নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেসবুকে আমি - রিয়াদুল রিয়াদ (শেষ রাতের আঁধার)

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার )

কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………

রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) › বিস্তারিত পোস্টঃ

কল্পকাহিনীঃসোসান মিহানা-(প্রথম পর্ব)

১৩ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:২৩



যতদূর চোখ যায় শুধু সমুদ্রের অথই জল। সমুদ্রের নীল জল, আকাশের নীলিমা আর সূর্যের আলোর সপ্তরঙার ছটায় উত্তাল ঢেউগুলো এক মনমাতাল রূপে অনুপম ভাবে উপচে পড়ছে সবুজ পাহাড়ের গায়ে। চারিদিকে সমুদ্র ঘেরা এক দ্বীপ,চারপাশে প্রাচীরসম পাহাড়। সুবিশাল শ্যামল পাহাড়গুলো দ্বীপের সীমান্ত রক্ষির মতন দাঁড়িয়ে আছে চারদিক ঘিরে। বিধাতা যেন নিজ হাতে সুনিপুণ কারিগরি দক্ষতায় গড়ে তুলেছেন এই দ্বীপ। পাহাড়ের মাঝে বিস্তীর্ণ জনপদ। যেখানে আছে ফুল ফলের স্বর্ণভাণ্ডার , গভীর ঘন বন, পাখির মন মাতানো কলতান। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে একবার তাকালে মনে হবে যেন এ এক স্বর্গপুরি।আর এ স্বর্গপুরির বাসিন্দা এক ভিন্ন জীবনধারার সম্প্রদায়।নির্দিষ্ট কোন ধর্ম মেনে এরা চলে না। তারা সম্পূর্ণ আলাদা জীবন যাপন করে। তাদের কাছে আছে প্রবল যাদুশক্তি।তবে এই যাদুশক্তি ব্যবহারের কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। ইচ্ছা করলেই এই যাদু ব্যবহার করতে পারে না। বিপদে পড়লে বা খুব বেশি প্রয়োজনের সময়টা ব্যতীত , তারা এই যাদু ব্যবহার করতে পারে না, পূর্ব নির্ধারিত হিসেবে। যাদুশক্তি থাকার কারণেই,বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে তারা এখনও টিকে আছে। তাদের দ্বীপের নাম সিলিওসিনসা এবং জাতির নাম কিন্দিবিবা।

এক অদ্ভুত জীবনযাপন কিন্দিবিবা সম্প্রদায়ের। তারা কারও শাসনে চলে না। তাদের ভিতর কোন নেতা বা রাজা অথবা প্রজা নেই। সবাই এখানে স্বাধীন। নিজের উপর নিজের কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য কারও প্রভাব নেই এই সম্প্রদায়ে। তাই তাদেরকে বলা যায় সম্পূর্ণ স্বাধীন। কেননা সক্রেটিস বলেছেন,

" The man who is the master of himself is truely free."



তারা সমুদ্রে মাছ ধরতে খুব ভালবাসে তার সাথে খেতেও।বন থেকে বিভিন্ন ফল, নিজেদের চাষ করা শস্য যার্যা দিয়ে তৈরি রুটি খেতেও খুব পছন্দ করে। তারা মাছ ধরে, সেগুলোকে মার্নাস নামক নরম গাছের অংশবিশেষের মধ্যে ফুটা করে ,তার মধ্যে মাছ ভরে পুড়ে খেতেও খুব পছন্দ করে। মার্নাস গাছের ঝাল আর হালকা তেতো ভাব, এবং মাছের মজায় খাবার যেন অসাধারণ হয়ে উঠে। এছাড়া তারা বিশেষ দিনে পাখি ও পোড়া ছাগল এবং জেব্রার মাংস খেতে ভুল করে না।

সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে তারা তাকে ভেলা বানিয়ে ভাসিয়ে দেয় অথই সমুদ্রে। আর সমবেদনাস্বরূপ সম্প্রদায়ের সকল বিবাহিত পুরুষ মহিলারা এসে একত্রে জড়ো হয়, সেদিন নিদ্রা ও আহারহীন ভাবে কাঁটায়,নিজেদের মধ্যে কোন কথা বলে না। সকালে সবাই গোসল করার পর তাদের মধ্যে কথাবার্তা বলা শুরু করে।

