ইদানিং চেষ্টা করছি খুব বেশি দূর তর্ক না করতে। যেহেতু ভীষণ রকমের বিশ্বাসী, তাই একটা হাদীস পড়ে ভয় ঢুকে গেছে মনে। এই পোস্ট লিখা শুরু করার আগে খুঁজলাম কিছুক্ষণ, পেলাম না। এমনি বলছি হাদীসটার মূল কথা--যখন আল্লাহ কাউকে শাস্তি দিতে চান, তখন তাকে কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন এবং অর্থহীন তর্কে মাতিয়ে রাখেন। ব্লগাররা খেয়াল করেছেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমি সচেতন চেষ্টা করছি অর্থহীন তর্কে নিজেকে জড়িয়ে না নিতে। সেদিন সাব্বিরের ব্লগ আবারও মনে করিয়ে দিল, মনে মনে অনেকগুলো আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়েছি সত্যি।
সে যাই হোক, আমার এখনকার লক্ষ্য হচ্ছে অর্থহীন তর্কে জড়িয়ে না পড়া। আর ইসলামিক রাষ্ট্রের গুরুত্ব ইসলামে আসলে ঠিক কতটুকু সেটার বিচার করা এই মুহুর্তে অর্থহীন, যে কারণে এ সংক্রান্ত কোন তর্কে জড়িয়ে না পড়ার চেষ্টা করছিলাম। আমি এই পোস্ট করছি, আমার কথাগুলো খুব স্পষ্ট করে বলে। এর পরে আমি কোন প্রশ্নের জবাব দিবো না। কারও কোন সত্যিকারের প্রশ্ন থাকলে বা আমাকে হিদায়াত দেয়ার আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে আমাকে ইমেইল করতে পারেন। ইমেইল এডরেস সাইডবারে আছে।
এই তর্কে জড়ানোটা অর্থহীন এখনকার প্রেক্ষাপটে কতগুলো কারণে।
প্রথমত, এ অনেক দূরের ভবিষ্যত। আমি অন্তত: একশ বছরের মধ্যে তেমন কোন সম্ভবনা দেখি না।
দ্বিতীয় কারণটা আমার শ্রোতা এবং পাঠকদের জড়িয়ে। আমার ব্লগার শ্রোতা এবং পাঠকদের একটা সীমাবদ্ধতা আমি খেয়াল করেছি, হয়তো ক্ষেপিয়ে দিব অনেককেই এটা বলে, কিন্তু বলছি। প্রতিটা জাতির নিজেস্ব দেখার চোখ থাকে। এই চোখটা সৃষ্টি হয় জাতীয় ইতিহাস থেকে। শিক্ষা থেকে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা পশ্চিমের গড়ে দেয়া। আমাদের অর্থনীতি, নৃতত্ত্ববিদ্যা, রাজনীতি, দর্শন সব পশ্চিমের ধ্যান ধারণা প্রসূত। পশ্চিমের ধ্যান ধারণা এসেছে তাদের নিজেস্ব ইতিহাস থেকে। আর পশ্চিমের ইতিহাসে ধর্ম আর রাষ্ট্রের ইতিহাস খুব বেশি রকমের খারাপ।
ধর্ম নিয়ন্ত্রনের চাবিকাঠি ছিল ধর্মনেতাদের হাতে। আজও পোপের কিছু নিজেস্ব লাইব্রেরিতে সাধারণ মানুষ যাওয়ার সুযোগ পায় না। ধর্মব্যাখ্যার কাজটা হতো, হয়, পুরোটাই জনসাধারণ্যের চোখের আড়ালে, এক বিন্দু স্বচ্ছতা নেই। পোপ স্রষ্টার মতই 'অলংঘনীয়', তাদের ব্যাখ্যা প্রশ্নের অতীত। এসব মাড়িয়ে স্রষ্টাকে ছোঁয়া ছিল অসম্ভব।
গ্যালিলিও থেকে শুরু করে যত বিজ্ঞানী এসেছেন, যারাই নতুন কোন সত্যের কথা বলেছেন, সবাইকে চার্চের ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। সাধারণ মানুষ বরাবর দেখে এসেছে, ধর্ম তাদের চলার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে, সহায়তা করে না। ধর্ম তাদের টেনে ধরে রাখে নিচে, উপরে উঠতে দেয় না।
