সম্পর্ক ও দুঃস্বপ্নরা
-অদ্বিতীয়া সিমু
রিতু একবার তাকাল, কিছু বলল না প্রথমেই। কিছুই মনে হল না ওর। নিতু এবার টিটকারি দিল।
-আপু, মনে হয় বাচ্চা এবার এ বাড়িতেই হবে !! কি বল ......
বলতে বলতেই চোখ টিপ দিল। রিতুও মুচকি হেসে চোখ টেপার জবাব দিল।
-শোন, নিতু !!
-হু, বল .....
-এবার বাচ্চাসহ দূরে কোথাও ফেলে আসব, কি বলিস .....!!
-ঠিক বলেছ , অন্তত দত্তপাড়া ছাড়িয়ে দূরে কোথাও ......
মিতু এবার মুখ ঝামটে উঠল। তিনবোনের মধ্যে সবার ছোট ও। যদিও বিড়াল আমদানীর ব্যাপারটা রিতুর মাধ্যমেই ঘটেছে, তবুও মিতুই ওদের রক্ষাকর্তী।
-কেন? তোমাদের কি হয়েছে? টুটু এখানেই বাচ্চা দিবে!!
রিতু কোন কথা বলল না। এবার নিতু কথা বলল।
-হুম, বাচ্চা হলেই কি তুমি রাখতে পারবে? তোমার স্মার্ট বিল্লি পিটু ওদের খেয়েই ফেলবে!!
-কে বলেছে? আমি রাখব .......
-রাখতে পারলে রেখ .......
-রাখবই ......
-রাখ ......
রিতু এবার ধমকে উঠল। ওর অসহ্য লাগছে।
-কি হয়েছে? তোরা এভাবে ঝগড়া কেন শুরু করেছিস?
বোনের ধমকে চুপ হল ক্ষণিকের জন্য নিতু-মিতু। কিন্তু রিতু ঘর থেকে চলে যাওয়া মাত্রই আবার আলোচনা শুরু হল।
-শোন মিতু, দেখিসনি আগের বাচ্চাগুলো পিটু খেয়ে ফেলেছে ........। এবারও খেয়ে ফেলবে।
-ভাল হয়েছে। তবু টুটু এখানেই বাচ্চা দিবে।
-কিন্তু দেখ বিড়ালরা পশু। দেখলিনা পিটুতো টুটুরই বাচ্চা, অথচ টুটুর অন্য বাচ্চাগুলোকে পিটুই খেয়ে ফেলেছে। ওদের রিলেশনটাই এমন .....
রিতু ঘরে ঢুকতে গিয়েও থমকে গেল। হ্যাঁ, পশুদের রিলেশনটাই এমন। এমনই বোধহয়! ওর বুকের ভেতরটায় কোথায় যেন শূন্য মনে হল। পিটু টুটুর বাচ্চা চুরি করে খেয়ে ফেলে। অথচ গাধা টুটুই পিটুকে নিয়ে বাচ্চা খোঁজার অভিযানে বের হয়। মিউ ..... মিউ ...... করে করে বাড়ি মাথায় তোলে। ডোরাও টুটুর বাচ্চা। কিন্তু ডোরা কখনও টুটুর বাচ্চা খায়নি। শুঁকেই মুখ কুঁচকে পালায়। হয়ত ওর ঘৃণা হয়, ওর মার বাচ্চা! হাঃ .... হাঃ .... হাসতে ইচ্ছে করল রিতুর।
কিন্তু পিটু? মার ভাষায়, ‘ ব্যাটা বিলাই এমনই হয়। ব্যাটারা কখনও সৈহ্য করে না। ’ রিতু শুধিয়েছিল, ‘ মা, বেটিরা সৈহ্য করে? ’। ’করতে হয়। ’ । যদি পশুর মত এমনই সম্পর্ক হতো তাহলে রিতু যে বেটি হয়েও সৈহ্য করত না, তা রিতু জানে। কেন করত না? নাকি করত? নাহ্, করত না। ও কখনই ডোরার মত পালিয়ে যেত না, ঘৃণায় মুখ কুঁচকে নিত না। ও পিটুর মতই ঘাড় মটকে কচ্ক্ করে চিুিবয়ে খেয়ে ফেলত! ছিঃ .... ছিঃ .... ও এসব কি ভাবছে! মাতো বলে রিতু এখনই কিছু সৈহ্য করে না। কেমন মেয়ে যে হয়েছে, কেমন মেয়ে যে পেটে ধরেছে! মা আক্ষেপ করে। রিতুর ভাবনাগুলো রিতুকেই হাসাল। ও মিষ্টির বাটিটা আলমারীতে তুলে রাখল রেহানের জন্য। রেহান রিতু-নিতু-মিতুর ভাই। ওদের আরেক ভাই মাহিন। মাহিন সবার ছোট।