তাদের ঘরগুলো উঁচু মাচানযুক্ত। সম্পূর্ণটাই কাঠের তৈরি। তাদের বাড়িগুলো আয়তাকার। অর্থাৎ উপরের ছাদ ও নিম্নতল সমতল ও দুই পাশ লম্বাকৃতি।





কিন্দিবিবা সম্প্রদায়ে বিবাহ হয় এক ভিন্ন ধারায়। এ সম্প্রদায়ের কোন কুমার ছেলে ও কুমারী মেয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করতে পারে না। অর্থাৎ একে অন্যকে দেখা নিষেধ বিয়ের আগে। পিতা মাতারা পাত্র পাত্রি পছন্দ করে, তাদের মধ্যে বিবাহ সম্প্রন্ন করে দেন। তাদের সম্প্রদায়ের বিয়ের প্রথম শর্ত হল, ছেলের বয়স মেয়ের বয়সের চেয়ে বেশি হতে হবে। প্রথমে পিতা মাতারা পাত্র- পাত্রি পছন্দ করেন। তারপর তাদের বয়সের হিসাব করে বিয়ের ব্যবস্থা করেন।



প্রথমে ছাদবিহীন দুটি ঘর তৈরি করা হয়, একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে। ঘরগুলো এমন ভাবে তৈরি করা হয় যেন, ভিতর থেকে বাহিরের কিছু না দেখা যায়। তারপর বর ও কনেকে সেই ঘরে প্রবেশ করানো হয়। তবে বর কনে একে অন্যকে দেখে না। বর কনে দুজনেরই এই প্রথম ঘরের বাহিরে আসা। প্রত্যেক ঘরের মধ্যে ১০ টা করে এক বিশেষ ধরণের গোলাকার ফল দেয়া হয়। তারপর প্রথমে কনে বরের ঘর না দেখে, একটি ফল বরের ঘরের দিকে ছুড়ে মারে। তারপর বর কনের ঘরের দিকে ছুড়ে মারে। এভাবে ১০ টা করে মোট ২০ টা ফল ছোড়ার, কোন এক পর্যায়ে যদি, বর ও কনের ফল পরপর গিয়ে উভয়ের ঘরে পরে ,তাহলেই তাদের মধ্যে বিবাহ হয়ে যায়। কিন্তু ২০ টি ফলের মধ্যে পরপর যদি ,বর ও কনের ফল পরস্পরের ঘরে গিয়ে না পড়ে, তবে আর তাদের মধ্যে বিবাহ হয় না।





কিন্দিবিবা সম্প্রদায়ের মানুষরা বর্তমানে স্বাধীন থাকলেও তারা একসময় এক ব্যক্তির অধীনস্থ ছিল। সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে প্রবল যাদুশক্তি থাকার পরও তাদের সেই ব্যক্তির কথা মেনে চলতে হত। একদিন সম্প্রদায়ের লোকজন জড়ো হল,আলোচনা করল। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হল, তারা আর কোন প্রভুর অধীনস্থ হয়ে থাকবে না।তারা স্বাধীন হিসেবে বাঁচতে চায়। তারা তাদের প্রভু হোসানেকতি কে বলল, প্রভু আমরা আপনার প্রজা। আপনার কথা মানাই আমাদের কর্তব্য। কিন্তু আমরা চাই স্বাধীনভাবে বাঁচতে। আমরা চাই আমাদের উপর কারও কর্তৃত্ব থাকবে না। আমরা স্বাধীনতা চাই প্রভু।"

হোসানেকতি এই কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না, রাগে চোখ জ্বলজ্বল করছে।রাগে শরীর কাঁপছে হোসানেকতির। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ দ্বীপে আঁচড়ে পড়তে লাগল দ্বীপে।কিন্দিবিবার লোকেরাও তাদের যাদুশক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করল, নিজেদের বাঁচাবার জন্য। এতে সেখানে এক হুলস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। অবশেষে হোসানেকতি বলল, আচ্ছা তোমাদের আমি স্বাধীনতা প্রদান করলাম। আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। আজ থেকে তোমরা স্বাধীন।



