নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

শামস ~ এলিফ শাফাকের দা ফরটি রুলস অফ লাভের অনুবাদ

১৬ ই মে, ২০২২ রাত ১০:৩৪



"যখন আমি ছোট ছিলাম, আমি দেখেছি আমার খোদাকে,
দেখেছি তার ফেরেশতাদের
স্বর্গ ও মর্তের অগনিত কুহকের দ্বার উন্মোচিত হতে দেখেছি আমার সম্মুখে।
ভেবেছিলাম, আমার মত বাকি সবাইও তাঁদের দেখে।
দিনশেষে বুঝলাম, আমার মত করে আমার খোদাকে আর কেউই দেখতে পায় না।"


- শামসুদ্দিন তাব্রিজ

সমরকন্দের খানিক দূরে, এক সরাইখানা, মার্চ, ১২৪২ ইসায়ি
.
বাওড়ি বাতাসে নিভুনিভু হয়ে জ্বলছে আমার ভাঙ্গা টেবিলের ওপর রাখা মৌমাছির মোমে তৈরি মোমবাতি। এদিকে আজ সন্ধ্যায় দেখা স্বপ্নঘোর আমার মনে এখনো জাগরুক -
.
বড় এক বাড়ি, তার উঠোন জোড়া ফুটন্ত হলদে গোলাপের বাগান। সেই উঠোনের ঠিক মাঝখানে এক পানির কূপ, রূহকে জুড়িয়ে দেয় এমন ঠাণ্ডা তার পানি। হেমন্তের শান্ত সুশীতল এক জোছনা রাত ছড়িয়ে আছে চরাচর জুড়ে। আশপাশে কেবল কিছু রাত জাগা প্রাণীর হুহুক্কার।
.
কিছুক্ষনের মাঝে দয়ালু চেহারার, প্রশস্ত কাঁধ, এবং সবুজাভ বাদামি বর্ণের গভীর আঁখিপটের একটি লোক বেরিয়ে এলো বাড়ির ভেতর থেকে। মধ্যবয়স্ক লোকটির অভিব্যক্তিতে অনিশ্চয়তা, চোখে ঠিকরে পড়ছে শোক। সে খুঁজছে আমায়।
.
"শামস, শামস, কোথায় তুমি?" সে ডানে বামে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো।
.
প্রবল বায়ুর তোড়ে মেঘ উড়ে এসে ঢেকে দিলো চাঁদকে। নাকি এরপর যা ঘটতে চলেছে, তা স্বচক্ষে দেখতে অনাগ্রহী চাঁদ লুকিয়ে গেলো নিজেই? প্যাঁচা ডাকা বন্ধ করে দিলো, বাদুড়গুলো ডানা গুটিয়ে বসে গেলো নিজ নিজ ডালে, এমনকি মশালে চটচট শব্দে পুড়তে - পোড়াতে থাকা আগুন পর্যন্ত হয়ে গেলো নিঃশব্দ, নির্বাক। সারা পৃথিবী জুড়ে বিরাজ করতে থাকলো এক অসীম নীরবতা।
.
লোকটি এগিয়ে গেলো কুপের দিকে। ঝুঁকে পড়ে উঁকি দিলো তার ভেতরে -
.
"শামস, প্রিয় শামস," ফিসফিসিয়ে উঠলো সে "তুমি আছো এখানে?"
আমি উত্তর দেয়ার জন্যে আমার মুখ খোলার চেষ্টা করি, কিন্তু আমার কণ্ঠ দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোয় না।
.
মানুষটা আরও ঝুঁকে উঁকি দিলো কুপের ভেতর। প্রথম প্রথম কুপের ভেতরের অন্ধকার ছাড়া তার চোখে আর কিছু ধরা পরছিল না। একটু পর, সামুদ্রিক ঝড়ে আক্রান্ত জাহাজের ভাঙ্গা মাস্তুলের মতো আমার একটি হাতকে খুঁজে পেলো তার চোখ। কুপের মধ্যের পানিতে ভাসছে সে হাত। তারপর, সে কুপের মধ্যে খুঁজে পেলো একজোড়া চোখ। কালো পাথরের মতো উজ্জ্বল সে চোখজোড়া প্রবল অন্তর্ভেদী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঘনকালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভরা চাঁদের দিকে। আমরা চোখ জোড়া ঠিক চাঁদের বুক বরাবর তাক করা, যেন তারা আমার হত্যাকাণ্ডের কারন জানতে চাইছে আকাশের কাছে।
.
