কেন যে নারী হলাম না
মাসিক মনোজগত পত্রিকায় " অব্যক্ত যন্ত্রণার কিছু কথা" শিরোনামে 'মনের জানালা' বিভাগে একটা লেখা লিখে ছিলাম নাম দিয়েছিলাম মিস নাসরিন সুলতানা শিউলী কাশিনাথপুর, পাবনা, মোবাঃ ০১৮৫৯১১৪৯৬২ । লেখাটি প্রায় এরকম ~
কথায় বলে যার কেউ নেই তার স্রষ্টা অাছে। অামি বলি যার মনের কথা শুনার কেউ নেই তার মনোজগত অাছে। কালের কপোল তলে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে মনোজগত ব্যথায় সান্ত্বনার প্রলেপ দেয়। যখন পৃথিবীতে অাপন জন বলতে কেউ থাকেনা, বেদনায় যখন নীল হয়ে যায় জীবন তখন নিবিড় মমতায় ছাপানো হয় মানুষের মনের কথা মনোজগতে।
অামি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। খুব কাছ থেকে দুঃখ সুখের অভিজ্ঞতা হয়েছে অামার। এক বোন অার তিন ভাই সহ ছয় সদস্যের পরিবার অামাদের। টানা পোড়নের সংসারে দেখেছি মা বাবার কি কষ্ট !! বছরে ছ'মাস টেনে টুনে সংসারের মাধ্যমে চললেও বাকী ছ'মাস অামাদের ভীষণ বর্ণনাতীত কষ্ট হতো।
বহুদিন দেখেছি খাবার রান্না করার পরে ভাগ বাটোয়ারা করে খেতে কিন্তু মা বাবা উপোষ থাকতেন প্রায়ই । কখনো অাঁচলের অাড়ালে মাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি, বাবাকে দেখেছি বিষন্ন চোখে দুরের অাকাশ দেখতে। বহুবার মাকে বলেছি দেখ মা অামি লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরী করলে অার অামাদের কোন দুঃখ থাকবে না। বড় হয়েছি লিখাপড়া শিখেছি নিজে কোন রকমে বেঁচে থাকার মত চাকরীও করছি। কিন্তু কষ্টের দীর্ঘশ্বাস অারো দীর্ঘ হয়েছে। মনে হয় অাগের জীবনটাই ভালো ছিল।
একটু বুদ্ধির পর অামার জানা মতে মনে পড়েনা কোন বায়না ধরে মা বাবার মনে কষ্ট দিয়েছি। বরাবরই ভালো ছাত্র ছিলাম এবং ভালো অাচরনের কারণে সবার প্রিয় ছিলাম। কিন্তু কেন জানি কিসের কারণে ভাগ্য নির্মাতা অামার প্রতি বিমুখ হয়ে গেলেন । অামিও ছিটকে পড়তে থাকলাম জীবনের উদ্দেশ্য হতে।
নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষাই অার অামার অবশিষ্ট নেই। পরাজিত যন্ত্রণার অাগুনে পুড়ে মরছি অনবরত। অামার যে অার কোন উপায় নেই। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, অদৃষ্টের কি বিড়ম্বনা, জীবনের স্বপ্নঝরা তপ্ত অভিলাষের প্লাটফর্মে শুধুই হাহাকার। না পাওয়া, না পারা, কিংবা যৎসামান্য পেয়ে হারানোর কষ্ট ঘুণ পোকার মতো কুড়ে কুড়ে খায় অামার ভিতর বাহির। অামি ডানা ভাঙ্গা বিহঙ্গের মতো ছটফট করি অার প্রবীনের মতো ফিরে দেখি অামার অতীত। প্রতিটি মুহূতেই ক্ষত বিক্ষত প্রাণের অশ্রুভেজা বৃষ্টি ঝরে পড়ে অামার অক্ষম জীবনের নিস্ফল অাঙিনায়।
যখন ছোট ছিলাম বুঝতে শিখতে শুরু করলাম তখন থেকেই কল্পনার নকশি কাঁথায় স্বপ্ন বুনতে থাকলাম। কিন্তু বিধি বাম অামার স্বপ্নের অপমৃত্যু হতে চলল। ভালোভাবেই এগোতে ছিলাম অতপর ছন্দপতন। এস এস পাশ করলাম। অাশারুপ না হলেও মন্দ না। তারপর একরকম দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে হঠাৎ থমকে যাওয়া। উঠে দাঁড়াতেই জীবন থেকে কয়েক বছর হারালাম । তবু হাল ছেড়ে দিইনী। মানুষের লাথি গুতো খেয়ে চরম ধৈর্য ধরে এগোতে এগোতে প্রতিষ্ঠিত জায়গায় পৌঁছতে না পারলেও একরকম সান্ত্বনার জায়গাতে পৌঁচেছি। কিন্তু যন্ত্রণার ঘায়ে মলম দিতে পারলাম না। সম্মানের অাত্নমর্যদা সবার জীবনে শোভা পায় না। বেঁচে থাকার জন্য দেশের এপান্ত হতে ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি অার বিবেকের দংশনে প্রতিনিয়ত দংশিত হচ্ছে।