স্বাধীনতা পাবার পর সেখানের লোকেরা আনন্দে, জয়োৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠল। তখন হোসানেকতি বলল, কিন্তু হ্যাঁ। আমি খুব মনঃকষ্ট নিয়ে তোমাদের ত্যাগ করছি। আমাকে তোমরা আমারই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিতাড়িত করলে। আমি ইচ্ছা করলেই তোমাদের প্রভু হয়ে থাকতে পারতাম। তোমরা আমার কিছুই করতে পারতে না। তবে তাতে বিশৃঙ্খলায় তোমাদের এ দ্বীপ ভরে যেত। অন্তঃযুদ্ধ, প্রবল যাদু বিদ্যা বিনিময়, আমাকে মারার বৃথা চেষ্টা, নানা কিছুতে তোমরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে। তোমরাই মারা যেতে। কিন্তু আমি তা চাই না। তোমাদের এতো বড় ক্ষতি হোক, আমার তা কাম্য না। কিন্তু আমি চলে যাবার পর, তোমাদের মধ্যে কোন কুমার কুমারী ছেলে মেয়ে, নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলে, তাদের যদি তোমরা তোমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে ,নৌকা বানিয়ে এমন কোন দ্বীপে ,যেখানে কোন মনুষ্য জীবের অস্তিত্ব নেই, সেখানে পাঠিয়ে না দাও ;তবে তোমরা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তোমাদের ধ্বংসের আগে, তোমাদের এই দ্বীপে এক ঝাঁক কবুতর আসবে। সেই কবুতর আসার পরও যদি, তোমরা তোমাদের মাঝে সেই কুমার কুমারীকে খুঁজে বের করে, তাদেরকে পাঠিয়ে দাও তবেও তোমরা পরিত্রাণ পেতে পার। তবে হ্যাঁ, মনে রেখো কিন্তু, তাদের অবশ্যই মনুষ্য জীবহীন দ্বীপে পাঠাতে হবে। যদি এমন কোন দ্বীপে পাঠাও ,যেখানে কোন মানুষ আছে তবেও তোমরা ধ্বংস হবে। তখন সেই দ্বীপে তোমাদের প্রত্যেকের জন্য, একটি করে কবুতর তোমাদের মৃত্যুর বার্তা নিয়ে যাবে। আর আমি তোমাদের বলে গেলাম, তোমরা ধ্বংস হবেই। যত ভাবেই তোমরা শর্তগুলো মানার চেষ্টা কর। বিদায়!"

এই কথায় সকলের মুখ মলিন হয়ে গেল। পরক্ষনেই আবার স্বাধীনতার উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠল। পরদিন সকালে, আলোচনার মাধ্যমে দ্বীপের সকলকে হোসানেকতির বলা কথাগুলো বলা হল ,এবং বুঝিয়ে দেয়া হল।





কিন্দিবিবা সম্প্রদায়ে কোন রাজা বা প্রভু না থাকলেও, তাদের বিচারকার্য পরিচালনার জন্য একজন " সান্সি" থাকে। প্রধানত সান্সি সম্প্রদায়ের সকলের মতানুসারে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। তার কাজ হল, তাদের দ্বীপে অন্য দেশ বা সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তির আগমন ঘটলে ,তাকে শাস্তি দেয়া। তাদের শাস্তি হয়ে থাকে প্রধানত, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ,কিন্দিবিবা সম্প্রদায়ের ভৃত্য হয়ে থাকা। ভৃত্য হয়ে থাকার সময় পাড় হয়ে যাবার পর, অপরাধী ব্যক্তিরা তাদের দ্বীপে থাকার অনুমতি পেলেও, তারা থাকে নিম্নশ্রেণির মানুষ হয়ে। তারা এই দ্বীপে শুধু অবজ্ঞাই পেয়ে থাকে। বর্তমানে এই সম্প্রদায়ের সান্সির নাম কোহাকাতি।

