somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বিএম বরকতউল্লাহ
পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

বিবেকের ছায়া

৩০ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মা-বাবা আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলেন ’ধনু’। সেই ধনু এখন বড় হয়েছে; তার সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে তার নামটিও। ’ধনু’ হয়ে গেছে ’ধনুডাকাত’। এখন ’ধনু’ নামে তাকে কেউ চেনে না, ’ধনুডাকাত’ নামে তার বিস্তর পরিচিতি।
ধনু ডাকাতের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাতে কী! তার যেমন গায়ের শক্তি তেমনি দুঃসাহস। শরীর তার একটুও ভাঙ্গেনি, হিংস্রতাও কমেনি, দুটি চোখ জবা ফুলের মত লাল। তাকে দেখলে মনে এক ধরনের ভয় জেগে ওঠে।
নিজের এলাকায় বা গ্রামে ডাকাতি করার বদনাম ধনু ডাকাতের নেই। তার এলাকায় চুরি ডাকাতি হয় না। লোকের ধারনা ধনু ডাকাতের ভয়ে এই এলাকায় চোর-ডাকাত ঢুকতে পারে না। এদিক থেকে এলাকার লোকজন খুব নিরাপদে আছে। লোকেরা বলে, ধনু অভাবের তাড়নায় ডাকাতি করে না-স্বভাবদোষে করে। ধনু ডাকাতকে অনেকেই ভয় পায় ও সমীহ করে।

একরাতে ডাকাতি করে বাড়ি ফিরছিল ধনু ডাকাত। নীরব-নিস্তব্দ গভীর রাত। পথের দু‘পাশে ছোট বড় নানা জাতের গাছ, মাঝেমধ্যে লতাপাতার কুন্ডলী। তার কাঁধে একটা ঝোলা। কোমরে গামছা বাধা। মুখে বিড়ি। ধুমছে ধুয়া ছেড়ে ভয়হীন ধনু ডাকাত হেঁটে চলেছে।
ধনু ডাকাতের মনে হল, কিছু একটা তার পিছু নিয়েছে, তার পায়ে পায়ে হাঁটছে। কিন্তু ভয় পেল না সে।
কে? আমার গায়ে গায়ে হাঁটছিস! কী চাস? কী, কিছুই বলছিস না যে! কথা কস না কে? তুই বোবা না কালা? হেহ্? কোন সাড়া না পেয়ে রাগের চোটে পেছনে ঘাড় ফিরিয়েই থ হয়ে গেল দুর্ধর্ষ ধনু ডাকাত।

একটি ছায়া! অবিকল তার আকৃতির ছায়াটি তার সামনে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া তো হয় কালো কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা একটা ছায়া। ধনু ডাকাত যা বলছে, যা করছে, সাদা ছায়াটিও তাই বলছে-করছে। ধনুর চক্ষু ছানাবড়া।

