সময়কাল ১৯৩০-১৯৪০
বাড়ীর বৈঠকঘরে বসে আছেন বাড়ীর কর্তা । তিনি উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। উদ্বিগ্ন ৩০০০ বিঘা জমি, বাগান এবং বাড়ীর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
কারন তার এখনও কোন উত্তরাধিকার নেই।
পর পর তিনটা বাচ্চা হলো শালার তিনটাই মেয়ে!!
বউ আবার পোয়াতী হয়েছে। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত করিমুল্লাহ মিয়া নিয়ে ফেলছে যে এইবার যদি ছেলে না হয় জঘন্য এই মহিলাকে আর ঘরে তুলবেনা। পরপর চারটা মেয়ে হবে তামাশা না কি ।
বাড়ীর ৭ মাসের পোয়াতী বউ যখন বাপের বাড়ীর উদ্দেশ্যে পালকিতে উঠলো রওনা হবার জন্য তখন বাড়ীর আরেক শরিকের একজন মহিলা এসে কানে কানে বলে গেলো যে '' বুবু কর্তা বলে দিছে যে এইবার ছেলে না হলে আর আসার দরকার নাই''
রওনা হলো ফাতেমা বিবি।
ফিরে এলো পুত্র সন্তান নিয়ে।
কর্তা খুশি।
পুত্র সন্তানকে নানা যত্নে মানুষ করার কারনে দেড় বছরের তৃতীয় কন্যাকে করিমুল্লাহ কর্তা পাঠিয়ে দিলেন শ্বশুরকূলে। মানে ফাতেমার মায়ের বাড়ীতে। এই মেয়ের যন্ত্রনায় বংশের প্রদীপের যত্ন নিতে অসুবিধা হচ্ছে মায়ের।
ফাতেমা ফিরে স্বামীর বাড়ী ফিরে আসতে পেরেছিলেন পুত্র সন্তান জন্ম দিতে পারার মত গৌরবজনক একটি কাজ করতে পারার ফলে। কিন্তু পৃথিবী থেকে তাকে বিদায় নিতে হলো কয়েকমাসের কারনে। কয়েকদিন ভীষন জ্বর ছিলো। তারপর যে কি হলো, শরীর শুকিয়ে কাঠ, খাবার কোন রুচি নেই শুধু বমি হয়। ২০/২৫ দিন লড়াই করার পর পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। করিমুল্লাহ মিয়ার ধারনা পুত্র সন্তান তার ঘরে আসার ফলে বাড়ীর বাকি শরিকেরা নজর দিয়েছে বলেই এ অবস্হা!
ফাতেমা বিবি যখন মারা যান তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৭ বছর।
৮ বছর বয়সে এ বাড়ীতে এসেছিলেন সন্তান জন্ম নেবার বয়স হবার সাথে সাথে সন্তান জন্মদান শুরু করেছিলেন ৪ টা জীবিত সন্তান এবং ১ টা মৃত সন্তান জন্মেছিলো। এরপর নিলেন পৃথিবী থেকে বিদায়, এই তার জীবনের অর্জন।
ফাতেমা মারা গেলেও পুত্র সন্তানটি যত্নেই মানুষ হচ্ছে। করিমুল্লাহ মিয়া বিয়ে করেছিলেন ফাতেমা বিবি মারা যাবার একমাসের মধ্যই। দ্বিতীয় স্ত্রী বিয়ের ১ মাসের মাথায় পোয়াতী। দ্বিতীয় স্ত্রী তিনটি পুত্র সন্তান আর কতগুলি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তার হিসাব নেই অবশ্য।
এ সময়কালের আরো একটি গল্প
যে বাড়ীর গল্প বলতে যাচ্ছি সে বাড়ীর ভূসম্পত্তি কয়েকহাজার বিঘা না হলেও বেশ ভালো ভূসম্পত্তি এ বাড়ীর কর্তাটিরও রয়েছে।