সুখের সান্নিধ্যে নাকি মানুষ দুঃখেকে ভুলে যায়। কিন্তু যাদের জীবনে দুঃখের সাটিফিকেট চিরস্থায়ী তারা কি করে দুঃখ, কষ্ট , যন্ত্রণা , হাহাকার, অপ্রাপ্তি, অবহেলা, উপেক্ষা, উপহাস, অভিশাপ কি করে ভুলে যায় !!! মনে পড়ে কষ্টের স্নৃতিগুলোর কথাঃ- ময়দা গুলে গরম করে খাওয়া, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা পেয়ারা খেয়ে জীবন বাঁচানো, ফেলে দেওয়া কলার চোচা খাওয়া, বিনে পয়সায় পাওয়া অবহেলায় অবহেলিত পথের ধারে কিংবা মাঠে ঘাঠে পাওয়া অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে, শাক পাতা খেয়ে, ভাতের মাড় খেয়ে; কোন রকমে বেঁচে থাকা। জীবন এতা কষ্টের হতে পারে স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সংগ্রামী জীবন যেন অাজ অামার নিজেই নিজের কাছে অাত্ন সমর্পন করেছে। জীবনে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার ভাগই বেশি। নিজের সুখের জন্য অামি কখনই লালায়িত না। কিন্তু কেন এমন হয়। নিজের দিকেই তাকাতে পারিনী অন্যের দিকে কি করে তাকাব। তবু অাশাবাদী মন অাশার বেলুন উড়াতে চেষ্টা করে।
এখন অামি ক্লান্ত হতাশায় জর্জরিত। অামি ভীষন পরাজিত একজন মানুষ। অামার বাবা অামাকে ছেড়ে গেছেন , অাপুটাও পরপারের বাসিন্দা। মা বাধ্যক্যের ভারে নতজানু । অসুখ বিসুখের যথাথ চিকিৎসা করাতে অপারগ। অামি অপদার্থ সন্তান রোজ হাশরে অামার কোন জবাব নেই। অামি এখনো স্রষ্টার দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করি হে স্রষ্টা, তুমি অন্তত অামার জনম দুঃখি মায়ের মুখে হাসি ফুটানোর ক্ষমতা দাও। অামি অামার মায়ের জন্য তোমার কাছে স্বচ্ছলতা ভিক্ষে চাই। যখন অামার মা থাকবেনা তখন তুমি অামাকে রাস্তার ফকির করলেও অামার কোন অাপত্তি থাকবে না।
সবাই মনে করে অামি স্বার্থপর প্রতারক। সবাই অামার বাহিরের দিকটাই দেখে কেউ বুঝতে চাই না। একজন নারীর জীবনে তেত্রিশের কোটা পেরিয়ে গেলে ও সংসার ধর্ম পালন করার নারী বাসনা অছোঁয়া রয়ে গেল। অামি সমাজ সংসারে মুখ দেখাতে পারি না। অামি দিনের অালোতে ওড়নার অাড়ালে মুখ ঢেকে পথ
চলি রাত হলে চোখের পানিতে বালিশ ভেজাই।
যে দিকে তাকাই শুধু স্বার্থপরতার গন্ধা। বাঁচবই অার ক'দিন। চারপাশে যা হচ্ছে যা দেখছি তা মুসলিম সভ্য সমাজে মানাই না। বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে দেখেছি এখানে সত্য, সততা, অাদর্শের বড়ই অভাব। সত্যিকার সম্পর্ক, বিশ্বাস, ভালোবাসা দেয়াল ঘড়ির মতই বিলীন হতে চলেছে।
মনের ভুবন তন্ন তন্ন করে মনের মতো একজন মানুষ খুঁজে না পাওয়ার অাফসোস হয়ত এ জীবনে অার মিটবে না। বুকের গভীরে লালিত স্বপ্নকে জীবন্ত কবর দিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে হয়না । অামি বিশ্ব বাসির কাছে একটাই অনুরোধ করব ভিক্ষা নয়, সাহায্য সহযোগিতা নয়, দয়া কিংবা করুণা নয়, অামার সামর্থ্যের মূল্যায়ন করে স্রষ্টা যেন অামার মায়ের মুখে সত্যিকার হাসি ফোটানোর ব্যবস্থা করেন। সৃষ্টিকর্তা যেন অামাকে সে পথ দেখিয়ে দেন।
জীবন নাট্যের মঞ্চে অামি অার কতকাল খেলনার পুতুল হয়ে থাকব। অামার বুকটা ছিঁড়ে যদি হৃদয়টা দেখাতে পারতাম তাহলে হয়ত দুঃখ কিছুটা লাঘব হতো। অামি কি করে পৃথিবীকে বুঝাব যে, অামার কোন দোষ নেই। অামি ভাগ্যের কাছে পরাজিত একজন অাদর্শ মানুষ, যে অন্যায়ের কাছে মাথা নিচু করে না, সত্যের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত কিন্তু জীবনের কাছে হার মানতে রাজী না।
এই পৃথিবীতে অামার মতো জনম দুঃখী পোড়া কপালের মানুষ দ্বিতীয়টি নেই। অামি হাসতে ভুলে গেছি অামার দু'চোখ জুড়ে স্বপ্নের বিনিময়ে শুধুই শ্রবানের বর্ষা ঝরে। কি জবাব দেব এই পৃথিবীর কাছে। অামি পারি না মিথ্যে বলতে, চুরি করতে, হিংসে করতে, মানুষকে ঠকাতে। মরনের পর স্রষ্টকে শুধু একটাই প্রশ্ন করব .....