লোকটা বসে পড়লো হাঁটু গেড়ে, বুক চাপড়ে কেঁদে উঠলো জোরে - "ওরা মেরে ফেলেছে ওকে! ওরা মেরে ফেলেছে আমার শামসকে!" সে চিৎকার করে চলল ক্রমাগত।
.
ঠিক তখন, পেছনের ঝোপ থেকে একটি ছায়া দ্রুত গতিতে সরে এলো বাগানের দেয়ালের দিকে। তারপর, জংলি বেড়ালের ক্ষিপ্রতায় তা অতিক্রম করে গেলো সে দেয়াল। ক্রন্দনরত মানুষটি কিন্তু খেয়াল করে নি এর কিছুই। ভেতর থেকে উদ্গত চুরমার করা বেদনায় সে কেঁদেই চলল, কেঁদেই চলল, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কণ্ঠ কাঁচের মতো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
.
"এই পাগল! চিৎকার বন্ধ করো বলছি!"
"..."
"বন্ধ করো এই বিচ্ছিরি আওয়াজ, নইলে ঘাড় ধরে তোমাকে বের করে দেয়া হবে!"
"..."
"এই, থামো এক্ষুনি! শুনতে পাচ্ছ না কি বলছি? থামো!"
.
টের পেলাম, একটা ক্রুদ্ধ পুরুষ কণ্ঠ ক্রমাগত এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আরও কিছুক্ষন স্বপ্নঘোরে থাকার জন্যে ভান করলাম, যেন শুনছি না আমি ওর চিৎকার। আমার মৃত্যুর ব্যাপারে আরও কিছু জানতে আগ্রহী আমি। একই সঙ্গে জানতে আগ্রহী, স্বপ্নে দেখা পাওয়া, পৃথিবীর সবচে দুঃখী চোখ জোড়ার অধিকারি এই লোকটা কে। কি সম্পর্ক তার, আমার সঙ্গে? কেন হেমন্তের এই শান্ত শীতল রাতে সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল আমায় পাগলের মতো?
.
কিন্তু আমার স্বপ্নঘোরে ডুব দেবার আগেই কেউ আমাকে দু'কাধে ধরে এমন জোরে ঝাঁকি দেয় যে আমার পুরো শরীর ঝনঝনিয়ে ওঠে, মাড়ির ভেতর দু'পাটি দাঁতের ঠকঠকানো আমি বাইরে থেকেই শুনতে পাই। বাধ্য হয়ে আমাকে ফিরে আসতে হয় বাস্তবের দুনিয়ায়।
.
খুব ধীরে, নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে আমি চোখ জোড়া খুলে দেখি আমার পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে। ঘন দাঁড়ির জঙ্গলে আচ্ছাদিত চেহারার, লম্বা স্বাস্থ্যবান এক লোক দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। তার গোঁফজোড়া আবার পাকানো, প্রান্তের দিকে সুচালো। দ্রুত বুঝে ফেলি, এ লোক সরাইখানার মালিক। একনজর দেখেই লোকটার ব্যাপারে আমার দুটো ধারনা তৈরি হয় - নিজের চড়া গলা, আর মারকুটে স্বভাবের জোরে সে তার চারপাশের সবাইকে তটস্থ রাখে সর্বদা। আর এ মুহূর্তে সে ক্ষেপে আছে ভয়ানক।
.
"কি চাই?" আমি জিজ্ঞেস করলাম। "আমার হাত ধরে টানাটানি করছো কেন?"
.
"কি চাই আমি?" সরাইখানার মালিক গর্জে ওঠে। "আপাতত চাই যে তুমি চিৎকার বন্ধ করো। আমার সমস্ত খদ্দের ভেগে যাচ্ছে তোমার জন্য।"
.
"তাই? আমি চিৎকার করছিলাম?" নিজেকে ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বিড়বিড় করি আমি।
.
