somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাপ্তাহিক খাবার পত্র (সংখ্যা ২)

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দি হান্ট ফর রসগোল্লা

বৎস, আইস আমরা রসের গোলক নিয়া আলোচনা(আলোচনা শুনিয়াই আলুভাজার কথা মনে করিলে হইবে না) করি।
রসের গোলকের উৎপত্তিস্থল ভারতের পশ্চিমবাংলার হুগলীতে(তাই বলিয়া জামদানীর উৎপত্তিও কিন্তু ভারতে নহে)। কালে তাহার রন্ধনপ্রণালী ও সুস্বাদ এই দেশে আসিয়া পৌঁছাইলো। বিক্রমপুর এবং যশোরের কলাপাড়ার মানুষেরা এই মিষ্টান্নকে সাদরে গ্রহণ করিয়া লইলো। তাহাদের রসগোল্লার সুনাম দেশব্যাপী ছড়াইলো। এরই ফলশ্রুতিতে আজি রসগোল্লার নাম শুনিয়া আমাদের মন আনচান করিয়া ওঠে।

রসগোল্লা মূলত দুই প্রকারের হইয়া থাকে। নরম রসগোল্লা এবং স্পঞ্জের রসগোল্লা। তাহাদের মধ্যে রন্ধনপ্রণালীর কি পার্থক্য আমি জানিনা। তবে স্বাদের পার্থক্য এই যে, নরম রসগোল্লা খাইতে নরম এবং স্পঞ্জের রসগোল্লা খাইতে স্পঞ্জের মত। স্বীকার করিতেছি আমি কখনো স্পঞ্জ খাইয়া দেখিনাই। তবে তাহা যে স্পঞ্জের রসগোল্লারই একটা অখাদ্য সংস্করণ একথা বলিতে পিছপা হইবোনা।

এত ইতিহাস জানানোর উদ্দেশ্য হইলো রসগোল্লার প্রতি আমার ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষুদ্রস্য প্রয়াস। কিন্তু ইতিহাস জানিয়া যে উদর পূর্ণ হয়না ইহা আমরা সকলেই জানি। সে কারণেই ধানমন্ডির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কে দাঁড়াইয়া আমরা তিন জনা সংকল্পবদ্ধ হইলাম যে, যে করিয়াই হউক আজিকে স্পঞ্জের রসগোল্লা উদরস্থ করিয়া ছাড়িব। মাস কয়েক আগে বিভিন্ন মিষ্টান্ন বিপণিতে স্পঞ্জের রসগোল্লা খুঁজিয়া পাইতে ব্যর্থ হওয়ায় কিঞ্চিৎ শংকায় ভুগিতেছিলাম; যদি তাহার দেখা না পাই! তাই আমরা তীর্থযাত্রীর স্বরূপ পদব্রজে রসগোল্লার খোঁজে বাহির হইলাম। উদ্দেশ্য- একখানা মিষ্টান্ন ভান্ডারও ছাড়িব না।

তিনজনা মিলিয়া চারি রাস্তার একটি নির্বাচন করা যে কীরূপ কঠিন ও সময়সাধ্য কাজ তাহা হাড়ে হাড়ে টের পাইলাম। একজন ডানদিকে যাইতে বলিলে আরেকজন ‘বামদিকের রাস্তায় রসগোল্লা পাওয়া যাইবে’ এরূপ বাণী লিখিয়া দিতে চায়। এইরূপ আনন্দজনক অভিযানের মধ্যে লেখাপড়াজনিত জটিল ব্যাপার-স্যাপার আনয়নের কারণে তাহাকে ল্যাম্পপোস্টের সহিত ঝুলাইয়া রাখিতে ইচ্ছা হইল। বহুকষ্টে আত্মসম্বরণ করিলাম।

অবশেষে ডানদিকে যাওয়াই সাব্যস্ত হইলো। মনে ভাবিলাম, ধানমন্ডি হ্রদের (লেক) নির্মল হাওয়া ও বিনামূল্যে বিনোদন উপভোগ করিতে করিতে যাইব। তাহা যে কীরূপ ভুল সিদ্ধান্ত ছিল অচিরেই টের পাইলাম। হ্রদ এলাকা হইতে বাহির হইয়া দেখি মিষ্টান্ন বিপণি বহু পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছি। বিফল মনোরথে পশ্চাতে হাঁটিতে লাগিলাম। বামদিক-পক্ষীয় বন্ধু, ‘এই কারণেই বাঙ্গালী জাতির এই দুর্দশা’ সংক্রান্ত থিসিস পরিবেশন করিতে লাগিল। রসগোল্লার বিরহে আমরা এতটাই বিপর্যস্ত যে, প্রতিবাদ করিবার চেষ্টাও করিলাম না।

সাকুল্যে অর্ধঘন্টাকাল হন্টনের পর বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের দেখা পাইলাম। বিপণিতে প্রবেশ করিয়া শংকিত কিন্তু সুললিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করিলাম সেইখানে রসগোল্লা কিনিতে পারা যাইবে কিনা। দোকানীর ধনাত্মক উত্তরে বন্ধুগণকে বলিলাম-‘পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।’ দুঃখভারাক্রান্ত মনে গাঁটের কড়ি খরচ করিয়া গরম গরম স্পঞ্জের রসগোল্লা কিনিলাম। আহা! এমন জিনিস হাতে নিয়াও সুখ!

