somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মত্যাগের কোরবানি এবং সোস্যাল মিডিয়ায় কোরবানি

১৪ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আর ক’দিন পরেই কোরবানি। অনেকেই গরু, ছাগল কিনবেন।
কেউ কেউ কিনবেন না। মানে কিনতে পারবেন না।
কিন্তু সেটা কাউকে প্রকাশ করতে পারবেন না।
পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবেন, কোরবানির কয়েকদিন। মধ্যবিত্তের চির অভ্যাস-পলায়নপরতা।

যাহোক, সেটা বড় বিষয় না।

আমি আমার জীবনে মাত্র একবারই কোরবানির পশু নিজে কেনার সুযোগ পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাড়িতে গেলাম। টাকা নিয়ে বাজারে গিয়েছি। বাজারের এক কোণায় ছাগলের হাট। একটা বড়সড় ছাগল ধরে বিক্রেতাকে দাম জিজ্ঞেস করলাম। তিনি দাম চাইলেন, আমি একটু কম বললাম। তিনি রাজি হলেন। ৫ হাজার টাকায় সেই ২০০২/০৩ সালের দিকে মাত্র ১৫ মিনিটে ছাগল কিনে বাড়িতে রওনা হলাম। আমি দেখতে পাই, আমাদের উৎসবের মুডে থাকা তপুরুষ ভাইজানেরা ট্যাকভর্তি টাকা নিয়ে বাজারে যান। কোন বাজারে কম দামে বড় গরু (মানে বেশি মাংসওলা গরু আরকি) পাওয়া যায় তার খোঁজ আগেই নিয়ে নেন। তারপর বাজারের এমাথা হতে ওমাথা তোলপাড় করেন। কখনো কখনো একাধিক বাজারে গমন করেন। গরু দেখেন, তাদের দাঁত, পা, চূড়, শিং বেছে তারপর তীব্র দামাদামী করে গরু কেনেন। সারা রাস্তায় অসংখ্য লোক দাম জানতে চান, আমরাও সহাস্যে সোৎসাহে দাম বলি। এটাকেই আমরা রেওয়াজ বলে জানি। সবাই এই কাজটিকেই রীতি বলে করে থাকি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন, কোরবানি স্রেফ খোদার খুশি ও তার আদেশ পালনের জন্য একটি কঠোর ধর্মীয় রীতি। যার উৎপত্তির ইতিহাসে জড়িয়ে আছে, একজন নবী (ইব্রাহিম আঃ) কর্তৃক তার পুত্র (হযরত ইসমাইল আঃ) কে জবেহ করতে উদ্যত হবার বেদনাতুর কিন্তু ইমানী ঘটনা। আজকের দিনে আমাদের জন্য বিধান হয়েছে পুত্র নয়, প্রিয় অর্থ/টাকা দিয়ে পশু কিনে তাকে জবেহ করে গরীবকে বিলিয়ে দেবার ত্যাগ স্বীকারের সিম্বলিক প্রথা। তার সাথে সাথে নিয়ত করা, আমার ভিতরে থাকা যাবতীয় কূ-রিপু কোরবানি করে দেবার। কিন্তু যখন সেই টাকায় কষ্ট ইফেকটিভ, অর্থাৎ কম দামে বড়, তাগড়া, তরুন, পুরুষালি গরু কেনার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বাজারে খরচ করেন, তখন কি কখনো এটা মনে হয়, এই কোরবানি, কোরবানির পেছনে খরচ হওয়া টাকা, গরুর গোস্ত-সবই আল্লাহর জন্য। তো আমার গরুর মাংস যাই হোক, তাতে তো খোদার কিছু যায় আসে না। আমি যেই পরিমান টাকা খোদার খুশির জন্য খরচ করব বলে মনে করেছি, সেটা দিয়ে ২ মণী, ৫ মণী, ১০ মণী-যেই গরুই কিনি-সেটাতো খোদার কাছে একই। আমার টাকা খরচ কবুল হবার জন্য তো গরুর সাইজ ম্যাটার করে না। তাহলে কম দামে বেশি গোস্ত (স্যরি, বড় গরু) কেনার পেছনে কেন সময় ব্যায়? সেটা নিয়ে কেন প্রতিযোগীতা? যদি কেউ বলেন, ভাই, গরীব দুঃখিকে গোস্ত দেব, কম টাকায় বেশি মাংসওলা গরু কিনলে আরো দু’জনকে বেশি দিতে পারব। ভাই, আপনার সারাবছরের সার্বিক ভ্রাতৃত্ববোধের যা ইতিহাস, তার সাথে এই সাময়িক ভ্রাতৃত্ববোধের মিল থাকে কি?

