somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সীড ব্যারেটঃ শাইন অন!

১১ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গরম পড়ে গেছে কিছুদিন হলো। তখন শরতের শেষ প্রায়, বাতাসের হুটোপুটি চলে। আমাদের রুমের দরজা জানালা খুলে দিলে প্রচুর বেদুইন বাতাস ট্রেসপাসিং করে। আমরা অবশ্য নিজেদের সম্পত্তি বিষয়ে উদাসীন। পৃথিবীতে আরো প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে খেয়াল রাখার। বাতাসে ভিজতে ভিজতেই আমার কম্পিউটারে 'গীটারিক' একটা গান ছাড়ে। প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছুই শোনা যায় না। তার পরে খুব মৃদু একটা কর্ড। আমি কান খাড়া করি, সে ভলিয়্যুম বাড়িয়ে দেয়। বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে মিশে কিছু শব্দ আমার কানে সুর হয়ে আসে। শুনতে শুনতে একটু বেখেয়াল হয়েছিলাম, মিনিট দুই কি তিন পরে দেখি বাতাসের চেয়ে তীব্র সেই সুর। ভয়ানক দুঃখী, করুণ আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়া সুরটা আমাদের রুমের ভেতর পাক খেতে থাকে। পাক খেয়ে ভেতরের বাতাসকে ঘোলা করে দেয়। আমি শুয়েছিলাম আধশোয়া হয়ে, উঠে বসতেও ভুলে যাই। গীটার, আর নাম-না-জানা যন্ত্রের যন্তর-মন্তর ঘুরতে থাকে প্রবল আকর্ষণে আমাকে বেঁধে নিয়ে।

তারপরে ধীরে ধীরে সুরের স্রোত একটু ধীর হয়ে আসে। আমার সজাগ হয়ে ওঠা ইন্দ্রিয়ের বার্তা পাইঃ এটা হয়তো আবারও ঝড় ওঠার পূর্বাভাস। একটু পরেই খুব নীরবতার মতো কেউ একজন কোমল অথবা কাতর স্বরে বলে ওঠে,
Remember when you were young, you shone like the sun.
মনে রেখো, তুমি যখন তরুণ ছিলে, সূর্যের মত প্রখরতায় জ্বলেছিলে।
Shine on you crazy diamond.

আমার শুনতে ভুল হয়। আমি গায়কের পেছনে, সুরের পেছনে একটা হালকা হাসির আওয়াজ পাই। আমার কৌতূহল তখন তুঙ্গে! হে উন্মাদ হীরক, তুমি জ্বলো। এমন ভাবে কেউ বলে নাকি? এমন উন্মূল কাতরতা ঝরে ঝরে পড়ছে হালকা ড্রামের সাথে।
Now there's a look in your eyes, like black holes in the sky.
Shine on you crazy diamond.

আমার মাথায় ভাবনার গুটিপোকারা চলাচল শুরু করে। কার চোখে এমন দৃষ্টি, যার মাঝে কৃষ্ণগহ্বরের ছায়া! মনে হয় কোন সত্যিকারের পাগলের কথাই বলছে গানে। আমি ভাবতেই থাকি, কারণ আর কোন গান আমাকে ভেতরের মানুষ নিয়ে এভাবে আগ্রহী করে তুলেনি। গীটারিক তখন মাথা নিচু করেই শুনছে, হাতে ওর অ্যাকুয়স্টিকটা ধরে আলতো আলতো হাত বুলাচ্ছে। এটা যদি আমার আগ্রহের সীমা হয়, তবে তা মুহূর্তেই পেরিয়ে গেল পরের কথাগুলো শোনার পরে।

You were caught on the crossfire of childhood and stardom,
blown on the steel breeze.
Come on you target for faraway laughter,
come on you stranger, you legend, you martyr, and shine!

এই কথা তো বন্ধু ছাড়া কাউকে নিয়েই বলা যায় না। কাউকে এমন আপন করে না চিনলে, না জানলে কীভাবে গায়ক টাকে এমন আহ্বান করবে?

