somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প - একটি বিকেল, আলফাজের জন্যে

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাস থেকে নামবার উদ্দেশ্যে একটা পা বাইরে রাখা মাত্রই বেকায়দায় নামা আষাঢ়ের ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আলফাজউদ্দিনকে আরও বেকায়দায় ফেলে দেয়, সে তার কাঁধের ব্যাগ টেনে মাথার ওপর এনে দৌড়ানো শুরু করে। দৌড়াতে দৌড়াতেই সে ডানে-বামে তাকায়, দেখে মনে হয় সে হয়তো কাউকে খুঁজছে অথবা এড়িয়ে যেতে চাইছে কাউকে। চলন্ত বাসে, আলফাজের মনে পড়ে, কেমন কেমন দেখতে একটা লোক তাকে উটকো কিছু প্রশ্ন করছিল। গায়ে পড়ে আলাপের মত আর কি। তার মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল আলফাজের কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে। জানতে চাইছিল - এই ব্যাগে ল্যাপটপ আঁটে কি না। আলফাজ বসে ছিল বেশ আরামে। বাসে প্রচণ্ড ভিড়, এর মধ্যেই বাসে উঠে ছিল সে। সাথেসাথেই বাস ড্রাইভারের পেছনের সরু করে পাতা সিট থেকে একজন নেমে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই আলফাজ তার আশপাশের তিনজনকে অ্যথলেটিক কায়দায় ডিঙ্গিয়ে সিটটা দখলে আনে। সেখানে গুটিসুটি মেরে বসে ব্যাগ থেকে একটা ডাইরেক্টরি গোছের মোটা বই বের করে সে ঘাঁটানো শুরু করে। খুব যে মনের সুখে কাজটা করছিল সে, অমন নয়। আলফাজ একটি অনলাইন বিজনেস পত্রিকা চালায়। বছরে বিশেষ বিশেষ সময়ে স্পেশাল ইস্যু বার করে কাগজের পত্রিকায়। পুরো পত্রিকা জুড়ে থাকে মূলত বড় বড় ব্যবসায়ীদের খবরাখবর, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি। সামনে এরকম একটা সংখ্যা বের করবে সে। কোন কোন ব্যবসায়ীর কাছে যাওয়া যায় - তার খোঁজখবর নেয়ার জন্যেই এই ডাইরেক্টরি পাঠ। এর মধ্যেই সেই সন্দেহজনক লোকটা ভিড় ঠেলে ঠুলে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে - বাহ, বেশ সুন্দর তো আপনার ব্যাগটা! কোথা থেকে কিনেছেন? কত দাম দিয়ে? ওর মধ্যে কি ল্যাপটপ আঁটে? একদম বড় সাইজেরগুলো?

আলফাজ দৌড়ে শাপলা চত্বরের ফুট-ওভার ব্রিজের সিঁড়ির গোড়ায় চলে আসে। সিঁড়িতেও প্রচণ্ড ভিড়। আলফাজ হাঁসফাঁস করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ওভারব্রিজের ওপরে উঠে আসে একদম। ব্রিজের মাঝ বরাবর এসে দাঁড়ায়। তারপর তার আর নেমে আসতে মনে চায় না। বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার তোড়ে বেশ শান্তি শান্তি লাগছে এখানটায়, কিন্তু একবার নেমে এলেই ভিজে জবুথুবু হয়ে যেতে হবে একদম। আশেপাশে মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে আবার। শীতল বাতাসের তোড়ে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে, ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে সমস্ত দিনের ক্লান্তি।