বিলকিস বানুর যখন বিয়ে হয় তখন বয়স ৭। আর হোসেন মিয়ার ১৮। এ বাড়ীতে পুত্রসন্তান মাত্র একটি। মেয়ে কতগুলি হিসাব নেই সে হিসা হোসেন মিয়া করাটা খুব প্রয়োজনও ভাবেন না, কিন্তু ইদানিং অন্য একটি প্রয়োজন তিনি অনুভব করছেন। সেটি হলো দ্বিতীয় স্ত্রী।
কারন এত অল্প বয়সে বিয়ে হওয়াতে প্রথম স্ত্রীর প্রতি এখন আর কোন আকর্ষন কাজ করে না।
একদিন পাকা সিদ্ধান্ত নিলেন। বিয়ে ঠিক করে আসলেন এক জায়গায়। পরের দিন হাটে গেলেন কিছু বাজার সওদা করলেন। কয়েকটা শাড়ী কিনলেন। একটা কিনলেন বড় বউয়ের জন্য। একটা কিনলেন বড় বিধবা কন্যার জন্য। কন্যা বিধবা হয়ে এখন তার কাছেই থাকে, একটি শাড়ী এখণ না দিলেই নয়, হাজার হোক উৎসবের মুহূর্ত এখন।
ঘোড়ার পিঠে করে হোসেন মিয়া দ্বিতীয় বিবাহ করতে গেলেন। সামনে বসিয়ে নিয়েছিলেন ৪ বছরের নাতীকে। এই নাতী হোসেন মিয়ার বিধবা মেয়ের একমাত্র সন্তান। ফজিলা, হোসেন মিয়ার মেয়ে বিয়ের মাত্র তিনমাস পর বিধবা হয়েছিলেন।
এ বাড়ীতে কখনও সতীনে সতীনে ঝগড়া হয়না কারন হোসেন মিয়ার যে দাপট আর যে মেজাজ তাতে কোন মহিলার সাহস নেই টু শব্দটি করার।
বিলকিস বানুর মনে তেমন কোন দুঃখ নেই, কারন দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে কোন পুত্র সন্তান জন্মায়নি। বিলকিস বানু শান্তিতেই ঘুমায় এটা ভেবে যে তার অবশ্যই একটা আলাদা দাম আছে, কারন তার পুত্রসন্তান রয়েছে।
সময়কাল ১৯৫০-১৯৬০
জয়নবের বিয়ে হতে হতে ভালোই বয়স হয়েছে। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে জয়নবের। অনেক দুঃশ্চিন্তায় ছিলো জয়নবের বাপ। যাক শেষমেষ বিয়েটা হয়ে গেলো। বাঁচা গেলো।
জয়নবের ভাইয়েরা বাড়ীতে পড়াশোনা করে, মক্তবে যায়। জয়নব এতকিছু বুঝেনা। তবে জয়নবের স্বামী নাকি মেলাদূর পড়ছে। পড়াশোনাটা যে কি অদ্ভুত জিনিস জুনব জানেনা। স্বামী থাকে শহরে। জয়নব পোয়াতী। প্রথম বাচ্চাটা মরা হলো! কি অলুক্ষুনে কান্ড।
অবশ্য জয়নের শেষমেষ আরো ১১ টা বাচ্চা হয়েছিলো। এর মাঝে ৬ টা ছেলে। তাই জয়নবের গর্বের সীমা নেই।
স্বামীর সাথে জয়নব শহরে এসেছিলো। প্রতিদিন ১৫-২০ টা লোকের রান্না, বাচ্চার কাঁথা পাল্টানো রাত্রে জেগে দুধ খাও য়ানো এ করতে কবে জয়নবের ৪৫ বছর হয়েছে জয়নব জানে না।
জয়নব স্বামী হারালো ৪৭ এ। ৪৮ এ এসে জানলো তার হা্ড্ডির ব্যামো হয়েছে।
ছেলেমেয়েরা অস্টিওপোরেসিস না কি যেনো বলে সেটাকে অত বুঝেনা জয়নব। তবে এতগুলা বাচ্চা জন্মানোর কারনে নাকি হাড্ডি বেশীরভাগ ক্ষয়ে গেছে!