নিজেকে এখন খুব বেশি অসহায় মনে হয়। দৃষ্টিসীমায় হতাশা ছাড়া অার কিছুই দেখি না। ধীরে ধীরে নির্জীব জড় পদার্থের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অামার সারাক্ষণ শুধু অাত্নহত্যা-অাত্নহনন করতে ইচ্ছে করে। অামি অার পারছিনা। অামি ধ্বংসের পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে শূন্যতার ধূসর মরুভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে অনাদি অনন্তকালের দিকে চলে যাচ্ছি।
জীবনে পিছন ফিরে তাকালে সুখের মধুময় এতটুকু স্নৃতি অামার নেই। মনে পড়েনা বুদ্ধির পর হতে অাজ পর্যন্ত ঈদ কিংবা উৎসবে নতুন পোশাক কিনতে পেরেছি। একটা ছেঁড়া সেলাই করা লুঙ্গি, দুটো ছেঁড়া ফাটা পেন্টকে সম্মানের অায়রন করে ইজ্জত বাঁচানো, দুটো শার্টকে সামাজিক মর্যদার প্রতীক ভেবে বেঁচে থাকা।
একবেলা খেলেও দুবেলার চিন্তা । রাশি রাশি কষ্টের পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে জীবনের অসঙ্গোতির কারণে প্রতিটি ক্ষণ অাত্নহত্যা করতে ইচ্ছে করে। বিবেকের কাছে পরাজিত অামি বেঁচে থাকার কোন সান্ত্বনা বানী খুঁজে পাইনা। প্রতিটি সেকেন্ড নিজেকে অাত্নহননের মধ্য দিয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে তেলাপোকার মতো অস্তিত্ব জিইয়ে রেখেছি।
লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর ফোন অার ফোন। বাধ্য হয়ে সিমটাকেই কবর দিলাম। কত রকম ভাবেই মানুষ জোর করে এগিয়ে অাসতে চাই। ঠিক একই মানের লেখা পুরুষের নাম থাকায় কেউ তেমনভাবে ফিরে চাইনী। তখন থেকেই মনে মনে ভাবি কেন যে নারী হলাম না। চলন্ত পথে নারীদের অাসন ছেড়ে দিতে হয়। অাইনী সহায়তার জন্য নারী অাদালত রয়েছে । নারী দিবস রয়েছে। চাকরীতে নারীর প্রধান্য রয়েছে। নারীর রহস্যময়ী চোখের ইশারা বিশ্ব জয়ের ইঙ্গিত। সামাজিক নেটওয়ার্ক থেকে শরু করে অান্তর্জাতিক অঙ্গনে নারীর অাধিপাত্য। মেয়েরা হাই দিলেও লাইক কমেন্ট শেয়ারের বন্যায় ভেসে যায় ফেসবুক অার ছেলেরা কলিজা বের করে দিলেও শূণ্য। কিছু নারীর নির্যাতনের কাহিনী দরদের পরশা সাজিয়ে উপস্হাপন করে। অথচ হাজার হাজার পুরুষের বুকে স্টীম রোলার চালাচ্ছেন নারীরা। পুরুষদের মুখ ফুঠে বলার যায়গাটুকুও নেই কি নির্মম নিষ্ঠুর অন্ধ এই পৃথিবী। নারীর শত মিথ্যে কথা সত্য সত্যের যেন স্বীকৃত সার্টিফিকেট দিয়েছে সমাজ রাষ্ট পৃথিবী। জীবনের চুল চেরা বিশ্লেষণী অভিজ্ঞতায় এ সিদ্ধন্তে উপনীত হলাম যে, অধিকার অগ্রাধিকার সব ক্ষেত্রেই নারীর প্রাধান্য বেশি। তাই বলতে গেলে বলতে হয় কেন যে নারী হলাম না!!!!!
০১৭৪৮১৭৩১৪৮
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৬