"তা আর বলতে! ভালুকের হাতের তালুতে কাঁটা ফুটলে তা যেভাবে চেঁচায়, তুমিও ঠিক সেভাবে চেঁচাচ্ছিলে। হয়েছিল কি? খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে? দুঃস্বপ্ন দেখছিলে তারপর?"
.
আমি জানতাম যে পুরো ঘটনার এটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা, এবং আমি যদি ওর সঙ্গে একমত হই, তাহলে সরাইখানার মালিক আমাকে আপাতত ছেড়ে দেবে। তবুও আমার মিথ্যে বলতে মন সায় দিচ্ছিল না।
.
"ব্যাপারটা অমন না, ভাই। আমি ঘুমাই নি, বা দুঃস্বপ্নও দেখছিলাম না। সত্যি বলতে স্বপ্ন বলতে যেটা বোঝায়,সে স্বপ্ন আমার দেখা হয়ে ওঠে না কখনো।"
.
"তাহলে তোমার ওরকম চ্যাঁচানোর মানে টা কি?" সরাইখানার মালিক জানতে চাইলো।
.
"আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এটা একটা ভিন্ন ব্যাপার।"
.
গোঁফে তা দিতে দিতে সে কিছুক্ষন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। এভাবে কিছু সময় যাওয়ার পর সে মুখ খুলল - "তোমাদের মতো দরবেশদের নিয়ে আর পারা গেলো না। গুদামঘরে আটকা পড়া ধেড়ে ইঁদুরগুলো মতো পাগলাটে মাথাওয়ালা তোমরা এক একটা। বিশেষত তোমার মতো ঘুরে বেড়ানো পাগলগুলো। সারাদিন রোজা রেখে টগবগে সূর্যের নীচে হেঁটে বেড়াবে আর জিকির করবে। মস্তিষ্ক গরমে সবসময় এরকম টগবগ করে ফুটতে থাকলে এসব উল্টোপাল্টা জিনিস তো দেখবেই!"
.
জবাবে আমি হাসি। সত্য হতেও পারে ওর কথা। প্রচলিত আছে, খোদার মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া, আর সত্যি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া - এ দুইয়ের মাঝে ব্যবধান খুব সামান্য।
.
এরমধ্যে দু'জন বেয়ারা এসে হাজির হল। তাদের হাতে খাবার বইবার বিশাল থালি, তাতে ছোট ছোট বর্তন, ছাগলের তন্দুর, মাছের শুটকি, খাসির ভুনা, গমের রুটি, মাংসের গোল্লা, সবজি, আর ভেড়ার চর্বিসহ পাকানো ঘন ডাল। সরাইখানায় খাবারের অপেক্ষায় থাকা খদ্দেরদের তারা পরিবেশন শুরু করলো এসমস্ত খাবার। সমস্ত জায়গা ভরে উঠলো বেরেস্তা, রসুন, আরও নানাবিধ সুগন্ধি মসলার ঘ্রানে। আমার টেবিলের সামনে এসে যখন তারা থামল, আমার জন্যে বাকি ছিল কেবল কিছু ফুটন্ত সুরুয়া, আর এক পাশে পোড়া লেগে যাওয়া রুটি।
.
"এগুলোর মূল্য পরিশোধ করার মতো পয়সা আছে তোমার কাছে?"
সরাইখানার মালিক প্রশ্ন করলো আমাকে। তার কণ্ঠে বিদ্রূপের সুর স্পষ্ট।
.
"না, তা নেই," বললাম আমি। "কিন্তু আমি অন্য উপায়ে এই খাবারের বিনিময় পরিশোধ করতে পারি। আমাকে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার বদলে আমি তোমার খোয়াবের তাবির বাতলে দেবো।"
.
"খোয়াবের তাবির? মানে স্বপ্নের অর্থ?" সরাইখানার মালিক হাত নেড়ে আমার প্রস্তাব প্রায় উড়িয়ে দিলো।"মাত্রই তুমি বললে যে তুমি স্বপ্ন দেখো না কখনো।"
.
"ওটাও সত্য। আমি খোয়াবের তাবির করি, যদিও আমি নিজে কখনো খোয়াব দেখি না।"
.
