অভিনয় করে।



- মামা চটপটি দিব?



চটপটি বিক্রেতা লোকটার দিকে তাকাল রাজ। আজ আর না করল না।

- দেন মামা, এক প্লেট ফুচকা দেন। ঝাল কম।



চটপটি বিক্রেতা লোকটা, ফুচকা খাবার লোক পেয়ে খুশি। রাজ খুশি না। রাজ বিষণ্ণ। আবার বিষণ্ণ চোখে তাকাল, পথের দিকে। খুব বাতাস। ঝড় হবার আগের বাতাস। মানুষ গুলো সামনে যেতে পারছে না। আটকে যাচ্ছে। বাতাসটা আটকে দিচ্ছে সামনে যাবার পথ। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ কেউ, বাতাসের সাথে না পেরে। বাতাসের বিপরীতেই ভাসতে লাগল রাজ, পা চালিয়ে। যত দ্রুত পারা যায়।



- তোমার কাছে ত্রিশ টাকা হবে?



রাকা বাতাসে বেসামাল ওড়না ঠিক করতে করতে সামনে তাকাল। কোথা থেকে যেন রাজ এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। হাপাচ্ছে ছেলেটা। রাকা একটু আগেই কেঁদেছে। বাতাসে সেই কান্না করা জল এখনও শুকিয়ে যায় নি। ওড়না ঠিক করে বলল, তুমি আবার আমার পিছনে পিছনে আসছ কেন?

- না আসলে তোমার কাছে ত্রিশ টাকা হবে? ফুচকার অর্ডার দিলাম, দিয়ে দেখি পকেটে টাকা নেই। কেমন একটা অবস্থা।

- তুমি টাকা নিতে আমার কাছে আসছ?

- হ্যাঁ।

- সিউর?

- হ্যাঁ আমি সিউর।

- আর কিছু না তো?

- না।



রাকা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও।

বলেই আবার হাঁটতে লাগল।

- কই যাও?

- বাসায় যাই। কই যাব আর?

- চল না ফুচকা খাই একসাথে।

- তুমি তো টাকা নিতে আসছ। আমাকে নিতে আসো নি।

- না আসলে আমি তোমাকে নিতেই এসেছি। আমার কাছে টাকা আছে।

- মিথ্যা বললে কেন?

- ভয়ে। চল না প্লিজ। খুব ইচ্ছা করছে, তোমার সাথে বসে ফুচকা খেতে। অর্ডার দিয়ে এসেছি। ঝাল কম। তুমি তো ঝাল খাও না।



রাকা অল্প সময় কিছু ভাবল। এক নজর তাকাল, নাকের ডগায় ঘাম নিয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকা রাজের দিকে। এরপর আর একটু সময় থেমে বলল, এরপর থেকে কষ্ট দিলে দেখো কি করি।

- দিব না।

- চল।



ফুচকার দোকানে পাশাপাশি বসে খাচ্ছে দুজন। এক প্লেটে। মাঝে মাঝে রাজ আবদার করছে, খাইয়ে দেবার। সায় দিয়েও আবার রাকা বলে, তোমাকে আমি ভালবাসি, তাই তোমার সাথে বসে ফুচকা খাচ্ছি। এবারই শেষ। আর কখনও না। আর আমি কিন্তু তোমার কাছে ফিরে আসিনি।



রাজ শুনে যায়। ভেবে যায়। ভালবেসে যায়। রাকার মত। রাজ জানে, কখনও রাকা দূরে যাবে না। কিছু অভিমানে, স্মৃতি হাতড়ে ঠিক ভালবাসবে। পাশে থাকবে।



