নতুন কিছু করো - স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাবসা করতে নামা মোবাইল অপারেটর কোম্পানী বাংলালিংক এবার এমপ্লয়ি মারার চূড়ান্ত অভিযানে নেমেছে।
বিগত কয়েকবছর ধরেই ক্রমাগত "এমপ্লয়ি আনফ্রেন্ডলি" আচরন করতে থাকা বহুজাতিক কোম্পানীটি কিছুদিন আগে ২০-২৫% কর্মী ছাটাইয়ের পরিকল্পনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় বাংলালিংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন। বিপদ টের পেয়ে বাংলালিংক দ্রুত এই কর্মচারী ইউনিয়ন এর অন্যতম এক উদ্যোক্তাকে টার্মিনেশন নোটিশ ধরিয়ে দেয় গত বৃহস্পতিবার। এ নিয়ে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষ আর এমপ্লয়িরা পুরো মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে। শোনা যাচ্ছে রবিবার থেকে কর্মবিরতিতেও যেতে পারে কর্মচারী ইউনিয়ন এর সদস্যরা।
দ্বিতীয় অবস্থা থেকে রবির কাছে পজিশন হারিয়ে তৃতীয় হতে চলা বাংলালিংক বেশ কয়েক বছর ধরেই কাস্টমারদের সার্ভিস দিয়ে ব্যাবসা করার চেয়ে এমপ্লয়িদের সুবিধা কমিয়ে ব্যাবসার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। তবুও তুলনামূলক এমপ্লয়ি সংখ্যা কম থাকায় জবের দিক দিয়ে সিকিউরড হিসেবে বিবেচিত ছিল বাংলালিংক। কিন্ত অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বাংলালিংকের "টাইগারদের" উপর এবার "শেয়ালের" দৃষ্টি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আমি নিজে বাংলালিংকের একজন প্রকৌশলী হিসাবে বেশ কয়েকবছর কর্মরত ছিলাম, তাই বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের পারসপেক্টিভ থেকে এটা যে কতটা ভয়াবহ একটা ব্যাপার তা খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারি।
বাংলাদেশে এমনিতেই যে পরিমাণে প্রকৌশলী বের হচ্ছে সে অনুযায়ী কাজের সুযোগ খুবই কম এটা মানতে হবে। প্রোডাক্টিভ ইন্ডাস্ট্রি বলতে গেলে নেই আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশে এক্সপার্ট না বানিয়ে বিদেশ থেকে এক্সপার্টদের আনিয়ে কাজ করা হয়।
যাইহোক, এরকম কনজাস্টেড জব মার্কেটে মোবাইল অপারেটর গুলো দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা প্রকৌশলীদের জন্য আশার আলো হিসেবে কাজ করছিল। একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানী যখন একটা দেশে ব্যাবসা করতে আসে তখন অবশ্যই তাকে সেই দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
টেলিকমের জব খুবই স্পেসিফিক ক্যাটাগরীর জব। বাংলাদেশের সংকুচিত জব মার্কেটে টেলিকমে কাজ করা একজন প্রকৌশলীর চাকরী চলে গেলে তাকে পুনরায় ঐ লাইনের চাকরী ম্যানেজ করা অসম্ভব কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
তাহলে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে কি হয়??
ব্যাপার হচ্ছে কানাডা/আমেরিকা বা অন্য দেশে চাকরী চলে গেলে তারা আপাত একটা অড জব জুটিয়ে দিব্যি খারাপ সময় পার করে দিতে পারে। ঐসব দেশে স্টারবাকস, টিম হর্টন অমুক তমুক নানা চেইন শপ আছে অড জবসের জন্য। আর একান্তই যদি কিছু না জুটে সে ক্ষেত্রে সরকার থেকে বেকার ভাতার ব্যবস্থাও আছে।
এর কোনটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য? একটাও না। এদেশে জব যাওয়া মানে ডাইরেক্ট পেটে লাথি খাওয়া।
যেহেতু ব্যাবসা করার ক্ষেত্রে ঠিকই বাংলাদেশের "বাংলা" নিয়ে বাংলালিংক নাম রেখে মার্কেটে নেমেছে, কাজেই এমপ্লয়িদের ট্রিট করার ব্যাপারে অবশ্যই বাংলাদেশের অবস্থা আর পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে হবে। রাশিয়ায় জব কাট করেছি বলে যদি বাংলাদেশেও করতে হয় তবে নাম বদলে রাশিয়ালিংক রাখে নি কেন??