"আমার উচিৎ তোমাকে এখুনি ঘাড় ধরে বের করে দেয়া। ঘিলুতে গিঁট লাগা পাগলের দল তোমরা দরবেশরা সব," থুতু মারার ভঙ্গীতে সরাইখানার মালিক কথাগুলো বলে। "মুফতে তোমাকে কিছু পরামর্শ দিই। জানি না তোমার বয়স কতো, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে দোনো জাহানের জন্যে যথেষ্ট পরিমান ইবাদত বন্দেগী তুমি ইতোমধ্যে করে নিয়েছ। এখন ভালো দেখে একটা মেয়ে খুঁজে বের করো, সংসার জমিয়ে বসো। বাচ্চাকাচ্চা নাও। তাহলে জমিনের ওপর পা থাকবে। সারা দুনিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর কি অর্থ, যেখানে সব জায়গার মানুষের দুর্দশার চেহারা একই? আমার কথা ভালো করে গেঁথে নাও মনে, এই ঘোরাঘুরির কোন ফায়দা নেই। সারা দুনিয়ার কোনা কোনা থেকে মানুষ এসে জড়ো হয় আমার এই সরাইখানায়। পেটের মধ্যে কয়েক গেলাস তরল পানীয় পড়বার পর সবগুলোর মুখ ছোটে, আর ঘুরেফিরে সব সেই একই গল্প বলে। একই খাবার, একই পানি, পুরনো ভুষিমাল সব গল্প সবগুলোর মুখে মুখে।"
.
"আমার তালাশ ঠিক অন্যসবার মতো না, আবার সবার থেকে খুব ভিন্নও না," আমি বলি, "আমি খোদাকে খুঁজছি। আমার তালাশ - খোদার তালাশ।"
.
"তাহলে তুমি ভুল জায়গায় খুঁজছ ওনাকে," সে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিউত্তর করে। তারপর ভারী কণ্ঠে বলে, "খোদা এই জায়গা পরিত্যাগ করেছে। কেউ জানে না যে সে কখন ফিরবে, বা আদৌ কখনো ফিরবে কি না।"
.
আমার অন্তর বুকের খাঁচার মধ্যে ধড়াস ধড়াস করে বাড়ি খেয়ে উঠলো কয়েকবার। "খোদাকে নিয়ে বুরাভালা বলা আসলে নিজের নসিবকে নিয়েই মন্দ কথা বলা।" বললাম আমি।
.
আমার কথা শুনে সরাইখানার মালিকের ঠোঁটের কোনে এক কিম্ভূতকিমাকার বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। এদিকে বাচ্চারা রাগলে যেমনটা লাগে, ওর মুখের মাংসপেশিগুলো বিরক্তিতে শক্ত হয়ে রইলো তেমন করে।
.
"খোদাকে কি আমাদের বলেন নি যে - 'তোমাদের হৃদপিণ্ড থেকে মস্তিষ্কে রক্ত পরিবহন করে যে শিরা/ধমনী, আমি তার চেয়েও তোমাদের ঘনিষ্ঠ?' " আমি জিজ্ঞেস করি। "খোদাকে আসমানে তালাশ করা ভুল। খোদা আমাদের সবার ভেতরেই আছেন। তিনি আমাদের পরিত্যাগ করেন না কখনো। কেউ নিজেকে নিজে কীভাবে পরিত্যাগ করে?"
.
"ছেড়ে যান তিনি, পরিত্যাগ করেন তিনি আমাদের!" কঠোর ভাষায় চিবিয়ে চিবিয়ে প্রতিউত্তর করে সরাইখানার মালিক। "খোদা যদি আমাদের ভেতরেই থাকে, আর এতো কাছে থেকে আমাদের কষ্ট পেতে দেখেও কোন রা না করে, তবে কেমনতরো খোদা সে? কেন আমাদের সুধারনা রাখতে হবে তার ব্যাপারে?"
.
"এটাই দিওয়ানেগির প্রথম শর্ত, বন্ধু," আমি বলি, "আমরা যে যেরকম, আমরা খোদাকেও ঠিক সে আঙ্গিকেই কল্পনা করি। যদি খোদার ভাবনা আমাদের মধ্যে কেবল ভীতি আর পাপবোধ বহন করে আনে, তবে তার অর্থ হচ্ছে এই যে - আমাদের অন্তরটাই পাপের বোঝায় কলুষিত, ভীত, অন্ধকার। আর যদি খোদার ভাবনা আমাদের মনের মধ্যে কেবলি ভালোবাসার উন্মেষ ঘটায়, তার অর্থ হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে আমরা নিজেরাই দিওয়ানা ধাঁচের মানুষ।"
.
"কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? তোমার বাতলে দেয়া সূত্র মতে খোদা তো স্রেফ আমাদের কল্পনা মাত্র, তাহলে।" সরাইখানার মালিক সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেও, আমি বুঝতে পারি যে সে আমার বক্তব্যে বিস্মিত হয়েছে।

সরাইখানার শেষমাথার এক প্রবল হইহল্লা - হট্টগোলে আমাদের আলাপে ছেদ পড়ে। ঘুরে তাকাতে দেখা গেলো, মদের নেশায় চূর হওয়া দু'জন মাস্তান সদৃশ মানুষ চারপাশে তাকিয়ে তুমুল স্বরে গালিগালাজ বর্ষণ করে চলেছে। বেপরোয়াভাবে তারা খাওয়ায় ব্যস্ত খদ্দেরদের থালা থেকে খাবার তুলে খেয়ে নিচ্ছে, তাদের পানীয়র সুরাহীতে মুখ লাগিয়ে পান করছে, কেউ প্রতিবাদ করা মাত্রই মক্তবে পড়ুয়া দুষ্ট ছেলেদের মতো তাদের নিয়ে হাসিতামাশায় মেতে উঠছে।
.
"হে মহান দরবেশবাবা, এদের তো আগে থামাতে হয়, কি বলো?" দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে সরাইখানার মালিক এগিয়ে চলে ওদের দুজনের দিকে, "দেখো খালি আমি কি হাল করি এই হতচ্ছাড়াদের।"
.
বিদ্যুতের বেগে সে ছুটে গেলো খাবারের কক্ষের শেষ মাথায়। দুটো মাতালের একটাকে ঘুরিয়ে এনে ধরাম করে ঘুষি মেরে বসলো ওর মুখে। নিঃসন্দেহে মাতালটা এটা আশা করে নি। ঘুষি খেয়ে সে একদম খালি বস্তার মতো লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। বিড়বিড় করে কি একটা কিছু বলতে বলতে সে একদম নিশ্চুপ হয়ে পড়লো।
.
অন্যজন অবশ্য বেশ শক্তপোক্ত ছিল। সে এতো সহজে হার মানার লোক না। অবশ্য কিছুক্ষণ প্রতিরোধের পর সরাইখানার মালিক তাকেও ঠেঙ্গিয়ে কাত করে ফেলে। মাটিতে মাতালটাকে পেড়ে ফেলে সরাইখানার মালিক ধরাম ধরাম করে লাথি মারে ওর পাঁজর বরাবর। তারপর ভারী বুটজুতো দিয়ে পাড়া দিয়ে ধরে ওর হাতের আঙ্গুলগুলো। একটা বা বেশ কয়েকটা আঙ্গুল তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে যাওয়ার মড়মড় শব্দ আমি দূরে দাঁড়িয়েই শুনতে পাই।
.
"থামো!" আমি চিৎকার করে উঠি। "মেরে ফেলবে নাকি মানুষটাকে?"
.
সূফী হিসেবে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে কারো জানের হেফাজতে, এবং কারো কোন ক্ষতি না করায়। মোহ আর মায়ায় জালে ঢাকা এ পৃথিবীর বুকে মানুষ কখনো কারনে, কখনো অকারনেই একে ওপরের সঙ্গে লড়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু সূফী হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে লড়বার মতো হাজারটা যৌক্তিক কারন থাকলেও কখনো লড়াই করবে না। সহিংসতা অবলম্বন করবার কোন সামর্থ্যই আমার নেই। কিন্তু আমি নিজেকে একটা নরম চাদরের মতো বিছিয়ে দিতে পারি ঐ রক্তপিপাসু সরাইখানার অধিকারী, আর মার খেতে থাকা মাতালের মাঝখানটায়, যাতে করে তারা আলাদা হয়ে যায়।
.
"তুমি মাঝখানে কথা বলতে এসো না দরবেশ, নইলে তোমারও খবর আছে!" সরাইখানার মালিক চেঁচিয়ে উঠলো, যদিও আমরা দুজনই জানি, সে যা বলল, তা আসলে করবে না।
.
