somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তি সংগ্রামের অম্লান স্মৃতি

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"Give me blood and I shall give you freedom." - Subhas Chandra Bose

"সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই তাঁদের স্মৃতির চরণে।"


৩রা মার্চ ১৯৭১ - বুধবার, ১৯শে ফাল্গুন, ১৩৭৭ - এই তারিখটা শুধু আক্ষরিক অর্থেই নয় সত্যিকারের অর্থেই আমার জীবনে রক্ত দিয়ে লেখা তারিখ।

আজ থেকে ৪৪ বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্নিঝরা উত্তপ্ত দিনে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌবনাদ্বীপ্ত এক তরুণ ছাত্র। এই দিনে, ঠিক এই তারিখে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে রাজশাহী শহরে পথের ধুলায় লুটিয়ে পড়েছিলাম আমি। আমার রক্তে পথের ধুলো ভিজে গিয়েছিল। সেই রক্তে রাঙ্গা ধুলায় মাখামাখি হয়ে মিশেছিল শেষ বিকালের রক্তিম সুর্য্যের লালিমা। কিছু অপরিচিত, অচেনা, অজানা মানুষ আমাকে পথ থেকে তুলে নিয়ে পথের পাশের একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ এতদিন পরেও বেশ মনে পড়ে রক্তাক্ত আমাকে দেখে ঐ বাড়ীর মা-বোনেরা শিউরে উঠে ছোটাছুটি করে বাড়ীর উঠানে শুকাতে দেওয়া শাড়ি ছিঁড়ে রক্তে ভিজে যাওয়া আমার পা বেঁধে দিয়েছিলেন। ঐ অচেনা অজানা মানুষ গুলো সন্ধার অন্ধকারে আমাকে রিকশায় তুলে কারফিউ ঢাকা শহরের অলিগলি দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কষ্টে পৌঁছে দিয়েছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । সংবাদ পেয়ে অপারেসন থিয়েটারে ছুটে এসেছিলেন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক আমার ফুপাতো ভাই ডাঃ শামসুল হক (এম. আর. সি. পি.) যিনি আমার পায়ে অপারেসন করে ব্যন্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন।

চার দিন পর ৭ই মার্চে হাসপাতালের ওয়ার্ডে আমার শয্যায় নার্সদের কল্যানে রেডিওতে বজ্রকন্ঠের সেই বিখ্যাত ভাষণ ভেসে এসেছিলঃ "......ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে.....রক্ত যখন দিতে শিখেছি রক্ত আরো দেব....এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" হাসপাতালেই একদিন জানতে পেরেছিলাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া আছে সেনাবাহিনীর গুলিতে আমি এবং আরো যারা গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি আমরা সবাই পাকিস্তানের শত্রু তাই ভাল হয়ে গেলেও আমাদের যেন ছেড়ে দেওয়া না হয় ! দু'তিন দিন পর পর ক্যান্টনমেন্ট থেকে একজন আর্মী অফিসার দু'দিকে দু'জন খোলা অস্ত্রধারী বডিগার্ড সাথে নিয়ে ওয়ার্ডে এসে আমাদের দেখে যেতেন। এরই মধ্যে একদিন আকাশ থেকে বিদ্যুৎপড়ার ভয়ঙ্কর ভারী ডাকের মত গগন বিদারী প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে হাসপাতালের তিন তলার জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম দাউ দাউ করে জ্বলে উঠা আগুনের লেলিহান শিখা। নার্সদের মুখে শুনেছিলাম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙ্গালী-প্রধান ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর রাজশাহী ঘাটি আক্রমন করে ওদের গোলা বারুদের অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ।

কেমন করে একদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলাম, কেমন করে পদ্মা পেরিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম সে এক আলাদা লম্বা ইতিহাস। ভারতের অচেনা মাটিতে, অপরিচিত পরিবেশে, কপর্দকহীন শুন্য পকেটে শুরু হয়েছিল কখনো অনাহারে, কখনো অর্ধাহারে একটু খানি আশ্রয়ের সন্ধানে চৈত্রদিনের দিকভ্রান্ত ছিন্ন পাতার মত পথে পথে আমার ঘুরে বেড়ানো! একদিন দুপুর বেলা ভারতের উত্তর বাংলায় শিলিগুড়ি শহরে চোখে চশমা আর ধুলি মলিন শার্ট আর লুঙ্গি পরিহিত উদ্দেশ্যহীন ভাবে আমাকে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে দেখে আমারই বয়সের এক তরুণ যুবক আমার চলার পথে সামনে এসে প্রশ্ন করেছিল "তোমাকে দেখেই বোঝা যায় এখানে তুমি নুতন। তুমি কে, কোথা এসেছ, কেন এসেছ জানিনা কিন্তু ঐ পাশের বারান্দায় বসে কয়েকজন বন্ধুর সাথে গল্প করার সময় এই পথে বেশ কয়েকবার তোমাকে যাওয়া আসা করতে দেখেছি। যদি এখানকার নকশালীরা বুঝতে পারে তুমি পুলিশের গুপ্তচর তাহলে যে কোন সময় তোমার গায়ে পেট্রোল বোমা ছুড়ে দিতে পারে আর পুলিশ যদি তোমাকে নকশালী সন্দেহ করে জেলে একবার ঢোকায় তাহলে জীবন নিয়ে কোনদিন বেরিয়ে আসতে পারবেনা, ক্রস ফায়ারে তুমি শেষ হয়ে যাবে।"

