বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়ে কাজ করি অনেক দিন। ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে নিবন্ধ খুব কমই আছে। আর যা আছে, তাতে ছবি নেই একেবারেই। আর আমাদের প্রজেক্ট বাংলা উইকিপিডিয়াতেও ব্যাপারটা একই। কারণটা আসলে মুক্ত লাইসেন্সে ব্যবহার্য ছবির অভাবের জন্য। ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ছবি তোলা হয়নি, তা না, কিন্তু যেসব ফটোগ্রাফার ছবি তুলেছেন, তাদের কাছে উইকিপিডিয়ার জন্য ছবি চাইতে গেলেই তাঁরা ছবি প্রতি টাকা চেয়ে বসেন। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে তোলা গণমানুষের মুক্ত বিশ্বকোষের পক্ষে তা দেয়া তো আর সম্ভব না, তাই মুনির হাসান ভাইয়ের আয়োজিত ঢাকার প্রথম উইকি-আড্ডায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আমরা নিজেরাই আমাদের দেশের সুন্দর ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ছবি তুলে মুক্ত লাইসেন্সে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এগুলি সারাবিশ্বের মানুষের ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেবো। ছবি গুলো নিয়ে যে যা খুশি, যেকোনো নিবন্ধে, যেকোনো কাজেই ব্যবহার করতে পারবেন। মুক্ত বিশ্বকোষের মূল ধারণা তো সেটাই, জ্ঞানকে মুক্ত হস্তে, কোনো বিধি নিষেধ ছাড়াই দান করা। জ্ঞান আর ভালোবাসাই হলো একমাত্র দুটো জিনিষ, যা দান করলে বেড়ে যায়, টাকা পয়সার মতো কমতে থাকেনা।
যাহোক, উইকি-আড্ডায় হাজির ছিলেন পুরানো ঢাকার অধিবাসী মাহে আলম খান (ম্যাক) ভাই, আর বাংলা উইকির দুইজন প্রশাসক রাজিবুল ও বেলায়েত। গল্পে গল্পে বেরিয়ে এলো পুরানো ঢাকার ছবির অভাব। আসলে পুরো ঢাকা শহরের ছবিই মুক্ত লাইসেন্সে (ক্রিয়েটিভ কমন্স বা জিএফডিএল) এর অধীনে পাওয়া দুষ্কর। আমার মনে পড়লো, সংসদ ভবনের ছবি জোগাড় করতে গিয়ে আমাকে এক জার্মান ভদ্রলোকের কাছে বিস্তর ই-মেইল চালাচালি করে তাঁর অনুমতি জোগাড় করতে হয়েছিলো। ইংরেজি/বাংলা সহ বিশ্বের অনেক গুলো ভাষার উইকিপিডিয়াতে এখন সেই ছবিই ব্যবহার করা হচ্ছে। যাহোক, প্রস্তাবটা আমরা সবাই লুফে নিলাম। আমি ছাত্রজীবনের গবেষণা-বৃত্তির অল্পবিস্তর কিছু টাকা জমিয়ে একটা ক্যানন ব্রান্ডের ডিজিটাল ক্যামেরা কিনেছিলাম বছর কয়েক আগে, সেটা সাথে করে নিয়ে এসেছি দেশে বেড়াতে আসার সময়। সেটাতে ২৫৬ মেগাবাইটের মেমরি কার্ড ভরে নিলে শ্থকয়েক ছবি তোলা যায় একবারে। ঠিক হলো, সেটা নিয়েই আমি চলে আসবো পুরানো ঢাকায়। বেলায়েত ও রাজিবুল মহা উৎসাহে দিনক্ষণ ঠিক করে নিলো।