এই অভিমানের ভালবাসা দূরে কাছে, কষ্টে সুখে বেঁচে রবে। কখনও যদি ভেবে বসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ভালবাসা। হারিয়ে গেছে কোথাও। তবুও একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে বুকের কোণে, কিছু অপ্রয়োজনীয় আবেগের সাথে। যেখানে মাখামাখি কষ্ট সুখ আছে, সেখানেই ভালবাসা বেঁচে রয়। যেখানে চোখের জলের সাথে, মিষ্টি হাসি আছে, সেখানেই ভালবাসা বেঁচে রয়। যেখানে সব হারিয়ে, বেদনার মাঝে ভাললাগার আনাচ কানাচ খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানেও ভালবাসা বেঁচে রয়। যেখানে কেউ কাউকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে, সেখানেও রাতের বেলা ঘুমাবার আগে চোখের তন্দ্রায় ভালবাসা বেঁচে রয়। ভালবাসা বলে কিছু নেই, বলার মাঝেও ভালবাসা বেঁচে রয়। কিছু সম্পর্ক হঠাৎ করে ভালবাসা ছুঁয়ে মনে হয়, কেমন যেন হেয়ালি, কেমন যেন আঁকড়ে রাখার।অভিমানে ভালবাসি

- শেষ রাতের আঁধার



গাড়ির হর্ন শুনতে অতটা ভাল লাগে না। তবে রিকশার টুং টাং বেলের শব্দ কানে একটা শান্তি শান্তি ভাব দেয়। রাস্তার ধারের চটপটির দোকানটার পাশে বসে গত কয়েকদিন ধরেই রিকশার টুং টাং শব্দ শুনছে রাজ। খুব একটা খারাপ লাগছে না। চটপটির দোকানের লোকটা প্রতিদিনই জিজ্ঞেস করে, মামা চটপটি দিব?

- না , মামা।



প্রতিদিনই একই জবাব দেয় রাজ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখে। রিকশার চাকার ঘুরতে থাকা দেখে, হুড নামানো, হুড তোলা রিকশায় যাত্রী দেখে। আর একটু পর পর বিষণ্ণ হয়ে তাকায়, পথের দিকে। বিষণ্ণতা ঝেঁকে বসে আরও বেশী, যখন পাশের চটপটির দোকানে বসে, যুগল গুলো একে অপরের মুখে ফুচকা তুলে দেয়। কিংবা হাতের ভিতর হাত লুকিয়ে রিকশায় পাশাপাশি দুজন বসে থাকে। এই সময়টায় একজনের কথা মনে পড়ে খুব। কেন যেন মনে পড়ে। যার আশায় পথের দিকে বিষণ্ণ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার কথা। তার কথা মনে পড়লেই রাজ, ছোট করে বা বড় করে একটা মেসেজ করে তাকে। কখনও রিপ্লাই আসে, বেশীর ভাগ সময় আসে না। মেসেজ আর কলের মধ্যে এই একটা পার্থক্য। কেউ কল দিলে, কেটে দেয়া যায়। বুঝিয়ে দেয়া যায়, সে তার উপর বিরক্ত। তবে যার উপর বিরক্ত তার মেসেজ গুলোও মানুষ গুলো কেন যেন মন দিয়ে পড়ে। রাজ জানে, রাকাও ওর মেসেজ গুলো মন দিয়ে পড়ে। তবে রিপ্লাই না দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে, রাজের উপর বিরক্ত। চরম মাত্রায় বিরক্ত। আবার ভাবনা ভুলও হতে পারে। হয়ত মেসেজ গুলো পড়ে না রাকা। সত্যিই বিরক্ত রাজের উপর।

- আজ কি তোমার ক্লাস আছে? বাসা থেকে কি বের হবে? খাওয়া দাওয়া কি ঘরেই করবে, নাকি বাহিরে বান্ধবীদের নিয়ে খাবার প্ল্যান আছে?



ছোট মেসেজের জবাব আরও ছোট। রাকা লিখে পাঠিয়েছে, তোমার এতো কি দরকার?

- আসলে কোন দরকারই নেই। এমনি জানতে চাইলাম।

- দরকার না থাকলে, জানারও দরকার নেই।

- আচ্ছা।



রাজের গত কয়েকদিন ধরে কেন যেন রাকাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। প্রচণ্ড দেখতে ইচ্ছা করছে। যতটা দেখতে ইচ্ছা করলে, সব কাজ বাদ দিয়ে বাসায় আশেপাশে ঘুর ঘুর করে একটু দেখার জন্য। ঠিক ততটা। রাজ রাকার বাসার আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে না। বাসার কাছের চটপটির দোকানের পাশে বসে আছে। রাকা বাসা থেকে বের হলে, এই রাস্তা দিয়েই যাবে। নিজেকে বখাটে রকম কেউ লাগছে। সেটা ব্যাপার না। দেখতে পেলেই হল। রাকার এখন আর রাজকে দেখতে ইচ্ছা করে না, জানে রাজ। করবার কথাও না। হিসেব নিকেশ বদলে গেছে। অনেক বেশী বদলে গেছে। রাকা এখন রাজের কণ্ঠ শুনবার জন্য অস্থির হয়ে থাকে না। আবেগি হয়ে বাচ্চা মেয়ের মত আবদারের সুরে বলে না, একটু কথা বলবে আমার সাথে?