কি যে বলে মেয়ে মানুষের তো বাচ্চা হবেই। যতসব টাকা কামানোর বুদ্ধি ডাক্তারদের। কয়েকবছর বিছানায় পড়ে থেকে মাত্র ৫২ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো জয়নব।
সময়কাল ১৯৭৫- ১৯৮৫
শাহেদা এ যুগের মেয়ে । দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। শাহেদার জগৎ রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল গীতি, মায়ের রান্নাঘরে প্রায়ই সাহায্য করা। শাহেদার বান্ধবীরা বাসায় মাঝে মাঝে বেড়াতে এলেও শাহেদা কখনো তার বাবার রক্তচক্ষুর ভয়ে কোন ছেলে বন্ধুকে এ বাসায় আসতে বলতে পারেনি।
শাহেদার অনেক বন্ধু মাঝে মাঝেই বলতো যে তোর বাড়ী যাবো একদিন, রান্না খাবো তোর হাতের। শাহেদা হালকা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।
শাহেদা জানে শুধু বাবা কেনো তার বড় দুই ভাই জানলেও লঙ্কা কান্ড বাধবে, হ্য়ত তার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যাবে।
শাহেদা তবে অনেক স্বপ্ন বোনে ভাবতে থাকে চাকরি করবে, সুন্দর করে একটা শাড়ী পড়বে হয়ত কপালে থাকবে টিপ রুবেলের সাথে দূরে ব হু দূরে গিয়ে একদিন হাত ধরে বসবে।
কিন্তু শাহেদার অজান্তে শাহেদার বিয়ে ঠিক হয়, পাকা কথা দেয়া হয়। শাহেদা কিছুই জানেনা। এমনকি শাহেদা এম, এ ফাইনাল পরীক্ষা ও দিতে পারেনা। সোজা কথা, আমাদের বাপু মান সম্মান আছে , মেয়েকে আইবুড়ি করে ঘরে রাখতে পারবোনা। এই ২৪ বছর পর্যন্ত আমরা ছাড় দিয়েছি এই অনেক, এটাই কে দেয়!
কি করবে করো কি পড়বে পড়ো বিয়ের পর যা ইচ্ছা করো। এখন আমাদের মান সম্মান টা দয়া করে বাঁচাও!
শাহেদা ভেবে পায় না কি এমন করেছে সে যাতে সবার মান সম্মান চলে যাবার উপক্রম হলো!
শাহেদা বিয়ের পর কয়েকদিন ভার্সিটিতে ক্লাস করলেও এম,এ আর পাস করা হয়নি কারন তাকে আবিষ্কার করতে হয়েছিলো যে সে একটি সন্তানের মা হতে যাচ্ছে। বাড়ির বাইরে গেলে এমনিতে শাশুড়ী বিরক্ত হতো বাঁকা চোখে দেখতো এখন এমন এমন কথা বলছে যে শাহেদা আর পারলো না, কারন তার এমনিতেই শরীর খারাপ সেখানে মানসিক সাপোর্ট পেলে হয়ত সে পারতো, কিন্তু যেখানে শরীরের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত মনও ভেঙ্গে যাচ্ছে সেখানে আর পারা যায়না।
রুবেলের সাথে বিয়ের পর কোনদিন যোগাযোগ হয়নি শাহেদার। যে কয়দিন ক্লাসে গেছে একবারও দেখা পায়নি। শাহেদা জানে রুবেল ইচ্ছা করে সামনে আসেনি।
শাহেদার মেয়ের বয়স যখন ৩ বছর শাহেদা ওর এক বান্ধবীর কাছে জানতে পারে যে রুবেল দেশে নেই আর আমেরিকায় চলে গেছে ১ বছর আগে। আর মেয়ের বয়স যখন ৬ বছর তখন জানতে পারে যে রুবেল দেশে এসিছিলো বিয়ে করতে। বিয়ের পর চলে গেছে আবার।
মানুষ এতো স্বার্থপর হয় কিভাবে? রুবেল কি পারতো না একটা বার শাহেদার সাথে যোগাযোগ করতে? একটা বার কোন বান্ধবীর মাধ্যমে হলেও ফোন করতে? সত্যি কোনদিন একবারও মনে পড়েনি তাহলে আমাকে? ভাবতে থাকে শাহেদা। বাম চোখ দিয়ে পানি গড়ায় একটু, ডান হাতে মুছে ফেলে শাহেদা কারন মেয়েদের আবার মন! নিজের বাবা মা ভাই যেখানে কোনদিন মনের খবর নিলো না সেখানে পরের ছেলে কয়দিনই বা কতটুকু সময় কাটিয়েছিলো তার সাথে যে তাকে মনে করবে??
