কানসাটের জেগে উঠা লোকজন অবশেষে বিজয় লাভ করেছে। নির্মম পুলিশী নির্যাতন, বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের পর জনতার রুদ্ররোষের মুখে সরকার অসহায়ভাবে পুলিশ ও বিডিআর প্রত্যাহার করেছে। সাব্বাস কানসাটবাসী!!! গণআন্দোলন যে পুলিশ বাহিনী দিয়ে থামানো যায় না, এই নিষ্ঠুর সত্য বুঝতে সরকারের অথর্ব লোকজনের অনেক দিন লাগল। মাঝখানে পুলিশের নির্যাতনে প্রাণ হারাল 20 জন নিরীহ গ্রামবাসী। কানসাটের আন্দোলন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, এটি হচ্ছে নূ্যনতম বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ন্যায়সংগত বিদু্যৎ চার্জের দাবীতে কানসাটের নিরীহ গ্রামবাসীদের আন্দোলন।
আজকের দৈনিক ইওেফাক জানায়, "গতকাল শনিবার বিকেলে কানসাট-সোনামসজিদ স্থলবন্দর সড়ক থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করায় কানসাট, ধোবরা, কলাবাড়ীসহ পাশর্্ববতর্ী বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ আনন্দ উল্ল্ল্লাসসহ বিজয় মিছিল বের করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী স্থানীয় এমপি অধ্যাপক শাহজাহান মিয়ার দুটি কুশপুত্তলিকা বানিয়ে জুতার মালা পরিয়ে দাহ করে। কানসাটে বর্বরোচিত পুলিশী হামলার প্রতিবাদে আজ রবিবার জেলায় 14 দল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান করেছে। হরতালের সমর্থনে সন্ধ্যায় জাসদ ও আওয়ামী লীগ জেলা শহরে মিছিল করে। এদিকে পুলিশের নির্যাতনে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া আতঙ্কগ্রস্ত গ্রামবাসী, যারা বন-জঙ্গল, আখক্ষেত এবং পাশর্্ববতর্ী ইউনিয়নের গ্রাম ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা এখনও ঘরে ফিরেনি। অন্যদিকে সংকট নিরসনে সরকার গঠিত বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে 5 সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল গতকাল সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসে পেঁৗছে। দলের অন্যান্য সদস্য হলেন, গৃহায়ন ও পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কামাল, দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু, রাজশাহী সিটি মেয়র ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মিজানুর রহমান মিনু এমপি এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-2 (ভোলাহাট-নাচোল-গোমস্তাপুর) আসনের এমপি সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন। প্রতিনিধি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সার্কিট হাউসে সকাল সাড়ে 10টা থেকে সাড়ে 3 ঘন্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকশেষে মেয়র মিনু সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভুল স্বীকার করে বলেন, গত 7 এপ্রিল পল্লী বিদু্যৎ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক গোলাম রাব্বানীকে তিনি একজন সন্ত্রাসী বলেছিলেন, সেটা বলা তার ভুল হয়েছিল। তিনি জানান, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে রাব্বানীকে সন্ত্রাসী বলা ঠিক হয়নি। তবে সেদিন ওই উক্তিটি তিনি বড় ভাইয়ের (স্থানীয় এমপি) কারণে বলেছিলেন বলে সাংবাদিকদের জানান। বৈঠকের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনি বলেন, কানসাট সংকট নিরসনে যা যা করার তা করা হবে। অপরদিকে পল্লী বিদু্যৎ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক গোলাম রাব্বানী জানিয়েছেন, 6 এপ্রিলের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারসহ গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি অথবা জামিন না দেয়া পর্যন্ত কোন আলোচনায় বসা হবে না।
গতকাল শনিবার বিকেল 4টায় কানসাট পুখুরিয়া ও গোপালনগর মোড় থেকে কোন ঘোষণা ছাড়াই পুলিশ সরিয়ে নেয়া হলে হাজার হাজার এলাকাবাসী রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্ল্লাস করে। এ সময় তারা সাংবাদিকদের জানায়, পুলিশ সরিয়ে নেয়ায় কানসাটবাসীর আন্দোলনের বিজয়ের সূচনা হলো। ...বাগদুর্গাপুর গ্রামের কমিশমুদ্দিন (72) জানান, পুলিশ দফায় দফায় গ্রামে হামলা চালিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে তা '71-এর বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশ গত 6 এপ্রিল নিহতের ঘটনার মামলা নিয়ে লুকোচুরি খেলছে। আসামীপক্ষ অভিযোগ করেছে পুলিশ বা কোর্ট কেউই মামলার সঠিক তথ্য জানাচ্ছে না। বৃহত্তর রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন কানসাটে হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল সকালে কানসাটের আব্বাস বাজারে এক সমাবেশ করেছে"।