ধনু ডাকাত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটতে লাগল। পেছনে তাকাল না, আড়চোখে দেখল ছায়াটি আগের মতই তাকে অনুসরণ করছে। এই নির্জন রাতে একজন মানুষ আর একটি সাদাছায়া লাগালাগি করে হাঁটছে। রা-শব্দ নেই। শুধু হনহনিয়ে হাঁটা। কি মুশকিল!
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল অসম্ভব রাগী ধনু ডাকাত। রাগে গজগজ করছে সে। গভীর রাতে চলাফেরা করে তার অভ্যেস। রাতে-বিরাতে চলতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে ভ‚ত-পেরেতের সাক্ষাৎ পেলেও থোরাই কেয়ার করে সে। কিন্তু এমন ছায়ারহস্যের মধ্যে পড়েনি কোনোদিন। সে আজ একটু বেকায়দায়ই পড়ে গেল। কিন্তু ধনু ডাকাত তো সহজে ভয় পাওয়ার লোক নয়। ধনু পেছনে না ফিরেই ভারী গলায় বলল,
‘তুই কে রে! কী চাস বল? আমার গায়ে গায়ে হাঁটবিনা বলে দিলাম, আমাকে চিনস না। বাড়াবাড়ি করলে তোর চ্যাপ্টা ভুড়িখান ফাটিয়ে দেব।‘ ছায়াটি কোনো জবাব দিল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ধনু আবারও হাঁটতে লাগল। দ্রুত। ছায়াটিও হাঁটছে তার সাথে। ভারী ঝামেলা তো! রাগে আগুন জ্বলছে তার গায়ে। যাকে দেখলে সবাই ভয় পায়, সমীহ করে রাস্তা ছেড়ে দেয়, এলাকাতে যার দুঃসাহসিক অনেক ঘটনা-রটনা আছে, তার সাথে এ রকম নির্জলা মস্করা! কিছুতেই মানতে পারছে না ধনু ডাকাত। সটান দাঁড়িয়ে গেল সে। দাঁড়িয়ে গেল ছায়াটিও। এবার দু’জন মুখোমুখি হলো।
-কে তুই. কি চাস? ক।
-আমি আপনার বিবেক। আমি এইমাত্র আপনার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছি। আপনার ভেতরে আর থাকতে পারছি না আমি।
-তুই আমার বিবেক? তুই এখানে কী করস? তুই থাকবি গিয়া আমার মনের ভিতরে। বাইরে কী করস তুই? বিবেক ছাড়া মানুষ চলে কীভাবে? বলল ধনু।
-না, আপনি বিবেক ছাড়া মানুষ নন। আপনার ভেতরে রয়েছে আরেকটা বিবেক। অতি দুষ্ট ও বদ বিবেক। আমি তার অসৎ কর্মকান্ডে ত্যক্ত-বিরক্ত। সে আপনাকে বশ মানিয়ে আপনার ভেতরে অর্জন করেছে প্রবল শক্তি-সামর্থ। আপনাকে সে ভুলপথে পরিচালিত করছে প্রতিনিয়ত। তার কথায় আপনি চলছেন-বলছেন আর ভয়ঙ্কর সব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। আমার কোনো কথাই শুনছেন না আপনি। তাই আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমি আপনাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে চাই। হয় আপনি আমার কথামত চলবেন, নয় আমি আপনাকে চিরতরে ত্যাগ করে চলে যাব?

ধনু ডাকাত চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে বিস্ময়ে সরলভাবে তাকিয়ে রইল তার সামনে দন্ডায়মান বিবেকের দিকে। কী বলবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কাঁধের গাটরিটা নামিয়ে রাস্তার ধারে একটা পুরনো গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল সে। ছায়াটিও তার সাথে গিয়ে সামনা সামনি দাঁড়াল।