শ্রান্তি-মাখা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলফাজ চোখ মেলে চারপাশটা দেখতে দেখতে পকেট থাবড়ায়। মোবাইল বের করে চোখের সামনে ধরে। ঘড়িতে সন্ধ্যে ছ'টা। পড়ন্ত বিকেলে অফিস ফেরতা মানুষগুলির সাথে ছিনিমিনি খেলার শখ হয়েছে আষাঢ়ের ছেনাল মেঘের। সেই খেলায় অংশ নেবার শখ নেই বলেই আলফাজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে এখানেই, এই ফুট-ওভারব্রিজের ওপরেই সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ না বৃষ্টি থামে। তার ভাড়া করা একরুমের ফ্ল্যাট এখান থেকে হাঁটাপথে দশমিনিটের রাস্তা। রুমে কোনমতে ফিরতে পারলেই বেশ একপ্রস্থ গড়াগড়ি দিয়ে নেয়া যেত খাটে। কিন্তু বাসে দুঘণ্টার জ্যাম ঠেঙ্গিয়ে আসার পর শরীর আর সায় দেয় না এই বৃষ্টির মাঝে দৌড়ঝাঁপের।

আলফাজের ঘুরেফিরে মনে আসে তার কাঁধের ব্যাগটার কথা। জায়গামত, তথা কাঁধেই ঝুলছে ওটা এখনও। কেউ কেড়ে নিতে আসে নি। আলফাজের সন্দেহ হচ্ছিল বাসের সেই আগ বাড়িয়ে খেজুরে প্যাঁচাল পাড়তে আসা লোকটাকে। ব্যাগে ল্যাপটপ আছে কিনা এই প্রশ্ন করছিল কেন সে? আচ্ছা, ল্যাপটপ আছে কিনা এটা তার প্রশ্ন ছিল না। সে জিজ্ঞেস করেছিল - ব্যাগে ল্যাপটপ আঁটে কিনা। তা ই বা কেন জানতে চাবে সে? নিশ্চয়ই সে কোন ব্যাগ ছিনতাইকারী দলের অংশ! মোবাইলে কল দিয়ে নিজের দলের লোকদের খবর দিলে তারা ওঁত পেতে থাকতো শাপলা চত্বরের আশেপাশে, বাইক টাইক কিছু একটা নিয়ে। আলফাজ নামা মাত্রই বাইক থেকে টান দিয়ে তার ব্যাগ নিয়ে চলে যেত, হারিয়ে যেত মানুষের ভিড়ে। ল্যাপটপ! সাধ আর সাধ্যের বনিবনা না হওয়ায় ঐ বস্তু তার কখনো কেনা হয় নি, প্রয়োজন থাকা সত্যেও। তবে পত্রিকার যৎসামান্য লভ্যাংশের একটা অংশ ব্যয় করে সে এই সৌখিনদার ব্যাগ কিনেছে আগের ইস্যুর পত্রিকা বের করবার পর। নানা বড় বড় মানুষের অফিসে - বাসায় ঘোরাঘুরি করে বেড়াতে হয়, দু তিন-সেট শার্ট প্যান্ট ঘুরিয়ে ঘারিয়ে পড়ার পাশাপাশি কাঁধে একটা জুতসই ব্যাগ না ঝোলালে কেমন যেন দেখায়। সেই এত সখে কেনা ব্যাগ মাঝরাস্তায় কেউ টান দিয়ে দৌড় দিলে আর আফসোসের সীমা থাকতো না।

