somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডেবিট ক্রেডিট জীবন ও একটি ফাইল (ছোট গল্প)

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সৃজনের সহজ সরল জীবনটা কেমন যেন ডেবিট ক্রেডিটময় জীবন হয়ে গেছে। হিসাববিজ্ঞানের ক্লাস করাতে গিয়ে কিছুদিন আগে সে বিষয়টা ধরতে পেরেছে। ছাত্রদের ডেবিট ক্রেডিট বুঝাতে গিয়ে দেখলো তার পুরো জীবনটাই ডেবিট ক্রেডিটময়। হিসাববিজ্ঞানকে ব্যবসায়ের ভাষা বলা হয়। আর ডেবিট ক্রেডিট এই ভাষার প্রাণ। জীবনে প্রাণ আছে তো ডেবিট, আর প্রাণ নাইতো তা ক্রেডিট। মানুষ একটাই মাত্র সম্পদ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। সেটা হচ্ছে প্রাণ। প্রাণ চলে গেলেই সম্পদ চলে গেল। মানুষ পৃথিবী থেকে ক্রেডিট হয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তার নগদান বইয়ে পৃথিবীর হিসাবের খাতাটা একবার দেখতে ইচ্ছে করে সৃজনের। সেখানে কি হিসাবটা এরকমভাবে লেখা আছে?
মানুষ হিসাব ডেবিট
টু মৃত্যু হিসাব ক্রেডিট
(যেহেতু সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সম্পদ হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন এবং মৃত্যুর মাধ্যমে সম্পদ ফিরিয়ে নিলেন)।
হিসাববিজ্ঞানের ভাষায় যেখানেই সম্পদ আর ব্যয় সেখানেই ডেবিট ক্রেডিটের উপস্থিতি। সম্পদ যদি আসে তাহলে ডেবিট, আর যদি ব্যয়ের মাধ্যমে চলে যায় তাহলে ক্রেডিট। এই ভাবনাটা সৃজনের জীবনটাকে বেধে ফেলেছে।
বাংলাদেশে কথায় কথায় হরতাল হয়। সেদিন জামায়াতে ইসলামের হরতালে সৃজনের চোখের সামনে একটি গাড়ি ভাঙচুর হলো। সদ্য কেনা মনে হচ্ছে। আনুমানিক মূল্য ২০ লাখ টাকা হবে। কার গাড়ি কে জানে? কিন্তু দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। সৃজন মনে মনে ডেবিট ক্রেডিট মিলাতে বসে যায়। হিসাবটা হবে-
হরতাল হিসাব ডেবিট ২০,০০,০০০ টাকা
টু সম্পদ (গাড়ি) হিসাব ক্রেডিট ২০,০০,০০০ টাকা।
(যেহেতু নগদ ২০ লক্ষ টাকায় কেনা সম্পদটি হরতালের কারণে ভস্মীভূত হলো।)

এছাড়াও ভয়াবহ আরেকটি ডেবিট ক্রেডিটের হিসাব সৃজনের মাথাটাকেই পুরো খারাপ করে দিচ্ছে। পত্রিকার নিউজ আকারে এসেছে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে জামায়াত শিবির হরতাল ডেকেছে। সেই হরতালে ৩ জন পাবলিক ড্রাইভার মারা গেছেন। গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ৩ জন ড্রাইভারকে মারা হয়েছে। আচ্ছা সৃজন যদি সেদিনের হরতালে ভাঙচুর করা গাড়িতে থাকতো! তাকে যদি গান পাউডার দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো কেমন হতো হিসাবটা!
মৃত্যু হিসাব ডেবিট
টু ড্রাইভার হিসাব ক্রেডিট।
(যেহেতু মৃত্যু আসলো এবং ড্রাইভাররা চিরবিদায় নিল। )
মৃত্যুকে হিসাববিজ্ঞানের পরিভাষায় এভাবে ব্যক্ত করতে পেরে সৃজনের মনে ভাবনা হয়, আচ্ছা সৃষ্টিকর্তার চুড়ান্ত হিসাব বইতে সৃজনের মৃত্যু হিসাবটা কেমন হতে পারে!
সৃজন হিসাব ডেবিট
টু মৃত্যু হিসাব ক্রেডিট।
(যেহেতু সৃজনকে সম্পদ হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়ে মৃত্যুর মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা তাঁর সম্পদ ফিরিয়ে নিলেন।)

যদি সত্যি সত্যি সৃজন ড্রাইভার হিসাবে চিরবিদায় নিত তাহলে সরকারি ও বিরোধীদলের হিসাব বইতে কিভাবে হিসাবটা লিপিবদ্ধ হত? সরকারি দলের হিসাব বইতে নিশ্চয়ই এভাবেই লেখা হবে-
ক্ষমতার লাভ হিসাব ডেবিট
টু পাবলিক হিসাব ক্রেডিট।
(যেহেতু ক্ষমতায় থাকার লাভের জন্য বিরোধীদলের হরতালে পাবলিকের মৃত্যু হয়েছে।)
বিরোধীদলের হিসাব বইতে উঠবে-
ক্ষমতার লোভ হিসাব ডেবিট
টু পাবলিক হিসাব ক্রেডিট।
(যেহেতু সৃজন নামক জনৈক পাবলিক দলের ক্ষমতাপ্রাপ্তির লোভ বিষয়ক লাভে জীবন উতসর্গ করেছে।)

সরকারি ও বিরোধীদল উভয়ক্ষেত্রেই পাবলিক ক্রেডিট। ক্রেডিট মানেই সম্পদ চলে যাওয়া। 'পাবলিক সম্পদ' চলে গেলে রাজাদের কিবা আসে যায়! সৃজন একজন আমজনতা, সাধারণ ভাষায় পাবলিক। পাবলিকরা সবসময়ই ক্রেডিটে থাকে। সৃজন নিজের জীবনেও ক্রেডিটেই আছে। ডেবিট হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কিন্তু পারে না। এভাবে ক্রমাগত ডেবিট ক্রেডিটময় জীবনের চক্রে সৃজন হাবুডুবু খেতে থাকে। এটাই কি হিসাবচক্র? জীবনের হিসাবচক্র কোথায় গিয়ে থামবে!