রেহান বাসায় নেই এখন। হযত কোন বন্ধুর বাসায় আড্ডা দিচ্ছে। কতদিন পর দেশে আসলো! নিউজিল্যাণ্ড থেকে ফেরার পর রিতু রেহানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল রেহান অনেক শুকিয়ে গেছে। ওকে বেশ কালোও দেখাচ্ছে। এমনিতেই ঘাড় উঁচু করে রেহানের সাথে কথা বলতে হয়। এখন মনে হচ্ছে আরও লম্বা হয়ে গেছে। এম বি এ করছে। ওর দিকে তাকিয়ে রিতুই অবাক হয়ে গেল কবে এত বড় হল। মা অবশ্য রিতুকে প্রায়ই বলে, ‘ বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস, বিয়ে করবি কবে? ’ রেহানের দিকে তাকিয়ে রিতুর সত্যিই মনে হল ও বুড়ি হয়ে গেছে। রিতু রেহানের চেয়ে তিন বছরের বড়। রিতুর বয়স কত? সাতাশ বা আটাশ! মনে করে খুব মজা পেল রিতু। ও বুড়ি!
বাড়ি আসার পর রেহান রিতুর সংগে ভালমত কথাই বলেনি। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। রাতে হয়ত দু’টা কথা হয়, তেমন নয়। রিতু ফিল করে রেহান অনেক দূরের হয়ে গেছে। যে রেহান রিতুর হাতে মাখা ভাত ছাড়া খেত না, সে রেহান খাবার সময় রিতুকে শুধায়ও না! সেদিন খাবারটেবিলে কেমন করে কথাগুলো বলল!
-আপু বিয়ে-শাদী কবে করছে?
রিতু চমকে উঠেছিল। কি বলে রেহান! আব্বুও হেসে তাল দিল।
-জিজ্ঞেস কর তোর আপুকে ......
রিতুর হাত থেকে ছলকে পড়ল পানি, আর একটু হলে গ্লাসটাই পড়ে যেত। রেহান জানে, সব জানে। সব জানার পর কোন ভাই বোনকে এভাবে বলতে পারে! ও জানে রিতুর একবার বিয়ে ভেঙে গেছে। রিতুর জীবন কিভাবে তছনছ হয়ে গেছে। রিতু চেষ্টা করছে দুঃসহ স্মৃতি থেকে বের হয়ে আসতে। রেহানের উচিৎ বোনকে সাপোর্ট করা। নিতু-মিতু চুপ করে খেতে থাকে। মাহিন ফোড়ন কাটে।
-হু, আপুর বিয়ে হলে বাড়িতে উৎসব হবে .....
রিতু এবার রেগে ওঠে।
-এইটে না উঠতে উঠতেই বড় হয়ে গেছে মাহিন!
-না, সবাই বলে লেখাপড়া শেষ, জব করছ ......
রিতু কথা বলে না, মিতুর পাতে মাছ উঠিয়ে দেয়। ওর বুক ঠেলে কান্না পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খাবার ঘর থেকে বের হয়ে এল। ও শুনতে পাচ্ছে ওরা কথা বলছে। নিতুর জন্য গর্ব লাগছে। নিতু প্রতিবাদ করতে শিখেছে। মিতুও ফোড়ন কাটে।
-না, আপু যেদিন ফ্লাট কিনবে নিজে, সেদিন বিয়ে করবে .......
রেহান খেতে খেতেই বলে ,
-মানে??
