ঈদের একদিন পর অথাৎ ঈদের তৃতীয় দিন। সকাল থেকেই ছোট বোনটা বায়না ধরেছে মামা বাড়ি যাবে। অনেক বুঝিয়ে সকাল গড়িয়ে বিকাল পাচঁটা নাগাদ রওনা দিলাম। যাওয়ার বেলায় দাদু বলছিল, পুরান বাড়ির জেঠির (বাপের বড় ভাই এর বউ) অবস্থা ভালো না। কথাটা গায়ে মাখার মত কিছুই মনে হল না। এর আগেও উনি অসুস্থ হয়েছেন অনেকবার। জমদূত বারবার উনার গলার কাছে এসে ফিরে গেছেন। পরিচিত এক রিক্সাওয়ালার রিক্সায় রওনা দিলাম। বেশিদূরের পথ নয় রিক্সায় গেলে পনে এক ঘন্টার মত লাগে। চাচা ভাই ও তার বউ যাবে ঐ দিকে তার শশুড় বাড়ি। তাই এক সাথেই রওনা হলাম। বেশিদূর যাওয়া হয়নি মাইল খানেক যাওয়ার পরেই বড় ভাই এর ফোনে ফোন এল। জেঠি মারা গেছেন। সবাই ইন্নানিল্লাহ বললেও আমি আলহামদুল্লিাহ বললাম। যাক যন্ত্রণাকর এক জীবনের অবসান হয়েছে। মরে গিয়ে বেচেঁ গেছে। সৃষ্টিকর্তা তাহলে মুখ তুলে তাকিয়েছে। বড় ভাই ফোনেই জিজ্ঞাস করল জানাজা কখন? সাথে সাথে জানাতে পারল না ফোন কর্তা। খানিকবাদেই জানা গেল ইশার নামাজের পর জানাজা। মৃত্যুকে করব দেওয়ার কি তাড়া। যাত্রা বিরতি করতে মন চাইল না, মৃত্যু মানুষের মনে প্রভাব ফেলে কিন্তু এই মৃত্যু আমার মনে খানিক প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। আমি স্বাভাবিক ভাবেই মামা বাড়ি গেলাম। বড় মামা বিয়ে করেছেন আড়াই বছর, একটা মেয়েও হয়েছে এখন পযন্ত তার মুখদর্শন করা হয়নি। এবার সেই সুযোগ এসেছে। আমি বরাবরই একটু বেশি দুষ্ট, মামা বাড়ি গেলে সেটা আরো বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যাতিক্রম নয় বরং আরো বেড়ে গেল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তারপরেও ছোট ছোট ভাই-বোনদের সাথে ফুটবল খেলায় মেতে রইলাম। আসার পর শুধু বলেছিলাম জেঠি মারা গেছে, ইশার নামাজের পর জানাজা, তাই যেতে হবে। কিন্তু আমার কোন আচরণে কারো মনে হয়নি বরং উল্টো সন্দেহ হওয়ার মত আচরণ, আমি সত্য বলছি না মিথ্যা।
মাগরিবের নামাজের পর রওনা হলাম, ছোট বোনটাকে মামা বাড়ি রেখেই। বাড়ি না গিয়ে সরাসরি মরা বাড়িতে উপস্থিত হলাম। কবর খোড়া হচ্চে, নিজেদের পুরাতন ভিটা হলেও আসা হয় না খুব একটা। নিজেকে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে আড়াল করে রাখা। বাড়ির ভিতরের চাল চিত্র একদম পাল্টে গেছে। আমাকে দেখেই মৌলভি জেঠা বলল, খাটিয়াটা লাশের কাছে দিয়ে আসতে। দুইজনে মিলে লাশ যেখানে গোসল করাচ্ছিল সেখানে দিয়ে সোজা চলে আসলাম। সময়ের কাটা খুব দ্রুত দৌড়ায়। দেখতে দেখতে জানার সময় হয়ে এল। লাশ কাদে নিয়ে জানাজার জন্য এগিয়ে আসলাম। এই লাশের খাটিঁয়া এই প্রথম কাধেঁ নিয়েছি তাই নয়, এর আগে কয়েকবার নিয়েছি কাধেঁ। লাশের খাটিয়া নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী, প্রতিটিবার যখনই খাটিয়া কাধেঁ নিয়েছি ততবার তাই মনে হয়েছে। লাশবিহীন খাটিয়া যতটা হালকা হয়, লাশ সহ ঠিক তার উল্টোটা হয়। লাশ কাদে নিয়ে মনে হল, আমি এক সময় মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম কিন্তু কোন দোয়া দুরুদ সব ভুলে গিয়েছি। মনে করার চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল লাশের জীবিত থাকা কালীন মানবেতর দিনগুলোর দৃশ্য।
