![]()
১ম অংশ
৩.
মিসির আলির বাসার কাছাকাছি আসতেই কে যেন আমাকে ডাক দিল।
"এই ছেলে, এদিকে আসো,কাছে আসো, কাম ক্লোজ।"
ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম লাল গেঞ্জির উপরে নীল জিন্স শার্ট পড়া, চোখে রোদচশমা দেওয়া, বাংলার লাখো হৃদয় ভেঙ্গে দেওয়া বাকের ভাই। সবই ঠিক ছিল, শুধু কানে হেডফোন দেওয়া। আমি নিশ্চিত তাতে গান বাজছে, হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লাল দোপাট্টা মলমল কা...
আমি চিনেও না চেনার ভান করলাম। একটু মজা করা যাক। একটা শ্রদ্ধাভাব এনে বললাম, জ্বি, আমাকে বলছেন?
'এই তোমার নাম হিমালয় না? আই মিন হিমু, রাইট?'
আমি অবাক হবার ভান করে বললাম, আপনি আমাকে কি করে চেনেন? আপনি কি পুলিশ?
'বেয়াদবি করবা না। আমি জানি তুমি আমাকে চিনেছ। আমি তোমাদের বাকের ভাই।'
'তাই তো। আপনারএকটা মুদ্রাদোষ ছিল, আপনি একটা চেইন হাতের তর্জনিতে অনবরত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচাতেন, আবার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচ খুলে আবার প্যাঁচাতেন।'
'এখনো প্যাঁচাই।' বলেই পকেট থেকে চেইনটা বের করে তার দোষটা মানে মুদ্রাদোষটা দেখাতে লাগলেন। 'তুমি মিসির সাহেবের বাসা চেন না? আমি চিনতে পারছি না। শো মি হিম হাউস।'
'আচ্ছা, আপনি আমাকে কলা খাওয়াবেন না?'
'হোয়াই, কেন?
'সালাম দেই নাই যে। মতি সালাম না দেওয়াতে আপনি ওকে কলা খাইয়েছিলেন। আমাকে একটা খাওয়ান তো, খিদে পেয়েছে।'
'ওকে। কাম। এই দোকানদার, একে কলা দাও। (আমার দিকে ফিরে) কলা খেয়ে মিসির সাহেবের বাসা দেখাও। '
আমি বিনিয়ের সুরে বললাম, 'সাথে এক কাপ দুধ চা হলে ভাল হয়।'
বাকের ভাই একটা কলা দিয়ে বললেন, কুইক ইট ব্যানানা।'
আমি আরো ধীরে ধীরে খেতে লাগলাম। ঢাউস সাইজের কলাটা একটু একটু করে চায়ে ভিজিয়ে খেতে লাগলাম।
বাকের ভাই কেন যেন কিছু বললেন না। তিনি হয়তো আর আগের মতো রাগী নেই। এখন একটা ডায়লগ দেওয়া উচিৎ, 'মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়।'
ক্ষুধার্ত পেটে চায়ে ভেজা কলা অমৃত সমান লাগছে। আবারও প্রমাণিত হলো, "হাঙ্গার ইজ দা বেস্ট সসেজ।"
৪.
এত রাতে মিসির আলির জেগে থাকার কথা না। তিনি নিয়ম করে রাত দশটায় ঘুমান। কিন্তু তিনি জেগে আছে, শুধু জেগেই আছেন তা নয়, তিনি একটা পাতিল সামনে নিয়ে গম্ভীরভঙ্গিতে বসে আছেন। পাতিলে তিনটা কৈ মাছ। আনমনে সাঁতার কাটছে, একটু পর পর মুখ পানিতে তুলে আবার ডুব দিচ্ছে। মিসির আলীর কোলে চামড়ায় বাঁধানো একটা নোটবই। বইয়ের উপরে সোনালী রঙে লেখা।
ব্যক্তিগত কথামালা
ড. মিসির আলি
পিএইচডি
নোটবইয়ের মাঝে তার একটা আঙ্গুল গুঁজে রাখা। আর দুই আঙ্গুলের ভাঁজে সিগারেটের মতো কলম রাখা। অন্য হাতে একটা স্টপ ওয়াচ। গম্ভীর ভঙ্গিতে তিনি পাতিলের মাছে আচরণ পর্যবেক্ষণ করছেন।
বাকের ভাই মনযোগ আকর্ষণের জন্য কাশির মতো শব্দ করলেন, হুহ হু...