ছোটখাটো অসংখ্য ভয়ের সঙ্গে আলফাজের মত ছোটখাটো মানুষদের নিত্যকার জীবন ব্যবসায়। দুটো কাঁচা পয়সা তিলে তিলে জমিয়ে কেনা একটি ব্যাগ - তা হারালে চলবে কিভাবে - সেই ভয়; এই মাসে পত্রিকার জন্যে পাঁচটি বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে, তার তিনটি দিয়ে পত্রিকার খরচ - দুটো দিয়ে কোনক্রমে মাসকাবারি, যদি সামনের মাসে একটি বিজ্ঞাপন ছুটে যায় বা কম হয় তবে জীবন চলবে কিভাবে সে ভয়; বাড়িতে ছোট মেয়েটার অসুখ বা বড় ছেলের স্কুল ফিস বাবদ টাকা বিকাশ করবার জন্যে কখন ফোনকল আসে সেই ভয়; ক্ষীণকায় গড়ন ও শ্যামবর্ণের সাংঘাতিক দুর্মুখ মাঠ-পর্যায়ের এনজিওকর্মী স্ত্রীর ঘরে ইদানীং কাজের খাতিরে ম্যালা লোকের আগমন ঘটে দিবারাত্রি নির্বিশেষে, কিন্তু কি উপলক্ষে - সেই দুশ্চিন্তা বা ভয়; রুমের ভাড়া চাইতে মাসের দু' - তিন তারিখ হতেই বাড়িওয়ালার হম্বিতম্বির মুখোমুখি হবার ভয়; আর বাড়িও এমন কানাগলির শেষ-মাথায় যে কুকুরের ল্যাজের মত সরু সে অন্ধকার গলি মাড়িয়ে ঘরে ঢোকার ভয় - পাছে কোন কুকুরের লেজে আসলেই পাড়া লাগে আর কুকুর জম-কামড় বসায় হাঁটুর নীচে, সে ভয়; আবার ডাক্তারের ইঞ্জিকশান বাবদ কতটাকা অতিরিক্ত খরচ হবে সেই ভয়; মাঝরাত্রে পাশের ঘরের দরজা ঠকাস ঠকাস ধাক্কালে কেউ প্রাণ গলার কাছে উঠে আসবার মত ভয়, যদিও তার নিজের রুমটি একেবারেই ন্যাড়া, সম্বল তার কম্বলখানি গোছের, একটি মাত্র তাকিয়া- তক্তপোশ, পাশে একটি কাঠের রংচটা টেবিলের ওপর যমের অরুচিমতন একটি মান্ধাতার আমলের গাদা কম্পিউটার, যা এ পর্যন্ত বহুবার বিক্রি করবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়েছে তাকে, ক্রেতা যারা তারা কম্পিউটারটির গায়ের লোহালক্কড়গুলো কেবল সেরদরে কিনতে চেয়েছে; ভয় হয়, প্রতিদিন সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে গোসল সেরে কাঁধে ব্যাগটি ঝুলিয়ে কোন হোটেলের মধ্যে নাস্তা করতে ঢুকে পড়তে না পারার, কেননা এরমধ্যে সকালের নাস্তার ডালভাজি ফুরিয়ে গেলে দ্বিগুণ পয়সা খরচ করে কিনতে হবে অপেক্ষাকৃত ছোট একবাটি মুগডাল অথবা একটি ডিম মামলেট।

এইরকম বিবিধ ভয়ভীতির সাথে সারাটি জীবন কাটিয়ে আসা আলফাজের ইদানীং প্রায়ই মনে হয় - এই যে নিত্যকার ছুটে চলা, পেছনে সবসময় কারো না কারো হম্বিতম্বি - এরচেয়ে বরং চাপ সইতে না পেরে একদিন পাগল হয়ে গেলে কি খুব বেশী ক্ষতি হত? বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ন্যাংটো হয়ে হাঁটতে হত হয়তো তাকে, কিন্তু তাতেই বা কি? ন্যাংটোর তো আর চোরের ভয় নেই। তা যেহেতু হচ্ছে না , কাজেই আপাতত এই ভীতিপ্রদ জীবনের সঙ্গেই বন্ধুত্ব না পাতিয়ে উপায় নেই।

এতকিছুর ডামাডোলেই সে যেন কিভাবে বেশ চোখে পড়বার মত একটি ভুঁড়ি জুটিয়ে ফেলেছে। আজ, এ মুহূর্তেও কাঁধের ব্যাগের আড়াআড়ি ঝোলানো বেল্ট ঠেলে বেশ খানিকটা উঁচু হয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছিল সেটি। সেই ভুঁড়িতেই, এই ক্লান্ত বিকেলে, হাত বুলিয়ে আলফাজের মনে হল - তবুও বেশ সুখে আছে সে এবং এই ঢাকাশহরে বসবাসরত যত মানুষ, তাদের সুখদুঃখের ব্যাপারে, তাদের যাপিত জীবন নিয়ে খানিকটা চিন্তাভাবনা করবার, দুটো কথা বলবার হক এতদিনে হয়েছে তার।