সময়কাল ১৯৯০- বর্তমান এবং আরো কতকাল জানিনা!
রুবিনা মার্কেটিং এ এম,বি,এ করে একি মাল্টিন্যাশনাল সংস্হায় কর্মরত।
পড়াশোনা, বিয়ে, চাকরি কোথাও কোন সমস্যা নেই সমস্যা তার মনে কারন বিয়ের আজ ৫ বছর হলো কিন্তু ওয়েডিং এনিভার্সারিতে তার মন খুশিতে ডগমগ নেই। কারন কোনভাবেই সে কনসিভ করতে পারছেনা। রুবিনা আজকের আধুনিক মেয়ে কিন্তু রুবিনা জানে সংসারে শান্তি কি ভালোবাসা বলতে কি জিনিস তা থাকবেন যদি তার একটি অন্তত সন্তান না হয়। এরই মাঝে অনেক কিছু শুরু হয়ে গেছে বাইরের মানুষজন প্রায়ই যা তা বলছে সামির কে ধরে, সামির প্রায়ই মুখ হাপিস করে থাকে।
রুবিনা তো চেষ্টা কম করছেনা। ডাক্তার কবিরাজ কিছুই বাদ দিচ্ছেনা। যে যা বলছে তাই শুনছে। ২৮ বছরের রুবিনার জীবন যেনো থমকে যায় প্রায়। ২৩ থেকে ২৮ এই ৫ টা বছর কি না করেনি লেখাপড়া পাশাপাশি সংসার , শ্বশুর শাশুড়ী প্রতি দায়িত্ব। কোনটা কম করেনি। বিয়ে তো এখনকার অনেক মেয়েই ৩০/৩১ এ করছে মা ও হচ্ছে , সেখানে ২৩ বছরে বিয়ে করেও রুবিনা এখনও মা হতে পারেনি। এখন শেষমেষ যা হয়েছে তা হলো রুবিনা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে সামিরের অনেক আত্মীয়ই মনে করছে চাকরি করার কারনেই রুবিনার বাচ্চা হচ্ছে না। এটা কোন যুক্তি হলো??
কিন্তু রুবিনা জানে এ সমাজ পাথর টা তাকেই ছুড়ে মারবে। সুতরাং চুপ থাকে রুবিনা। চুপচাপ যে যা বলে শুনে যায়, এমনকি সামির কেও কিছু বলে না, কেনো জানি রুবিনার মনে হয়, সামির কে বললে সে হয়ত ফোঁস ফোঁস করে উঠবে।
সেতু পড়াশোনা করেছে প্রাণ রসায়নে। বাংলাদেশে চাকরির বাজার ভালো এ বিষয়ের তবে সেতু পুরোদস্তুর হাউসওয়াইফ। স্বামী সরকারী চাকরি করে, প্রায়ই পোস্টং চেন্জ হয়, সেতু চায়নি স্বামীকে একা ফেলে চাকরি করার জন্য ঢাকায় থাকতে। খারাপ লাগেনা সেতুর। ভালোই লাগে সংসার করতে।
সেতুর স্বামী সেতুর কাছে অনেক ভালো একজন মানুষ । মাঝে মাঝে যে সিরিয়াস ঝগড়া হয়না তা না। কিন্তু ভালো আছে সে। সংসার বাগান করা খারাপ কি? সেতুর ভালো লাগে অবসরে বই পড়তে। সেতুর ছোট ভাইটা এবার ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে, সেতুর স্বামীরও হঠাৎ ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে। ২ + ২ =৪ হওয়াতে সেতু তার ভাইকে বলে ঢাকায় চলে আসতে। সেতুর বাসায় থেকে কোচিং করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়ে গেলে বোনের বাসাতেই থেকে যায় পল্লব। কোচিং এর সময় পল্লব বাসায় থাকলেও পার্মানেন্ট থাকা শুরু করলে সেতুর ননদরা এটা ভালো চোখে নেয়নি।
বড় ননদ সেতুর স্বামীকে ফোন করে জানায় যে তুই কেনো এরকম একটা ইয়াং ছেলে কে বাসায় রেখেছিস? ঢাকা শহরে তো কত কিছুই হয়, শিগগিরই কিছু একটা কর!