তারপরে আমি এই গানের মানুষটিকে খুঁজতে শুরু করি। ইন্টারনেট দারুণ জায়গা, রহিম, করিম, মকবুলকেও খুঁজে পাওয়া যায়। আর আমার সামনে অচিরেই যে মানুষটা উঠে এলো, সে ধীরে ধীরে আমার চিন্তা-চেতনার জগতে একটা বড়ো ঢেউ ফেলেছে সামনের কিছু দিন।

এই গানটার নামঃ Shine On You Crazy Diamond। গানের সুর রজার ওয়াটার্স, ডেভিড গিলমোর আর রিচার্ড রাইটের লেখা। কথা লিখেছে ওয়াটার্স। পুরো ট্র্যাকটির দৈর্ঘ্য মাত্র তেইশ মিনিট। প্রথমে প্ল্যান ছিল পুরোটা একসাথে রাখার। পরে ঠিক করা হলো এই একটা গান দিয়েই অ্যালবাম শেষ ও শুরু করতে হবে। তাই দুইভাগে ভাগ করে ফেলা হলো পুরো গানটিকে। মোট নয়টা অংশের মাঝে ১ থেকে ৫ নম্বর ভাগ নিয়ে হলো প্রথম অংশ। আর ৬ থেকে ৯ পর্যন্ত ভাগগুলো নিয়ে হলো দ্বিতীয় অংশ। নয়টা ভাগের ব্যাপার হলো, এক একজন এক একসময়ে কম্পোজ করেছে। পরে সেই পীসগুলোকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। পিঙ্ক ফ্লয়েড ব্যাণ্ডের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড়ো গান। এবং এটাই সম্ভবত তাদের সবচেয়ে মহান সৃষ্টি।


কিন্তু এসব তো বইপত্রের কথাবার্তা। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই পাওয়া যায়। সেগুলো নিয়ে আজকে এই ঘোর রাত্রিতে আমি কেন ক্ষেপে উঠলাম? শাইন অন য়্যু ক্রেজি আমি যখন প্রথম শুনেছিলাম, আমি বারবার শুনছিলাম। বারবার তেইশ মিনিট করে পেরিয়ে যেতে লাগলো, আমি কিছুতেই মনস্থির করতে পারছি না। গানের সুর আর কথা আমার হৃদয়ে গেঁথে গেঁথে যেতে থাকলো। ঐ যে বললাম, "পৃথিবীতে আরো প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে খেয়াল রাখার।", আমি তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের নেশায় তখন বুঁদ হয়ে গেছি। এ কোন মানুষের কথা বলা হয়েছে গানের ভেতর? তাকে বার বার বলেই যাচ্ছে তুমি জ্বলতে থাকো? কী তার কাহিনী?

You reached for the secret too soon, you cried for the moon.
Shine on you crazy diamond.
Threatened by shadows at night, and exposed in the light.
Shine on you crazy diamond.
Well you wore out your welcome with random precision,
rode on the steel breeze.
Come on you raver, you seer of visions,
come on you painter, you piper, you prisoner, and shine!

এই লাইনগুলোতে আমার সামনে ধীরে ধীরে একটা অবয়ব পরিষ্কার হয়ে উঠতে থাকে। যেন কেউ খুব আলতো করে একটা পর্দা সরিয়ে নিচ্ছে একজন মানুষের মুখের ওপর থেকে। আমার চোখে ভাসে উদ্‌ভ্রান্ত, খেয়ালি একটা মুখ। মনিটরে খোঁজ লাগাই, আসলেই তো! উশকো খুশকো চুলের একটা সাদা-কালো ছবি ফুটে ওঠে। ঈষৎ বসে যাওয়া চোয়ালে একজন তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টিতে রাতের ছায়ার ভয়, আবার সূর্যের আলোয় ঝলসে যাওয়া অতীত! নির্বাক চোখের ভাষা কত তীব্র, প্রচণ্ড!


সীড ব্যারেট। পিঙ্ক ফ্লয়েডের প্রাণ ভোমরা। রজার, সীড, নিক মেসন, আর রাইট- চারজনের দল তৈরি হয়েছিল সেই '৬৫তে। সীড একইসাথে গান লিখতো, কখনো কখনো সুর দিত, গাইতোও। মূলত সেই সাইকেডেলিক রক মিউজিককে তুলে এনেছিল পিঙ্ক ফ্লয়েডের গানের মধ্যে। সীড ড্রাগ নিতো– সাইকেডেলিক ড্রাগ বলে পরিচিত এল.এস.ডি। বিষের মত রক্তনালী বেয়ে বেয়ে সীডের মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকে যেত কালকূট। যে ধরনের জীবনাচরণ সীডের ছিল, খামখেয়ালিপনায় ভরা, উচ্ছৃঙ্খলতায় ঘেরা; তাতে বেশি সময় লাগলো না প্রভাব পড়তে। ড্রাগের প্রভাবে অথর্বের মত জড় হয়ে যেতে লাগলো সে। একটা সময়ে ব্যাণ্ডের বাকিদের সাথেও সমস্যা শুরু হলো। একটা গানের দলের সদস্যদের মাঝে যে সমঝোতা থাকা দরকার, তাতে চিড় ধরে গেল। শেষমেশ সীড নিজেই দলত্যাগ করলো, ঠিকমত বাজাতেও পারছিলো না যে শেষদিকে!