শনিবার সকালে ঠিক দশটায় হাজির হলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর ক্যাফের সামনে। আমি বুয়েটে পড়াশোনা করেছিলাম, তবে আসলে আলসেমি করে ঢাকেশ্বরী_মন্দির আর আহসান মঞ্জিল ছাড়া পুরানো ঢাকায় ঘোরা হয়নি খুব একটা। যাহোক, বেলায়েত আর রাজিবুলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য ছিলো ঢাকেশ্বরী_মন্দির। বুয়েট ক্যাম্পাসের পিছনে গেলেই পাওয়া গেল মন্দিরের এলাকাটি। সুন্দর কারূকার্য্য মন্ডিত মন্দিরটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো, পরে এটিকে আবার নতুন করে গড়া হয়েছে। মন্দিরের মূল অংশে ঢোকার আগে ডানে রয়েছে মহানগর পুজা মন্ডপ। এখানে দূর্গার স্থায়ী মন্ডপ রয়েছে। সেটা পেরুলেই মন্দির অঙ্গন। ঢোকার মুখে জুতো/স্যান্ডেল জমা দিয়ে মন্দিরের বিভিন্ন অংশের ছবি তুললাম। দিনের এই শুরুর দিকেও পুজা করতে এসেছেন অনেকে। মন্দিরের দেবীমূর্তির পাশে গিয়ে সেবায়েতের অনুমতি নিয়ে ছবি তুলে নিলাম। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উপরে নিবন্ধটি !@@!440801 !@@!440802 শুরু করেছিলাম বছর খানেক আগে। আজ ছবি তুলতে পেরে ভালো লাগলো।
এর পর রাজিবুলের সাথে রিকশায় চেপে চললাম খান মহম্মদ মির্ধার মসজিদের পানে। বেলায়েত ও তার সঙ্গী আরেক রাজিব পিছনের রিকশায় অনুসরণ করলো। ওরা এই এলাকারই ছেলে, কাজেই পথঘাট সব নখদর্পনে। ওদের সাথে ছিলো মুনতাসীর মামুনের লেখা ঢাকা স্মৃতির বিস্মৃতির নগরী বইটি। পুরানো ঢাকার রাস্তাঘাট একটু সংকীর্ণ আকারের। সেখানে ট্রাফিক জ্যাম বেঁধে যায় সহজেই। সেরকম হালকা কিছু জ্যাম পেরিয়ে পৌছালাম মসজিদটির পাশে। গিয়ে আরেক বিপত্তি, মসজিদের গেটে তালা মারা। শিঁকের ফাঁক দিয়ে ক্যামেরা গলিয়ে ছবি তুললাম কিছু, কিন্তু ভালো অ্যাঙ্গেল পাচ্ছিলাম না। ভিতরে মসজিদের খাদেমকে দেখতে পেয়ে রাজিবুল তাঁকে অনুরোধ করলো আমাদের একটু ঢুকতে দেয়ার জন্য। বিশ্বকোষ আর নিবন্ধের কথা শুনে তিনি সোৎসাহে রাজি হয়ে গেলেন। ভিতরে ঢুকে বিভিন্ন দিক হতে গোটা বিশেক ছবি তুলে নিলাম। মোগল আমলের এই মসজিদটির বয়স অন্তত সাড়ে তিনশ বছর। নির্মাণ করেছিলেন খান মোহাম্মদ মীর্ধা। খাদেমকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এখানে এখনও নিয়মিত নামাজ হয়। মসজিদটির জরাজীর্ণ মিনারের পাশে আধুনিক মাইক লাগানো আছে সেজন্যই। জুতো খুলে মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম, গত ৩শ বছরে কত লাখো মুসুল্লী এইভাবে এই সিঁড়ি বেয়ে উঠেছেন, তা ভেবে খুবই রোমাঞ্চ হলো। তবে দুঃখের কথা, মসজিদটির সুপ্রাচীণ গম্বুজটির ঠিক পিছনেই সুঊচ্চ মোবাইল ফোনের টাওয়ার, যা মসজিদের চমৎকার দৃশ্যটির সৌন্দর্যহানী ঘটিয়েছে কিছুটা।
(এই লেখাটি বাংলা উইকিপিডিয়া প্রজেক্টের ২৩শে ডিসেম্বরের উইকি-অভিযানের উপরে)
[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৯:৪৬