তখন আমি প্রাইমারীতে পড়ি.......
স্কুলে ছুটির ঘন্টা বাজছে... বই-খাতা বগলে চেপে দে দৌড় কে আগে যেতে পারে। কারন স্কুলের সামনেই একটি সাকো যা পার হতে হলে একজন একজন করে উঠতে হবে। আর যে আগে উঠবে সে আগে পার হবে। এটাই স্বাভাবিক। শুধু আগে পার হয়ে যাওয়াই মূল উদ্দেশ্য নয়। আগে পার হতে পারলে আগে আগে বাড়ী যেয়ে ওছা জাল(নেট মশারীতে তিন টা বাশের কাঠি দিয়ে বানানো) নিয়ে আগে মধূমতি নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া যাবে এটাই ছিল উদ্দেশ্য।
আজও মনে পড়ে সামনে ওছা জাল পিছনে আমি আমার কোমরের সাথে চিকন রশি দিয়ে বাঁধা সিলভারের হাড়ি চলছি স্রোতের বিপরীতে। কিছুদুর যাবার পর জাল তুলে দেখতাম চিংড়ি মাছ চড়াৎ চড়াৎ করে লাফাচ্ছে। সেই সাথে দু' একটা রয়না/ভ্যাদা/মেনি মাছ উঠত এমন কি কইড়া পুটি অর্থাৎ বড় পুটি মাছ ও উঠত। কচুরিপানার ভিতর খ্যাপ দিলে চেউয়া বাইলা, নুন্দীবাইলা, ডগরী বাইলা, সাদা বাইলা মাছ সাথে দু একটা কই মাছ, সিং মাছ ও উঠত। আধা ঘন্টা এক ঘন্টা মাছ ধরলেই হাড়ি ভরা ভরা হয়ে যেত।
মাছ ধরা শেষ এবার নদীর চর থেকে তিলের পাতা ছিড়ে মাথায় ঘষা এতে চুল পরিষ্কার হয়, মাথা ঠান্ডা থাকে। গোসল করতে নদীতে ঝাপ দিলাম। দুরে একটা কলা গাছ ভেসে আসছে দেখে সাতরিয়ে তিন জনে মিলে ওটা ধরলাম। এক কলা গাছ ৩ জনেই সাতার দিলাম নিয়ে নদীর ওপারে যাবো। নদীর ওপারে খিরাই, বাঙ্গী (ফুড), তরমুজের চাষ হয় চুরি
তখন আমি হাইস্কুলে পড়ি......
স্কুল ছুটি তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে কইয়া জাল (কই মাছ ধরার উপযোগি) পুইটা (পুটি মাছ ধরার) নিয়ে রওনা নদীতে। জালের এক মাথায় একটুকরা কলা গাছের সাথে আর এক মাথা আমার হাতে। চলছি এবার স্রোতের সাথে। ১০/১৫ মিনিট পর জাল টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলে দেখা যেত সাদা চাপিলা মাছ আর পুটি মাছে জাল সাদা হয় গেছে (গল্প না মোটেই, সত্যি কথা) হাড়ি ভরতে সময় লাগত না। সে মাছের স্বাধ এখনও জিহ্বে লেগে আছে। অনেকটা ইলিশ মাছের মত ঘ্রাণ।
তখন আমি কলেজে পড়ি........
বছরে দুইবার ছুটিতে বাড়ি আসি ঈদের সময়। এবার এসে বন্ধুদের বল্লাম দোস্ত রাতে নদীতে মাছ ধরতে যাব। রাতে ঝাঁকি জাল নিয়ে ৪ বন্ধু চল্লাম আমি, আলিম, নূর ইসলাম আর একলাস মিয়া। শেষ রাতে পূর্ণিমা লাগবে ভরা জোছনা। বোরো ধান কেটে নিছে হয়ত ১ সপ্তাহ হবে। জোয়ার এসে ধানের গোড়া গুলো তলিয়ে গেছে। ও সকল ধানের গোড়ায় জাল ফেলে টানার সময় সে যে কি আনন্দ বড় বড় গলদা চিংড়ির লম্বা লম্বা পা আর দাড়ি জালে বেধে উপরের দিকে উঠে আসে। সাথে একটা কাপড়ের ব্যাগ ভাটা আসার আগেই ভরে গেল। আজও মনে পড়লে হাসি পায় আলিম নিজের লুঙ্গী খুলে
মধুমতিতে বাৎসরিক নৌকা বাইচ হতো। নদীর চরে মেলা বসত যে মেলায় কেনা কাটা করার জন্য ছোট বেলায় মাটির ব্যাংকে টাকা জমাইতাম। ঠিক মেলার আগের দিন ব্যাঙ্ক ভেঙ্গে কয়েনগুলো পাশের দোকানে দিয়ে ১ টাকা ৫ টাকার নোট নিতাম।
এখন আমি প্রবাসে থাকি.......
দেশে যাবো করে কিছু কেনা কাটা করলাম তার মধ্য আমার জন্য কিনলাম মাছ ধরার বড়শি, ছিপ, হুইল, কিছু মশলা যা দিয়ে মাছের আদার তৈরি করা হয়। বাংলাদেশি টাকার ১২/১৩ হাজার টাকা আমার খরচ। তবু মনে আনন্দ দেশে যেয়ে বিকাল বেলা মধুমতি নদীতে বড়শি ফেলব, দেশি রুই, বোয়াল বা আইড় মাছ যদি একটা পাই তাহলে ই স্বার্থক।
প্রতিবার আমি ঢাকা থেকে ফেরার সময় টুঙ্গীপাড়া নেমে সোজা খেয়া ঘাটে এসে নৌকায় উঠে আগে মধুমতির পানি দিয়া হাত মুখ ধুইয়া কখনও কখন ও দু একঢোক পান করে সকল ক্লান্তি দূর করতাম।
কিন্তু এবার বাড়ীতে আসলাম রাতের বাসে নদী পার হলাম ফেরীতে নদীর পানি টেস্ট করা হলো না ভালো করে রাতের অন্ধকারে আমার মধুমতি কে দেখা ও হলো না। পরদিন দুপুরের খাবার খেয়ে আমার শখের বড়শি নিয়ে নদীতে গেলাম।
একি! কোথায় আমার মধুমতি? কোথায় সেই স্রোত? কোথায় সেই কুল ভাঙ্গা ডেউ? নদীতে গর্জন নেই কেন? না খাওয়া রুগ্ন বস্তির ছেলেটির মত সুকিয়ে আমার মধুমতি চিকন একটা খালে পরিনত হয়েছে। দেখে মন খারাপ হয়ে গেল.... আমার কান্না পেতে লাগল।
ছবি গুলো গুগল থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৪:২৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