দুঃখজনক ব্যাপার, বাংলালিংক দাবি করে এই জীবনে তারা বাংলাদেশে লাভের মুখ দেখে নি। সত্যিই অদ্ভূত! তাহলে তারা গত ১১ বছর ধরে কোন দুঃখে বাংলাদেশে ব্যাবসা করে চলেছে? তাও আবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কাস্টমার বেইস রেখে! তাহলে তো দেরী না করে আগেই তাদের পাতি তারি গুটিয়ে ভেগে যাওয়া উচিত ছিল!
আসল কথা হচ্ছে প্রফিট দেখালে এমপ্লয়িদের এর শেয়ার দিতে হবে, যেটা রবি বা গ্রামীন দিয়ে থাকে। এভাবে এমপ্লয়িদের ন্যায্য পাওনা থেকে কোটি কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে এই বাংলালিংক।
ন্যায় নীতি নিয়ে নীতিকথা কপচানো এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর মাদার কনসার্ন ভিম্পেলের সিইও জো ল্যান্ডার নিজেই দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন কিছু দিন আগে।লিংক।।
বাংলাদেশের মার্কেটে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়ার পর এর পেছনে যাদের নীরলস প্রচেষ্টা সেই কর্মী প্রকৌশলীদের পেটে লাথি মারার এই মতলব কোনো মতেই মেনে নেয়া যায় না।
নেটওয়ার্ক এক্সপানশন হয়ে গেলে যদি কাউকে আর দরকার নাই-ই হয় তবে তাকে কেন "পার্মানেন্ট" পজিশনে নেয়া হবে? তাহলে "কন্ট্রাক্ট জব" পজিশন আর "পার্মানেন্ট জব" পজিশনের মাঝে পার্থক্য কি থাকল? এমন কি হলো যে একেবারে ২০-২৫% ছাটাইয়ে নেমে পড়তে হবে?? যদি কোম্পানী ব্যার্থ হয়ে থাকে তাহলে সবার আগে সিটিও -সিইও আর নীতি নির্ধারনী কর্মকর্তাদের ছাটাই করা উচিত।
টেলিকম সেক্টরে যারা কাজ করেন, বা এই সেক্টরে কাজ করা প্রকৌশলীদের যারা চেনেন তারা সবাই জানেন কি ভয়ানক স্ট্রেস আর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়। দিন নেই রাত নেই, শুক্র শনিবার কিচ্ছু নেই। আমি নিজে টানা ৩২ ঘন্টা কাজ করেছি, কোনো বিরতি ছাড়া।প্রায় সাবাইকেই করতে হয়। হয়ত আপনি আপনার ফ্রেন্ডদের সাথে মুভি দেখছেন শুক্রবার বিকেলে, হঠাত নেটওয়ার্ক সমস্যা। আপনাকে সব বাদ দিয়ে দৌড়াতে হবে সমস্যা সমাধানে। এই পরিশ্রম, এই ডেডিকেশন শুধু টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় না। একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য মমতা, আবেগ না আসলে এটা পসিবলই না।
সেই মমতা আর পরিশ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠানে পার্মানেন্ট পজিশনে থেকে হুট করে একদিন সকালে আপনি পেয়ে যাবেন টার্মিনেশন নোটিশ!! স্বান্তনা হিসেবে দেয়া হবে মাত্র একমাসের "বেসিক" সেলারী (গ্রস সেলারী ৩০ হাজার হলে সাধারণত বেসিক ১৫ এর আশে পাশে হয়)।
ভাবা যায়??
একজন সাবেক কর্মী হিসেবে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাই। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বাংলালিংকের কর্মীদের হেফাজতে রাখুন, সেই প্রার্থনা করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৮:০০