অনেক বেশি বয়সেই কোহাকাতি বিয়ে করেন। আজ কোহাকাতির বাড়িতে উৎসব। নাচ গান হবে তার বাড়িতে, ভোজনের ব্যবস্থা তো অবশ্যই থাকছে। পুরো দ্বীপের সব মানুষকে কোহাকাতি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তার বাড়িতে। তিনি এবং তার ছোট ভাই কাল মাছ ধরতে গিয়েছিল মাঝ সমুদ্রে। সত্যিই কাল বিধাতা তাদের প্রতি অসম্ভবভাবেই সহায় হয়েছিলেন,প্রচুর মাছ পেল। মাছের সাথে সাথে অন্যান্য খাবারের ব্যবস্থা আছে। আর এই সবের কারণ গত কাল কোহাকাতির একটি কন্যা হয়েছে। অপরূপ সুন্দরী, অসাধারণ চেহারা, অপূর্ব এক মেয়ে। একবার তাকালেই কেমন যেন মায়া লেগে যায়, চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করে না। যারা আসল, মেয়েটাকে দেখতে তারা সকলেই তারিফ করল। উৎসব আনন্দে রাতটা কেটে গেল। সকালে কোহাকাতি তার মেয়ের নাম রাখার জন্য সম্প্রদায়ের সব মানুষকে আবার আমন্ত্রণ জানাল। একজন একজন করে একটা একটা নাম বলল, সেই নাম থেকে বাছাই করে তার মেয়ের নাম রাখা হবে। অনেকে অনেকগুলো নাম বলল। অবশেষে একজন বলল, মিহানা। কোহাকাতির স্ত্রী বলল, হ্যাঁ মিহানা। মিহানাই আমার মেয়ের নাম।

মিহানা নামে সুদর্শনা। সবাই সমর্থন জানাল।আবার আনন্দ শুরু,উৎসবের তালে তালে।



কিন্দিবিবা সম্প্রদায়ের বিচারে ভৃত্য হওয়া এক ব্যক্তি সোমাসাহের এক পুত্র জন্ম নিয়েছে আজ। গতকাল সে কোহাকাতির অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়ে গিয়েছিল। এখন সে দুঃখ করে একা একাই বলছে-গতকাল আমি এ দ্বীপের সান্সির মেয়ের জন্ম উপলক্ষে অনুষ্ঠানে গেলাম। অথচ আমার সন্তানের জন্ম হল আজ,তার কোন অনুষ্ঠানই হবে না। অথচ কিভাবে কিভাবে আমি এ খারাপ অবস্থায় বাস করছি।"

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সোমাসাহে। তাদের এই দ্বীপে থাকার কথা না। সোমাসাহে আর তার স্ত্রী কাসিনা ছিল খুব এডভেঞ্চার প্রিয়। হুটহাট বের হয়ে যেতেন বেড়াতে। বেড়ানো ছিল তাদের শখ।বিশেষ করে নিজস্ব জাহাজে চড়ে। একবার জাহাজে চড়ে যাবার সময় হঠাৎ জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ল। জাহাজ এসে পৌছাল এই দ্বীপে।সোমাসাহে ভাবল, সুন্দরই তো দ্বীপটা। যাই একটু ঘুরে দেখি।

এই দ্বীপে ঘুরতে ঘুরতেই কিন্দিবিবার লোকেরা ওদের ধরে নিয়ে গেল সান্সির কাছে। সান্সির বিচারে সোমাসাহে আর কাসিনাকে ২০ বছরের জন্য ভৃত্য বানিয়ে রাখা হল। আজ মাত্র ২ বছর শেষ হল। আরও ১৮ বছর এই বন্দীশালায় থাকতে হবে। কিভাবে যে থাকবে এতোগুলো বছর? ভাবতে ভাবতেই কাসিনা সোমাসাহেকে ডাক দিল। সোমাসাহে ঘরে গেল। কাসিনা বলল, আচ্ছা আমাদের ছেলে হল। তার কোন নাম রাখবে না?