কিছুদিন পর সেতুর সিরিয়াল ঝগড়া বাধে তার স্বামীর সাথে ঝগড়ার এক পর্যায়ে তার স্বামী বলে বসে যে তুমি এ পর্যন্ত কত টাকা ইনকাম করে আমাকে খাইয়েছো?
সেতু ফ্যাল ফ্যাল করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে, কেনো জানি সেতুর মাথা দুলে উঠে, নিজের কানকে কেমন জানি লাগে। কিছুক্ষন পর একটু স্বাভাবিক হয়। সেতু একবার ভাবে যে বলবে বিয়ের সময় আমার বাড়ী থেকে গোটা বাড়ীর ফার্নিচার থেকে শুরু করে ৩০ ভরি সোনার গয়না, ১০ লক্ষ ন গদ টাকা দেয়া হয়েছিলো তোমাকে ভূলে গেলে?
তারপর সেতু ভাবে না এসব বলতে গেলে কথাবার্তা আরো নানারকম মোড় নিতে পারে সেসব হয়ত সে মেনে নিতে পারবেনা।
বাড়ীতে সব বলে সেতু ওর ভাইকে হলে পাঠিয়ে দেয়। সেতুর বাবা মা সেতুকেই উল্টো দোষারোপ করে বলতে থাকে যে আগেই বলেছিলাম তোর বাসায় পল্লব কে রাখার দরকার নাই, জামাই রাগ করতে পারে। এখন যখন অলরেডি একটা সমস্যা হয়েছে তখন, বুঝছিস আরো আগে তোর বোঝা উচিৎ ছিলো।
সেতুর সংসারে এরপরও অশান্তি ছিলো। অশান্তির কারন হলো সেতুর কোন পুত্রসন্তান নেই। পর পর তিনটি কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার লজ্জা তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
আমি বেশ কিছু ঘটনা গল্প আকারে বলে গেছি, কেউ বলেন যে আমাদের সমাজের নারীরা নিপীড়িত, উপেক্ষিত, কেউ বলেন যে না ধীরে ধীরে অবস্হার অনেক উন্নতি হচ্ছে।আমিও স্বীকার করে নিচ্ছি যে সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুর বদল ঘটছে। কিন্তু কিছু কিছু মৌলিক জায়গা রয়ে গেছে সেখানে আজো নারীর অবস্হানের কোন পরিবর্তন এ সমাজে নেই।আমাদের দেশের অনেক নারী আজ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন ঠিকই
কিন্তু তাদের মতামতের গুরুত্ব আজও এ দেশের বেশীরভাগ পরিবার বা সমাজ দেয়না। বিয়ে এমনকি কয়টি সন্তান সে গ্রহন করবে সেটি তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। হয়ত এখন শিক্ষিত মহিলারা ২ টির বেশী বাচ্চা নিতে আগ্রহী নয়, কিন্তু স্বামী বা শ্বশুরবাড়ীর চাপে তাকে অনেকসময় ৩/৪ টি বাচ্চা নিতে হচ্ছে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য। তাহলে আসলে কি আমি বলবো আমরা আধুনিক যুগে বসবাস করছি?
আমার প্রথম গল্পটির ফাতেমা চরিত্র টি থেকে তাহলে আর পার্থক্য কোথায় এসব নারীর জীবনে?