এখন আর বলে না, আমরা আজ সারারাত কথা বলব আচ্ছা? তোমার কি ঘুমে খুব সমস্যা হবে? কাল কি খুব জরুরী কোন কাজ আছে? আমার জন্য না হয় কষ্ট করলে।

না বলে কয়ে, হুট করে কাদা ময়লা মাড়িয়ে, সরু গলিটার ভিতর দিয়ে গিয়ে, রাজকে বলে না, বাসা থেকে নিচে নাম এখন। যা পরে আছ, তা পরেই। লুঙ্গী থাকলে লুঙ্গী, খালি গায়ে থাকলে সেভাবে। ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড সময় তোমার। আমার এক বান্ধবী তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কাছে একটা বক্স আছে, নিয়ে দাও। দ্রুত।

কিছু না বুঝেই তাড়াহুড়া করে নিচে নেমে রাজ দেখে রাকার বান্ধবী না। রাকাই দাঁড়িয়ে। একটু মুচকি হেসে বলে, সারপ্রাইজ। কি করব? দেখতে ইচ্ছা করছিল। তোমার তো ইচ্ছা করে না দেখা করতে। আমিই আসলাম। নাও এই বক্সে মুরগী ভুনা আছে। আমি রান্না করেছি আজ। খারাপ হলেও খেতে হবে।



রাজ বোকার মত তাকিয়ে থেকে, হাত থেকে বক্স নিয়ে নেয়। রাকা রাজের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার লুঙ্গী এতো ময়লা কেন? ধুয়ে দাও না কতদিন?

- না আসলে, মেসে থাকি, ধুয়ে দেয়া হয় না।

- আজকেই ধুয়ে দিবে। এতো নোংরা ছেলে আমার খুব অপছন্দ। যাও মুরগী ভুনা নিয়ে ঘরে যাও। আমি চলে যাব।

- চলে যাবে?

- হ্যাঁ। দেখতে ইচ্ছা করছিল। দেখা তো শেষ।



রাজ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের মত রাকা চলে যায়। পাগলামি দেখে বোকা হয়ে চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে রাজ।

এখন আর এমন পাগলামি করে না রাকা। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে অনেক বড় হয়ে গেছে। এসব পাগলামি, ফালতু জিনিস বুঝে গেছে। নিজের ব্যাপারে অনেকটা বুঝে গেছে রাকা। তাই আর সময় দিতে ইচ্ছে হয় না রাজকে। তাই আর দেখতে ইচ্ছে হয় না, সারা রাত কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, কিংবা সেদিনের মত বলতেও ইচ্ছে হয় না, রাজ ভালবাসি অনেক। আমাকে ভাল বাসবে তো সবসময়?

রাজ এখনও ভালবাসে। অনেক বেশীই বাসে। ভালবাসা অপ্রয়োজনীয় একটা আবেগ। তবুও কেউ কেউ বুকের কোণে জমিয়ে রাখে এই অপ্রয়োজনীয় আবেগটা। কখনও কখনও অতিরিক্ত মাত্রায় প্রকাশ করে, সুখ পায়, দুঃখ পায়, এই অপ্রয়োজনীয় আবেগ ঘিরে।