জানাজা শেষ করে চলে আসলাম, কবর দেওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। সর্বশেষ জেঠির মুখ দেখেছিলাম মাস তিনেক আগে তারপর আর বাড়ি যাওয়া হয়নি তাই দেখাও হয়নি। মৃত্যু মানুষের মুখ দেখতে ইচ্ছা করে না তাই মরার পর আর দেখিনি। সবাই লাশ কবরে নামাচ্ছে আর আমি সোজা হাটছি দোকানের উদ্দেশ্যে। মনের ভিতরে একটা ইতিহাস রচনা হচ্ছে, একটা মানবতার ব্যার্থতার রচনা হচ্ছে যার সমাধি হচ্ছে আমার পিছনে। কত মানুষ সেখানে উপস্থিত। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে গ্রামের রুই-কাতলা সবাই। কয়েক মাস পরেই নির্বাচন এখন একটু মানুষ প্রীতি বেড়ে গেছে।
আমি স্বাভাবিক ছিলাম। দোকানে বসে সিগারেট টানলাম, দুই বন্ধুর সাথে রাত এগারটা পযন্ত আড্ডা দিলাম। শরীর খুব ক্লান্ত লাগছিল তাই বারটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল বেলা ঢাকায় চলে আসব সেটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। মা বলল, তর দাদু দেখা করে যেতে বলেছে। ছোট বোন বলল, দাদু পুরান বাড়িতেই আছে, খুব সম্ভবত কবর স্থানের পাশেই বসে আছে। যদিও আমি জানতাম উনি ওখানেই থাকবেন। খুব পরহেজগার উনি, ধর্ম কর্ম একটু বেশিই মানে। উনার স্বামীও যে সেই কবর স্থানেই শুয়ে আছে আজ ত্রিশ বছরের উপরে। স্বামীর করবের পাশে ওনার কবরের জায়গা রেখে পরের সব জায়গা কবরে ভরে গেছে। কত মানুষ মরছে। পারিবারিক কবরস্থান, কবর হয়েছে প্রায় একশ এর মত। নাস্তা খেতে বসে ছোটটাকে জিজ্ঞাস করলাম কি হয়েছিল রে জেঠির।
কিডনি থেকে শুরু করে সব আৎ (শরীরের ভিতরের অঙ্গ) পচে গিয়েছিল। জান ভাই আজ তার বড় মেয়ের ঘরের নাতির বিয়ে, সেখানে সবাই চলে গেছে। কথাটা আমাকে অবাক করল। আমি নিশ্চুপ হয়ে অতিতের কিছু কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। আমার বোন আবার বলা শুরু করল, মরার আগে সে সবাইকে দেখতে চেয়েছিল কিন্তু কেউ আসেনি। আগেও অসুস্থ হয়েছিল তাই হয়ত আসেনি। একমাত্র ফরিদা আপাই ছিল পাশে। জান ভাই মারার আগে জেঠার কাছে মাফ চেয়েছে, ছেলের কাছে, ছেলের বউ এর কাছে সবার কাছেই মাফ চেয়েছে।
আমি নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছিলাম, আর স্বরণ করার চেষ্টা করছিলাম, আমার সাথে উনার কি কোন স্বৃতি জড়িয়ে আছে।
কাল করব দেওয়ার পর যখন কুলখানির কথা হল তখন তার ছেলেটা পাচঁ হাজার টাকা দিল, আফসোস কি জান? মরার আগে এই টাকাটা দিল না,যদি দিত তাহলে হয়ত আরো কিছুদিন বেচেঁ থাকত।
আর কিছু কি বলেছিল, আমি প্রশ্ন করলাম।
বলেছে, কোন সময়ের জন্য ছেলেমেয়েগুলোকে পালণ করে বড় করেছিলাম?আজকে আমি তাদের মুখ দেখতে পারলাম না।
মৃত্যু শয্যায় একজন মানুষ এই কথাটা বলছে ভেবেই চোখটা ভিজে গেল। সত্যিই ত সন্তানের জন্য কত করেছেন আর সেই সন্তানেরা কি করল?
মরার তিন মাস আগে থেকে খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু পানি আর ভাতের মাড় খেয়ে এই কয়দিন বেচে ছিল। মেজোটা বলল, আমি গিয়েছিলাম একদিন, আমার কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল, আমি পাশের বাড়ির ভাবির কাছ থেকে ভাত এনে খাওয়ালাম কিন্তু সাথে সাথে বমি করে দিল।
তুই সর্বশেষ কখন গিয়েছিলি? বড়টা বলল, ও ত সপ্তাহে তিন চারদিনই যেত দেখতে। মেজোটা বলল, মরার আগে আঙ্গুর ফল খেতে চেয়েছিল, সাড়া এলাকা ঘুরে কোথাও আঙ্গুর ফল পায় নি, পরে যখন পুলিশ দাদা শুনল সে বাজারে পাঠাইছিল কিন্তু নিয়ে আসার আগেই পরপারে চলে গেছে। শেষ ইচ্ছাটাও পূর্ণ হয়নি।
চিকিৎসা করায়নি কেন?