-বারে, এখন যেখানে আছি সেটাত আমাদের বাপের বাড়ি। আর যখন বিয়ে হবে তখন হবে জামাইর বাড়ি। তাহলে আমাদের বাড়ি কোথায়!!
-মেয়েদের বাড়ি থাকতে হয় নাকি!
এবার রেগে ওঠে নিতু।
-তার মানে ভাইয়া, তুমি কি বলতে চাচ্ছ মেয়েদের কোন বাড়ি হবে না, পরিচয় থাকবে না! শুধু পুরুষদেরই বাড়ি, পুরুষদেরই পরিচয়!
-যত্তসব! আপুর মত তুইও নারীবাদী হয়ে উঠেছিস .......
-না, ভাইয়া, আপু কখনই নারীবাদী নয়, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে .....
-হয়েছে ......! তুমিও ভার্সিটি লেভেলে ঢুকেই আপুর শিষ্য হয়ে উঠেছ! আর ......
মাঝখানে মিতু-মাহিন ফোড়ন কাটে,
-ফেমিনিস্ট ..... ফেমিনিস্ট ......
-ফেমিনিস্ট ..... ফেমিনিস্ট ......
মিতু-মাহিনের ঠাট্টাতে নিতু আরও রেগে ওঠে,
-শব্দটা কাদের উৎপাদন! নিশ্চয়ই নারীদের নয় ..... অবশ্যই নারীরা নারীবাদী। তাহলে পুরুষরাও পুরুষবাদী!
রেহান প্রশ্ন করে,
-হুম, তাহলে আলাদা কেন?
-দেখ ভাইয়া মানুষ হতে হয়, কেউ মানুষ হয়ে জন্মায় না।
-তাহলে নারী-পুরুষও হতে হয়!
-অবশ্যই .....
-তাহলে আগে মানুষ, তারপর নারী-পুরুষ .....
-মোটেও তা নয় ভাইয়া। মানুষ জন্ম নিলেই মানুষ হয় না। তারা খুব সহজেই লিঙ্গভিত্তিক আত্মপরিচয় খুঁজে নেয়। তাই বলে তাই হয়ে ওঠে না। নারী এবং পুরুষের আলাদা অর্থ আছে। নারীকে যেমন নারী হতে হয়, পুরুষকেও তেমনি পুরুষ হতে হয়। তারা যেমন একে অন্যের পরিপূরক, তেমনি ইণ্ডিভিজুয়ালি ’মানুষ’। এবং মানুষ না হতে পারলে অমানুষ .....। যদি কেউ শুধু নারী হয় সেটা যেমন অন্যায়, তেমনি শুধু পুরুষ হওয়াও অন্যায় বৈ কি ........
দীর্ঘ বক্তৃতার পর নিতুর গাল দুটা লাল দেখাচ্ছে, উত্তেজিত। ও জানে রিতু আপু যা ওকে বলে মিথ্যে নয়! ও এসব নিয়ে ভাবে।
মা এবার দুশ্যপটে হাজির হলেন।
-কি হল রিতুর আব্বু, তোমার সামনেই ছেলেমেয়েরা বাজে তর্ক করে যাচ্ছে!
খুব পবিত্র মনে হচ্ছে মাকে। নামাজ পড়ে মাত্র উঠেছে। গায়ে নামাজের আলাদা ওড়না জড়ানো। রিতুকে নিয়ে কথা উঠলে মা সৈহ্য করেন না। যদিও রিতুকে সবচেয়ে বেশী গালি দেয় মা নিজেই। মা-ই বলেন, ‘ আমার পেটে জন্মেছে দাউস! ’ রিতু অবশ্য এই দাউস শব্দ নিয়ে কখনও গবেষণা করেনি। মা বলে, ‘ দাউসরা কখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ’ তাহলে সে হিসেবে রিতুও প্রবেশাধিকার রাখে না। তাহলে ছেলেদের কি বলে? তাদের সবারই বোধহয় জান্নাতের টিকিট কনফার্ম! তাইতো এত কথা বলে বোনের বিরুদ্ধে!
হয়ত মা নামাজপাটিতে বসে দোয়া করেছে, দোয়া করেছে রিতুর জন্য। ও যেন ভাল পথে ফিরে আসে সেজন্য।
এবার উচ্চস্বরে বললেন,
-বলি, রিতুর বাপ ....!!