সোমাসাহে তাকালেন তার ছেলের দিকে। সত্যিই দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে ছেলেটা। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, ছেলেটার চোখগুলো অনেক সুন্দর। মায়াময় চোখ, তাকালে চোখ ফেরানো কঠিন।

সোমাসাহে বলল, পেয়েছি। আমার ছেলের নাম হবে সোসান। তোমার পছন্দ হয় নি?

সোসান অর্থ যার চোখ দিয়ে জ্যোৎস্না ঝরে। কাসিনা বলল, অসাধারণ নাম।অবশ্যই পছন্দ হয়েছে।





মিহানা বড় হতে থাকে , বাবা মায়ের অনেক আদরে। মিহানাকে শিক্ষা দানের জন্য তাদের বাড়িতে একজন পণ্ডিত রাখা হল। সে তাকে নানা রকম শিক্ষায় শিক্ষিত করতে লাগলেন। পৃথিবীর নানা জায়গা সম্পর্কে নানা কথা, ইতিহাস, নানা বিখ্যাত লেখকদের বই সম্পর্কে। এই পণ্ডিতও এই দ্বীপে ভৃত্য হিসেবে আছে, তবুও উচ্চ শিক্ষিত হিসেবে , সবাইকে শিক্ষাদানের জন্য তাকে রাখা হয়েছে।

অপরদিকে সোসানকে ওর বাবা মা বিভিন্ন গাছপালার ছবি একে তার নাম শেখায়। তার উপকারিতা অপকারিতা শেখান। সোসানের বাবা একজন কারিগর। তিনি কাঠ দিয়ে, নানা রকম জিনিস বানাতে পারতেন। নৌকা, খাট, পশুপাখির ফাঁদ ইত্যাদি। সোসানের মা একজন ডাক্তার। যদিও এ সম্প্রদায়ের একমাত্র সোসানের বাবা ছাড়া এ কথা কেউ জানত না। সোসানের বাবা নানা রকম কারিগরি শিক্ষা এবং সোসানের মা সোসানকে ডাক্তারি শিক্ষা দিতে লাগল।

সময়ে সময়ে বড় হতে লাগল মিহানা, একটু বিলাসিতায়। বড় হতে লাগল সোসান বাবা মায়ের আদরে। অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে।





আজ এ সম্প্রদায়ের দুজন কুমার কুমারীর বিয়ে হচ্ছে। সম্প্রদায়ের প্রায় সকল বিবাহিত নারী পুরুষই এ বিয়েতে এসেছে। বিয়ের কাজ শুরু হল। এখন বর কনের মধ্যে ফল ছোঁড়াছুড়ি হচ্ছে। বিয়ের নিয়ম অনুসারে। সব ঠিক মতই চলছিল। হঠাৎ কনে চিৎকার দিয়ে উঠল, " সালোকা, সালোকা "। সালোকা অর্থ সাপ। চিৎকার দিতে দিতে কনে ঘর থেকে বের হয়ে আসল। কিছুক্ষণ পর বরও অবস্থা কি দেখার জন্য ঘর থেকে বের হল। বর কনেকে দেখে ফেলল। সাথে সাথে সবই চিৎকার করে উঠল, " এ কি হল? এদেরকে নৌকা বানিয়ে পাঠিয়ে দাও আমাদের দ্বীপ থেকে। "

বর বা কনের পিতা মাতার বলার কিছুই ছিল না। কেননা এটাই এই দ্বীপের, এই সম্প্রদায়ের নিয়ম। এ কাজ না করলে তাদেরই অমঙ্গল হবে। নৌকা বানানো হল। সে নৌকায় দুজনকে চড়ানো হল। একজন ভৃত্যকেও সে নৌকায় সাথে করে দিয়ে দেয়া হল। ভৃত্যটার কাজ হবে ছেলে আর মেয়েটাকে মনুষ্যহীন দ্বীপ খুঁজে দেয়া। তারপর থেকে ভৃত্যটা মুক্ত। নিয়ম অনুসারে সব কাজ করা হল। এই নিয়মের আর একটা বিশেষত্ব হল, যে মেয়ে ও ছেলেকে মনুষ্যহীন দ্বীপে পাঠানো হবে, সে মেয়ে ও ছেলের আয়ু এক সমান হয়ে যাবে। ছেলে যদি মেয়ের চেয়ে দশ দিনের বড় হয়, তবে ছেলে মারা যাবার দশ দিন পর মেয়েটা মারা যাবে।