আজও আমাদের সমাজের বেশীরভাগ পরিবার বিশেষ করে পুরুষ সদস্যরা একটু পুত্র সন্তানের জন্য কয়েকটি বাচ্চা গ্রহন করতে পারে।
পুত্র সন্তান বংশের বাতী, সে বাতি জ্বলতে থাকে পুত্র সন্তানটি অযোগ্য নেশাখোর অশিক্ষিত হলেও। বুক ফুলিয়ে এরকম একটি ছেলের বাবা একটি উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিমতী মেয়ের বাবার পাশ দিয়ে টেক্কা দিয়ে হেঁটে যেতে পারে। কারন পুরুষ হলো সোনার চামচ। সে চামচ বাঁকা হলেও সোনাই তো
অশিক্ষিত সমাজের কথা বাদই দিলাম, সেখানে আজও সেই ৩০' ৪০' এর দশকের মত পালে পালে বাচ্চা জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। সামান্য স্বাস্হ্য সুবিধা টা নেই। ঘরে ভাত খাওয়ার টাকা নেই কিন্তু বাচ্চা জন্মাচ্ছে। নারীমুক্তি বলতে আমি বুঝতাম অর্থনৈতিক মুক্তি, শিক্ষার মুক্তি। কিন্তু সে মুক্তি টা এরকম যে এক মাসের বাচ্চা পিঠে বেঁধে গরিব মেয়েগুলো কাজ করে ঘরে যখন দুটো টাকা নিয়ে যাবে সাঁঝের বেলা অকর্মন্য স্বামীর পিটন খাবে, তারপর টাকাটা কেড়ে নিয়ে গিয়ে মদের বোতল কিনে এনে জুয়ার আসরে বসবে ?
আমাদের সমাজের অনেক কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসের কারনে শুধুমাত্র পুরুষ মানুষ সোনার চামচ মেনে নিয়ে কি অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটিয়েও মার খেয়ে যাবে মেয়েগুলো?
বছর বছর গাভীর মত বাচ্চা দিয়ে যাবে?
উচ্চশিক্ষিত হবার পরেও একজন নারী শান্তি পাবেনা ঘরে বা বাইরে?
সত্যিকার অর্থে ঠিক কতজন নারী পায় শারীরিক মানসিক সুখ তার স্বামীর কাছে?
আজকের এই যুগে ঠিক কতজন মেয়ে বিয়ের পিড়িতে বসে শারীরিক বা মানসিক সুখের চাহিদার কথা মাথায় রেখে?
নাকি শাহেদার মত বাবা মায়ের মান সম্মান শুধুমাত্র রক্ষা করেন?
কিভাবে সম্ভব হয় একটি বিয়ে যেখানে দু তরফের মানসিক কোন যোগাযোগ নেই অথচ বিয়ের রাতেই অচেনা এক মানুষের সাথে শরীরের যোগাযোগ হয় ঠিকই!
তাহলে কি বিয়ে মানেই শুধু শরীর ? শরীর টা কার? মেয়েদের মতামতের গুরুত্ব না থাকলে মনে হয়না মেয়েদের শরীরেরও এখানে কোন গুরুত্ব আছে।
আমার লেখাকে কেউ নারীবাদী কেউ মার্ক্সবাদী বা কেউ আরো কোন মতবাদ দিয়ে হয়ত আলোচনা করতে চাইবেন। ওয়েলকাম অল কিন্তু আমি আশা করবো এই বিষয়গুলো যারা ভালোভাবে জানেন তারা একটা ভালো আলোচনায় আসুন। আমিও হয়ত অনেককিছু জানবো।
আরো একটা কথা না বললেই হয় আমার একজন শিক্ষক ক্লাসে একবার বলেছিলেন যে নারীর চেয়ে আমাদের সমাজে আরো অব হেলিত শিশুরা।
স্যারের কথা ঐদিন আমি সাথে সাথেই মেনে নিয়েছিলাম। এবং বলেছিলাম স্যার সবচেয়ে বেশী অবহেলিত মেয়ে শিশুরা! তাই আমার কাছে মনে হয় নারী বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। প্রয়োজন আছে থাকবে, যতদিন এ দেশের মেধা ও মননের মুক্তি না ঘটবে!
উৎসর্গ
বেগম রোকেয়া
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন
আমার মনে হয় আর কিছু বলতে হবেনা!!