somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইচ্ছা পূরণের গল্পঃ তৃতীয় পর্ব

২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দ্বিতীয় পর্বঃ view this link


সেলিম আংকেল ড্রাইভিং এ বসেই একদম ভিন্ন মানুষ। ছটফটানি একেবারেই বন্ধ। রাস্তার দিকে অখন্ড মনোযোগ, সেইসঙ্গে ভাষার প্যাটার্নও বদলে গেল উনার। বললেন,
- তোমার লেস্টারে যাওয়া কিছুদিনের জন্য স্থগিত। ডিটেইলস আমি বলতে পারবো না। তোমার মা আর আন্টি মিলে কি সব শলা-পরামর্শ করেছে। বাসায় গিয়ে আন্টির কাছ থেকেই বিস্তারিত শুনে নিও।

এরপর আর কথা তেমন একটা এগুলো না। মাশুক একটু চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। হু হা ছাড়া আর কিছুই আংকেলের পেট থেকে বের করতে পারলো না। ফলে হতাশ হয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার দিকে মনোযোগ দিল ও।

বাসার পোর্টিকোতে গাড়ী এসে থামলো। আন্টি গাড়ীর শব্দ শুনেই বের হয়ে এলেন। মাশুককে নামতে দেখেই দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন পরম আদরে। বেশ ক’বছর পর দেখা হলেও ওর মনে হলো আন্টি বদলাননি তেমন একটা, একই রকম আছেন। ছিমছাম, সুন্দর। আন্টিকে দেখতেই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল মাশুকের, বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী মা’র তো এখন ঘুমিয়ে পরার কথা। নাকি মন খারাপ করে বসে আছে? মনটা হু হু করে উঠলো; কেমন আছে মা এখন ওকে ছাড়া?

সেলিম আংকেল আর রুবিনা আন্টি, নিঃসন্তান একটি দম্পতি। একেবারেই বিপরীত চরিত্রের দু’জন মানুষ। সেলিম আংকেল হৈ চৈ, চেচামেচি না করে থাকতে পারে না, রুবিনা আন্টি শান্ত-শিষ্ট, ধীর-স্থির। আংকেল যখন কথা বলে, সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে, আর আন্টির কথা শুধুমাত্র পাশের মানুষই শুনতে পায়। মাশুকের কেন জানি মনে হয়, চরিত্রের এই বৈপরীত্বই উনাদের দু’জনকে একসাথে ধরে রেখেছে এতোটা বছর। আরেকটা ব্যাপারে উনাদের খুব মিল। সেটা হলো মাশুক আর মৃন্ময়ের প্রতি ভালোবাসার টান। এই ব্যাপারে দু’জনই অন্ধ। মাশুকের মনে আছে, খুব ছোটবেলায় মা একবার খুব অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতাল-অফিস দৌড়াদৌড়ি করার পর বাবাকে আর খুজে পাওয়া যেত না। সেই পুরো সময়টাতে এই দু’জনের কারনে ওরা দু’জন মা-বাবার অভাব তেমন একটা অনুভবই করে নাই। মা তো সবসময়ই বলে, সেলিমভাই আর রুবিনা হলো তোদের দ্বিতীয় বাবা-মা! ওরা দু’ভাইবোনও জানে, কথাটা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো না।

গাড়ী থেকে নেমে আশেপাশের পরিবেশ একঝলক দেখে মাশুক মুগ্ধ হয়ে গেল। একেবারেই চুপচাপ, নিরিবিলি একটা এলাকা। জায়গাটার নামটাও চমৎকার, হেয়ারফিল্ড - খরগোশের মাঠ! লন্ডনের মধ্যে হলেও মূল লন্ডনের অনেক বাইরে, একটা সাবআর্ব এলাকা। গাছগাছালী আর টিলাময় এলাকাটা দেখে মনেই হয়না এটা লন্ডনের মধ্যে। একেবারেই গ্রামীন পরিবেশ। কাছেই নাকি একটা নদীও আছে। নাম রিভার কৌন। আংকেলদের বাসাটাও দারুন। সামনে ছিমছাম ছোট্ট একটা বাগান। ব্যাকইয়ার্ডও বেশ বড়, গাছপালায় ভরা। আন্টি জানালো কাঠের বাউন্ডারী ওয়ালের ওপাশেই নদীটা। ডুপ্লেক্স বাড়ীটার নীচের তলায় ড্রইং, ডাইনিং আর কিচেন। উপরে ছোটবড় তিনটা বেডরুম।