এদিকে সবাই যখন বিয়ের অনুষ্ঠানে যায়, তখন যে সব ঘরে কুমার কুমারী ছেলে মেয়ে আছে সেসব ঘরে তালা দিয়ে যায়,যাতে তারা বের হতে না পারে। সোসানকেও তাই ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে গেল। আর মিহানার ঘরে ছিল মিহানার দাদী, তাকে পাহারায় রেখেই কোহাকাতি ও তার স্ত্রী সে বিয়ের অনুষ্ঠানে যায়। মিহানার দাদী ওকে নানা রকম গল্প শুনাতে থাকে। গল্প বলতে বলতে একসময় ঘুমিয়ে যায়, মিহানার দাদী। মিহানা এখন একা ঘরে। কেমন যেন ভাল লাগছিল না একা একা। মিহানা মনে মনে ভাবল, " দাদী তো ঘুমিয়ে আছে, যাই বাহির থেকে একটু ঘুরে আসি। কিন্তু আমাকে না বাবা, মা, দাদী সবাই এই সম্প্রদায়ের প্রাচীন নিয়মের কথা বলেছে। এখন আমি যদি কোন কুমার ছেলেকে দেখে ফেলি, তবে তো এই সম্প্রদায়ের ক্ষতি হবে। নতুবা আমাকে এ দ্বীপের বাহিরে পাঠিয়ে দিবে। থাক যাবনা বাহিরে। আরে যাহ্‌, কুমার ছেলে যারা আছে, সবাই না ঘরের ভিতর তালা বদ্ধ। আমি বাহিরে গেলে সমস্যা কি? যাই বাহিরে। "

মিহানা বাহিরে বের হয়ে আসল। জীবনে প্রথম ঘরের বাহিরে আসা, বাহিরে আলো রূপ দেখে আনন্দে দিশেহারা হয়ে গেল মিহানা। মিহানা ভাবল, বাহিরের রূপ এতো সুন্দর। আর বাবা মা কিনা আমাকে এতদিন ঘরের ভিতর এতদিন আটকে রেখছে।

বাহিরের বাতাস গায়ে লাগাল, বাহিরের আলো গায়ে লাগাল, হাঁটতে হাঁটতে দেখতে লাগল, প্রকৃতির রূপ। হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসল একটা গাছের নিচে।



সোসান ঘরের ভিতর হাঁটাহাঁটি করতে করতেই, কি মনে করে যেন ঘরের দরজার কাছে এসে ভিতর থেকে ধাক্কা দিল। আশ্চর্য ব্যাপার, দরজা খুলে গেল। আসলে সোসানের বাবা মা তাদের ঘরের দরজা লাগালেও টা ঠিকমত আটকে ছিল না। সোসান ওর ঘরের দরজার বাহিরে এসে দাঁড়াল। সোসানেরও খুব ভাল লাগছে বাহিরে বের হয়ে। এতদিন বাহিরে আসতে পারে নি, মনে মনে খুব আফসোস হচ্ছে। সোসান একবার দুবার আকাশের দিকে তাকিয়ে, সোজা সামনের দিকে তাকাল। দেখল অপূর্ব সুন্দর এক মেয়ে সোসানের দিকে তাকিয়ে। চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করছে না সোসানের এই মেয়ের দিক থেকে। মিহানাও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোসানের চোখের দিকে। মিহানা মনে মনে ভাবল, এতো মায়াময় কারও চোখ হয় কি করে? মিহানারও ইচ্ছে করছে না চোখ ফেরাতে। মনে হচ্ছে সারাজীবন এই সুদর্শনের আখিপানে তাকিয়ে থাকুক। তার ভালবাসার অশ্রু জলে স্নান করে জীবন ধন্য করুক।

