বয়েস বাড়ার সাথে সাথে আমাদের দায়িত্ব বাড়তে থাকে। পেশায় পদোন্নতি ঘটে। আর যত বড় পদ তত বড় দায়িত্ব। জীবনের কোন না কোনো পয়েন্টে এসে আমাদের মধ্যে এক ধরণের স্ট্রেস কাজ করতে পারে। কিন্তু জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন স্ট্রেস কে প্রাধান্য দিয়ে আমরা ক্ষণিকের জন্য ব্রেক বা রেস্ট নেবার প্রয়োজন মনে করি না। তারপর আমাদের মধ্যে কাজের প্রতি, জীবনের প্রতি, জীবনের লক্ষ্যের প্রতি অনীহা জাগলে সেটাকে আমরা ‘স্ট্রেস’ বলে হয়তো চালিয়ে দেই। কিন্তু স্ট্রেস তো পূর্বেই ছিলো, এখন আপনি ‘বার্ণআউট (Burnout)’ পর্যায়ে চলে গেছেন।
বিতৃষ্ণা এবং কোন কাজেই মন ঠাহর করতে না পারা কে ‘বার্ণআউট (Burnout)’ বলে। যখন দীর্ঘসময় ধরে আমাদের আবেগী মন, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এবং শারীরিক অবস্থা ক্লান্তির মধ্যে দিয়ে বাহিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বার্ণআউটের প্রভাব পেশায় বেশি পড়তে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর প্রভাব জীবনের অন্যান্য পাতায় এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
‘বার্ণআউট (Burnout)’ এর কাছে স্ট্রেস হলো ছোট বাচ্চা মাত্র। স্ট্রেস হয়তো সাময়িক কিছু মানসিক বা শারীরিক চাপে (বিশেষ করে কাজে বা পেশার চাপ) ঘটতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্রেক এবং রেস্ট নেবার মাধ্যমে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বার্ণআউট মানে ক্ষয়ে যাওয়া, আপনাকে ব্যবহার করে ডাস্টবিনে কেউ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে এমন অনুভূত হওয়া। এমনকি আপনি যে ‘স্ট্রেস’ না ‘বার্ণআউট’ এ ভুগছেন সেটা নির্ণয় করার কোন মেডিক্যাল পরীক্ষাও নাই।
কিন্তু বার্ণআউট আপনাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলতে পারে তাই এটাকে স্বীকার করা জরুরী। বার্ণআউটের ফলে আপনি প্রোডাক্টিভ হতে পারবেন না। আপনার মতে হতাশা কাজ করতে পারে। সংশয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারেন।
আপনার পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং পেশাগত জীবনের বারোটা বাজাতে সক্ষম। দীর্ঘদিন এই সমস্যা ভেতরে পুষে রাখলে একসময় আপনার মধ্যে কিছু রোগের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘সাইনোসাইটিস’ জাতীয় সমস্যা। আমি নিজে এর মধ্যে না গেলে আজ এই প্রবন্ধ হয়তো লেখা হত না। আলহামদুলিল্লাহ! আমি কিছুটা এখন সুস্থ আছি কিন্তু বার্ণআউটের ফলে আরো বিবিধ সমস্যা হতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য,
১. হৃদরোগ (Cardiovascular diseases)
২. ইমিউন সিস্টেমের দুর্বলতা (Immune system suppression)
৩. পাকস্থলীর সমস্যা (Gastrointestinal issues)
৪. পেশীর ব্যথা (Musculoskeletal pain)
৫. ক্রনিক ক্লান্তি সিন্ড্রোম (Chronic fatigue syndrome)
৬. অনিদ্রা (Insomnia)
৭. অবসাদ ও উদ্বেগ (Depression and anxiety)