মাছ থেকে চোখ না সরিয়েই মিসির আলি বললেন, কাশতে হবে না। আমি জানি তোমরা এসেছ। হিমু, ব্যাগটা হাত থেকে নামিয়ে টেবিলে রেখে বিছানায় বস। আর আপনি, বাকের ভাই, চেয়ার টেনে বসুন।
দুজনই সুবোধ বালকের মত তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। তিনি এবার স্টপ ওয়াচ থেকে একটা মান তার নোটবইয়ের একটা ছকে টুকে নিলেন। আমি চুপিসারে ছকের উপরের লাইন পড়ে ফেললাম। সেখানে লেখা,
'মৎসের শ্বাস গ্রহণের ছক'
'হিমু, চুপিসারে দেখা মহাপুরুষের কাজ না।' মিসির আলি চোখ মাছের উপর রেখেই কিভাবে বুঝলেন কে জানে।
নোটবইটা রেখে এবার তিনি আমাদের দিকে ফিরলেন, 'জানি, আমার আচরণ তোমাদের বিস্মিত করেছে। আমি তাই কোন প্রশ্ন করার আগেই শুরুতে সম্পূর্ণ ঘটনা বলছি। আজ কৈ মাছ ভাজা খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। তিনটা জ্যান্ত কৈ মাছ এনে জসুকে বললাম ভেজে দিতে। জসু বলল সে কৈ মাছ কুটতে পারবে না। আমি রাগ করে রান্নাঘরে মাছ তিনটা রেখে এলাম।
তারপর রুমে এসে রাগ কমাবার জন্য উল্টো দিকে দশ থেকে এক পর্যন্ত গুনলাম। গুন গুন করে মনে মনে গাইলাম, আজি এ বসন্তে এর ফুল এত পাখি গায়...। রাগ কমল/ রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম জসু নেই। মাছগুলো পলিথিন ছিড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেমন যেন মায়া হল। কাগজে হাত পেঁচিয়ে কসরত করে মাছ তিনটাকে পাতিলে ভরে পানি ঢাললাম। মাছগুলো পানিতে সাঁতার কাটতে লাগল। তারপর হঠাৎ একটা মাছ পানির উপর ভেসে উঠে ডুবে গেল। তারপর অন্যগুলোও একটু পর পর একই কাজ করতে লাগল।
আমার এই ওঠানামাটা হিসাব করে দেখতে ইচ্ছে হল। সেটাই দেখছিলাম। দেখলাম, গড়ে ৫০ সেকেন্ড এরা পানিতে ডুবে থাকে। একসময় খেয়াল হল, যে মাছগুলো আমি খেতে চাচ্ছিলাম, সেই মাছের উপর আমার মায়া পড়ে গিয়েছে। এখন এদের জন্য একটা একুরিয়াম কেনার কথা ভাবছি। শুনেছি, এলিফ্যান্ট রোডের দিকে কাটাবনে পাওয়া যায়।
এখন বল, এখানে আসার কি কারণ?'
আমি বলতে চাচ্ছিলাম আমি বাক্স রহস্য উৎঘাটন করতে আপনার কাছে এসেছি, কিন্তু বাকের ভাই কথা শুরু করাতে আর পারলাম না। বাকের ভাই যা বলল তাতে আমরা আসলেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বাকের ভাই বললেন,
'মুনাকে খুঁজে পাচ্ছি না। কোথাও সে নেই। নো এনিহোয়ার। সি ইজ গুম। প্লিজ ফাইন্ড হার।'
মিসির আলির ভ্রু কুঞ্চিত হল।
১২.১১.১৪
(চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




