somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাহানারা ইমাম ও যুদ্ধাপরাধী মাওলানা মান্নান যখন একই শিক্ষা কমিশনের সদস্য!

০৩ রা জুন, ২০০৯ রাত ১০:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুক্তিযোদ্ধা রুমী, তাকে ও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বীরত্ব কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। এখানে আমার লেখার উদ্দেশ্য তার মা জাহানারা ইমাম কে নিয়ে। ১৯৭২-৭৫ সালে জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের দ্বাবী করেছেন বলে অন্তত আমার জানা নেই। তারপর শহীদ জিয়ার আমলে গঠিত শিক্ষা কমিশনে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ইনকিলাব পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মান্নানের সাথে জাহানারা ইমামও ছিলেন একজন সদস্য। জাহানারা ইমামের নিশ্চয় জানা ছিল মান্নান শহীদ মুনীর চৌধুরীর ঘাতক এবং তাকে(জা .ই) ঐ কমিশনে সদস্য হতে জিয়া বা তার সরকার হতে বাধ্য করেছিলেন এমন কোন প্রমাণও নেই। তথাপি বাংলাদেশের বিরোধীতাকারী এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর সাথে একই কমিশনে যূক্ত হলেন? তারপর ১৯৮২-৯০ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়া এবং জামাত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে একটি কথাও বলেন নি জাহানারা ইমাম। কিন্তু ১৯৯১ সালে এমন কি হল যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্বাবী সহ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দ্বাবী জানালেন? কারণ একটাই যেহেতু ১৯৯১ সালে বিএনপি কে জামাত সরকার গঠনে সমর্থন দেয় তাই আলীগের প্রয়োজনে ও ঐ দলের ক্ষমতার স্বার্থে তিনি গঠন করলেন ঘাদানিক যা মূলত আলীগের নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত তাদেরই উপদল। বর্তমানে যার নব সংস্করণ হচ্ছে সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই বিএনপি ও জামাত জোট করে আর কোনদিন ক্ষমতায় যেতে না পারে তাই এই ঘৃণ্য কৌশল। আলীগ ভাল ভাবেই জানে মুজিবের যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সৈন্যদের ছেড়ে এবং জিয়ার দালাল আইন রহিত করার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি পরিত্যাক্ত হয়ে গেছে। তাই ৫ মাস হয়ে গেল বিশেষ করে হাসিনার সৌদি আরব সফরের পর মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে ভয়ানক ভাবে চুপচাপ। নির্বাচনের আগে যেমন এই নিয়ে প্রতিদিন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর দেখতাম এখন তা আর চোখেই পড়ে না। সে যাই হৌক আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহেব এ নিয়ে চমৎকার ও মূল্যবান আর্টিকেল লিখেন দৈনিক প্রথম আলোতে(১৩ই নভেম্বর ২০০৭ইং)। উনি জাহানারা ইমামের এমন অদ্ভুত ও রহস্যপূর্ণ আচরণের খুব সামান্যই তুলে ধরেছেন, যা আমি আরো কিছু ব্যাখ্যা করলাম মাত্র। ব্লগারদের উনার আর্টিকেলটি পড়ার জন্য অনুরোধ রইল!

********************************
********************************

সহজিয়া কড়চা
সৈয়দ আবুল মকসুদ
বর্তমান বাস্তবতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি


সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়-কথাটি বাঙালির নয়, এটি ইউরোপ থেকে এসেছেঃ আ স্টিচ ইন টাইম সেভ্‌স নাইন। বাংলা প্রবাদ হওয়া উচিত ছিলঃ সময়ে একটি ফোঁড়ও নয়, কিন্তু অসময়ে হাজার ফোঁড়। কথাটি মনে হচ্ছে কয়েক দিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ধর্মপন্থী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দাবিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে। আরেকটি প্রবচনের কথা বাঙালি একেবারেই বিবেচনায় আনতে চায় না, তা হলোঃ ভাবিয়া করিয়ো কাজ করিয়া ভাবিয়ো না। এটিও বহিরাগতঃ লুক বিফোর ইউ লিপ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এমন সব মানুষ কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন, তাতে মন হচ্ছে যেকোনো দিন গোলাম আযমও এ দাবিতে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেবেন।
যুদ্ধাপরাধী ও রাষ্ট্রবিরোধীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য। পরাজিত পক্ষ আত্মসমর্থন করলে যুদ্ধবন্দী হয়। সব যুদ্ধবন্দী যুদ্ধাপরাধী নয়। যুদ্ধবন্দীরা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী মানবিক আচরণ পায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয় অথবা ক্ষমা করা হয়। যুদ্ধাপরাধী নিয়াজি, রাও ফরমান আলিদের ভারত সরকার ক্ষমা করে দিয়েছে।
একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধিতা করেছিল, তারা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘দেশদ্রোহী’। দেশদ্রোহিতার অপরাধ কঠিন অপরাধ। সে অপরাধে শুধু একাত্তরের ঘাতকদের নয়, পরবর্তীকালের কোনো রাষ্ট্রবিরোধীরও বিচার সম্ভব। যারা একাত্তরে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ করেছিল, তাদের বিচার করে প্রচলিত আইনেই মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যায়। তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়; প্রতিহিংসামূলকভাবে নয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে যারা খুন, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধে লিপ্ত ছিল, তাদের সংখ্যা হাজার হাজার; কিন্তু একজন রাজাকারও ফাঁসির দড়ি গলায় পরেনি-সে এক ভয়াবহ বি্নয়কর ব্যাপার। কেন একজন অপরাধীকেও প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা গেল না-সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কেউ নেই। খুনির ফাঁসি দেওয়ার জন্য আমাদের দেশে আইন-আদালত সব সময়ই ছিল। তা সত্ত্বেও অপরাধীরা ছাড় পেল কীভাবে?
পাকিস্তানি কারাগার থেকে প্রত্যাবর্তন করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দেন, তাতে তিনি বলেনঃ ‘ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে যারা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদের বিচার হবে। সে ভার সরকারের ওপর ন্যস্ত রাখুন।’
শেষ বাক্যটি তিনি বলেছিলেন এ জন্য যে তিনি বিমানবন্দরে নেমেই শুনেছিলেন, অনেকেই প্রতিহিংসার বশে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছিল। কাদের সিদ্দিকী প্রকাশ্যে পল্টন ময়দানে স্বাধীনতাবিরোধী বাঙালি, বিহারি প্রভৃতিকে গুলি করে হত্যার যে জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তাতে বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে চূর্ণ হয়ে যায়। সে জন্য অপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দেওয়ার ভার তিনি সরকারের ওপর ন্যস্ত রাখেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার একজন প্রধান নেতা মওলানা ভাসানী। স্বাধীনতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তিনি কলকাতা থেকেও বলেছেন, দেশে ফিরে এসেও বলেছেন। ১৯৭২ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি শিবপুর কৃষক সম্মেলনে তাঁর ভাষণে বহু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের সঙ্গে বলেনঃ ‘এই দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যারা বিট্রে করেছে, তাদের নাম সন্ধান করে, উপযুক্ত কমিটি নিয়োগ করে-যে কমিটির প্রধান পরিচালক হবেন হাইকোর্টের একজন যোগ্যতম জজ-বিচারের পর যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, তাদের নাম ভোটার লিস্ট হতে বাদ দিতে হবে।’
