somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের প্রথম ঘোষিত বীরশ্রেষ্ঠ জগৎজ্যাতি দাস এবং .........!

১৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




তিনি বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে বীরগতি পেয়েছেন। তিনি ছিলেন শত্রুদের কাছে জীবন্ত এক ভয় আর বিস্ময়। তিনি দুর্ভাগা, তিনি স্বীকৃত নন এই খেতাবে, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও নন। নিজের জীবন তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন, মৃত্যুর পরেও তাঁর শব ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে শত্রুদের আঘাতে- প্রকাশ্যে, তিনি যে দেশকে ভালবেসেছিলেন।

যে বীরের কথা বলতে এসেছি, তিনি বাংলার ঘোষিত-অস্বীকৃত প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ জগৎজ্যোতি! হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে বিংশ শতাব্দীর এই অভিমন্যু জন্ম গ্রহণ করেন যিনি বাংলার কুরুক্ষেত্রের চক্রব্যূহে প্রাণ দিয়েছেন বাংলার তরে। জলসুখা গ্রামের জিতেন্দ্র চন্দ্র দাস ও হরিমতি দাসের কনিষ্ঠ পুত্র জগৎজ্যোতি দাস।

১৯৭১ সালে ছিলেন এইচএসসি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালনে ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে ভর্তি হন; বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা আয়ত্তের পাশাপাশি ধারণা নিয়ে আসেন অস্ত্র ও বিস্ফোরকের উপর। ভাটি-বাংলার মাটিকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে তিনি হন দাস পার্টির কমান্ডার। প্রতিজ্ঞা করেন দেশ মাতৃকার মুক্তির।


পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের কাছে জগৎজ্যোতি ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। বিশাল ভাটি-বাংলায় শত্রুসেনাকে পদদলিত করতে দাবড়ে বেড়িয়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রু মুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর উপর। দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে প্রাণের বাজি রেখে লড়ে যান দাস পার্টির যোদ্ধারা।


দাস পার্টির সাফল্যে ভীত ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আর তাই পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়, এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না। মাত্র ১৩ জন সহযোদ্ধা নিয়ে বানিয়াচং-এ পাকবাহিনীর ২৫০ জন সেনা ও দোসরদের অগ্রগতি রোধ করে দেন, যুদ্ধে প্রাণ হারায় শত্রু সেনার ৩৫ জন।


পাকিস্তানীদের গানবোট ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার জামালগঞ্জ থানা ও নৌ-বন্দর সাচনাবাজার শত্রু“মুক্ত করে লাইম লাইটে চলে আসেন তিনি।তাঁর নেতৃত্বে সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কের বদলপুর ব্রিজ বিধ্বস্ত করা হয় আর তাঁরই কৃতিত্বের কারণে ভারতীয় কমান্ড বাহিনীর মেজর জি,এস,ভাট প্রশংসা লাভ করেন। ১৭ আগস্ট পাহাড় পুরে কমান্ডার জগৎজ্যোতির রণকৌশল আর বীরত্বে রক্ষা পায় অসংখ্য নিরীহ নর-নারী। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে তাঁর বীরত্ব-গাঁথা প্রচার হয়। জগৎজ্যোতি একা হাতে একটি এলএমজি নিয়ে দখন করে নেন জামালপুর থানা যেখানে আস্তানা গেড়েছিল স্থানীয় পাকি-দোসর রাজাকাররা।