রসগোল্লা তো পাইলাম কিন্তু খাইবো কীভাবে! সড়কের মধ্যিখানে সকলকে লোভ দেখাইয়া খাইব এমন নিষ্ঠুর আমরা নই। প্রস্তাব করিলাম, চ’ হ্রদের কপোত-কপোতীদের মধ্যে বসিয়া খাই। আশা করা যায়, তাহারা প্রেমসুধা আহরণ করিতে এতই ব্যস্ত থাকিবে যে আমাদের রসগোল্লার দিকে কেহ নজর দিবে না। আর যদি অন্য কেহ আসিয়া পড়ে তবে তাহাকেও দুই-চারটা রসগোল্লা দিয়া শান্ত করা হইবে।

পরিকল্পনা মোতাবেক হ্রদে ফেরত আসিলাম। কতিপয় কলেজ-পড়ুয়ার প্রেমালাপ দেখিয়া যারপরনাই বিরক্ত হইলাম। বাবা প্রেম করিবি তো নিজ পরিচয়ে কর। এইরূপ ঢাক-ঢোল পিটাইয়া নিজ কলেজের বদনাম করিবার কারণ কি! যাই হোক, আমরা তিনজনা পাঁচ-ছয় জোড়া কপোত-কপোতীর মধ্যিখানে আরাম করিয়া বসিলাম। আসার পথে পানি কিনিয়া লইয়াছিলাম। তাহা দিয়া হস্ত ধৌত করিয়া রসগোল্লার মোড়ক উন্মোচন করিলাম। রসে টইটুম্বুর রসগোল্লা দেখিয়া আনন্দে চোখে পানি আসিয়া পড়িয়াছিল।

খাইতে গিয়া বলিলাম; গরম রসগোল্লা খাইয়া জুইত পাইতেছিনা, ঠান্ডা হইলে ভালো হইতো। জ্ঞানী বলিয়া সর্বজনস্বীকৃত বন্ধু জ্ঞান জাহির করিল যে, যাবতীয় মিষ্টান্ন গরম গরম খাইতে উত্তম। মানিয়া লইয়া আরো গোটা দুয়েক গলধঃকরণ করিলাম। সৈয়দ মুজতবা আলী স্মরণে আবৃত্তি করিলাম- ‘রসের গোলক এত রস কেন তুমি ধরেছিলে হায়….।’ আমার খাদক বন্ধু দেখি কথা না বলিয়া রসগোল্লা একের পর এক সাবাড় করিয়া চলিয়াছে। যেকোন মূহুর্তে শেষ হইয়া যাইবার আশংকা। তাহাকে থামাইয়া দিয়া মোড়কের মুখ বন্ধ করিলাম। উঁকি মারিয়া দেখিলাম গোটা চার রসগোল্লা অবশিষ্ট আছে। ঘোষণা করিলাম, ইহাকে আমি বাটীতে লইয়া যাইয়া ঠান্ডা করিয়া খাইব। খাদক বন্ধু বহু কষ্টে নিমরাজি হইলো। আমরা পুনরায় হস্ত ধৌত করিয়া উঠিয়া পড়িলাম।

বাটীতে ফিরিয়া হিমঘর(ফ্রীজ) এর এক কোণায় রসগোল্লা লুকাইয়া রাখিলাম। মনে মনে প্রার্থনা করিতে থাকিলাম যেন কেহ তাহা সাবাড় না করিয়া দেয়। মধ্যরাত্রে হিমঘর হইতে বরফশীতল রসগোল্লা বাহির করিয়া আস্তে আস্তে গোটাদুই খাইলাম। কোন এক জ্ঞানী বলিয়াছেন ‘revenge is best served cold’ অর্থাৎ প্রতিশোধ ঠান্ডা হইবার পরই সর্বোত্তম হয়। আমি স্বগোতক্তি করিলাম, রসগোল্লাও best eaten cold (served লিখিয়া কাহাকেও রসগোল্লা পরিবেশনের কোন ইচ্ছাই আমার নাই)। আরো দুইটা রসগোল্লা বাকি ছিল। সকালে নাস্তা খাইবার পর তাহা খাইতে কীরূপ সুস্বাদু হইবে তাহা চিন্তা করিতে করিতে সুখনিদ্রা দিলাম।

বাটীতে তো আর খাদকের অভাব ছিল না, সকালে উঠিয়া দেখি কেহ আমার সবেধন নীলমনি দুইখানা রসগোল্লা শেষ করিয়া মোড়কখানা সযতনে হিমঘরে রাখিয়া দিছে। আমি মনঃক্ষুণ্ন হইয়া মোড়কখানি ময়লা ফেলিবার ঝুড়িতে রাখিয়া আসিলাম।

নিজ মনকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলিয়া যে, ‘দুঃখিত হইও না বৎস। সকল ভালো জিনিসেরই একদিন সমাপ্তি ঘটে।’


সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১০:১৪
২৪টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×