দেশে থাকতে মাত্র ৩-৪ বার ডেন্টিষ্ট তথা দাতের ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। তাও সরকারী হাসপাতালে! তারপর দেশে কোলগেট ও পেপসুডেন্ট টুথপেষ্ট এভেইলএবল হলে(আগে কিছু নির্ধারিত ও অভিজাত বিপণীতে পাওয়া যেত) দাতে তেমন সমস্যাই হয় নাই। তবে একটি দাত অনেক আগেই খানিকটা ক্ষয় হতে হতে বৃটেন আসার পর এই বছর ফেলে দিতেই হল। ১৫-২০% টিকে ছিল তাই ডেন্টিষ্ট যখন দাত তুলে তখন সমস্যা হয় নাই। এর তিন মাস পর আবার যখন এই মাসের শুরুতে গেলাম তখন তিনি বললেন এই জায়গায় একটা দাত বসানোর কথা। আমি প্রথমে বললাম আদৌ কি দরকার আছে? তারপর তার কথাতেই রাজী হইলাম। তাকে খরচের বিষয়ে প্রশ্ন করাতে বলল "তোমার যদি উচ্চ আয় না থাকে এবং ট্যাক্স ক্রেডিট পাও তাইলে সম্পূর্ণ ফ্রি"। খুশীতে আমার মন ভরে গেল। ঠিক আছে ডেন্টিষ্ট যখন বলতাছেন তাইলে দাতের ইমপ্ল্যান্ট ব্রীজটা করেই ফেলি। পরে ডেন্টাল সেন্টারের রিসেপশনিষ্টকে জিজ্ঞাসা করলাম বিত্তবান বা সামর্থ্যবানদের জন্য এটা কেমন খরচ? বলল সব মিলিয়ে ৩১০ পাউন্ড লাগবে। পরে আমি ওয়েব সাইটে দেখি এটাই প্রাইভেটে লাগে ৭০০ পাউন্ড। উল্লেখ্য বৃটেনে National Health Service(NHS) যা সরকারী ফান্ডে চলে এমন ডেন্টাল সেন্টারে নিম্ন হতে উচ্চ আয়ের মানুষেরা পুরো থেকে ৬০-৭০% দাতের চিকিৎসায় ভর্তূকী পেয়ে থাকে। তাই NHS ছাড়া প্রাইভেটে চিকিৎসা অনেক ব্যায় বহুল। কাজেই আমারও দাত বসানো বিনা খরচে ও আরামে হয়ে গেল। এখানে অন্য সব চিকিৎসা সম্পূর্ণ ফ্রি তবে ওষুধ আয় অনুযায়ী কিনতে হয়। বিত্তবান-সামর্থ্যবান ও ট্যাক্স ক্রেডিট যাদের নাই এমন বৃটিশরা ছাড়া বাকী বৃটিশ নাগরিকরা ৯৯% ওষুধই ফ্রি পায়। এছাড়াও রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে, স্ক্যান সহ সব ধরণের টেষ্ট বৃটিশ নাগরিক ও বৈধ রেসিডেন্টদের জন্য ফ্রি। রোগ নিয়ে অহেতুক ভুল চিকিৎসা, ভুল ওষুধ প্রায় নেই। কাজেই অহেতুক রোগ না থাকলে বাড়তি অর্থের জন্য ডাক্তাররা অবৈধ কোন কাজ করে না।
সহজে সারার মত রোগ হইলে এক কোর্সের ওষুধেই রোগ সারে। সেই সাথে দীর্ঘ মেয়াদেও সারার মত রোগ হইলে সেটাই ধীরে ধীরে সুন্দর ভাবে সারে। ক্যান্সার সহ যেকোন জটিল রোগ সারানোর জন্য যতটা সম্ভব প্রচেষ্টা সহ হার্ট, লিভার, কিডনী, চোখ সহ সম্ভ্যাব্য প্রতিস্থাপনযোগ্য শরীরের অঙ্গ ষ্টোরে রিজার্ভ থাকলে সেগুলোও ফ্রিতে স্থাপন করে দেয়। বহু লোক এগুলো মৃত্যুর পর এটা দান করে যায়। খালি যদি বৃটিশদের সবাই একটু বুঝে অতিরিক্ত মিষ্টি, চর্বি, সোডা, প্রসেসড ফুড এবং এলকোহল কম গ্রহণ করত তাইলে তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে NHSর অর্থ অপচয়টা কম হইত।