রাকা হয়ত আর ভালবাসে না। বাসলে এভাবে ভুলে থাকতে পারত না। সেদিনের মত অমন ব্যবহার করে, দূরে চলে যেতে পারত না। ভুল এতোটা বেশী ছিল না। অপরাধ এতোটা ছিল না। তবুও কত সহজে সম্পর্ক ভেঙে দিল। কয়েক বার কল করল সেদিন রাজ। কথা বলতে ইচ্ছা করছিল তাই। রাকা ধরে নি। বার বার কেটে দিল। টানা প্রায় ৫০ বারের উপর কল, বেশীর ভাগ সময় ধরল না, মাঝে মাঝে কেটে দিল। এরপর প্রায় চার ঘণ্টা মোবাইল বন্ধ। এই সময়টা মনে হচ্ছিল রাজের দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস আটকে আছে কোথাও, মোবাইলটা না খুললে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণা শেষে চার ঘণ্টা পর যখন রাকা মোবাইল খুলল তারপর থেকে ওয়েটিং । প্রায় ২০ মিনিটের মত। এই সময়টা আরও বেশী যন্ত্রণার ছিল। বুকের ভিতরের চিন চিন ব্যথাটা হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছিল অনেক। সূক্ষ্ম ব্যথাটা মনে হচ্ছিল, পাগলা কুকুরের কামড়ের মত। যেই কামড়ের যন্ত্রণায়, রাজ নিজেও পাগল হয়ে গেছে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, প্রচণ্ড রাগে, একটা মেসেজ করল রাকাকে। রেগে থাকলে মানুষের কথার ঠিক থাকে না। এটা বলা উচিৎ না। এমনটা করা ঠিক হবে না, এই ভাবনা আসে না। রাগের সময় মানুষের ভিতরের মানুষটা ঘুমিয়ে যায়। জেগে উঠে ভিতরের পশুটা। পশুটা ভাল কাজ করে না। পশুটা ভাল কথাও বলে না। মেসেজের কথা গুলোও ভাল ছিল না। রাজের ভিতরের পশুটা, রাকাকে অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিল। রাগ মিটাল। কেন এমন করবে কারণ ছাড়া রাজের সাথে রাকা? সমস্যা থাকলে ছোট করে একটা মেসেজ দিয়ে জানাতে পারে। কল কেটে দিল। না কেটে একটু ধরে বলতে পারে, একটু সমস্যা। অন্য কারও সাথে ২০ মিনিট কথা বলল, রাজের সাথে ১ মিনিট বলতে পারল না। মোবাইল বন্ধ করে রাখলে রাজের অস্থির লাগবে তাও বুঝল না রাকা। এমন করে রাজকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে, একবারের জন্যও ভাবল না রাকা। রাগ হতেই পারে রাজের। রাগের প্রকাশও করল। মেসেজ দিয়ে একটু হালকা লাগছে নিজেকে। পশুটার অনেক ভাল লাগছে। মেসেজ দেবার একটু পরেই রাকা রিপ্লাই দিল। রাজের মেসেজের তুলনায় অনেক ছোট করে।

" তুমি আমাকে কখনও বুঝ নি। বুঝবেও না। আমার তোমার সাথে থাকা সম্ভব না। আসলেই সম্ভব না। এমন খারাপ ভাষার মেসেজের পর তো কখনই নয়। আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। আমি কেন আজ সারাদিন এমন করলাম, তাও তোমাকে বলব না। তার আর কোন প্রয়োজন দেখছি না। বাই। এখন থেকে তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। "



সেই থেকে সত্যিই বদলে গেল রাকা। ভালবাসার জায়গাটায় কেন যেন এড়িয়ে চলা, অবহেলা, কিংবা অনেকটা ভালবাসাহীনতা দখল করে নিল। রাজ যত করেই চাইত রাকার সাথে যোগাযোগ করতে, রাকা এড়িয়ে চলত। যত করে চাইত ভালবাসার কথা বলতে, রাকা ফিরিয়ে দিত। যত করে বলত, ভুল হয়েছে, রাগের মাথায় ওসব বলেছি। রাকা নিশ্চুপ থেকে দূরে সরিয়ে দিত। রাজ ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছে, রাকা বুঝতে পারে না। পারবেও না।



রিকশায় টুং টাং শব্দ বেজে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে রিকশা চলে যাচ্ছে একের পর এক। রাজ সেসব দেখছে। দেখতে দেখতেই হঠাৎ সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কাউকে দেখে। যার জন্য চটপটির দোকানের পাশে কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করছে, তার জন্য। রাকা এদিকেই আসছে। রাজ একটু না দেখার ভান করে অন্য দিকে তাকাল। গাছের পাতার দিকে তাকাল। রাকা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি এখানে কি করতেছ?