জীবনটা আজকাল আলফাজকে বড্ড ভাবায়। এটা ঠিক দুমুঠো ডালভাত জোটানো বা কোন টেইলার্সের কাপড় তার গায়ে চাপছে, অথবা কয় কদম কিভাবে হিসেব করে ফেললে একদিন তার কয়তলা বাড়ি তোলা সম্ভব সে জাতীয় চিন্তাভাবনা নয়। যেমন, ধরা যাক এই যে মেয়েটি - দেখে যাকে যুবতি বলেই মনে হয়, এক হাতে প্রকাণ্ড এক ব্যাগ নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে উঠে আসছে ওভারব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে - সে কি কখনো চিন্তা করেছে, এত কষ্ট কেন করছে সে? যে জীবনের প্রত্যাশায় আজ তার সোনার যৌবনের ডাক শোনার সময় নেই, সেই আয়াসের জীবন পাওয়ার জন্যে সে আয়ুরেখা ধরে ঠিক কতটা পথ হেঁটে এসেছে, আর বাকি ই বা কতটা, সে কি জানে? সে কি চিন্তা করে? আলফাজের চোখ চরকির মত ঘুরে বেড়াতে থাকে বৃষ্টির ছাঁট এড়িয়ে ফ্লাইওভারের সিঁড়ি থেকে নিয়ে গোটাটা শরীর জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলির ওপর। বেশিক্ষণ লাগে না, আলফাজ পেয়ে যায় তার পরবর্তী চরিত্র। বৃষ্টির ছাঁটে সর্বাঙ্গ শাড়ি গায়ে পেঁচিয়ে সদ্য যৌবন হারানো মধ্যবয়সী মহিলাটি যেন আজ তার যৌবনের আঁচ নতুন করে অনুভব করতে পারছে। সে আঁচ এতটাই মোহনীয় তার কাছে যে নিজ সদ্য ফিরে পাওয়া সে যৌবনের গরবে গরবিনী হয়ে সে আমলেই আনছে না তার শরীরকে চেটেপুটে খাওয়া চারপাশের শত শত ছোঁকছোঁক চোখ।

পায়জামা পাঞ্জাবী গায়ে সাদা চুল-দাঁড়ির এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখা যায় ওভারব্রিজের নীচে। বৃষ্টির ছাঁট থেকে মাথা বাঁচিয়ে সিএনজি দরদাম করছেন তিনি। গোটা চার-পাঁচ আধ ন্যাংটো পথশিশু এই জনাকীর্ণ ওভারব্রিজেই পিছল খাবার চেষ্টা করছে বৃষ্টির ফলে জমা কাদাপানিতে। বিশাল গড়নের এক পাগলিনী সব সময় বসে থাকে এই ওভারব্রিজের ওপর। কাউকে কিছু বলে না সে, কোন টাকাপয়সাও চায় না। কেবল থেমে থেমে ডানে বামে দুলতে থাকে অদ্ভুত ভঙ্গীতে। যেমন এই মুহূর্তটায় তার দুলুনি সাংঘাতিক বেড়ে গেছে। এক বয়োঃভারে নুব্জ্য ভদ্রমহিলা, দেখে ভিখিরি মনে হয়, আলফাজের সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্রই আলফাজ সচকিত হয়। অবিকল তার মৃত মায়ের মত দেখতে এর চেহারা। আলফাজের মনে পড়ে যায় তার মায়ের কথা। জীবনের শেষ দশটি বছর একদম নির্মোহ সন্ন্যাসিনীর জীবন কাটিয়েছিলেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে তাদের একটুকরো জমির ওপর ছোট একটি টিনের ঘর, সেই ঘরের একটি ছোট কক্ষে পাতা একটি কাঠের খাটিয়া, খাটিয়াতে কোন জাজিম- তোশক কিচ্ছু ছিল না, ছিল শুধুমাত্র একটি জায়নামাজ - এই নিয়ে মায়ের পৃথিবী। এরই মধ্যে নামাজ, দোয়া, কোরআন শরীফ পড়া, দিনে দু'বেলা অতি সামান্য খাদ্যগ্রহণ (অধিকাংশ সময়েই অভাবের তাড়নায়) এবং ঘুম। একঘেয়ে একটি জীবনের প্রতি কি একরোখা আনুগত্য ছিল তার! আর এতেই ছিল মায়ের অপরিমেয় সন্তুষ্টি। মায়ের চোখে মুখে চেহারায় যে অপরিমেয় দীপ্তি খেলা করতো - অমনটা আর কারো চেহারায় আলফাজ দেখেছে কি কখনো? আলফাজের মনে পড়ে না।