বাহাত্তরের ৯-১০ ডিসেম্বর সন্তোষে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির যে জাতীয় সম্মেলন হয়, তাতে এক প্রস্তাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বলা হয়েছিলঃ ‘পার্টি উদ্বেগের সহিত লক্ষ করিতেছে যে বাংলাদেশ সরকার ও তাহার প্রধানমন্ত্রী প্রথম দিন হইতেই পাকিস্তানি যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের কথা বলিয়া আসিলেও উক্ত ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। সকল যুদ্ধবন্দীই ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং যুদ্ধবন্দীদের বাংলাদেশে ফিরাইয়া আনার কোনো ইচ্ছা বা কার্যক্রম দেখা যাইতেছে না। শাসক দল যত ঘোষণাই করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে ভারত সরকারই উক্ত যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক।···যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশের চরম গণহত্যার জন্য দায়ী। তাহাদের অপরাধ ক্ষমা করিবার কোনো এক্তিয়ার বাংলাদেশের জনগণ সরকারকে দেয় নাই।’
গণহত্যার নায়কদের বিচারের জোর দাবি মওলানা ভাসানী অব্যাহতভাবে করেছেন। তিনি পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকদের ৩০ বছর নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞারও দাবি করেন। কিন্তু কোনো যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দালালদের বিচার না হওয়ার মূল কারণ অনেক মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা ও বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের সহযোগী ছিল। তাদের বাঁচাতে গিয়ে সকলকেই বাঁচিয়ে দেওয়া হয়।
সেক্টর কমান্ডার ও বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল অনেক। তাঁরা কি বলতে পারবেন, সে প্রত্যাশার এক শতাংশও তাঁরা পূরণ করেছেন ৩৬ বছরে? মন্ত্রিত্ব, রাষ্ট্রদূত বা উচ্চ সরকারি চাকরি, জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, প্রকাণ্ড ব্যবসা-বাণিজ্য করা দোষের কিছু নয়। ওগুলো করেও জাতির স্বার্থে কিছু কাজ করা যায়। কয়েক দিন ধরে দেখছি, অনেকেই গোলটেবিলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে জোর বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা এত দিন কোথায় ছিলেন? এ দাবি আগে যাঁরা তুলেছেন (যেমন কাজী নূরউজ্জামান বীর উত্তম), তাঁদের তো তাঁরা সহযোগিতা দেননি। তাঁরা তো এ দাবি নিজের থেকেও তোলেননি। আওয়ামী লীগ তুলেছে বলে তাঁরা তুলেছেন। আওয়ামী লীগও নিজের থেকে তোলেনি। কাদের সিদ্দিকী, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি তুলেছে বলে আওয়ামী লীগ তুলেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যদি জিল্লুর রহমান সাহেবের নিজের মনের দাবি হতো, তাহলে যেদিন তাঁর দল বিচারপতি এ কে এম নূরুল ইসলামকে নমিনেশন দেয়, সেদিন তিনি পদত্যাগ করতেন। বিচারপতি ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, না পাকিস্তানের পক্ষের-সে খবর এই বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতার নিশ্চয়ই অজানা নয়।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর যে দল ক্ষমতাসীন হয়, তার এক নম্বর কর্তব্য ছিল যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তানিদের দালাল ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা এবং বিচারের মুখোমুখি করা। এটি তাদেরই দায়িত্ব, অন্য কোনো পরবর্তী সরকারের নয়। এ ক্ষেত্রে তারা মোটেই কোনো কাজ করেনি, তা-ও নয়। বাহাত্তরের ২৪ জানুয়ারি জারি করা হয় দ্য বাংলাদেশ কলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার, ১৯৭২। ওটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইন ছিল না, তা ছিল পাকিস্তানিদের যেসব দালাল-সহযোগী হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের আইন। এক সদস্যের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালও গঠিত হয়েছিল দায়রা জজ ও অতিরিক্ত দায়রা জজের নেতৃত্বে। হাজার পঞ্চাশেক অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। দালাল আইন দু-তিনবার অ্যামেন্ডমেন্ট বা সংশোধন করা হয় ১৯৭২ সালের ১ জুন ও ২৯ আগস্ট।
দালাল আইনের ভালো-মন্দ দিক নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময়ই বিতর্ক হয়েছিল। এ আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে, সে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন সে সময়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের মধ্যে মাওলানা ভাসানী, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবুল ফজল, বিচারপতি এস এম মোর্শেদ, আলীম আল রাজী, এনায়েতুল্লাহ খান প্রমুখ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। সে জন্য একপর্যায়ে তিনি সাধারণ ক্ষমাই ঘোষণা করেন। তবে খুন-ধর্ষণের সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের তিনি ক্ষমা করেননি।