রাজ কিছুই বলল না। গাছের পাতার দিকেই তাকিয়ে রইল। এমন একটা ভাব ধরল, যেন কথা শুনে নি। রাকার কোন কথাই কানে আসে নি। রাকা আবার বলল, আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি রাজ।



রাজ একটু মিথ্যে মিথ্যে চমকে যাবার মত ভাব করে বলল, আরে তুমি? কেমন আছ? এখানে?

- ভাল আছি। আমার বাসা এখানে, আমি তো এখানেই থাকব। তুমি এখানে আসছ কেন?

- ও তোমাদের বাসা এখানে?

- কেন তুমি জানো না?

- জানতাম, ভুলে গেছি।

- তুমি আমার বাসার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতেছ কেন? আমি আরও দুই তিন দিন দেখছি তোমাকে। আমি বলছি না তোমার সাথে দেখা করব না।

- আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসছি, কে বলল?

- তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসো নি?

- না।

- তাহলে কিসের জন্য আসছ?

- এমনি ঘুরতে ঘুরতে চলে আসলাম।

- প্রতিদিন ঘুরতে ঘুরতে চলে আসো?

- হ্যাঁ। আসলে ব্যাপারটা হল, এই মামার ফুচকা অসাধারণ লাগে। তাই প্রতিদিন ওনার ফুচকা খেতে আসি।

- তাই?

- হ্যাঁ।

- তার মানে আমার সাথে দেখা করতে আসো নি এখানে?

- না।

-সিউর তুমি?

- হ্যাঁ।

- আচ্ছা, থাক। আমি যাই।

- কই যাও? একটু কথা বলি।

- তোমার সাথে কিসের কথা? তোমার সাথে আমার কিছু আছে নাকি? আর তুমি তো আমার সাথে দেখা করতে আসো নাই। আসলে একটা কথা ছিল।

- তোমার সাথেই দেখা করতে আসছি।

- মিথ্যা বলবা না।

- মিথ্যা না। সত্যি কথা। দেখতে ইচ্ছা করছিল অনেক। তাই গত কয়েকদিন ধরে এখানে বসে থাকি।

- কেন? আমার সাথে কি তোমার?

- আমি তোমাকে ভালবাসি।

- বাস না। বাসলে কখনও ঐ ধরণের মেসেজ আমাকে পাঠাতে না।

- সরি তো আমি। অনেক রাগ উঠে গেছিল তাই। জানো, আমার প্রতি রাতে অনেক কষ্ট লাগে। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে।

- করুক। তাতে আমার কি? আমি তো অনেক সুখে আছি। তাই না?

- তুমি তো আমাকে মনেই কর না।

- হুম সেটাই। মনে করি না বলেই, কষ্ট পাই, কান্না করি।



রাজ চুপ করে রাকার দিকে তাকাল। এরপর মাথা নিচু করে বলল, আমিও তো কষ্ট পাচ্ছি। সেদিন তুমি যদি ছোট করে একটা মেসেজ দিতে, তাহলে এসবের কিছুই হত না। আমি ইচ্ছা করে রাগ করিনি। তুমি গ্রামে যাবার পর থেকে আমার সাথে ভাল করে একটু কথাও বলতে না। তার উপর সেদিন, সারাদিনে কথা বললে না। মেসেজের কোন রিপ্লাই দিলে না। আমার কেমন লাগছিল একবার বুঝতেও চাচ্ছিলে না। এরপর রাখলে মোবাইল অফ করে। তখন আরও রাগ হচ্ছিল। মোবাইল খোলার পর তুমি ওয়েটিং এ। সেই অবস্থায় মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। পাগল পাগল লাগছিল, তাই......।