আলফাজ তার হাতের তালু সোজা করে চোখের সামনে মেলে ধরে। চোখের সামনে জাজ্বল্যমান এ আয়ুরেখা ধরে ঠিক কতটা পথ কোন দিকে হেঁটে গেলে তার জীবনের একটা অর্থ দাঁড়াবে? জীবনের অর্থ কি? তুচ্ছ একজন মানুষ সে, জীবনে সুখের মুখ আজ পর্যন্ত দেখতে পায় নি। সকাল হতে হন্যে হয়ে ছুটতে হয় জীবিকার পিছে - নইলে না খেয়ে থাকার শঙ্কা। কেন তার মাথায়ই এসব প্রশ্ন ঘোরে? সেকি তবে নিজের ব্যার্থতা ঢাকার জন্যে, নিজের অপ্রাপ্তিগুলো ভুলে থাকার জন্যে মনের মাঝে বানিয়ে নিয়েছে এক কল্পনার জগৎ যেখানে সে নিজেকে দিয়েছে উচ্চ জীবন দর্শনের অধিকারী এক চিন্তকের সম্মান? তার এই কল্পনার জগত বা তার এই জীবন বিশ্লেষী চিন্তাধারার সফলতা কোথায়? কোথায় নিয়ে পৌঁছাবে তাকে তার এই চিন্তা? যে প্রশ্নগুলো সে করে - নিজেই নিজেকে, তা আর এমন নতুন কি প্রশ্ন? যুগে যুগে কত অগুনতি মানুষ এ প্রশ্নগুলো করেছে নিজেকে, সমাজকে। আবার বিপরীতমুখী চিন্তাও খেলা করে তার মনে - কেন তার প্রতিটি কাজেরই বিশেষ অর্থ থাকতে হবে? তার চিন্তাভাবনা গুলি তাকে আনন্দে রাখে যেহেতু, কেন সেগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা?

সন্ধ্যার আজানের শব্দে হুঁশ ফেরে আলফাজের। চারপাশে চকিত দৃষ্টি বুলিয়ে সে অবাক হয়ে যায়। ঝুপ করে নেমে এসেছে সন্ধ্যার অন্ধকার। বৃষ্টির ফোঁটা আগের মত বড় বড় না হলেও ঝিরি ঝিরি ভাবে পড়ছে বেশ খানিকটা নিজের মত করে। যেন আকাশে আজ কিছুই করার নেই মেঘদলের । দীর্ঘদিন ধরে আকাশ জুড়ে পায়চারি করে করে তারা আজ ক্লান্ত, আজ ঝরে পড়তেই হবে তাদের। রমজান মাসের সন্ধ্যা, সবাই নিশ্চয়ই ইফতারে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। রাস্তা একদম শুনশান, ফাঁকা। খালি রাস্তায় এই রমজানে প্রায়ই ছিনতাইয়ের কথা শোনা যাচ্ছে। আলফাজের গা সিরসিরিয়ে ওঠে। ওভারব্রিজ থেকে দ্রুত নেমে এসে সে বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে থাকে। মাথার ওপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর পায়ের নীচে কাঁদাপানি, কোনকিছুই তার গতিরোধ করতে পারে না। প্রায় হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসে সে প্রবেশ করে তার ফ্ল্যাটে, তার রুমে।