কিছু পর, যখন সরাইখানার বেয়ারাগুলো লোকদুটোকে তুলে সরাইখানার বাইরে রেখে এলো, ততক্ষণে সেই মাতাল দু'জনের একজনের নাক , আরেকজনের আঙ্গুল ভাঙ্গা, আর পুরো কামরার এখানে সেখানে রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পুরো সরাইখানা জুড়ে এক ভীতিকর নীরবতা। নিজের সহিংসতায় সবাইকে নীরব করে দিতে পারার গর্বে গর্বিত সরাইখানার মালিক আমার দিকে তাকাল গর্বের চোখে। তারপর, সে যখন পুনরায় কথা বলা শুরু করলো, তার উদ্দেশ্য আমি হলেও কণ্ঠ আর বাচনভঙ্গি শুনে মনে হল সে কথা বলছে পুরো সরাইখানার সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে।
.
"আমি বরাবর এমন ছিলাম না, দরবেশ। সহিংসতা আমার পছন্দ নয়, কিন্তু একসময় এসে উপলব্ধি করলাম যে এটা ছাড়া উপায় নেই। যখন আসমানের খোদা দুনিয়ার মানুষদের মধ্যে ইনসাফ বজায় রাখার দায়িত্ব ভুলে যান, তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের শক্ত হাতে দুনিয়ায় ইনসাফ কায়েম করা লাগে। তো যখন তুমি তোমার খোদাকে খুঁজে পাবে, তাকে বোলো - সে যদি তার ভেড়ার পালদের এভাবে নিরাপত্তাহীনভাবে ছেড়ে দেয়, তো তারা বসে বসে জবাই হবার জন্যে অপেক্ষা করবে না। তারা আত্মরক্ষার্থে নেকড়েতে পরিণত হবে।"
.
জবাবে আমি হালকা কাঁধ নাচিয়ে উত্তর করলাম, "তোমার ধারনা ভুল"। তারপর ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম সরাইখানার দরজার দিকে। কিন্তু লোকটা আমার পথ জুড়ে দাঁড়ালো।
.
"তোমার কি ধারনা যে - আমি দুর্বল ভেড়া থেকে প্রতিশোধপরায়ণ নেকড়েতে পরিণত হয়েছি, আমার এই দাবী ভুল?"
.
"না, ,ওটা ঠিক আছে," আমি উত্তর করি। "দেখাই যাচ্ছে, তুমি বেশ তন্দুরুস্ত নেকড়েতে পরিণত হয়েছ। কিন্তু তুমি যেটাকে 'ইনসাফ' বলছে, ওটাকে আমি ইনসাফ মনে করি না।"
.
"দাঁড়াও! তোমার সঙ্গে আমার আলাপ শেষ হয় নি," সরাইখানার মালিক চেঁচিয়ে উঠলো পেছন থেকে। "তোমার শর্তই সই। খাবার আর থাকার জায়গার বিনিময়ে তুমি আমাকে আমার খোয়াবের তাবির বাতলে দেবে।"
.
"বরং আরও ভালো একটা প্রস্তাব দিই," বললাম আমি। "আমি তোমার হস্তরেখা পড়ে শোনাই।"
.
আমি ঘুরে হেঁটে গেলাম ওর দিকে। ওর রক্তাভ চোখে চোখ রেখে তাকালাম প্রখর দৃষ্টিতে। ও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিতান্ত অস্বস্তি সহকারে সরিয়ে নিলো ওর দৃষ্টি। তবুও, যখন আমার মুঠিতে ওর হাত পাকড়ে হাতের তালু মেলে ধরলাম আমার চোখের সামনে, ও হাতখানা টেনে সরিয়ে নিলো না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম ওর হাতের তালুর বুকে গভীরভাবে দাগ কেটে এগিয়ে চলা আঁকাবাঁকা, অমসৃণ আয়ুরেখাগুলিকে।
.