-কেন!! আমিতো খাচ্ছি .....
-যাও, যার যার খাওযা শেষ টেবিল ছাড়!
কোনরকম পাট চুকল সেদিন। এরপরেরদিনই রেহান বাইরে যাবার আগে বলে গেল মেয়েদের বাবা-মা শিক্ষা দেয় সন্তান পালনের জন্য, অন্য কারণে নয়। রিতুর হাসি পেল। তাহলে স্বামীর পাশে থাকবে কে! ওতো মনে করে বিয়ে একটা বণ্ড। বিযে একটা পবিত্র সম্পর্ক। যেখানে একজন নারী আর একজন পুরুষ একত্রিত হয় নিজেদের অপূর্ণতাগুলো পূরণ করে সম্পূর্ণ হতে। চোখ বন্ধ করে একজন আরেকজনের হাত ধরে পথ চলতে পারে। যেখানে থাকে শুধুই বিশ্বাস ........ । হতে পারে এরই নাম ভালবাসা। শুধু সন্তান উৎপাদনই নয়, স্বামীর কর্মপ্রেরণা হবে স্ত্রী, আর স্ত্রীর কর্মপ্রেরণা হবে স্বামী; নয়তো কিসের বাঁধন। মিষ্টিটা রেখে আরমারী বন্ধ করে ঘরে চলে এল রিতু।
রাত সারে বারটা। রিতু আবার গেল আবার গেল আলমারীর কাছে। মিষ্টির বাটি খালি। রেহান খেয়ে ফেলেছে। কে রেখেছে, প্রশ্ন করেনি! কেমন হয়ে গেছে রেহান! অনেক বড়!
রিতু ঘরে ঢুকল, টুটু বাচ্চা দিয়েছে। কুঁই ..... কুঁই ..... শব্দ হচ্ছে। কোথায়? যাহ্ বাবা, খুঁজে কাজ নেই, পিটুর পেটেই যাবে।
মিতু এবার তরবর করে বলতে লাগল,
-আপু জান, টুটু বাচ্চা দিয়েছে ৩টা, পিটু অলরেডী ১টা পেটে চালান করেছে, ১টা নিতে পারেনি, জখম করেছে, ১টা ভাল আছে .....। মা বলেছে জখম বাচ্চা বাঁচে না, সত্যি!!!
রিতু এবার ধমক দিল।
-ওরা পশুর জাত!! ব্যাটা বিলাই খাবেই, পিটু ব্যাটা!! যাও, এখন নিজের ঘরে যাও ......
মিতু এবার চুপ করে চলে গেল। রিতুর মাথাটা ঝিমঝিম করছে। বাচ্চা তাহলে ওর ঘরে। ও বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুম আসছে না। রেহানের কথাগুলো পীড়া দিচ্ছে বারবার। ও চেষ্টা করছে ঘুমাতে .......
চোখটা লেগে এল হঠাৎ। কচ্কচ্ শব্দ হচ্ছে দুই পাশ থেকে! বেডসুইচটা টিপতেই দেখল বিভৎস দৃশ্য! টুটু তার জখম মৃতপ্রায় বাচ্চাটা চিবিয়ে খাচ্ছে, আর শোকেসের ওপর পিটু ভাল বাচ্চাটা ধরে চিবিয়ে খাচ্ছে! রিতু কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল। না, না, এ হতে পারে না! এ দুঃস্বপ্ন!
মিতু ডাকছে,
-আপু, টুটুর একটা বাচ্চাও নেই!!!!
রিতু ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসল। রাতের দুঃস্বপ্নরা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। টুটু জখম বাচ্চাটা চিবিয়ে খাচ্ছে, পিটু সুস্থ বাচ্চাটা চিবিয়ে খাচ্ছে! ওর চোখের সামনে রেহান-নিতু-মিতু-মাহিন সবার মুখগুলো ভেসে উঠল ......। আস্তে আস্তে কেমন করে যেন সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে আসছে ...... ধূসর ...... নীল ...... অনেকগুলো কষ্ট .....। রিতু অতলে হারিয়ে যাচ্ছে ........
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ২:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