যেখানেই সে যায়, যা কিছুই খরচ করে বা কিছু অপচয় হতে দেখে সেখানেই সে ডেবিট ক্রেডিটের হিসাবটা কষে ফেলে। ভার্সিটি জীবনে হিসাববিজ্ঞানের অংকে মনোযোগ আসেনি। সাবসিডিয়ারী বিষয় বলে অবহেলায় এড়িয়ে গেছে। পরীক্ষার জন্য কোনোরকমে ডেবিট ক্রেডিটের হিসাব মেলাতে চেষ্টা করেছে। পরীক্ষায় চুড়ান্ত হিসাবে ডেবিট ক্রেডিটকে কখনোই সমান করতে পারেনি। বামপাশে সম্পদ হিসেবে যা ডেবিট হবে ডানপাশে ব্যয় হিসেবে তা ক্রেডিট হবে। ডেবিট ব্যালেন্স বেশি হলে উদ্বৃত্ত আর ক্রেডিট ব্যালেন্স বেশি হলে দায়। সৃজনের ক্রেডিট ব্যালেন্সই সবসময় বেশি থাকে। জীবনের হিসাবে সৃজন কখনোই ডেবিট ব্যালেন্স বেশি দেখাতে পারে না।

ভার্সিটি জীবনে কোনটা ডেবিট, কোনটা ক্রেডিট তা মিলানোর প্রয়োজন পড়েনি। তাই চুড়ান্ত হিসাবের অঙ্কটি ভুল থেকে গেছে। বাবা প্রতিমাসেই একটা নির্দিষ্ট টাকা সৃজনের কাছে পাঠাতেন। তাতে সারা মাস ভালোভাবে চলে বেশ উদ্বৃত্তও থাকতো। ডেবিটের দিক বেশি থাকতো বিধায় ক্রেডিট বা ঘাটতির দিকে মনোযোগ দেয়া হয়নি। এখন সে নিজে চাকরি করে। সরকারি চাকরি। প্রথম শ্রেণীর মর্যাদাসম্পন্ন চাকরি হলেও বেতনে তৃতীয় শ্রেণীর। এই বেতন দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে ক্রেডিটের দিকটা বেশি থাকে। তাই ঘাটতি পোষাতে তাকে নানান চিন্তায় ডুবে থাকতে হয়।

অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। আচ্ছা এইযে দীর্ঘশ্বাসটা বের হল সেটা ডেবিট না ক্রেডিট? আচমকা এই প্রশ্নটা সৃজনের মনে নাড়া দেয়। টেবিলের উপর রাখা রাফ কাগজটায় সে হিসাব করতে বসে। এর হিসাবটা হবে-
অক্সিজেন হিসাব ডেবিট ০ টাকা
টু কার্বনডাই অক্সাইড হিসাব ক্রেডিট ০ টাকা।
(যেহেতু প্রকৃতি থেকে ০ টাকায় অক্সিজেন গ্রহণ করলাম এবং ০ টাকায় কার্বনডাই অক্সাইড ত্যাগ করলাম।)

সম্পদ যতটুকু অর্জন করলাম ততটুকু বিসর্জন দেয়া হলো। সৃজন সারাদিনে ০ টাকার অক্সিজেন গ্রহণ করেছে এবং ০ টাকার কার্বনডাই অক্সাইড ত্যাগ করেছে। তাই নগদান বইয়ের উভয় পাশ সমান থাকবে। প্রকৃতি থেকে শূন্য টাকায় অক্সিজেন গ্রহণ করে সবাই বেঁচেবর্তে আছে । আচ্ছা বিধাতা যদি নিঃশ্বাসের উপর মূল্য ধার্য করতেন তাহলে কত টাকা নিঃশ্বাস বাবদ ব্যয় হতো? অফিসে বসে এই প্রশ্নটিই আজ সারাদিন সৃজনের মাথায় ঘুরছে। কিছুদিন হলো সরকারি গুরুত্বপূর্ণ একটি দপ্তরে বদলি হয়ে এসেছে। এখন তার হাতে প্রচুর তদবিরের ফাইল।

সৃজন টেবিলের উপর রাখা ফাইলগুলো একপাশে সরিয়ে ভাবতে বসে। চরম নাস্তিকদের ভাবনায় ধরা যাক বিধাতা বলে কিছু নেই। প্রকৃতি নামে এক কর্পোরেট সংস্থা অক্সিজেন এবং কার্বনডাই অক্সাইডের ব্যবসা করে। এক ঘনফুট অক্সিজেনের মূল্য গাড়িতে ব্যবহৃত সিএনজি গ্যসের মূল্যের সমান ধরা হলো। সিএনজির বর্তমান বাজারদর এক ঘনফুট প্রায় ২৬ টাকা। একজন ব্যাক্তি প্রতিদিন ১০০০ ঘনফুট অক্সিজেন ব্যবহার করলে প্রতিদিন ২৬ হাজার টাকা ব্যয় হবে।