বৃটেন সহ ইইউভূক্ত বেশীর ভাগ সদস্য রাষ্ট্র সহ ইউরোপে সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ও আইসল্যান্ডের নাগরিকদের জন্য সব ধরণের চিকিৎসা পুরাটাই বিনামূল্যে। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের স্বাস্থ্য সেবার জন্য ইন্সুরেন্স গুণতে গুণতে কাহিল হওয়ার অবস্থা হয় যদিও সেই দেশের চিকিৎসা ইউরোপের মতই অনেক উন্নত। আর অষ্ট্রেলিয়া ও কানাডাতে সব চিকিৎসা ফ্রি হলেও চোখ ও দাতের চিকিৎসা ফ্রি না। এর জন্য অষ্ট্রেলিয়ান ও কানাডিয়ানদের অনেক অর্থ ব্যায় করতে হয়। তাই মানুষ মুখে শুনি তাদের আত্নীয়রা যারা অষ্ট্রেলিয়া ও উঃ আমেরিকায় থাকে তারা বাংলাদেশেই দাতের চিকিৎসাটা করায়।
আর স্বদেশ তথা বাংলাদেশের কথা!!! যদিও সংবিধানে বলা আছে স্বাস্থ্য সেবা সব নাগরিকের অধিকার তবে বাস্তবে যার অর্থ-ক্ষমতা আছে সে চিকিৎসা পায় আর যার নাই সে অকালে মরে অথবা খানিকটা কি সারা জীবন ধূকে। অনেক সময় অর্থ ব্যায় করেও দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা সঠিক চিকিৎসা পায় না। কোন সময় টেষ্টের দরকার নাই কিংবা তেমন বেশী ওষুধের দরকার নাই। কিন্তু প্যাথলজিকাল ল্যাব ও ওষুধ কোম্পানী হতে কমিশন খাওয়ার লোভে অহেতুক রোগীদের অর্থ অপচয় করায়। অনেক সময় বুঝে বা অবহেলা করে সঠিক পথে টেষ্ট ও ওষুধ না দিয়ে রোগকে বাড়িয়ে তোলে। এতে করে অনেক মানুষই নিস্ব হয় অথবা দেনায় জর্জরিত থাকে। ইউরোপ ও সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের দেশ গুলিতে ইউটিলিটি বিল(গ্যাস, বিদ্যুৎ), টেলিফোন, জ্বালানি তেল সহ বিভিন্ন পণ্য হতে নির্ধারিত অথবা কিছুটা বাড়তি কর আরোপ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান সহ বেশ কয়েকটি সেক্টরে বরাদ্দ করে। তাই সেই সকল দেশে চিকিৎসা নিয়েতো ভাবতেই হয় না আর অন্য সব ক্ষেত্রেও র্দূনীতিও অনেক কম। তাই বলছিলাম বাংলাদেশে বিভিন্ন শুল্ক করের উৎস থেকে একটা অংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হলে তথা সরকার এই উদ্যোগ নিলে সব দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা অনেকটা ভাল স্বাস্থ্য সেবা পেত। উদ্যোগটা নিঃসন্দেহে কঠিন কিন্তু মোটেও অসম্ভব না। আমাদের বাংলাদেশে এখন পৃথিবীর ৯৮% ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানী উৎপাদন করে। এটা আর কোন কল্পনার বিষয় না। দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। যদি ভেজাল মূক্ত খাদ্য, খাদ্যের সঠিক গুণাগুণের লেভেল এবং বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা থাকত তাইলে আমাদের দেশের মানুষের আয়ু ৯০+ বছর হইত। আর যাই হৌক বাংলাদেশের মানুষের আশা ও মনোবল অনেক এই উৎসাহ হতেই ইউরোপকে দেখেই এই লেখার প্রয়াস। আমার মরহুম আব্বা ও মরহুমা আম্মা সহ বহু মানুষকে চিকিৎসা নিয়ে সংগ্রাম ও অনেককে চরম কষ্ট-র্দূভোগ পোহানো সহ ধুকে ধুকে মরতে অথবা দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে থাকতে দেখছি। তাই ইউরোপকে দেখে আর চাই না যে ভবিষ্যত প্রজন্ম স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির জন্য কষ্ট করুক।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৫:১২