কানসাট সমস্যার পটভূমি হিসেবে সমকাল জানায়, "চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এলাকা বিদু্যতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অবহেলিত এক জনপদ। যে কারণে তারা আন্দোলন করে আসছে বহুদিন থেকে। জানা যায়, সারাদেশে বিদু্যৎ সংকট থাকলেও এ এলাকায় সমস্যা ভিন্ন ধরনের। এখানে সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনেরও সমস্যা প্রকট। ফলে কতর্ৃপক্ষ চাইলেই এখানে চাহিদা অনুযায়ী বিদু্যৎ দিতে পারে না। এ কারণে এখানে সারাদিনে বিদু্যৎ থাকেই না। কখনো কখনো দিনের পর দিন বিদু্যৎ থাকে না।
কানসাটবাসী যখন আন্দোলন শুরু করে তখন তাদের প্রধানতম দাবি ছিল মিটার ভাড়া এবং মিনিমাম চার্জ প্রত্যাহারসহ 6 দফা। এটা যৌক্তিক দাবি হিসেবে এলাকার গ্রাহকরাও গ্রহণ করেন এবং গোলাম রব্বানীর পেছনে সমবেত হন তারা। কানসাট পল্লী বিদু্যৎ সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক গোলাম রব্বানীর মতে, প্রতি গ্রাহককে মিটার ভাড়া এবং মিনিমাম চার্জ হিসাবে দিতে হয় 110 টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিদু্যৎ বিল। পল্ক্নী বিদু্যতের অধিকাংশ গ্রাহকই ক্ষ ুদ্র গ্রাহক। গ্রামের এমনও ছোট পরিবার আছে যারা সারা মাসে মাত্র 25-30 ইউনিট খরচ করেন। অর্থাৎ তারা 60-75 টাকার বিদু্যৎ খরচ করেন। কিন্তু প্রতি মাসেই তাদের মিটার ও মিনিমাম চার্জ হিসাবে আরো যুক্ত হচ্ছে 110 টাকা। তারপরও মোদ্দা কথা হলো, দিনের পর দিন বিদু্যৎই থাকে না এ অবহেলিত জনপদে। সংগ্রাম কমিটির দাবি হলো, গরিব কৃষকরা তথাকথিত মিনিমাম চার্জ ও মিটার ভাড়া কেন দেবে?
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মিজানুর রহমান মিনু সমস্যা সমাধানে দমন নীতির আশ্রয় নেন। যে কারণে জানুয়ারিতেই সেখানে দু'দফায় নিহত হন মোট 9 জন। এরপরও দাবি মানা হয়নি। 6 দফা পরিণত হয় 14 দফায়। এ নিয়ে সংগ্রাম কমিটি আন্দোলন করে আসছিল। গত 4 এপ্রিল সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে 14 দফা মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন মেয়র। কিন্তু কোনো একটি দাবিও তিনি কার্যকর করেননি বলে এলাকাবাসী জানান। যে কারণে এলাকার গ্রাহকরা মেয়রের বিরুদ্ধে আরো ক্ষ ুব্ধ হয়ে ওঠেন। 6 এপ্রিল স্থানীয় বিএনপির ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেখানে আবারো নিহত হয় 4 জন। মেয়র মিনু 12 এপ্রিল কানসাট পরিদর্শনে যান। মেয়র কানসাট ত্যাগ করার পর পরই আবারো পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে 6 জনকে হত্যা করে। পুলিশ এলাকার ঘরে ঘরে গিয়ে হামলা ও লুটপাট করে। মেয়রের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ কোনোভাবেই আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে পারে না বলেই এলাকাবাসী মনে করেন"।
সাব্বাস কানসাটবাসী। মানুষগুলো যখন জেগে উঠে তখন নিবর্তনমূলক পেশী শক্তি অসহায় হয়ে দাঁড়ায়। এই সত্যটি আরেকবার আমাদের সামনে দিনের আলোর মত স্পস্ট হয়ে উঠল। এর পাশাপাশি আড্ডাবাজ ধিক্কার জানায় সেসব নির্বোধদের যারা অন্ধের মতো কানসাটের বিশজন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করল, গৃহহারা করল এখানকার নিরীহ মানুষগুলোকে, ভেঙ্গে দিল মানুষের সাজানো সংসারকে। ধিক্কার জানাই যারা এরকম সংকটকালে নির্বিকার ছিল, প্রমোদ ভ্রমনে লিপ্ত ছিল, যারা নিজেদের অপরাধের দায়-দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ-নির্লিপ্ত। সরকারের ক্ষমতাসীন দায়িত্বশীল নির্লজ্জ মানুষগুলোকে এজন্য অবশ্যই অপমানিত হতে হবে। ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম লেখা থাকবে কলংকের সাথে।
"হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান"
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০