- তোমার কাছে আমি এতো কিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুমি কখনও আমাকে বুঝ নি, বুঝবেও না। তোমার বোঝা উচিৎ ছিল, আমি ইচ্ছা করে অমন করছি না। অবশ্যই কোন সমস্যা আছে। সেদিন সকাল থেকে আমার আম্মু, মারাত্মক অসুস্থ। তাকে নিয়ে টানাটানি। আমার মা আমার সবচেয়ে আপন মানুষ। কাছের মানুষ। আম্মুর ঐ অবস্থায় নিজের মাথার ঠিক নেই। এই অবস্থায় আবার তোমাকে মেসেজ দিব। আমার মোবাইল ছিল আমার ছোট ভাইয়ের কাছে। ও মোবাইল কেটে দিচ্ছিল। এরপর ও ই বন্ধ করে রাখছে। মোবাইল অন করে আব্বুর সাথে কথা বলছি। আম্মু তখন হাসপাতালে। আব্বু চট্টগ্রাম থেকে আসছে, সে জন্য। আব্বুকে বলছিলাম, না আসলেও চলবে। আম্মুর অবস্থা ভাল এখন। আমি আব্বুর সাথে কথা শেষেই তোমাকে কল দিতাম। কিন্তু তুমি ঐ মেসেজ দিলে। মেসেজ দেখে, রাগ হল খুব। কেউ আমাকে খারাপ কথা বললে, আমার লাগে খুব। আমি তোমার কাছ থেকে ঐ মেসেজ কখনই আশা করি নাই।



রাজ নিষ্প্রভ চোখে থাকে রাকার দিকে। বুঝতে পারছে ভুল হয়েছে, বুঝটা আরও আগেই এসেছিল। কথা খুব খারাপ জিনিস। একবার বের হয়ে গেলে, আর ফেরত আনা যায় না। খুব করে ইচ্ছা করে রাজের, সেদিনের মেসেজের কথাগুলো ফিরিয়ে নিতে। বুকের ভিতর একটা বোবা বেদনা গুমরে গুমরে কাঁদছে। বেদনাটা কথা বলতে চাচ্ছে, বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে রাকাকে সত্যি ভুল হয়েছে।

রাজ তবুও একটু শান্ত ভাবে বলতে লাগল, আমি জানি আমি অপরাধ করেছি। অনেক বড় অপরাধ। ওভাবে আমার মেসেজ দেয়াটা ঠিক হয় নি। তোমাকে আমি মেসেজে কোন খারাপ কথা বলি নি। নিজেকেই বলছি। মাফ পাবার যোগ্য আমি না জানি। তবুও মাফ চাচ্ছি। আমি তোমাকে ভালবাসি রাকা। আমার কষ্ট পেতে আর ভাল লাগছে না।

- আমিও ভালবাসি। ভালবাসব। তবে কখনও ফিরে আসব না। কখনই না। দূর থেকে ভালবেসে কষ্ট পাব, তবুও না। আসি আমি।

- রাকা প্লিজ।



রাকা কথা শুনল না। হন হন করে হাঁটতে লাগল। পিছন থেকে বার কয়েক ডাক দিল রাজ। শুনল না রাকা। কিংবা শুনেও না শোনার ভান করল। রাজ বুঝতে পারল, ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। হয়ত আর কখনও ফিরবে না। রাজ ভালবাসবে দূর থেকে, রাকা ভালবাসবে দূর থেকে। এই ভাবেই চলবে। জীবন তো চলেই, হয়ত কাউকে সাথে নিয়ে। কিংবা কাউকে হারিয়ে। বা দূরে অনেক দূরে থেকে কারও জন্য হৃদয়ে অনুভব নিয়ে। অথবা কখনও, মিথ্যে রাগের , মিথ্যে ঘৃণার অভিনয় করে।



- মামা চটপটি দিব?



চটপটি বিক্রেতা লোকটার দিকে তাকাল রাজ। আজ আর না করল না।

- দেন মামা, এক প্লেট ফুচকা দেন। ঝাল কম।



চটপটি বিক্রেতা লোকটা, ফুচকা খাবার লোক পেয়ে খুশি। রাজ খুশি না। রাজ বিষণ্ণ। আবার বিষণ্ণ চোখে তাকাল, পথের দিকে। খুব বাতাস। ঝড় হবার আগের বাতাস। মানুষ গুলো সামনে যেতে পারছে না। আটকে যাচ্ছে। বাতাসটা আটকে দিচ্ছে সামনে যাবার পথ। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ কেউ, বাতাসের সাথে না পেরে। বাতাসের বিপরীতেই ভাসতে লাগল রাজ, পা চালিয়ে। যত দ্রুত পারা যায়।



- তোমার কাছে ত্রিশ টাকা হবে?