গায়ের সাথে লেপটে থাকা ভেজা কাপড়ের কামড়ে তার শরীর জুড়ে শিরশিরে একটি অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। কম্পিউটারটা ছেড়ে সে ভেজা জামা কাপড় খুলে মেলে দেয় জানালার পাশে। ভিজে যাওয়া ব্যাগ থেকে আধভেজা কাগজপত্রগুলি বের করে ফ্যানের নীচে ফেলে রাখে। এরপর সে কম্পিউটারের সামনে বসে ইন্টারনেট ওপেন করে। আসতে আসতে একটি একটি করে বর্ণ টাইপ করে সে তার বর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া কিবোর্ডে। স্ক্রিনে বাফারিং এর চিহ্ন দেখা যায়। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চক্রাকারে চিহ্নটি ঘুরতে থাকে স্ক্রিন জুড়ে। আলফাজের মনে আফসোস হয় - কেন সে তিনশো টাকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন চালায়! কারন এই স্পিডে ইন্টারনেট থাকা আর না থাকা প্রায়ই একই কথা। পরের মাসে বিজ্ঞাপন একটা বেশী আসলেই সে পাঁচশো টাকার প্যাকেজ নিয়ে নেবে বলে ঠিক করে মনে মনে। অবশেষে বহুকাল পড়ে পর্দা স্থির হয়। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে গায়ে সুতোটি পর্যন্ত না জড়ানো অসংখ্য অগনিত নারীর উত্তেজক সব ছবি। আলফাজের জীবন দর্শন সংক্রান্ত উচ্চমার্গীয় চিন্তাভাবনা তার বৃষ্টিভেজা শরীর হতে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটার মত ঝরে পড়তে থাকে ক্রমাগত।

কিন্তু এই অসংখ্য দেহোপজীবিনীর মধ্যে একটি মেয়ের চেহারার সারল্য আলফাজকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। চেহারা, চোখ, ঠোঁট বা দেহভঙ্গীতে তার কোন কর্কশ উগ্রতা নেই। অন্যান্য ছবির মেয়েগুলির মত তার চেহারায় নেই সেই উগ্র আদিম আহ্বান। তবু আলফাজ তার চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। তার চোখ মায়াময়, গভীর, তার গালে মিষ্টি টোল, তার চেহারা জুড়ে কমনীয়তা, তার সমস্ত শরীর মিলিয়ে পর্দায় যে উপস্থাপন - তা আলফাজের জন্যে মস্ত এক ধাঁধাঁর জন্ম দেয়। আলফাজ মোহগ্রস্থের মত তাকিয়ে থাকে তার ছবির দিকে। ছবির নীচে ছোট করে লেখা তার নাম, ক্রিস্টি।

আলফাজ ক্রিস্টির ছবিটি ডাউনলোড করে নিজের ফেইসবুক পেইজ ওপেন করে। তারপর নিজের ওয়ালে সেই ছবিটি পোস্ট দিয়ে ওপরে ক্যাপশন লেখে - "ক্রিস্টি! ক্যান ইউ হিয়ার মি? তুমি কি শুনতে পাও?" আজ বিকেলে পরিচিত হওয়া আমাদের আলফাজ ভুলে যায় তার সংসারের কথা, তার এনজিওকর্মী রুখু মেজাজি স্ত্রীর কথা, তার প্রায়ই রোগ অসুখ বিসুখে ভোগা ছোট মেয়ে বা স্কুলগামী বড় ছেলেটির কথা। আলফাজ সব ভুলে যায়, ভুলে যায় জীবনের মানে খোঁজার প্রচেষ্টা, তার ইত্যকার অস্তিত্ব সংকট, তার উন্নত জীবনদর্শন। আলফাজ সব ভুলে যায়। আলফাজের ভুলে যেতে হয়। আলফাজদের ভুলে যেতে হয়। আপলোডকৃত ছবিতে একটা দুটো লাইক পরে। একটি তির্যক কমেন্ট দেখা যায়। আলফাজ গোনায়ও ধরে না সেগুলো। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে - পৃথিবীর অপর গোলার্ধের এক তুমুল অন্ধকারোজ্জল জগতের বাসিন্দা ক্রিস্টি নাম্নী নারীর প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১১:১২
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×