যেহেতু আল্লাহ পাকের জন্য গরু কোরবানি দেয়া, তাই কোরবানি দেবার সাথে সাথে সবার হিংসা, ইর্ষা, লোভ, কামনা, বদবুদ্ধি, পশু প্রবৃত্তি, রিপু, কুমতলব, নারিপ্রীতি-এসব পাশবিক বজ্জাতি কোরবান বা ত্যাগ হয়ে যাবার কথা। আশা করা যায়, কোরবানির মধ্য দিয়ে দেশের কয়েক লাখ মানুষ চরম ভাল মানুষ হয়ে সাদা মনের মানুষ হয়ে যাবেন। যেহেতু মনের পশু কোরবানি করে খোদাতালাকে খুশি করতেই সবাই নিয়মমাফিক কোরবানি করলাম। আর সেটা যদি না করে থাকি, তবে সারাদিন এত সেলফি, কাউফি, শুভ কামনা, চোস্ত মেসেজ, ছুরি কাঁচির ঝনঝনানি বৃথা। মাঝখান হতে বেচারা গরুরা আমাদের পিউরিফাই করতে জীবন দেবে। আল্লাহ শুধু গরু জবাই করতে বলেননি। সেইসাথে আরও অনেক কিছু করতে বলেছেন। আল্লাহপাক তো ছোট গরু বড় গরুর কোনো ভেদ করেননি। তাহলে বিশাল বিশাল গরুর ছবি ফেসবুকে দেবার হিড়িক কেন পড়ে আমাদের এখানে? ছোট গরুর ছওয়াব কম নাকি? নাকি ছোট গরু আর ছাগলের সামাজিক স্টাটাস কম বলে? সেই সাথে কোরবানি সংলগ্ন অন্তত ১৫ দিন টিভিতে মাংসের নানা রেসিপি, কী রাঁধবেন, কোনটা কেমন মজা, ফ্রিজ কেনার ও কেনানোর ধুম-পশুর মাংস কেন্দ্রীক এই উৎসব কোরবানির মাহত্ম ও ধর্মীয় পবিত্রতার প্রতি অবজ্ঞা বলে আমার মনে হয়। মনে রাখবেন, কোরবানি মাংস খাবার উৎসব নয়, আত্মত্যাগের শিক্ষা নেবার উৎসব।

আরেকটা অনুরোধ।

পশু জবাই কোনো আনন্দের বিষয় নয়। বরং যেকোনো আত্মদান, বলিদান, প্রানহানি একটি গুরুগম্ভীর, মর্যাদাপূর্ন সমীহপূর্ন, বিষয়। ছুরি হাতে, জবাইয়ের, গরু/ছাগলকে বাঁধা অবস্থায়, মাংস প্রসেসিং, কাটাকুটি, জবাইকৃত পশুর সাথে সেলফী-এই ছবিগুলো সোস্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করা অত্যন্ত দুঃখজনক, হাস্যকর, বিব্রতকর, ভয়ানক, সহিংস ও অবিবেচকের কাজ। কোরবানির ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে খেলো করে দেয় এরকম কাজ। বহু আগে আমি নিজে একটা গরুর সাথে ছবি তুলে একটা শিক্ষামূলক লেখা লিখেছিলাম। ওই ছবির জন্য আজও শরম পাই।

পশুর এমন ছবির, এমনকি আপনি যে গরুটি কিনেছেন, তার ছবি প্রদর্শনী নিজের একধরনের অহমিকা, প্রদর্শনেচ্ছার প্রতিফলন। তাছাড়া, যাকে জবেহ করে ফেলবেন-তার আগে তার ছবি প্রচার করবেন, তার দাম, আকার, উৎস, জাতপাত, রং, ম্যানলি চেহারা-এসব নিয়ে আলাপ হবে, কমেন্ট হবে-এই পুরো বিষয়টা কি পশুগুলোর প্রতি একধরনের তাচ্ছিল্য আর ধর্মীয় মাহত্মের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা মনে হয় না? একটি প্রাণীকে জবাই করবেন, তাকে নিয়ে প্রচার, তার চেহারা প্রদর্শনকে মানুষ হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও উদ্ধত বলে মনে হয় না? আপনি মানুষ, আর ওরা পশু, ওদের ওপরে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা বিধাতা আমাদের দিয়েছেন। তাই বলে, ওদের জবাই করব, আবার সেটার আগে প্রদর্শন করে মজা/ভাব নেব-খোদা তা পছন্দ করবেন তো?

প্রচার ও প্রদর্শন-ধর্মের মূল থীমের পরিপন্থী বলেই আমি জানি। বুজুর্গরা ভাল বলতে পারবেন। আমার পোস্টের লক্ষ্য কোরবানিকে নিরুৎসাহিত করা নয়। আমাকে নব্য পশুপ্রেমী ভাববেন না। কোরবানি করুন। সাদকাহ দিন। গোস্ত বিতরন করে দিন। পাশাপাশি ধর্মাচরন পালনকে বিনীত, মহিমাময় ও খোদার সন্তুষ্টিতে নিবেদন করার পথ দেখানোই আমার উদ্দেশ্য। নিরবে, সম্মানের সাথে, রিয়া বর্জিত সহিহ সংকল্পে কোরবানি করাই নিয়ম। সেটাই আল্লাহ আমাদের কাছে চান, যা চেয়েছিলেন তার পয়গম্বরের কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৫
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×