ধনু ডাকাতের পেশা ডাকাতি। সে এইমাত্র ডাকাতি করে এসেছে। তার তিরিক্ষি মেজাজ আরো তিরিক্ষি হচেছ। ধনু ডাকাত একটা বোতল বের করে মুখে দিতেই ছায়াটি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল বোতলটি। মনা মেজাজ খারাপ করে তাকাল ছায়াটির দিকে। কিছুই বলল না। তারপর সে কোঁচর থেকে বিড়ি বের করে মুখে দিল। দেশলাই থেকে একটা কাঠি বের করে বিড়িতে আগুন দিতেই ফুস করে উড়ে গেল বিড়িটা। ধনু রাগে আগুন হয়ে গেল। সে কোনো কথা না বলে কটি থেকে বের করল একটা ছুরি। অন্ধকারে ছুরিটি কেমন ঝিলিক দিয়ে উঠল। ধনু ডাকাত ছুরিটি নাড়াচাড়া করে ছায়াটিকে দেখিয়ে বলল,
এটা কি তুই চিনস?
চিনি, এটা একটা ছুরি, জবাব দিল ছায়াটি।
ধনু বলল, এটা দিয়ে কী করি জানস?
আলবৎ জানি, ছায়াটি বলল।
যদি জানস তো কোন সাহসে আমার সামনে এখনও দাঁড়িয়ে আছিস। আমি এই ছুরি দিয়ে তোকে চাক চাক করে ফেলব। তুই ভাগ এখান থেকে।
ছায়াটি শরীর ঝাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আপনি এসব কাজে এতই ওস্তাদ যে, যদি সত্যি আমাকে চাক চাক করতে পারতেন, এতক্ষনে করে ফেলতেন, একটুও দেরি করতেন না। পারেন না, তাই করেন না।
এ কথা শুনে ধনু অপমানবোধ করল। সে রাগে কাঁপতে লাগল। কোনো কথা না বলে আচমকা ছুরিটা ফস করে ঢুকিয়ে দিল ছায়াটির পেটে। কিন্তু ছায়াটি দিব্যি দাঁড়িয়ে রইল আগের মত। একটু নড়া-চড়াও করল না।
একি! ধনু দু‘চোখ বন্ধ করে অন্ধভাবে কচুকাটা শুরু করে দিল। সে ভাবছে এতক্ষণে ছায়াটি কেটেকুটে চাকচাক হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। ধনু হাঁপাতে লাগল। সে চোখ খুলে দেখে ছায়াটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আগের মতই হাসছে। ধনু রাগে অস্থির হয়ে হাতে পায়ে কিল ঘুষি আর লাত্থি-গুঁতো মারা শুরু করে দিল ছায়াটিকে। ছায়াটি দাঁড়িয়ে আছে একদম স্বাভাবিকভাবে।

ক্লান্ত-শ্রান্ত ধনু ডাকাত গাছতলায় বসে হাঁপাতে হাঁপাতে ছায়াটিকে বলল, মস্করা করস, নাহ্? গাছের ডালা ভেঙ্গে তোর পিঠে ভাঙ্গবো । রাখ, একটু রেষ্ট নিয়া লই। আমার মাথায় চেলচেল করে রক্ত উঠছে। তোর দফা রফা করে ছাড়ব না আমি। তুই ধনুকে চিনস, মাগার এখনও ধনুডাকাতকে চিনস না। এবার বুঝবি।

সামনে দাঁড়িয়ে সাদাছায়াটি সরলভাবে বলল, এ জীবনে আপনি কয়টি ভালো আর কয়টি খারাপ কাজ করেছেন, আপনার নির্মমতা কত মানুষের জীবনে কত দুঃখ-যন্ত্রণার কারণ হয়ে আছে, কত কান্না, কত হাহাকার কত অশ্র“ ঝরিয়েছেন আর কত মানুষের অভিশাপ বয়ে চলেছেন আপনি। একটু ভেবে দেখেন তো ওসব কি আপনার বেঁচে থাকার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল? বেঁচে থাকার জন্য কি এরচেয়ে ভালো কোনো পথ নেই? তবে কেন মানুষ হয়ে পশুর মতো কাজ করে এভাবে মানুষের অভিশাপ নিয়ে চলেছেন আপনি? বলুন, জবাব দিন।

ধনুডাকাত ঝিম মেরে বসে রইল। তার দু‘চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তার হাতে নির্মমভাবে আহত-নিহত হওয়া ও লুটপাটের সময় মানুষের আহাজারির করুন চিত্র বিচিত্রভাবে ভেসে উঠল। তার দু‘চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তার সমস্ত শরীর ঘেমে সয়লাব।
প্রচন্ড বেগে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধনু। মনে হলো তার শ্বাসের সাথে একটা দানব বেরিয়ে গেল। মনাডাকাত উঠে দাঁড়ালো এবং হঠাৎ করে ছায়াটিকে ঝাপটে ধরে আলিঙ্গন করতে লাগল। পরে সে সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে গেল।

তারপর ধনুডাকাতকে আর রাতের অন্ধকারে ঘরের বাইরে কদম ফেলতে দেখা যায়নি।


সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:২০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×