আবার ধরা যাক প্রকৃতির প্রয়োজনেই উক্ত ব্যক্তি কার্বনডাই অক্সাইড বিক্রয় করবে। ১০০০ ঘনফুট কার্বনডাই অক্সাইড সে অক্সিজেনের অর্ধেকদামে বিক্রয় করতে পারবে। কারণ প্রকৃতিতে কার্বনডাই অক্সাইড উৎপাদন অনুকূল। মানুষ ব্যতীত গাছ এবং জৈব আবর্জনাও কার্বনডাই অক্সাইড উৎপাদন করে। তাহলে উক্ত ব্যক্তি কার্বনডাই অক্সাইড বিক্রয় বাবদ পাচ্ছে ১৩ হাজার টাকা। অক্সিজেন ক্রয়বাবদ প্রতিদিন তার অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ১৩ হাজার টাকা। শুধু অক্সিজেন ব্যবহার বাবদ উক্ত ব্যক্তির একমাসে সর্বমোট ব্যয় ৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা।

সৃষ্টিকর্তা এ মুহূর্তে অক্সিজেনের মূল্য ধার্য না করাতে সৃজন স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে। বেতন হিসেবে সরকারি টাকা যা পাওয়া যায় তাতে পরিবার নিয়ে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকা দুষ্কর। অক্সিজেনের মূল্য পরিশোধ করতে হলে সরকারি চাকরিজীবী একেকজনকে প্রতিমাসে ৪ লাখ টাকা থেকে বেতন শুরু করতে হতো।

মোবাইলের রিংটোন টা বেজে উঠতে সৃজন বাস্তবে ফিরে আসে। আননোন নাম্বার। রিসিভ বাটনটা চেপে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে সুরেলা কণ্ঠে ভেসে আসে-
আসসালামু আলাইকুম স্যার, আপনি কি মিঃ সৃজন বলছেন?
জ্বী বলছি।
স্যার, আমি প্রকৃতি কর্পোরেট লিমিটেড থেকে ,আজরা বলছি।
কী আপনি আজরাইল বলছেন?
জ্বীনা স্যার, আমি আজরা বলছি।
আজরা মেয়েদের নাম হতে পারে। একসময় আজরা জেবিন নামে একজন স্টেজ পারফরমার যুবক হৃদয়ে ঝড় তুলেছিল। কিন্তু সৃজন প্রথমে আজরাইল ই শুনেছিল। বয়স হওয়ার সাথে সাথে শরীরের অর্গ্যানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই বোধহয় কানে ভুল শুনেছে।
স্যার আপনি কি প্রকৃতি কর্পোরেট লিমিটেডের কোনো ক্রেডিট কার্ড করিয়েছেন? যদি না করিয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে সংক্ষেপে এর সুবিধা বুঝাতে পারি।
সৃজনের কৌতুহল জাগে। একটু আগে প্রকৃতি নিয়ে কি যেনো ভাবছিল। এ নামে যে অলরেডি একটি কর্পোরেট সংস্থা গজিয়ে গেছে তা ভাবনার বাইরে ছিল। তাদের ক্রেডিট কার্ডে কি সুবিধা আছে তা জানার জন্যই সৃজন সম্মতি দেয়।
স্যার, আমাদের এই ক্রেডিট কার্ডে আপনি চল্লিশ বছর পর্যন্ত অক্সিজেন ফ্রি পাবেন। তারপর স্যার পরবর্তী দশ বছর সামান্য মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তারপরের দশ বছর একটু বাড়তি মূল্য, তারপরের দশ বছর চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরে কি মূল্য ধার্য হতে পারে? প্রশ্নটা মোবাইলের ওপ্রান্তে ছুঁড়ে দেয়।
সামান্য স্যার। প্রতিদিন মাত্র ১ পয়সা।
প্রতিদিন ১ পয়সা হলে দশ বছরে ৩৬৫০ পয়সা মানে ৩৬ টাকা পঞ্চাশ পয়সা। সৃজন এত অল্পদামে দশ বছর অক্সিজেন পাবে। পলিসিটা নেওয়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহী হয়। পঞ্চাশ থেকে ষাট বছরে কি মূল্য পলিসি আরোপিত হবে?
স্যার, সে পলিসিতে প্রতি ঘন্টায় ১ টাকা ধার্য হবে। আপনি এই দশ বছরে সর্বমোট ঘন্টা পাবেন ৮৭,৬০০ টি। আপনাকে সর্বমোট পরিশোধ করতে হবে ৮৭,৬০০ টাকা।
কৌতুহলটা ধীরে ধীরে আতঙ্কে রূপ নেয়। ৩৬ টাকা থেকে কীভাবে ধাইধাই করে ৮৭,৬০০ টাকা হয়ে গেল। আ্চ্ছা, তার পরের দশ বছর? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে সৃজন চুপ করে থাকে।
স্যার পরবর্তী দশ বছর অর্থ্যাৎ ষাট থেকে সত্তুর বছর বয়সে প্রতি সেকেন্ডে ১ টাকা মূল্য ধার্য করা হবে।
সৃজন মনে মনে হিসাব কষে চমকে উঠে। এই দশবছরে আছে ৩১ কোটি ৫৩ লক্ষ ৬০ হাজার সেকেন্ড। ১ টাকা মূল্য ধরে সর্বমোট মূল্য দাঁড়ায় সাড়ে ৩১ কোটি টাকার উপরে! ওরে বাবা! ৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হলে সৃজনকে আর্থিকভাবে সাড়ে একত্রিশ কোটি টাকা অক্সিজেন কিনতে হবে!
আর আমি যদি আপনাদের এই পলিসি না নেই? সৃজন তীর্যকভাবে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।
আপনি স্যার এই পলিসিটি নিতে বাধ্য থাকবেন। কারণ আমাদের কর্পোরেট সংস্থা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে মানুষের প্রতিটি নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসের মূল্য ধার্য করা হবে। মূল্য পরিশোধ করতে পারলে তিনি যত বছর ইচ্ছা পৃথিবীতে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারবেন।
আপনারা কীভাবে প্রতিটি মানুষের নিঃশ্বাসের মনিটরিং করবেন?
স্যার এই ন্যানো টেকনোলজীর যুগে এটা অসম্ভব কিছুই নয়। একটি অদৃশ্য ন্যানো ট্রান্সমিটার নাকের গোড়ায় বসানো থাকবে। প্রতিদিন কত ঘনফুট অক্সিজেন আপনি গ্রহণ করছেন আর কত ঘনফুট কার্বনডাই অক্সাইড আপনি ত্যাগ করছেন তা মিটারে উঠে যাবে। সে হিসাবে বিল হবে। এই যেমন আপনারা মিটার অনুযায়ী গ্যাস বিল, পানির বিল, কারেন্ট বিল ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। চল্লিশ বছর পর্যন্ত আপনাকে ফ্রি অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়েছে। পরবর্তী ১০ বছরের হিসাব অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। আপনি এখনই আমাদের পলিসিটা বুঝে নিয়ে রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়ে যান।
পলিসি রেজিস্ট্রিভুক্ত না হলে কী অসুবিধা হবে সৃজন জানতে চায়।
এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী একটি অটো মিটারে যুক্ত। সবারই অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বনডাই অক্সাইড ত্যাগের পরিমাণ মিটারে প্রদর্শিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে স্যার আমাদের মিটারে আপনার ক্রেডিটের পরিমাণ অতিরিক্ত হলে আর আপনি তা জীবদ্দশায় পরিশোধ করতে পারবেন না প্রতীয়মান হলে বিনা নোটিশেই আপনার অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।

অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে তো মারা যাওয়া। সৃজন আতঙ্কিত হয়। সত্যিই কি প্রযুক্তি এতদূর এগিয়ে গেছে। মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস মাপার প্রযুক্তি কোনো এক কর্পোরেট সংস্থা বাগিয়ে নিয়েছে। এখন সহস্র কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। মানুষ বেঁচে থাকতে হলে এই সেবাটি নিতে বাধ্য। আজরার কন্ঠস্বরটি এখন সত্যি সত্যি আজরাইলের কণ্ঠ বলেই সৃজনের ভ্রম হয়। হঠাৎ করেই মোবাইলটা ডিসকানেক্ট হয়ে যায়।

সৃজনের ভাবনাটা বাস্তবে ফিরে আসে। সরকারি চাকরিতে ৪০ হাজার টাকা বেতন সাকূল্যে। কর্পোরেট এ যুগে বিধাতার দেওয়া অক্সিজেন সে বিনামূল্যে পাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া প্রাণ সম্পদই তার সম্বল। নিঃশ্বাস নেওয়া এবং ছাড়ার মধ্যেই তার প্রাণটা সচল আছে। এখন এই নিঃশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পার্থিব রসদ প্রয়োজন। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে হলে তাকে কাজ করতে হয়। সারা মাস কাজ করে সে পায় সর্বমোট ৪০ হাজার টাকা। সংসারে সদস্য সংখ্যা ৭ জন। এই সাতজনের নিঃশ্বাস সচল রাখার দায়িত্ব সৃজনের। এর মধ্যে খাওয়ার খরচ, ফ্ল্যাট ভাড়া, বিদ্যুত, পানি, গ্যাসের বিল, যাতায়াত খরচ, আপ্যায়ন খরচ বাবদ চলে যায় ৪০ হাজার টাকা। বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ, স্ত্রীর খরচ, উটকো কিছু খরচের টাকা কোথা থেকে আসবে সে চিন্তা-ই সর্বক্ষণ মাথায় ঘোরে সৃজনের।

আবারও মোবাইলটা বেজে ওঠে। ওপ্রান্ত থেকে কিন্নরী কণ্ঠে সুরেলা আওয়াজ ভেসে আসে।

আসসালামু আলাইকুম স্যার। আপনি সৃজন বলছেন? আমি ভ্যালুয়েবল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে সুবেহা বলছি।
সুবেহা আবার কেমন নাম? সুবহে থেকে সুবেহা নাকি! হতেও পারে! আজকাল এমন কিছু আনকমন নাম দেখা যায়। এরকম আনকমন নাম সৃজনের ভালোই লাগে। এই যেমন সৃজনের নামটাও আনকমন। মা রেখেছে এই নামটা। বড় হয়ে সু-জন হবে, এজন্য বাবা রাখতে চেয়েছিলেন সুজন। মা সৃজন করেছেন। ভেবেছিলেন বোধহয় ছেলে বড় হয়ে সৃজনশীল হবে। বাবা আর আপত্তি করেননি। স্রেফ সৃজন। নামের আগে পরে কিছু নেই। সৃজন বড় হয়ে ভেবেছিল নামের পাশে একটা পদবি থাকলে ভালো হতো। সৃজন চৌধুরী। বেশ ভারিক্কী হতো নামটা। কিন্তু সৃজনরা মিয়া বংশের। সৃজন মিয়া কথাটা কেমন শোনায়! তাই মা স্কুলে শুধু সৃজন ই দিয়েছেন।

