রাত ২ টো বাজতে চলল। আবাসিক এলাকার ১৪ নম্বর রোডটি এই মূহুর্তে জনমানহীন। কোথাও কেউ নেই। লাম্পোস্টের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে গোটা সড়ক। কমলা রঙের আলোর নিচে শুয়ে আছে কয়েকটি বেওয়ারিশ কুকুর। সারাদিন ঘুরে এসে তারা আশ্রয়ে নিয়েছে এই লাম্পোস্টের তলে।
রোডের বাড়িগুলোও এখন নিস্তব্ধ। কোথাও আলো জ্বলছে না। এখানকার অবস্থানরত অভিজাত পরিবারের সদস্যরা সবাই তলিয়ে আছে গভীর ঘুমে। রহমত মিয়ারও ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু কোন উপায় নেই। তাকে জেগে থাকতে হবে। এটাই তার চাকরি। এই রোডের অন্যতম একটি বাড়ীর দারোয়ান সে। ৮ বছর ধরে এখানে চাকরী করছে সে। অন্যান্য দিন অবশ্য হাফ নাইট জেগে থেকে তারপর ঘুমিয়ে পড়ে সে। তবে আজকের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। তার মালিক দবির সাহেব এখনও বাড়ি ফেরেন নি। সাহেব না আসা পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে তাকে। এর আগে কখনও এত দেরী করেন নি তার মালিক। তবে আজ কেন এত দেরি হচ্ছে, বুঝতে পারছে না রহমত মিয়া।
হঠাৎ রোডের মাথায় এক তিব্র আলো দেখা গেলো। গাড়ীর হেডলাইটের আলো। আজকাল গাড়ির হেডলাইটগুলোতে এলইডি নামক বাল্ব থাকায় আলো খুব তিব্র থাকে। সাধারণত এ আলোয় চোখও ঝলসে যায়! গাড়িটি ১৪ নম্বর রোডে প্রবেশ করলো। রহমত মিয়া বাইরের তিব্র আলো দেখে বুঝতে পারলো যে তার মালিক এসেছে। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে খুলে দিল বাড়ির প্রধান ফটক। তিব্র আলো ও চাপা গর্জন করে ভেতরে ঢুকলো কালো রঙের পাজেরো গাড়ি।
রহমত মিয়া দ্রুত গেট আটকিয়ে গাড়ির দিকে এলো। মালিকের বের হওয়ার জন্য দ্রুত দরজা খুলল। সাথে সাথেই চমকে ঊঠলো সে। গাড়ির সিটে শুয়ে আছেন মালিক। গায়ের সাদা শার্ট ভিজে গেছে রক্তে। চোখ খোলা, মুখ হা করে শুয়ে আছেন দবির সাহেব। গাড়ির সিটেও লেগে আছে রক্তের দাগ। সিটের নিচে পরে আছে জমাট বাঁধা রক্ত।
চিৎকার দিতে গেল রহমত মিয়া। কিন্তু স্বর বের হলো না গলা দিয়ে। খুব ভয় পেয়েছে সে। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ড্রাইভারের দিকে। সাথে সাথে আবার চমকালো। দবির সাহেবের ড্রাইভারের নাম মোখলেস। কালো মত কম বয়সী ছেলে। কিন্তু এখন যে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে সে মোখলেস নয়। অন্য একজন। তবে জামাটা মোখলেসের, চিনতে পারলো রহমত মিয়া। সিটে বসা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। এই ছেলেও কম বয়সী, ফর্সা। তবে চেহারায় অদ্ভুত কাঠিন্য দেখা যাচ্ছে। রহমত মিয়া তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে ছেলেটাও তার দিকে তাকালো। চোখ রক্তবর্ণ, চেহারায় ফুটে উঠেছে পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা। রহমত মিয়াকে দেখে এক অদ্ভুত বাকা হাসি হাসল সে। জামার ভেতর থেকে বের করে আনলো একটা সাইলেন্সারওয়ালা রিভলবার। সরাসরি তাক করলো রহমত মিয়ার দিকে। তারপর আস্তে আস্তে চাপ বাড়ালো ট্রিগারে!
----------
“এটা কোনো কথা?” বিরক্তি ধরে পড়ল আবিরের গলা দিয়ে। “ভাবছিলাম এবার ঈদের ছুটি নিয়ে বিয়েটা করে ফেলবো। কিন্তু সে কপাল আর হলো না। সামনের মাসেই ঈদ। আর এখনই এরকম খুন জখম!”
গুলশান থানার ওসি আবির মাহতাবের বয়স খুব বেশি না। এই ত্রিশ-বত্রিশ হবে। চেহারাও খারাপ না। লোকে বলে পুলিশের চাকরি করলে চেহারা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আবিরকে দেখে তা একটুও মনে হয় না। যেমন উঁচু লম্বা, তেমনি স্মার্ট! আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এরকম সুন্দর ছেলে পুলিশে কেন ভর্তি হলো। কারণটা অবশ্য কখনও জিজ্ঞেস করি নি।
আজ সকালের ঘটনা বলি। আমি এই সাড়ে ন’টা নাগাদ অফিসে গেছি। যারা কখনও থানায় গেছেন, তারা হয়ত জানেন যে থানার কাজ শুরু হওয়ার কথা নয়টা, কিন্তু শুরু হতে হতে দশটা-এগারোটা বেজে যায়। আমাদের থানাও এর ব্যতিক্রম না। আমি সাড়ে নয়টার দিকে একরকম হেলে দুলেই অফিসে যাই যেন কোন তাড়া নেই।
তবে আজকের ঘটনা ভিন্ন। অফিসে ঢুকেই দেখি হৈ হৈ কারবার। সবাই এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। কারও হাতে ফাইল তো কারও কানে ফোন। সবাই খুব ব্যস্ত। দৌড়ের উপর আছে বুঝতে পারছি। আমি হাঁটতে হাঁটতে আমার চেম্বারে ঢুকলাম। চেয়ারে বসে টেবিলে রাখা গ্লাসটা তুলে পানি খেলাম। তারপর পিওনকে ডাক দিলাম ভেতরে।
পিওন এলো। জিজ্ঞেস করলাম, “কি হইছে রে? এত চেঁচামেচি হচ্ছে ক্যান সকাল সকাল?”
“আপনি কিছু জানেন না?” পিওনের সরল বিস্ময়।
না তো! কি হইছে?
কালরাতে আবাসিকে একলোক খুন হইছে।
কি বলিস? কে খুন হইছে?
দবির আহমেদ।
এমপি দবির আহমেদ?
জি স্যার।
ওহ গড!
ব্যস! তারপর আর কি! সোজা গাড়ি দাবড়িয়ে চলে এলাম স্পটে। এসে দেখি আবিরের প্রাথমিক ইভেস্টিগেশন শেষ। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। আমি কাছে যেতেই ঐ বিয়ে বিষয়ক কথাটা বলে উঠলো সে।
আমি বললাম, কাহিনী কি? কিছু জেনেছিস?
সে বলল, তেমন কিছু না। জাস্ট কাল রাতের ঘটনা। প্রায় ২টা-৩টা দিকের। এমপিকে আগেই মেরে ফেলা হইছে। খুনি মে বি লাশ নিয়ে আসছিল গাড়িতে করে। আর বাড়ির দারোয়ানটাকে মেরেছে এরপরে।
হুম্মম... বাসার লোকজনের সাথে কথা বলেছিস?
নাহ। এখন যাবো। চল।
চল।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৬