জামালপুর মুক্ত করার অভিযানে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হন তাঁরা, হারাতে হয় তাঁর সহযোদ্ধা বীর সিরাজুল ইসলামকে। মাত্র ১০-১২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনি মুক্ত করেন শ্রীপুর। খালিয়াজুড়ি থানায় ধ্বংস করে দেন শত্রুদের বার্জ।
আগস্ট মাসে গুলি ব্যয় ছাড়াই দিরাই-শালায় অভিযান চালিয়ে কৌশলে আটক করেন দশ সদস্যের রাজাকারের দলকে। যারা এলাকায় নির্যাতন চালাচ্ছিল, খুন, ধর্ষণ ও লুটপাট চালাচ্ছিল। রানীগঞ্জ ও কাদিরীগঞ্জে অভিযান চালিয়েও জ্যোতি আটক করেন ঘরের শত্রু রাজাকারদের। ২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার জামালগঞ্জ থানা ও নৌ-বন্দর সাচনাবাজার শত্রুমুক্ত করে লাইম লাইটে চলে আসেন।
১৬ নভেম্বর ১৯৭১; এই দিন ছিল বীরের ললাটে লেখা শেষ দিন। ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথেই ৪২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে অভিযানে যাত্রা করেন জগৎজ্যোতি। কে জানত- এই অভিযান তাঁর শেষ অভিযান, বীরত্বের অন্তিম-গাঁথা এখানেই রচিত হবে। তাঁদের লক্ষ্যস্থল ছিল বানিয়াচং/বাহুবল। কিন্তু লক্ষ্যস্থলে যাওয়ার পূর্বেই বদলপুর নামক স্থানে হানাদারদের কূট-কৌশলের ফাঁদে পা দেন জগৎজ্যোতি। বদলপুরে ৩/৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটক করে চাঁদা আদায় করছিল।
দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ জ্যোতি রাজাকারদের ধরে আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেই পিছু হঠতে থাকে কৌশলী রাজাকাররা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জগৎজ্যোতি- ভাবতেও পারেননি কী ফাঁদ তাঁর সামনে। সাথের ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে তাড়া করেন রাজাকারদের। অদূরেই কুচক্রী পাকসেনাদের বিশাল বহর আর প্রচুর সংখ্যক গোলাবারুদ নিয়ে অপেক্ষা করছিল তাঁর। অজান্তেই চক্রব্যূহে প্রবেশ করেন জগৎজ্যোতি। আগে থেকে প্রস্তুত বিশাল বহর আর মজুদের কাছে বিপদে পড়ে যান জগৎজ্যোতি ও তাঁর সহযোদ্ধারা। তবুও যুদ্ধে করে যান মুক্তিযোদ্ধারা।

সঙ্গীদের জীবন বাঁচাতে স্থান ত্যাগের নির্দেশ দেন জগৎজ্যোতি।
সহযোদ্ধাদের পালানোর সুযোগ করে দিয়ে কভার করতে থাকেন জগৎজ্যোতি ও তাঁর সহযোদ্ধা ইলিয়াস। কিন্তু দুর্ভাগ্য, হঠাৎ করে ইলিয়াসও গুলিবিদ্ধ হন। নিজের মাথার গামছা খুলে জগৎজ্যোতি বেঁধে দেন সহ-বীরযোদ্ধার ক্ষত।


ইলিয়াস তাঁকে পালানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু পিছু ফিরে যাননি জগৎজ্যোতি। একাই যুদ্ধ করতে করতে পাক-বাহিনীর বারোজনকে প্রপারে পাঠিয়ে দেন। বিকেল পৌনে পাঁচটায়, শূন্য অস্ত্রভাণ্ডারে বিকেলের সূর্যের মতই ম্লান হয়ে আসে শত্রু-বধের তেজ, গুলিবিদ্ধ হন জগৎজ্যোতি। নিভে যায় এক বীরের জীবন-প্রদীপ।

শুনা যায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেও তিনি জীবিত ছিলেন। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় অত্যাচার করতে করতে।তাঁর গায়ে পেরেক বিদ্ধ করে সেই ছবি খবরে ছাপানো হয়। আজমিরিগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসা হয় তাঁর লাশ।

সেদিন ছিল ঈদের বাজার। শত শত লোকের সামনে খুঁটির সাথে বেঁধে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় তাঁর লাশকে। রাজাকাররা থু থু ফেলতে থাকে তাঁর উপর। এমনকি জগৎজ্যোতির মা-বাবাকেও ধরে আনা হয় বীভৎস লাশ দেখাতে। পরিবারে যখন স্বজন হারানোর কান্নার রোল তখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় জগৎজ্যোতির বাড়িতে। ভাসিয়ে দেওয়া হয় তাঁর ক্ষত-বিক্ষত লাশ ভেড়ামোহনার জলে।


স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ জানান, বীরগতিপ্রাপ্ত জগৎজ্যোতিকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল একাধিকবার এবং তার বীরত্ব-গাঁথা প্রচার হচ্ছিল সম্মানের সঙ্গে। অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয় জগৎজ্যোতির বীরত্ব-গাঁথা।


অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ মরণোত্তর পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জগৎজ্যোতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদানের ঘোষণা সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে প্রতিশ্রুতি থেকে ফিরে আসেন সরকার। ১৯৭২ সালে জগৎজ্যোতিকে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বাস্তবে পুরস্কার প্রদান করা হয় তারও দুই যুগ পরে।

দেশ তাঁকে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি দেয়নি!
তাঁরা তো কখনো কোনো প্রাপ্তির অপেক্ষায় ছিলেন না!

আজকের দিনটিতে একটি মাতৃভূমির জন্য জগৎজ্যাতি বিলিয়েছেন নিজের প্রাণ।

জগৎজ্যাতি প্রতিটি মুহূর্তে থাকেন এই বাংলার নিঃশ্বাসে, স্পন্দনে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৩২
১২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×