এখন যে মেয়েটি ফোন করেছে সে আগের কোম্পানির নয়। মোবাইলটা ডিসকানেক্ট হয়ে যাওয়ার পর সৃজন ফোনটা আবার আশা করেছিল। প্রকৃতি কর্পোরেট আর কি চমক নিয়ে বাজারে এসেছে তা জানার কৌতুহলটা রয়েই গেছে। বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার কল সেন্টারের মেয়েদের যান্ত্রিক কণ্টস্বর সৃজনের চেনা হয়ে গিয়েছে। সুবহে কে শুধুই সুবেহা নাকি নামের সাথে আর কোনো পদবী আছে। সৃজনের জানতে কৌতুহল হয়।

আচ্ছা আপনি কি শুধুই সুবেহা? সৃজন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় মোবাইলের ও প্রান্তে।

জ্বী স্যার, আমি শুধুই সুবেহা। আমি কি স্যার আপনাকে আমাদের ভ্যালুয়েবল বীমা কোম্পানির পলিসিটা সংক্ষেপে বুঝাতে পারি? বিনীত কণ্ঠে ওপাশ থেকে জানতে চায়।

ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীগুলোকে সৃজন একটু ভয় পায়। কয়েক বছর আগে ইন্স্যুরেন্সের এক ফিল্ড সুপারভাইজারের পাল্লায় পড়ে একটি পলিসি খুলে ফেলেছিল আরকি! প্রতিমাসে ৫,০০০ টাকা প্রিমিয়াম জমা দিলে মৃত্যুর পর সৃজনের পরিবার ১০ লক্ষ টাকা পাবে। সৃজন মারা গেলে এই ১০ লক্ষ টাকা স্ত্রী সন্তানরা ভাগবাটোয়ারা করে নিবে। সৃজনের ভাবনায় আসে তার কী লাভ হবে? আচ্ছা ধরা যাক সৃজনের মৃত্যুর বিনিময়ে সৃজনের পরিবারে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকার নগদ আগমন ঘটল। পরিবারে হিসাবটা হবে-
নগদান হিসাব ডেবিট ১০,০০,০০০ টাকা
টু চিরবিদায় হিসাব ক্রেডিট ১০,০০,০০০ টাকা
সৃজন চিরবিদায় নিয়ে পৃথিবী থেকে ক্রেডিট হয়ে যাবে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা দু’চারদিন কাঁদবে। তারপর সৃজনের কোথায় কোথায় সম্পদ আছে তা হিসেব-নিকেশ করবে। তাদের জীবনে আবার ডেবিট ক্রেডিটের চক্র চলতে থাকবে।

ঠিক আছে, আপনাদের পলিসিটা বুঝান। সৃজনের কন্ঠে কৌতুহল।

স্যার, আমাদের পলিসিটা অতি সংক্ষিপ্ত। আপনি প্রতিমাসে ভ্যালুয়েবল বীমা কোম্পানিতে ফিক্সড ৫,০০০ টাকা মূলধন সংস্থান করলে ১০ বছর পর আপনি ১০ লাখ টাকা মূলধন ফেরত পাবেন। এর মধ্যে আপনি মারা গেলেও আপনার পরিবার পুরো মূলধন ফেরত পাবে। আর দুই বছর পর থেকে যদি আপনি মুনাফা পেতে চান আমাদের পলিসিতে সে ব্যবস্থাও আছে।

আমি আপনাদের মূলধন সংস্থান করবো কেন? আপনারা তো মূলধন নিয়েই ব্যবসায় নেমেছেন। সামান্য কিছু মূলধন বিনিয়োগ করে জনগণের হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছেন। জনগণ আপনাদের প্রিমিয়াম নামক ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়। প্রিমিয়ামের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পুরো হিসাব বাজেয়াপ্ত হয়। বছরের পর বছর টাকা পরিশোধিত হয় না। সৃজনের কণ্ঠে কিছুটা উষ্মা ঝরে।

স্যার, আমাদের পলিসিটা একটু ভিন্ন ধরনের। আপনি মূলধন যোগান দিবেন। দুই বছর পর থেকে প্রতিমাসে আপনার মূলধন বিনিয়োগের লাভ পাবেন। ধরুন, আপনি প্রতিমাসে আমাদের কোম্পানির একটি শেয়ার কিনলেন যার মূল্য ৫,০০০ টাকা। বছরে ৬০,০০০ টাকার শেয়ার। দুই বছরে ১ লাখ ২০ হাজার। ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে আপনি ব্যবসায় করলে মাসে কত টাকা আয় হবে বলে আপনার ধারনা?