ওদিকে সোসানও এক ধ্যানে তাকিয়ে মিহানার দিকে ভাবছে, হায় সৃষ্টিকর্তা! তুমি কি পৃথিবীর সব রূপ এই মেয়ের মাঝেই দিয়েছ? যার দিকে একবার তাকালে, আর অন্য কোন দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। আমার মন যে চাচ্ছে চোখের ভিতর এই মেয়ের ছবি একে সারাজীবন ধরে দেখি। এমন নির্মল রূপের অধিকারিণী মানুষের হওয়া আসলেই কি সম্ভব? অপূর্ব।



সোসান মিহানা দুজন যেন এখন আর এ ভুবনে নেই। হারিয়ে যাচ্ছে জলহারা মেঘের অশ্বে চড়ে কল্পলোকের রাজ্যপূরীতে। যেখানে শুধু মায়ার ইন্দ্রজাল। সে জালে আবদ্ধ শুধু সোসান ও মিহানা।



যখন দুজন ভাবনার অতলে হারিয়ে গেছে। গভীর ধ্যানে মগ্ন একে অপরের রূপ তপস্যায়। ঠিক তখনই মিহানার দাদী সেখানে আসলেন। এসে দেখলেন, সোসান মিহানা একে অপরের দিকে তাকিয়ে। মিহানার দাদী চিৎকার করে বলে উঠলেন, " হায় হায়। মিহানা এ তুই করেছিস? তাড়াতাড়ি ঘরে চল। "

মিহানাকে ধরে ওর দাদী টান দিল। টান দিয়ে নিয়ে গেল, অতি দ্রুত ঘরে। সোসান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, মিহানার চলে যাওয়া পথের দিকে।

চোখের আড়াল হয়ে যাবার পর হঠাৎ মনে হল, এখন যদি বাবা মা চলে আসে তাহলে তো বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তালার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ঘরে ঢুকে গেলে তালা লাগাবে কি করে? তালা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই হঠাৎ তালাটা লাগিয়ে ফেলল লাগিয়ে পড়ল আরও বিপদে। এখন ঘরে ঢুকবে কি করে? সোসান চোখ বুলিয়ে আশেপাশে দেখল। চোখ পড়ল ঘরের এক কোণে একটা কাঠের কিছু অংশ পচে গেছে। যদিও ভাঙে নি। কিছু দূরে একটা বিড়ালকে ঝিমাতেও দেখল। ওর মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। অনেক কষ্টে বিড়ালটা ধরে, একটা আছাড় মারল। আধা মরা করে ফেলল। তারপর দৌড়ে গিয়ে ঘরের কাঠের পচা অংশটুকু ভেঙে ফেলল আর সেখান দিয়েই ঢুকল ঘরে। ভাঙা জায়গার পাশে আধ মরা বিড়ালটা রেখে দিল। তারপর চুপচাপ ঘরে শুয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরেই সোসানের মা বাবা আসলেন। তারা ঘরের তালা খুলেই দেখলেন,আধ মরা বিড়াল। আর ঘরের কিছু জায়গা ভাঙা। কি হয়েছে বুঝতে পারল না। সোসানের মা সোসানকে ডাক দিল।

- কি ব্যাপার সোসান? এখানে আধ মরা বিড়াল আর আমাদের ঘরেরই বা এই অবস্থা কেন?

- মা, ঐ যে ঘরের ভাঙা জায়গা দেখছ না? ঐটা ঐ মরা বিড়ালের কাজ। বিড়ালটা কাঠ ভেঙে ঘরে ঢুকছে কিন্তু আঘাত পাওয়াতে এই অবস্থা।



সোসানের বাবা অন্য পাশ দিয়ে বললেন, কি পাগলের মত কথা বলছ। বিড়াল কি করে ঘরের কাঠ ভাঙতে পারে?

- তাই তো বাবা। বিড়াল কি করে ভাঙতে পারে?

- তাহলে ঘর ভাঙল কি করে?