কেন তুমি জাননা, একমাত্র ফরিদা আপাই যা সেবা যন্ত করেছে, ফারুখ ভাই বা তার বউ ত কোনদিন ফিরেও তাকায়নি। ফারুখ ভাই ত একটা গাধা, সারাদিন শুধু পরিশ্রম করতে জানে আর কিছু নয়। জীবনে বউকে কিছু বলল না মাকেও না। আমাদের এখানে এসে বলল, আমি কারো চোখে খারাপ হতে চাই না, তাই দুইজনের মাঝে বসে শুধু শুনে যাই।
হুম তাই, ফরিদা আপ না থাকলে আরো আগেই মারা যেত। ঘর জামাই নিয়ে তবু ত কম যন্ত্রণা সহ্য করেনি।
ছোটটা বলল, আলমের মায়ের কাফফারা রোজা করত,সেই জন্য কিছু টাকা পাইছিল আর ফেতরা,কোরবানির গরুর চামড়ার টাকা মানুষে যা দিত তাই জমিয়ে মাস খানেক আগে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। মরার আগে বলেছিল, আমার চিকিৎসা করা কিন্তু কেউ শুনত না, শেষে এই জমানো টাকা দিয়েই টেস্ট করায়,আর সব পচে গিয়েছে ধরা পড়ে।
আমি আর শুনতে পাচ্ছিলাম না, আমার চোখের সামনে অতিতগুলো ভাসতেছিল।
তারপরেও জিজ্ঞাস করলাম, আলমের মায়ের খবর কি?
ভালো না, নাকে নল দিয়ে খাওয়ায়। শুধু মাত্র চিকিৎসার উপরেই বেচেঁ আছে। জেঠির মত হলে আরো আগেই মারা যেত।
আমি বের হয়ে এলাম। ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনার আগে গেলাম দাদুর কাছে। গিয়ে দেখি ফরিদা আপা কাদছে আমাকে দেখে বলল ভাই তুইও বাপের একমাত্র ছেলে। কত চিন্তা করে কাকা,কাকি। তাদের আশার ভরসা কিন্তু তুই। এই যে মা আমার চলে গেল এখন কি আর চাইলেও কেউ ফিরিয়ে আনতে পারবে? ফরিদা আপার চোখের জল আমার গায়ে পড়ছে। আমি দেখছি মায়ের জন্য এক মেয়ের কান্না আর ভাবছি অন্য মেয়েগুলো আর ছেলেটাও যদি এমন হত তাহলে হয়থ মানুষটা আর কিছুদিন বেচেঁ থাকত।
দাদুর কাছে বিদায় নিয়ে রওনা হল আর নিজের বিবেকের কাছে কিছু প্রশ্ন নিয়ে এলাম।
সংসারে উনার বয়স্ক স্বামী, একমাত্র ছেলে তার বউ নাতি-নাতনি ছাড়াও চার মেয়ে ছিল। শুধু মাত্র ছোট মেয়েটা (ফরিদা আপা) উনার স্বামী সহ এখানে থাকত আর মায়ের যন্ত করত। পাড়ার মানুষের বাড়িতে কাজ করে দুমুঠো নিজের আর মায়ের পেটে দিত। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি চরম দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করতে উনাকে। খুব বেশি স্বৃতি নেই আমার। নতুন বাড়িতেই আমার জন্ম আর উনি প্রায় সময় অসুস্থ থাকত তাই আর উনার কাছে খুব বেশি একটা আশা হত না। তবু যখন আসতাম খুব আদর করত।
চরম দারিদ্রতা যখন ঘাড়ে চাপে তখন বিবেক,ভালোবাসা,মায়া সব সঙ্গ ত্যাগ করে। এক মাত্র ছেলের বিয়ের পড়েই উনার জীবনের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হতে থাকে। ছেলে একটা সময় সাবলম্বি হয়, কিন্তু সংসারে তখন তার কত মুখ। মায়ের খবর নেওয়ার সময় নেই। সবার ভাগ্য ফিরলেও উনার আর ভাগ্য ফিরেনি। অর্ধাহারে অনারে দিন যাপন করেছেন। একমাত্র মেয়ে আর মেয়ের জামাই এর উপর ভরসা করতে হয়েছে দিনের পর দিন। অনেক দিন ধরে অনেক অসুস্থ ছিলেন, না মরেও মরার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল, তাই মৃত্যুটা যেন উনার জন্য আর্শিবাদ হয়েই এল। আর আমিও আমার পিছনে একটা দারিদ্রতার,কষ্টের, সন্তান থেকেও না থাকার আর্তনাদের কবর দিয়ে আসলাম। ব্যাস্ত জীবনে প্রবেশ করার আগে আমার মনে ঠিকই কিছু প্রশ্ন রয়ে গেল।
পদ্যকারের অভ্যাস যেমন সব বিষয়েই পদ্য খোজা, পদ্য তৈরি করা আমিও হয়ত তেমন গদ্য খুজেছি, নয় গদ্য হিসাবেই উপস্থাপন করেছি। ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী। হয়থ অভ্যাসবশতই গদ্য বানিয়ে ফেলেছি সত্য একটা ঘটনাকে। দোয়া প্রার্থী উনার জন্য।