এই ধরুন, টোয়েন্টি থেকে থার্টি পারসেন্ট। সৃজন জবাব দেয়।

সেই হিসেবে ২,৪০০ থেকে ৩,৬০০ টাকা। আপনি দুই বছর পর থেকে প্রতিমাসে তা নিয়মিত পাবেন। আপনার অফিসের বেতনের ব্যাংক হিসেবেই তা চলে যাবে। মূলধন প্রতিমাসে যত বাড়বে আপনার মুনাফাও আনুপাতিক হারে বাড়বে। আপনার বেতনের সাথে তা যোগ হতে থাকবে। ধরে নিন এটা আপনার বেতনেরই অংশ। আপনি কর্মক্ষম থাকতেই মূলধন বিনিয়োগে বেতন হিসেবে লাভ পেতে থাকবেন। আপনার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। অনেকটা আস্থার সুরে বলে সুবেহা।

মেয়েটির এই মার্কেটিং পলিসিকে সৃজন মনে মনে সাধুবাদ জানায়। মার্কেটিংয়ের পরিভাষায় এটাকে পার্সোন্যাল মার্কেটিং বলে। বাংলা করলে ব্যাক্তিক বাজারজাতকরণ। সুবেহা নিজেকে উপস্থাপন করছে কর্পোরেট ভাষায়। তবে বিষয়টি সে স্বচ্ছভাবে বুঝাতে পেরেছে। এখন হাতে কাগজপত্র পেলে ভালো করে বুঝে দেখবে।

সুবেহা বেশ স্মার্টলি বলে স্যার, আমি আশা করি কিছুটা আপনাকে বুঝাতে পেরেছি। আপনার কর্মক্ষেত্র অথবা বাসস্থানের লোকেশনটা দিলে আমাদের মার্কেটিং অফিসার আপনার ওখানে গিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আসবে। আপনি আমাদের ডকুমেন্টস পড়ে শর্তাবলি বুঝে আমাদের পলিসি গ্রহণ করতে পারেন আবার বর্জনও করতে পারবেন।
সৃজন মনে মনে হিসাব কষতে থাকে। দুই বছর পর মূলধনের লাভ পেতে থাকবে। সময়টা বেশি নয়। কিন্তু যদি লাভ না দেয়? আজকাল মাল্টিপারপাস নামে ভুয়া কিছু ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে ২০%-৩০% তথা বছরে ২৪০%-৩৬০% লাভের লোভ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আমানত নিয়ে আত্মগোপন করছে। লোভী জনগণ সব হারিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছে। অতি লোভের ফাঁদে পড়ে সব হারাচ্ছে। দেখার এযন কেউ নেই। দেখা যাক এদের পলিসিটা কেমন হয়।
সৃজন ঠিকানা বলে। সুবেহা তা নোট করে নেয়। কিছুক্ষণ পরই অফিসে এক সুদর্শন তরুণ এসে হাজির হয়। হাতে দুইটি কাগজ। একটা সার্টিফিকেটের মতো। তাতে নাম ঠিকানার ঘর, শেয়ার মূল্য ৫০০০ টাকা লেখা। শেয়ার ক্রয়ের তারিখের ঠিক পরবর্তী মাস থেকে কি হারে লভ্যাংশ পাওয়া হবে তার একটি ছক। নমিনির নামের ঘর আছে। সৃজন একনজর চোখ বুলিয়ে পলিসিটা বুঝে নেয়। সেদিনই একটি পলিসি খুলে ফেলে। সরকারি বেতন থেকে মাসে বাড়তি খরচ যোগ হলো ৫,০০০ টাকা।
পলিসি হিসাব ডেবিট ৫,০০০ টাকা
টু নগদান হিসাব ক্রেডিট।
(যেহেতু নগদ ৫,০০০ টাকা শেয়ার/পলিসি ক্রয় বাবদ ব্যয় হয়েছে।)

সৃজনের ডেবিট ক্রেডিটের পোকাটা স্থায়ীভাবে আসন গেড়েছে কুইক ক্যাপিটাল ব্যাংক থেকে একটি ফোন আসার পর। ব্যাংক থেকে একটি ক্রেডিট কার্ড করা হয়েছিল অনেক আগে। ব্যাংক কোম্পানি অনেকটা যেচে এসে কার্ড ধরিয়ে দিয়েছিল। ৫ লক্ষ টাকা ইচ্ছামত ব্যয় করা যাবে। প্রতিমাসে বেতনের অর্থ থেকে কিস্তিতে কিস্তিতে কেটে নেবে। এই টাকাটা একটা বাড়তি বোঝা সৃজনের জন্য। বেতনের টাকা থেকে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গায়ে লাগে। পরিবারের হিসাবটা এলোমেলো হয়ে যায়। বাস্তব জীবনে এখন প্রতিমুহূর্তে হিসাব মিলিয়ে চলতে হয়। ডেবিট দিক বেশি হলে উদ্বৃত্ত থাকে। কোনোমাসেই সৃজনের ডেবিট দিক বেশি হয় না। ক্রেডিট দিকটা বেশি থাকে। ফলে দায় থেকেই যায়।

ব্যাংকে কিস্তি পরিশোধের তাগাদা থেকে সৃজনের মাথায় ডেবিট এবং ক্রেডিট চরকির মত ঘুরতে থাকে। বেতন পেয়ে মাসের বাজার খরচ হয়েছে নগদ ১০,০০০ টাকা। কুইক মার্কেট কোম্পানি থেকে ফোন এসেছে। ফোনে ফোনেই বাজার সেরে ফেল সৃজন। সেখানে বেতন থেকে পরিশোধ করতে হয়েছে নগদ ১৫ হাজার টাকা।