দালাল আইন ও সংবিধানের মৌলিক অধিকার নিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, যিনি ১৯৭৩-এ আওয়ামী লীগের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হন, প্রশ্ন তুলে তাঁর পত্রিকায় লিখেছিলেনঃ ‘শাসনতন্ত্রের প্রথম সিডিউলে বর্ণিত অপরাপর আইনসহ দালাল আইনকে মৌলিক অধিকারসমূহের আওতাবহিভূêত করা হয়েছে। দালালদের বিচার ও শাস্তি প্রদানের জন্য এই আইনটি বলবৎ রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে। দালাল আইনের সাথে মৌলিক অধিকারের সংঘর্ষ অবধারিত। কিন্তু দালাল আইনে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের নির্দিষ্ট সময়সীমার উল্লেখ না থাকায় ক্রমাগতভাবে এই আইনের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা আছে। এই আইনবলে কারো বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন হলেও তিনি মৌলিক অধিকার ও শাসনতন্ত্রের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হবেন। সাড়ে ছয় কোটি বাঙালি, যারা সীমান্ত অতিক্রম করেনি, তাদের প্রত্যেকেই দালাল-এ কথা চিন্তা করেন এমন কিছুসংখ্যক লোকও সমাজে রয়েছে। যদি খারাপ ধরনের লোক ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তাঁরা এই আইনকে অত্যাচার-উৎপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রয়াস পাবেন। পরবর্তী সরকারসমূহ প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক কর্মীকে হয়রানি করার জন্য এই আইন বলবৎ রাখতে প্রলুব্ধ হতে পারে। ৪৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক এই আইনকে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পরিবর্তন-সংশোধনের নামে আরো কঠোর করারও অবকাশ রয়েছে। আমার মতে, দালাল আইনে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দায়ের করার সময়সীমা নির্ধারণ না করার বিচ্যুতি ভবিষ্যতে সুষ্ঠু রাজনীতি নিশ্চিত করার স্বার্থেই শোধরানো উচিত ছিল।’ [ইত্তেফাক, ১৯ নভেম্বর ১৯৭২]
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, লেখাটি ইত্তেফাকে প্রকাশের পর বঙ্গবন্ধু মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন। ওই দিন তিনি গণভবনে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনাও করেন। দালালদের ব্যাপারে তিনি যতটা সম্ভব নমনীয় হওয়ার চেষ্টা করেন। দালাল আইন নিয়ে বেশ কিছু মামলা-মকদ্দমাও হাইকোর্টে ১৯৭২-৭৫ এ হয়েছিল। বিচারপতি কে এম সোবহানের কোর্টে লুৎফর মৃধা বনাম রাষ্ট্র, বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী, বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেইন, বিচারপতি রুহুল ইসলাম ও অন্যান্য বিচারপতির কোর্টে মায়মুননেসা বনাম রাষ্ট্র, মশিউর রহমান যাদু মিঞা বনাম রাষ্ট্র, আবদুর রহমান বকুল বনাম রাষ্ট্র, এ কে এম নাজমুল হুদা বনাম রাষ্ট্র, হাফেজ মওলানা নূরুদ্দিন বনাম রাষ্ট্র প্রভৃতি মামলা ছিল দালাল ও মৌলিক অধিকারবিষয়ক।
দালাল প্রশ্ন সমাধানে বঙ্গবন্ধুর সময় যথেষ্ট কাজ হয়েছে। তবে ১৯৭৫ পর্যন্ত স্বাধীনতার পক্ষ এবং পাকিস্তানি দালালদের মধ্যে একটি বিভাজনরেখা ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও বীর উত্তম জিয়াউর রহমানের সরকার যেদিন কাজী জাফরের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করে, সেদিন মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের-স্বাধীনতাসংগ্রামী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের-পার্থক্য সম্পূর্ণ ঘুচে গেল। ওই কমিশন মাওলানা মান্নানও ছিলেন, জাহানারা ইমামও ছিলেন। এসব তথ্যে যাঁরা বিব্রত বোধ করছেন, তাঁদের রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলিঃ সত্যরে লও সহজে।
এখনকার পত্রিকা পড়লে মনে হবে, শুধু মুসলিম লীগ, জামায়াত বা নেজামে ইসলামীর লোকেরাই পাকিস্তানিদের দালাল ছিল। বস্তুত সব শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যেই পাকিস্তানিদের সহযোগী ছিল। আবদুল হক তাঁর কমিউনিস্ট পার্টির নামের সঙ্গে বাংলাদেশ হওয়ার পরও ‘পূর্ব পাকিস্তান’ই রেখে দেন। অত্যন্ত ‘প্রগতিশীল’ বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত না হলে, আর বছরখানেক টিক্কা খাঁরা বাংলাদেশ দখল করে রাখলে অনেক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে আজ মানুষ ভিন্ন পরিচয়ে জানত।
আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় দলের একটি এবং তার নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে; সুতরাং তার দায়িত্ব বেশি হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান কয়েক দিন ধরে বলছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় এখনই’, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি এখনই শুরু করা উচিত’, ‘যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে নিবন্ধন না দেওয়া’ প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো দিনই কোনো ব্যবস্থা নেবে না এবং তা সমর্থনও করবে না। কারণ, তাদের মধ্যে প্রণয় এমন গভীর যে একসঙ্গে জোট বাঁধুক বা না বাঁধুক-ক্ষমতায় যাক বা না যাক-কোনো