যেখানে দাঁড়িয়ে ছেলেটি আমাকে নকশালী আতঙ্কবাদীদের কথা শোনাচ্ছিল সেখান থেকে ঐ উগ্র মাওবাদী আন্দোলনের উৎপত্তিস্থল এবং যে জায়গার নামে আন্দোলন ঐ নাম পেয়েছে সেই নকশালবাড়ীর দূরত্ব মাত্র ষোল মাইল!

দেশে আমার বাড়ীতে সাদা শাড়ি পরা আমার দুখিনী বিধবা মা, আমার একমাত্র ভাই ও ভাবী এবং বোনেরা কেউই আমার কোন খবর জানেনা, ওরা জানেনা আমি কোথায়, জানেনা আমি মরে গিয়েছি নাকি বেঁচে আছি। আর এখন বিদেশের অজানা, অচেনা মাটিতে, সহায় সম্বলহীন আমি। ছেলেটির কথাগুলো আমার কানে যেতেই আমার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যেতে শুরু করেছিল । আমার ভয় বিহ্বল সাদা, ফ্যাকাশে, আতঙ্কিত মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না তবে মনে আছে ক্ষুধার্থ, তৃষ্ণার্ত গলায় ছেলেটাকে আমার পরনের লুঙ্গিটা তুলে আমার ব্যন্ডেজ বাঁধা পা দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পাকিস্তানী মিলিটারীর গুলিতে আহত হয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছি।

দেবদূত দেখতে কেমন হয় কোনদিন জানতামনা। অন্ততঃ সেদিন, সেই মুহুর্তের আগে অবধি জানতামনা। সেদিন আমি দেবদূত দেখেছিলাম। ছেলেটি জানালঃ "আমি আমার বোন ভগ্নিপতির বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করি। ওদের বাড়ি খুব বেশি দুরে নয়। চলো আমার সাথে, আমার জামাইবাবু এ সময় বাড়ী থাকেন না কিন্তু আমার দিদি তোমাকে আশ্রয় দেবে, দেখো।" ছেলেটি ওর বোনের কথা এক বর্ণও বাড়িয়ে বলেনি বরং মনে হয় কমিয়ে বলেছিল। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা নিম্ন মধ্যবর্তী সংসারের টিনের ছোট বাড়ীটার টিনের দরজা ঠেলে ছেলেটার পেছনে পেছনে ভেতরে ঢুকে উঠানে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল সিমেন্টে বাঁধা বেদীর মাঝখানে একটা তুলসী গাছ আর তার নীচে একটা নেভানো মাটির প্রদীপ। রান্নাঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একটা পেয়ারা গাছ তার মিষ্টি শীতল ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে ছোট্ট উঠানটিতে । বাড়ির কোথাও জাগতিক বৈভবের চিহ্ন ছিলনা, যা ছিল তা নিঃশ্বতার গৌরব। কোন কাজের ছেলে বা ঝি চোখে পড়েনি, চোখে পড়েছিল দিদির হাতের সাদা শাখা আর সিথির জ্বল জ্বলে সিঁদুর। আচমকা মনে পড়েছিল বিমল মিত্রের লেখা "সাহেব বিবি গোলাম"-এর ভুতনাথ বাবুকে, মনে হয়েছিল এ বুঝি ভুতনাথ বাবুর কারখানায় তৈরী সেই মোহিনী সিঁদুর।

কত দিন পেট পুরে দু'মুঠো খেতে পাইনি, কতদিন গোসল করার সুযোগ পাইনি। ওদের কুয়ো তলায় গোসল করতে গিয়ে দেখি কুয়োর পাশে টানানো দড়িতে আমার জন্য একটা ধোয়া লুঙ্গি ঝোলানো আর আমার জন্য বোনের নিজের হাতে কুয়ো থেকে তোলা বড় বালতি ভর্তি আমার গোসলের পানি। আমি কি কেঁদেছিলাম? আমার চোখ কি অশ্রু সিক্ত হয়েছিল? গোসল শেষে যখন ওদের ঘরের বারান্দায় পেতে দেওয়া মাদুরে গিয়ে দিদির বেড়ে দেওয়া গরম গরম ভাত খেতে বসলাম তখন মনে হলো পৌরণিক গল্প কাহিনীতে "অমৃত" বলতে যা বোঝানো হয়েছে তাই-ই বুঝি মুখে তুলে দিচ্ছি।

*********************************
সত্তুর দশকে আমি




সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৫৮
১১টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×