কুইক বাজার কোম্পানির কাস্টমার ম্যানেজার জিসানের কথায় গলে গিয়ে ঘরে অফিসে বাজারের কাজটা সেরে ফেলেছে।
স্যার, আমি কুইক বাজার থেকে জিসান বলছি। আপনি যদি ঘরে বসে নিত্যদিনের বাজার পেতে চান তাহলে আমাদের পলিসিটা নিতে পারেন। সৃজন তাদের বাজার পলিসিটা জানার জন্য সম্মতি দেয়।
স্যার, যদি কিছু মনে না করেন একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
হুঁ, করুন।
স্যার, আপনার পরিবারের সদস্য সংখ্যা কতজন?
সাতজন।
স্যার, আপনার পরিবারে মাসিক কতটাকা খরচ হয় বাজার বাবদ?
১৫,০০০ টাকা আনুমানিক।
ঠিক আছে স্যার। আমরা ১৫,০০০ টাকায় আপনার পরিবারের পুরো বাজার বহন করবো। আপনার পরিবারে কি কি সদাইপাতি এবং কাঁচা বাজার লাগবে তা আমাদের জানিয়ে দেবেন আমরা ঠিক ঠিক তা পৌঁছে দেবো।
স্যার, আপনি কি এখন অফিসে আছেন? আপনি চাইলে আপনার অফিসে এসে আমাদের পলিসিটা আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারি। সাথে ডকুমেন্টও নিয়ে আসবো।
সৃজনের কাছে কৌতুহলই লাগে। নতুন একটি পলিসি। দেখা যাক স্টাডি করে। ঠিক আছে, চলে আসুন বলেই কর্মস্থলের ঠিকানা বলে।


সৃজন মোবাইলটা রেখে ডেবিট ক্রেডিট নিয়ে আবারও ভাবতে বসে। মাসের ৫ তারিখ বেতনটা সৃজনের ব্যাংকে জমা হয়।
বেতন হিসাব ডেবিট ৪০,০০০ টাকা
টু ব্যাংক হিসাব ক্রেডিট।
(যেহেতু বেতন হিসাবে ৪০,০০০ টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে।)
সৃজনের বেতনের নগদান বইতে লিখা হবে-
নগদান হিসাব ডেবিট ৪০,০০০ টাকা
টু সৃজনের বেতন হিসাব ক্রেডিট ৪০,০০০ টাকা।
(যেহেতু ব্যাংক থেকে পুরো টাকাটা তুলে সংসারের কাজে খরচ করে ফেলা হয়েছে।)
নগদে টাকাটা এসেছে নগদেই খরচ করে ফেলতে হলো এ মাসে। সারাটা মাস পড়ে রয়েছে। এখনও ঘর ভাড়া বাকি। সেগুন বাগিচা এক আধুনিক ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকা। ষোলশ’ বর্গ ফিট। ভাড়া ২২,০০০ টাকা। গ্যাস, কারেন্ট, পানি, পয়োঃ নিষ্কাশন, নিরাপত্তা এগুলো বাবদ পঁচিশ হাজার টাকা পড়ে যায়। মাসের ১০ তারিখ ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে গেলে হিসাবটা কিরকম হবে। সৃজন ভাবতে থাকে। ফ্ল্যাট ভাড়া হিসাব ডেবিট ২২,০০০ টাকা টু নগদান হিসাব ক্রেডিট ২২,০০০ টাকা। কী সব ডেবিট ক্রেডিটের যন্ত্রণা মাথায় চাপল! সৃজন মাথা থেকে হিসাব ঝেড়ে ফেলতে চায়। এমন সময় অফিস পিয়ন এসে জানায় একজন তরুণ সাক্ষাতপ্রার্থী। নিশ্চয়ই কুইক বাজার থেকে জিসান এসেছে।
ছেলেটি বেশ চৌকষ এবং সপ্রতিভ। মাত্র ১৫ মিনিট বুঝিয়ে মাসে ১৫,০০০ টাকার বাজার সদাই করার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। তাজা শাকসবজি, তাজা মাছ, দুধ, ডিম, ফল-ফলাদি কিনতে সৃজনকে আর সময় বের করার চিন্তা করতে হবে না। স্রেফ মোবাইলেই লিস্ট পাঠিয়ে দেবে আর বাসায় টাটকা জিনিসপত্র চলে যাবে। বাজার-সদাই বাসায় পৌঁছার পর বিল পেমেন্ট। বেতনের হিসাব থেকেই তা পরিশোধ করা যাবে। বাজারটা কেউ করে দিলে সৃজন সময়টা অন্য কাজে বিনিয়োগ করতে পারে। সেই বিনিয়োগ থেকে বাড়তি আয় হবে। সেই আয় বাড়তি ব্যয় মেটাতে ব্যবহৃত হবে। সৃজন একটি পলিসি খুলে ফেলে।

কুইক বাজার কোম্পানির মার্কেটিং পার্সোন্যাল জিসান চলে যাওয়ার পর সৃজনের মনে ভাবনা আসে প্রতারণার ফাঁদে পা দিল নাতো! আজকাল চারিদিকে প্রতারণা। যদি প্রতিদিন চাহিদামত বাসায় কাঁচা বাজার পাঠানো সম্ভব না হয়। অথবা যদি পঁচা বাসী শাক-সবজি, মাছ-মাংস দেয়? ফেরত দেওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করা হয়নি। মনটা খচখচ করতে থাকে। স্ত্রীর কাছে জেনে নিতে হবে। সবকিছু ঠিক আছে কিনা। ঠিক না থাকলে পেমেন্ট করা হবে না।