যে ড্রাগের প্রভাবে অপার্থিব সুর সৃষ্টি হতো, কী অদ্ভুত খেয়ালে সেই ড্রাগই কেড়ে নিলো সবঃ গান, সুর, ছন্দ, সৃষ্টি, চিন্তা। এর পরের গল্পটা সরল। সীড নীরব হলো, নিশ্চুপ হয়ে এলো তার গীটার, নিথর হলো লেখার কলম। পিঙ্ক ফ্লয়েডের যাত্রা অবশ্য থামেনি। আরেক বন্ধু ডেভিড গীলমোরকে নিয়ে ব্যাণ্ডের কাজ আবার শুরু হলো। একে একে বেশ কয়েকটি অ্যালবাম বের হলো তাদের। অবশেষে '৭৫-এ এসে মুক্তির মুখ দেখলো Wish You Were Here । এই অ্যালবামের গান মাত্র চারটা, যার মাঝে একটা গানই তেইশ মিনিটের "শাইন অন য়্যু ক্রেজি ডায়মণ্ড"। গানের প্রতিটি লাইন সীডকে নিয়েই লেখা। একজন বন্ধু, সহযাত্রী, সমমনা সাথী আমাদের মনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। সীড ব্যারেট চলে যাবার পরে পিঙ্ক ফ্লয়েডের বাকি সদস্যেরা আর কখনই তার প্রভাব পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে ছিল তাদের বন্ধুর চেয়েও বেশি একজন, ভাবাদর্শিক নেতা!

দ্বিতীয় অংশের কথাগুলো এরকমই প্রমাণ করেঃ
Nobody knows where you are, how near or how far.
Shine on you crazy diamond.
Pile on many more layers and I'll be joining you there.
Shine on you crazy diamond.
And we'll bask in the shadow of yesterday's triumph,
sail on the steel breeze.
Come on you boy child, you winner and loser,
come on you miner for truth and delusion, and shine

কী দূর্দান্ত পংক্তি। কী অস্বাভাবিক কবিতা। আমি যতবারই পড়ি, শিউরে উঠি। একজন রক্তমাংসের মানুষের জীবন কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার চারপাশের সবার কাছে। আমরা হয়তো কখনও খেয়ালও করি না কারা আমাদের দিকে অনুগত দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।

শেষে একটা অসামান্য ঘটনা না বলে পারছি না। এই গানটির স্টুডিওর রেকর্ডের সময়ে, '৭৫ সালের কোন এক পড়ন্ত বিকেলে সীড ব্যারেট এসে চুপচাপ বসেছিলো এক কোণে। সম্পূর্ণ মাথা কামানো, একটু স্থূল শরীরের জবুথবু বসে থাকা মানুষটিকে কেউই চিনতে পারেনি। বাকি সবাই তখনও বাজনা, গাওয়া এসবে মগ্ন। অনেকক্ষণ পরে রেকর্ডিং শেষ হলে তাদের ম্যানেজার জানালেন, সীডের কথা। ততক্ষণে সে চলেও গেছে স্টুডিও ছেড়ে। যাদের সাথে তার প্রায় পাঁচ-সাত বছর যোগাযোগই নাই, তাদের সাথে দেখা করতে কেন সীড ঐ দিনটাই বেছে নিলো? সেদিনে তো সকলে তাকেই মনে করছিলো, তার জন্যেই গাইছিলঃ
"কাম অন ইউ বয় চাইল্ড, ইউ উইনার, ইউ লুজার
কাম অন ইউ মাইনার ফর ট্রুথ অ্যান্ড ডিলিউশন, অ্যান্ড শাইন!"


***
- অনীক আন্দালিব
১৭.৭.৯


**মূল গানটি ইস্নিপ্‌স-এ খুঁজে পেলাম না। এখানে অন্য দু'টি কভার-এর অডিও লিঙ্ক দিচ্ছি, আগ্রহীদের সংগ্রহের জন্য প্রথম অংশ এবং দ্বিতীয় অংশ

* গানটির লাইভ ভিডিওঃ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৪৪
৩১টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×