সোসান অনেক ভেবে চিন্তে বলল, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। আসলে হয়েছি কি, বিড়ালটা আমাদের ঘরের পাশে এসে ডাকতেছিল। আমি ওটাকে তাড়ানোর জন্য জোরে করে ঘরের ওখানে ধাক্কা দিলাম, আর ভেঙে গেল। বিড়ালটা উঁচু মাচান থেকে পড়ে মরে গেল।

- তাহলে বিড়ালটা ঘরের ভিতরে আসল কি করে?

- নিশ্চয় কোন শিয়াল বা হায়না এটাকে খাবার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে।

- আরে ঘরের ভিতর শিয়াল বা হায়না আসবে কি করে?



সোসান চেচিয়ে বলে উঠল, উঃ, আমি জানি না। আমি এখন ঘুমাব।



সোসান বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর মনে মনে ভাবল, যাক বাঁচলাম। মিথ্যা বলা যে এতো কঠিন কাজ আজ প্রথম বুঝলাম।





- জানিস তুই মিহানা কি করেছিস?



মিহানা দাদীর সামনে বসে আছে। দাদী বলে যাচ্ছেন, এখন কেউ যদি কোনমতে এ ঘটনা জানতে পারে তবে তোকে আর ঐ ছেলেকে মানুষ ছাড়া কোন দ্বীপে নৌকা বানিয়ে, তারপর তাতে চড়িয়ে পাঠিয়ে দিবে। তুই চলে গেলে আমি থাকব কি করে? এই বুড়িটা তোকে অনেক ভালবাসে। তোকে ছাড়া এই বুড়িটা থাকতে পারবে না। তুই যে ঘরের বাহিরে গিয়েছিলি, আর ঐ ছেলেটাকে দেখছিলি সে কাউকে বলবি না। আমাকে একা করে তুই কোথাও যাবি না।



দাদীর চোখ চোখ হঠাৎ করেই ভিজে এসেছে। মিহানারও খারাপ লাগছে খুব। দাদীর কোলের ভিতর ঢুকে বলল, তাতে তো আমাদেরই বিপদ হবে।

- হোক যা হবার। আমি তোকে বলছি, তুই কাউকে বলবি না।

- আচ্ছা দাদু, মনে কর ছেলেটা যদি কুমার না হয়। সবাই না তাদের কুমার কুমারী ছেলে মেয়েকে ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে গেছে।

- আরে না, আমাদের সম্প্রদায়ের বিবাহিত লোক আর মহিলারা তখন বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিল। তাছাড়া আমি ছেলেটাকে চিনি। ওর নাম.........



এমন সময় মিহানার বাবা ঘরে এসে ঢুকলেন। তার সাথে মা। মিহানার বাবা এসেই বলতে লাগলেন, জানো মা, আজ যে বিয়েতে গিয়েছিলাম, সেই বিয়ের বর কনেকে নৌকায় করে ভাসিয়ে দিয়েছি।



মিহানা একটু আগ্রহ দিয়ে জানতে চাইল, কেন বাবা?

- কেননা ওরা বিয়ের কাজ শেষ হবার আগেই, একে অপরকে দেখে ফেলেছে। যা আমাদের সম্প্রদায়ের নিয়মে নিষিদ্ধ।



কথাটা শুনে মিহানা একটা অদ্ভুত রকম শব্দ করল, যেন অনেক ভয় পেয়েছে।

মিহানার মা জিজ্ঞেস করলেন, কিরে মা? কি হয়েছে?

- না মা, কিছু না।



মধ্য পর্ব- আগামী কাল

( কিছু কথাঃ কিছুটা উদ্ভট কাহিনীর এই গল্পটা লেখা শুরু করেছিলাম যখন, তখন বয়স অনেক কম। মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়ি। লেখার প্রতি নেশাটা এই গল্প দিয়েই শুরু। গল্পের ভাষা, সংলাপ, ঘটনা কিছুটা অপরিপক্ব ঠিক এই কারণেই। নবম শ্রেণীর লেখা বলে কথা। কি মনে করে যেন, ব্লগে দিলাম। )

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.