ধীরে ধীরে ওর প্রকৃত সত্তার রঙ উন্মোচিত হতে শুরু করলো আমার অন্তঃচক্ষুর সম্মুখেঃ ক্ষয়ে যাওয়া খয়রি আর নীলের সংমিশ্রণ, যা প্রায় ধূসর বর্ণ ধারন করেছে। ওর আত্মিক - আধ্যাত্মিক শক্তি ক্ষয়িষ্ণু, ম্রিয়মাণ। বাইরের পৃথিবীকে মোকাবেলা করবার মতো কোন সক্ষমতাই বাকি নেই তাতে। ওর সত্তার ভেতরটা, এক মরা গাছের মতোই মৃতপ্রায়। ওর আত্মিক - আধ্যাত্মিক শক্তি ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে যে শুন্যতা আর দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা ঢাকবার জন্যেই ও ওর শারীরিক শক্তির পাশবিক প্রদর্শনে এতোটা আগ্রহী।
.
আমার হৃদতন্ত্রের গতি বেড়ে গেলো, কারন আমার চোখে কিছু একটা ধরা দিচ্ছিল। প্রথমে খুব আবছাভাবে, যেন পর্দার আড়ালে থাকা কোন এক সত্তা। অস্পষ্টতা ক্রমাগত দূর হতে শুরু করলে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে।
.
"লালচে বাদামি বর্ণের কেশের এক নারী, শরীরে উল্কি আঁকা, খালি পা, তার কাঁধের ওপর এক রক্তিম বর্ণের চাদর বিছিয়ে রাখা।"
.
"তুমি তোমার এক আপনজনকে হারিয়েছ।" আমি বললাম, তার বাম হাতের তালু আমার চোখের সামনে টেনে নিতে নিতে।
.
"তার স্তন মাতৃদুগ্ধে পরিপূর্ণ, পেট এতো বড় - যেন এখনি তা ফেটে ভেতরের শিশু বেরিয়ে আসবে। সে একটি কুঁড়েঘরে বসা। সে ঘরে আগুন লেগেছে। রৌপ্য নির্মিত জিন বিশিষ্ট ঘোড়ার পীঠে চড়ে একদল সৈন্য সে কুঁড়েঘরের বাইরে হন্যে হয়ে ফিরছে, অস্ত্র বাগিয়ে। পুরো এলাকার বাতাস ঘন হয়ে আছে খড়, আর মানুষের মাংশের পোড়া ঘ্রানে। আক্রমনকারীরা চ্যাপ্টা আর প্রশস্ত নাকের মঙ্গোল। ঘাড় খাটো আর গুঁজো। হৃদয় পাথরের মতো কঠোর। চেঙ্গিশ খানের দুর্দম সৈন্য ওরা।"
.
"তুমি দু'জনকে হারিয়েছ আসলে," আমি আমার আগের বক্তব্য সংশোধন করি। "তোমার স্ত্রীর গর্ভে তোমাদের প্রথম সন্তান ছিল।"
.
ভ্রূ কুঁচকে ও নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। দাঁত দিয়ে ঠোঁটের কোন কামড়ে ধরা। সবমিলিয়ে চেহারা দেখে ওর মনের ভাব বোঝার আর কোন উপায় ছিল না। এক ধাক্কায় ওর বয়স যেন বেড়ে গেছে অনেকখানি।
.
"তুমি যা হারিয়েছ, তার কোন সান্ত্বনা হতে পারে না। কিন্তু তোমার একটা জিনিস জানা উচিৎ," আমি বললাম। "ওরা আগুনে পুড়ে, বা ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা যায় নি। ছাদ থেকে এক ভারী কাঠের টুকরা মাথার ওপর খসে পড়াতে তোমার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে, প্রায় ব্যাথামুক্ত অবস্থায় মারা যায়। তুমি সবসময় ভেবে এসেছ যে অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে সে মারা গেছে। কিন্তু বাস্তবে সে অতটা ভোগে নি, যখন মৃত্যু এসে তাকে আলিঙ্গন করে।"
.
সরাইখানার মালিকের ভ্রূ আরও কুঁচকে ঘন হয়ে আসে, এমন কোন চিন্তার চাপে, যা কেবল সে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। খসখসে কণ্ঠে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি এসব কীভাবে জানলে?"
.