দিনই তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে না। যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীল কাজ বিএনপি বুক ফুলিয়ে করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তার নিজের কর্মসূচি নিজে বাস্তবায়ন না করে অন্যকে দিয়ে করাতে চায়-যে কাজটি আওয়ামী লীগ নয়টি বছর ক্ষমতায় থেকে করেনি, তা করার দায়িত্ব হস্তান্তর করছে নয় মাস বয়সী সরকারকে। জাতির জনকের মর্যাদাপ্রাপ্তিসহ যেসব কাজের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ নেতারা বর্তমান সরকারের কাছে অর্পণ করছেন, তা সম্পন্ন করতে এ সরকারকে ২৭ বছর সময় দিতে হবে। কেউ দিলে সরকার সানন্দে সে সময় নেবে, তবে জনগণ তত দিন চুপ করে বসে থাকবে কি না?
দেশপ্রেমিকদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান, তাঁরা বলছেন, দালালদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই, তাদের এক্ষুনি ফাঁসি দিতে হবে, দালালদের প্রশ্নে সমস্ত জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। এসব উক্তির অর্থ বোঝার সাধ্য আমার মতো মানুষের নেই। কোনো যুদ্ধে বিজয়ী শক্তির দায়িত্ব বিরাট। ক্ষমা করার ক্ষমতা শুধু বিজয়ী শক্তিরই থাকে-পরাজিতদের নয়। জাতি যদি আজ সত্যি ঐক্যবদ্ধ থাকত, তাহলে এর চেহারা হতো অন্য রকম; বিশ্বে মর্যাদা হতো অনেক উঁচুতে। দেশ আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে যদি আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করি, তাহলে ১৪ কোটি মানুষের জীবনে নেমে আসবে অমানিশার অন্ধকার।
দালাল ও স্বাধীনতাবিরোধীদের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপ্রতি বঙ্গবন্ধু যে সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন, সেখান থেকে আবার পেছনের দিকে যাওয়া সম্ভব হবে না। কোনো সরকারের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। তিনি যাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাদের আবার আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। বিচার মানে আইনের প্যাঁচের মধ্যে যাওয়া; সেখানে সাক্ষীসাবুদ, আসামি-ফরিয়াদি, জেরা-পাল্টা জেরা থাকবে। ৩৬ বছর পর অনেক কিছু প্রমাণ করা কঠিন। নাৎসি বাহিনীর সদস্য কুট ওয়ার্ল্ডহেইম জাতিসংঘের মহাসচিব ও পরে অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। গুন্টার গ্রাস তাঁর অপরাধ স্বীকার করেন এবং মূলধারার সঙ্গেই আছেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি মৌলিক প্রশ্ন; একাত্তরে যারা খুন, ধর্ষণ করেছে, সেই অপরাধীদের বিচার আরেকটি প্রশ্ন; পাকিস্তানপন্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ একটি ভিন্ন প্রশ্ন এবং ধর্মপন্থী, বিশেষত ইসলামপন্থী রাজনীতি বন্ধের দাবি সম্পূর্ণ আরেকটি বিষয়। এই সবগুলোকে যাঁরা একাকার করে ফেলেছেন, তাঁরা বিবেচনাপ্রসূত কাজ করছেন না।
বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতাটি কী তা অন্ধ ও বধির এবং মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি ছাড়া যেকোনো সুস্থ মানুষের অজানা নয়। অর্থনীতি বিপর্যস্ত, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং প্রতিদিন বাড়ছে, তুচ্ছ ঘটনা উপলক্ষ করে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে একটি বছর, কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয়-আগামী বছর ভাত জুটবে কি না কেউ জানে না, শিল্প-শ্রমিক বেকার, আন্তর্জাতিক চাপ ও চক্রান্ত সর্বকালের মধ্যে এখন সর্বাধিক, জাতির টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব রক্ষার সব দায়দায়িত্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও যৌথ বাহিনীর হতে ছেড়ে দিয়ে অবসরপ্রাপ্ত দেশপ্রেমিকেরা শুধু গোলটেবিল বৈঠক করলে জাতির সর্বনাশ অবধারিত।

সৈয়দ আবুল মকসুদঃ গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Click This Link
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমাধ্যম আক্রমণ: হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন নূরুল কবীর ও নাহিদ ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৫


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ সেই স্বপ্নকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিউ এজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৪৯

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

সবাই যখন ওসমান হাদিকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মহাকাব্য শেয়ার করছে, তখন ভাবলাম—আমার অভিজ্ঞতাটাও দলিল হিসেবে রেখে যাই। ভবিষ্যতে কেউ যদি জানতে চায়, এই দেশটা কীভাবে চলে—তখন কাজে লাগবে।

রিকশায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×