এই ব্যপারটা চার্চের সৃষ্ট। ধর্মনেতাদের সৃষ্ট। আর সাধারণ মানুষের কাছে চার্চ বা ধর্মনেতারাই ছিল স্রষ্টার রিপ্রেজেন্টেটিভ, তাই স্বাভাবিক ভাবেই অ্যানালজিটা এরকম হয়েছে: ধর্ম সব খারাপের মূল। যখন উন্নয়নের ডাক আসলো, তখন প্রয়োজন ছিল ধর্ম ব্যপারটা পুরোপুরিই ছুঁড়ে ফেলা। তবু মানুষ ধর্মকে পুরোপুরি ছুঁড়ে ফেলতে পারে নি, ধর্মকে দরকার ছিল খুব উদ্বেগের সময়ের জন্য শেষ আশ্রয় হিসেবে স্রষ্টা নামের রহস্য জনক কিছুর দিকে ধরণা দেয়ার জন্য। অনেকটা 'শখের প্রভু' টাইপ। স্রষ্টার যখন যেভাবে আমাকে দরকার, তখন সেভাবে আমি থাকবো না হয়ে, আমার যখন যেভাবে স্রষ্টাকে দরকার, আমি তখন তাকে সেভাবে ডাকব। বাহ, কি ফুলপ্রুভ সিস্টেম! আমার চলার পথেরও বাঁধা সৃষ্টি করলো না, আমারও নিজেস্ব প্রয়োজনে শখের প্রভুকে ডাকা গেল প্রকম্পিত হৃদয়ে! ধর্ম বন্দী হয়ে গোল চার দেয়ালের ভিতর।
হ্যা পশ্চিমের উন্নতি হলো এর উপর। কিন্তু এই ইতিহাস আমাদের নিজেদের ইতিহাস না। আমাদের ইতিহাসে, ইসলামের ব্যাখ্যা কখনই সাধরণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল না। কোন কিছু নিষেধ হলে সে কোরআন আর হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনার সাথেই হতো। আবার যে সমস্ত ব্যপারে অস্পষ্টতা আছে, সে ব্যপারে কোন নির্দিষ্ট এবং একটাই অলংঘনীয় রায় নেই। ইসলামে মুহাম্মদ (সা), যিনি আল্লাহর সরাসরি নির্দেশনায় চলেছেন, তিনি ছাড়া আর কোন 'অ্যাবসুলুউট ফিগার' নেই, যিনি যুগে যুগে মানুষের মাথার উপর ছড়ি ঘুরাবেন। আমাকে উমার (রা) এর সেই ঘটনা বরাবর মুগ্ধ করে, যেখানে জনসাধারণের জন্য একটা সমাবেশে তিনি একটা রায় দেয়ার পরে একজন মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা আদায় করেছেন এমন নাগরিক পাওয়ার জন্য। এটাই ইসলামিক সিস্টেম, যেখানে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফাও সাধারন মানুষের কাছে জবাবদিহি করতেন নিয়মিত।
যাই হোক, আমাদের দেশীয় বুদ্ধিজীবি আন্দোলনের অনেকটাই কমিউনিস্ট প্রভাবিত। মূলত কমিউনিজমের বাতাস লাগায় আমাদের দেশীয় বুদ্ধিজীবিরা প্রশ্ন করা শিখেছেন জোড়ালো। তবে কমিউনিস্ট সাহিত্যগুলোর ইতিহাস লেখা হয়েছে ক্রুসেডের সময়কার খ্রীষ্টিয়ান সাহিত্যগুলো থেকে, যেখানে মুসলিমদের ইতিহাস সম্পর্কে মারাত্মক রকমের একপেশে খবরাখবর দেয়া। মুহাম্মদ (সা) এবং খিলাফত সম্পর্কে মারাত্মক কিছু মিথ্যা কথা আছে, একপেশে ইতিহাস আছে, যেগুলো আপনি এখন পশ্চিমা কোন ঐতিহাসিককে বলতে শুনবেন না। গত পঞ্চাশ বছরে 'আনবায়াসড' ইতিহাসের ব্যপারে একাডেমিক আন্দোলন শুরু হয়েছে খুব করে, যেটা এই ব্যপারগুলো বদলে দিয়েছে।
আমাদের দেশীয় বুদ্ধিজীবিদের একপেশে ইতিহাস জ্ঞান (আর ফলশ্রুতিতে ভুল প্রশ্ন করার ফলে) আমাদের দেশে 'ধর্ম আর রাষ্ট্র' কথাটা একটা অচ্ছ্যুত শব্দ। নোংরামি। অশ্লীল। এই ধারণাটা স্বাধীনতা পূর্ব ইতিহাস ঘাটলেও পাওয়া যাবে। স্বাধীনতার সময়ে রাজনীতি সচেতন মুসলিমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারণে যেই ভুল করেছেন, তার জেরও বইতে হবে আমাদের প্রজন্মকে। সাধারণ মানুষের কাছে রাজনীতি আর ধর্ম হয়ে গেলো আরও হাজার গুণে স্টিগমাটাইজড আইডিয়া।
(চলছে)
একটা ওয়ার্নিং: তর্ক এড়াতে এই পোস্টের অবতারণা। এই পোস্টে আমি কোন [ইটালিক]অপ্রাসংগিক[/ইটালিক] মন্তব্য দেখলে আমার নিতান্ত অপ্রিয় কাজটা করবো, সোজা ডিলিট।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০