"প্রিয়তমা স্ত্রীর ঠিকমতো দাফন কাফন করতে না পারার দুঃখে তুমি তোমার পুরোটা জীবন দোজখের আগুনে পুড়েছ মনে মনে। এখনো তুমি স্বপ্নে দেখো, যে গর্তে চাপা পড়েছিল সে, সেই গর্তের ভেতর থেকে সে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু, এসব তোমার মস্তিষ্কের অলীক কল্পনা। বাস্তবে তোমার স্ত্রী, আর তার গর্ভের সন্তান - দুজনই খুব ভালো আছে। তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে অসীমে, আলোর মতো মুক্ত অবস্থায়।"
.
এরপর, আমি প্রতিটা শব্দ গুণে গুণে ওকে বললাম - "তুমি চাইলে প্রতিশোধের নেশায় ধুঁকতে থাকা নেকড়ের জীবন ত্যাগ করে আবারো ভেড়ায় রুপান্তরিত হতে পারো। তোমার ভেতর এখনো সে সত্তা জীবিত আছে খানিকটা।"
.
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র সরাইখানার মালিক তার হাতটা টেনে সরিয়ে নেয় আমার হাতের মুঠো থেকে, যেন কোনভাবে ফুটন্ত এক কড়াই ছুঁয়ে ফেলেছে সে। "আমার ভালো লাগছে না তোমার কথাবার্তা, দরবেশ," সে বলে। "আমি তোমাকে আজ রাতে এখানে থাকতে দিচ্ছি। কিন্তু কাল খুব ভোরে, আলো ফুটে ওঠার আগেই তুমি বিদায় নেবে এখান থেকে। তোমার চেহারা যেন আর না দেখি আমি।"
.
তো, এই হল দুনিয়ার নিয়ম, ভাবলাম আমি। মানুষকে সত্য বলো, তারা তোমাকে অপছন্দ করবে। আর তাদেরকে ভালোবাসার পথ বেছে নিতে বলো, তারা একধাপ এগিয়ে তোমাকে ঘৃণা করা শুরু করবে।
.
(From The Forty Rules of Love - translated into Bengali by me)

(এলিফ শাফাকের দা ফরটি রুলস অফ লাভ অনুবাদ করছি। ১০,০০০ শব্দের কিছু বেশি শেষ হয়েছে। প্রায় দেড় লাখ শব্দের উপন্যাস। মাওলা ব্রাদার্স থেকেই প্রকাশ করার ইচ্ছা। এলিফ শাফাককে ইমেইলও করা হয়েছে, অফিশিয়াল পারমিশনের জন্যে। যা হোক, বিষয় সেটা না। এই বইটা, একটা ইনার জার্নি। আগে যখন পড়েছিলাম, সাংঘাতিকভাবে নাড়া খেয়েছিলাম ভেতর থেকে। এতোটা কাঁপিয়ে দিয়েছিলে, এর আগে, হেরমেন হেসের সিদ্ধার্থ বইটা।
.
অনুবাদ যখন করছি, আমার মূল চিন্তা, শামস, এবং রুমির অংশগুলোতে, তাদের বক্তব্যের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে বাংলায় অনুবাদ করতে পারার ব্যাপারটা। এই অংশে শামসের একটা পার্টের অনুবাদ শেয়ার করলাম। যে কেউ পড়ে পরামর্শ দিতে পারেন, শামসের বয়ানের সঙ্গে এই বাংলার ওজন মেলে কি না।
.
"Love" শব্দটার অনুবাদে দেওয়ানেগি ব্যবহার করছি। পার্থিব, এমনকি মানব - মানবীর ভালোবাসা অর্থে, এই 'লাভ' শব্দটা এলিফ শাফাক তার উপন্যাসে ব্যবহার করেন নি। আর কোন শব্দ ব্যবহার করা যায় কি? পরামর্শ দিতে পারেন।)



মন্তব্য ১ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই মে, ২০২২ ভোর ৪:২৯

বলেছেন: চল্লিশ টা রুলের আমার অনুবাদ আছে।
বইটি চারবার পড়েছি।
আপনার অনুবাদ পুরোটাই আপনার ইচ্ছে মতো শব্দের ব্যবহার সেটা অনুবাদ নাকি ভাবানুবাদ একটু হলে জানাবেন।।

রুলস নাম্বার এক থেকে দশের আপনার অনুবাদ টা দেন।।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.