বিখ্যাত টাইম মানেজমেন্ট এক্সপার্ট লরা ভান্ডারকাম (Laura Vanderkam) এর মতে আমাদের প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৭.৬ ঘন্টা কাজ করা আদর্শিক হিসেবে ধরা যেতে পারে এবং সপ্তাহে ৩৮ ঘন্টার বেশি হওয়া যাবে না। কিন্তু খেয়াল করে আমি দেখেছি, আমি দিনে কখনো কখনো ১০ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করি। সপ্তাহে যা প্রায় ৭০ ঘন্টায় রুপান্তরিত হয়। যা উচিত নয়। এটাকে বলা হয় ‘Overloaded Burnout’।
আর যদি আপনার পেশা বা কাজ আপনার পছন্দ সই না হয় এবং উক্ত কাজ বা পেশা ছেড়ে দেওয়ার উপায়ও না থাকে তাহলে আপনি সেই কাজ বা পেশা থেকে আস্তেধীরে নিজেকে সরিয়ে নেবেন। অথবা নিজের কাজকে খুব একটা ভালোবেসে করতে পারবেন না। যদি এমন ক্ষেত্রে বার্ণআউট ঘটে তবে সেটাকে ‘Under Challenged Burnout’ বলা হয়।
আমরা জীবনে বিভিন্ন সময়ে অনুভব করি আমাদের কাছে যদি একটি সাহায্যের হাত থাকতো তাহলে কত-ই-না ভালো হত। কোথাও কেউ নাই – এই অনুভূতি, একা অনুভব করা, নিজেকে অদক্ষা মনে করা, নিজেকে অযোগ্য মনে করায় যেসব বার্ণআউট ঘটে তা ‘Neglect Burnout’ নামে পরিচিত।
সর্বশেষ, বার্ণআউট খুব ভয়ংকর প্রকৃতির। জীবনের এই চেহারা কেউ না দেখুক! কারণ, এই ধরণের বার্ণআউটের ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার নিজের জীবনের উদ্দেশ্যই ভুলে যায়, কখনো কখনো আত্মহত্যা করার মত চিন্তাও মাথায় আসতে পারে। এই বার্ণআউট কে ‘Habitual Burnout’ বলা হয়ে থাকে।
তবে এ পর্যায়ে এসে আপনাকে আপনি আর ফিক্স করতে পারবেন না। আপনাকে সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নেওয়া অতীব জরুরী। নিজের শরীর যেমন খুব খারাপ করলে বড় বড় ডাক্তার দেখান ঠিক তেমনি নিজের মনও বিগড়ে যেতে পারে, অসুস্থও হতে পারে।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিম্নোক্ত ঔষধ সেবন করতে পারেন,
১. ট্রানকুইলাইজার (Tranquilizers): ডায়াজিপাম (Diazepam), অ্যালপ্রাজোলাম (Alprazolam)
২. বিটা-ব্লকার (Beta-blockers): প্রোপ্রানোলোল (Propranolol), অ্যাটেনোলোল (Atenolol)
৩. এসএসআরআই (Selective Serotonin Reuptake Inhibitors or SSRIs): ফ্লুওক্সেটিন (Fluoxetine), সের্ট্রালাইন (Sertraline)
যদিও এই রোগের মেডিসিনে খুব বেশি উপকার নাও হতে পারে। কারণ দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা যে ‘আমি’ কে হারিয়ে ফেলেছি তাকে খুঁজে পাওয়া এতো সোজা কখনোই হবে না। তবে, একটু নিজের মত কিছুদিন থাকুন। নিজের যা মন চায় তা করুন, নিজেকে অন্তত ক’টা দিন ওর মত থাকতে দিন। কারণ আমার মতে আমাদের দেশে সবচেয়ে ‘Overloaded Burnout’ ঘটে থাকে। থামুন! এত কর্মাশিয়াল না হয়ে একটু ইমোশনাল বেয়িং হওয়া যায় না!
শেষ কবে কেঁদেছিলেন?
ফুটনোট: মনোবিজ্ঞান নিয়ে আমার কোনো ডিগ্রী নাই। যেটুকু আমি পড়ি বা জানি তা থেকেই লিখে থাকি। অনুরোধ পেলে রেফারেন্স দিয়ে দেবো। ভালো থাকুন।
ছবি: Bing Enterprise (Copilot Ai)
Also Read It On: বার্নআউট (Burnout): চাপ থেকে জ্বলন্ত ছাই!