স্যার আমি স্ট্যান্ডার্ড ক্যাপিটাল ব্যাংক থেকে বলছি। আপনার কি আমাদের ব্যাংকে কোনো ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড আছে?
না নেই।
তাহলে স্যার আমাদের ব্যাংক আপনাকে নগদ ২০ লক্ষ টাকা মূলধন সুবিধা অফার করছে। আপনার বেতন থেকে প্রতিমাসে সমন্বয় করে নেওয়া হবে।
ব্যাংক আমাকে ২০ লক্ষ টাকা মূলধনও দেবে? ওয়াও! তাও যেচে! আরেকটু বাজিয়ে দেখার জন্য সৃজন পাল্টা প্লশ্ন ছুঁড়ে দেয়। আমি তো চাকরি করি, ব্যবসা করি না। ব্যাংক আমাকে মূলধন দেবে কেন?
স্যার আমাদের ব্যাংকের পলিসি হচ্ছে ঋণ নয়, মূলধন। চাই সে চাকরিজীবী ব্যবসায়ী, অন্য পেশাজীবী যাই হোক। তার প্রয়োজনে তাকে আমরা মূলধন সরবরাহ করবো।
তাই নাকি! তো এই মূলধনের কি সুদ নিবেন না? প্রতিমাসে সুদের হার কত?
স্যার, আমরা সুদ নেব না তবে মূলধন ব্যয় শেয়ার করবো। আপনাকে আমাদের ব্যাংক যে মূলধন সরবরাহ করবে তার একটা সুযোগ ব্যয় আছে। আপনি এ সুযোগ ব্যবহার করে কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারেন। কিংবা যাতায়াতের সুবিধার জন্য একটি গাড়ি কিনতে পারেন। এমনকি পুরো টাকাটা আপনার পরিবারের পেছনে ব্যয় করে লাভবান হতে পারেন।
স্যার, এই টাকাটা আপনার পরিবারের জরুরী কোনো প্রয়োজন মেটাতে কাজে লাগতে পারে। হতে পারে আপনার সন্তানের ভালো কোনো স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য খরচ লাগবে। হতে পারে আপনার বৃদ্ধ বাবা-মা’র জন্য সুচিকিৎসার জন্য নগদ টাকার প্রয়োজন।
সৃজন মনোযোগ দিয়ে অপর প্রান্তের কথা শুনে। মাথার মধ্যে ডেবিট ক্রেডিটের কথা ঘুরতে থাকে। সৃজন ঋণ নিলে সৃজনের হিসাবে হবে- নগদান হিসাব ডেবিট ২০,০০,০০০ টাকা
টু ঋণ হিসাব ক্রেডিট ২০,০০,০০০ টাকা
আচ্ছা ২০ লাখ টাকা মূলধন সংস্থান করে আপনারা কিভাবে তা ফেরত নেবেন? স্পষ্ট করেই সৃজন জানতে চায়।
স্যার দুই বৎসর পর থেকে প্রতিমাসে আপনার বেতন হিসাবে এ টাকা ক্রেডিট হবে। আমাদের ব্যাংক হিসাবে ডেবিট হবে। দুই বছর সময় আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হবে। কারণ আপনি তো ঐ পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে দুই বছরের আগে মুনাফার মুখ দেখবেন না। তাই গ্রেস পিরিয়ড আমরা দুই বছর করেছি। দুই বছর পর থেকে আমরা আপনার কাছ থেকে কিস্তিতে মূলধনের টাকা ফেরত নেবো।

ছেলেটি সৃজনকে ভাবনার খোরাক যোগায়। এই মুহূর্তে ২০ লক্ষ টাকা পেলে সৃজন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে। ২০ লাখ টাকা ঋণে আছে সৃজন। এই টাকাটা যোগানের জন্য বৈধ অবৈধ সব পথেই সৃজন মাথা খাটিয়ে চলছে। ব্যাংক থেকে এরকম মূলধন পেলে ঋণ পরিশোধ করে আবার সে ঘুরে দাঁড়াবে। ডেবিট ক্রেডিটের হিসাবটা এ মুহূর্তে সমান হয়ে যাবে দুই বছরের জন্য।

নাহ্! নতুন একটি ফাইল এসেছে। এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। কমপক্ষে ফ্ল্যাট ভাড়ার ২৫ হাজার টাকা এ ফাইল থেকে নগদ নারায়ণ হিসেবে নিতে হবে। নতুবা ফ্ল্যাট ভাড়ার হিসাব মেলানো যাবে না। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ উঠাতে হলে নতুন আরেকটি ফাইলের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শুধু ক্রেডিটের দিক উদ্বৃত্ত থাকবে তা হতে দেওয়া যায় না। এখন ডেবিট দিক উদ্বৃত্ত করতে হবে। সৃষ্টিকর্তার অক্সিজেনের মূল্য সে একজীবনে পরিশোধ করতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তার কাছে আজীবন ক্রেডিটেই থাকতে হবে। কিন্তু পরিবারের কাছে আর সে ক্রেডিটে থাকতে চায় না। সৃজন নিবিড়ভাবে ফাইলে মনোনিবেশ করে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৩৬
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×