রাকা বাতাসে বেসামাল ওড়না ঠিক করতে করতে সামনে তাকাল। কোথা থেকে যেন রাজ এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। হাপাচ্ছে ছেলেটা। রাকা একটু আগেই কেঁদেছে। বাতাসে সেই কান্না করা জল এখনও শুকিয়ে যায় নি। ওড়না ঠিক করে বলল, তুমি আবার আমার পিছনে পিছনে আসছ কেন?

- না আসলে তোমার কাছে ত্রিশ টাকা হবে? ফুচকার অর্ডার দিলাম, দিয়ে দেখি পকেটে টাকা নেই। কেমন একটা অবস্থা।

- তুমি টাকা নিতে আমার কাছে আসছ?

- হ্যাঁ।

- সিউর?

- হ্যাঁ আমি সিউর।

- আর কিছু না তো?

- না।



রাকা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রাজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও।

বলেই আবার হাঁটতে লাগল।

- কই যাও?

- বাসায় যাই। কই যাব আর?

- চল না ফুচকা খাই একসাথে।

- তুমি তো টাকা নিতে আসছ। আমাকে নিতে আসো নি।

- না আসলে আমি তোমাকে নিতেই এসেছি। আমার কাছে টাকা আছে।

- মিথ্যা বললে কেন?

- ভয়ে। চল না প্লিজ। খুব ইচ্ছা করছে, তোমার সাথে বসে ফুচকা খেতে। অর্ডার দিয়ে এসেছি। ঝাল কম। তুমি তো ঝাল খাও না।



রাকা অল্প সময় কিছু ভাবল। এক নজর তাকাল, নাকের ডগায় ঘাম নিয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকা রাজের দিকে। এরপর আর একটু সময় থেমে বলল, এরপর থেকে কষ্ট দিলে দেখো কি করি।

- দিব না।

- চল।



ফুচকার দোকানে পাশাপাশি বসে খাচ্ছে দুজন। এক প্লেটে। মাঝে মাঝে রাজ আবদার করছে, খাইয়ে দেবার। সায় দিয়েও আবার রাকা বলে, তোমাকে আমি ভালবাসি, তাই তোমার সাথে বসে ফুচকা খাচ্ছি। এবারই শেষ। আর কখনও না। আর আমি কিন্তু তোমার কাছে ফিরে আসিনি।



রাজ শুনে যায়। ভেবে যায়। ভালবেসে যায়। রাকার মত। রাজ জানে, কখনও রাকা দূরে যাবে না। কিছু অভিমানে, স্মৃতি হাতড়ে ঠিক ভালবাসবে। পাশে থাকবে।



এই অভিমানের ভালবাসা দূরে কাছে, কষ্টে সুখে বেঁচে রবে। কখনও যদি ভেবে বসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ভালবাসা। হারিয়ে গেছে কোথাও। তবুও একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে বুকের কোণে, কিছু অপ্রয়োজনীয় আবেগের সাথে। যেখানে মাখামাখি কষ্ট সুখ আছে, সেখানেই ভালবাসা বেঁচে রয়। যেখানে চোখের জলের সাথে, মিষ্টি হাসি আছে, সেখানেই ভালবাসা বেঁচে রয়। যেখানে সব হারিয়ে, বেদনার মাঝে ভাললাগার আনাচ কানাচ খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানেও ভালবাসা বেঁচে রয়। যেখানে কেউ কাউকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে, সেখানেও রাতের বেলা ঘুমাবার আগে চোখের তন্দ্রায় ভালবাসা বেঁচে রয়। ভালবাসা বলে কিছু নেই, বলার মাঝেও ভালবাসা বেঁচে রয়। কিছু সম্পর্ক হঠাৎ করে ভালবাসা ছুঁয়ে মনে হয়, কেমন যেন হেয়ালি, কেমন যেন আঁকড়ে রাখার।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.