রাতে খাবার টেবিলেই পরিকল্পনাটা শুনলো মাশুক। সজীব যেহেতু সপ্তাহখানেক পরে আসবে তাই এ’কয়টা দিন মাশুক এখানেই থাকবে। সজীব আসলে ওকে নিয়েই লেস্টারে যাবে। উনারা দুজনে ওদেরকে ওখানে নিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে আসবেন। পরিকল্পনাটা ওর খুব একটা পছন্দ না হলেও কিছু বললো না। সবার মিলিত সিদ্ধান্তটা বিনাবাক্যে মেনে নিল।

সজীব আসা পর্যন্ত ক’টা দিন একেবারে খারাপ কাটলো না মাশুকের। প্রতিটা দিনই যেন একেকটা পিকনিকের দিন। একফাকে গিয়ে কৌন নদীটাও দেখে এলো। নদী দেখে হাসি পেল ওর। দেশের খালের মতো চিকন একটা জলধারা, এটা নাকি নদী! তবে বিলাতী নদী বলে কথা! নদীর দুইপাড়ের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই একেবারে। কি সুন্দর ঝকঝকে তকতকে সবকিছু। নদীর পাড় ধরে হাটার ব্যবস্থা। জায়গায় জায়গায় বেন্চ পাতা। নদীর মধ্যে ঝাকে ঝাকে হাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবকিছু ছবির মতো। সব দেখেশুনে ঢাকার বুড়িগঙ্গার দৈন্যদশা মনে পরলো ওর। কি হতে পারতো, আর কি হয়ে আছে! দেশের বাইরে যতোগুলো শহরের মধ্যখান দিয়ে বয়ে চলা নদী দেখেছে ও, তার মধ্যে বুড়িগঙ্গার অবস্থাই সবচেয়ে করুণ। এসব দেখে মন খারাপ করা আর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আসলে করার খুব একটা কিছু নেইও।

দেখতে দেখতে সজীবের আসার সময় হয়ে এলো। যথাসময়ে ওকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়েও এলো। পরের দিন সবাই মিলে লেস্টারে চলে এলো। আন্টি এরমধ্যে হুলুস্থুল কান্ড করে ফেললেন। এক সপ্তাহ খাওয়ার মতো রান্না করে ফ্রিজ বোঝাই করে দিয়ে আসলেন। মুখে একটু ''কি দরকার ছিল'' জাতীয় ভদ্রতা দেখালেও মনে মনে ওরা দুজনেই খুব খুশী। সজীব বললো,
- আন্টি চিন্তা করবেন না। সিদ্দিকা কবীরের রান্নার বই নিয়ে এসেছি। আম্মুর কাছ থেকে টুকটাক রান্নাও শিখে এসেছি। দুজনে চালিয়ে নিতে পারবো!

আন্টির চেহারা দেখে ওদের মনে হলো না যে, তিনি খুব একটা ভরসা পাচ্ছেন, তবু কি আর করা! ওদেরকে দিয়ে যে কোনও সমস্যা সাথে সাথে জানানোর প্রতিজ্ঞা করিয়ে তারপর উনারা বিদায় নিলেন, আর ওরা দু'জন হাফ ছেড়ে বাচলো। আসলে বড়রা কেউ বুঝতেই চায় না যে, ওরা এখন আর ছোট্ট বাচ্চা না!

উনারা যাওয়ার পর তিনদিন ধরে ওরা সবকিছু গোছগাছ করলো, ইউনিভার্সিটির ফর্মালিটিগুলো শেষ করলো, শহরটাও মোটামুটি ঘুরে দেখলো। ক্লাশ শুরু হতে এখনও দিন দশেক বাকী। সেদিন বিকালবেলা সব ঝামেলা মিটিয়ে থিতু হয়ে দু’জনে চায়ের কাপ হাতে বাসার ছোট্ট বারান্দাটায় বসলো। এ’কদিন ছোটাছুটি করতে করতে দু’জনেই পেরেশান হয়ে গিয়েছে। আজই প্রথম দম ফেলার অবকাশ মিললো।

- তুই কি জানিস, আজ থেকে ঠিক পাচ দিন পর আকাশে রক্তিম চাদ দেখা দিবে? চায়ে চুমুক দিয়ে মাশুক বললো।
- না, জানিনা। আর দেখা দিলেই বা কি?

সজীবকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখালো। আসলে মাশুকের সাথে ওর এতোদিনের বন্ধুত্ব। তারপরও মাঝে মাঝে ও ওকে বুঝতে পারে না। মাশুকের মাথার মধ্যে কখন কি উদয় হয়, কি চিন্তা করে তা পড়তে পারা আসলেই খুব কঠিন! হঠাৎ হঠাৎ এমন সব কথা বলে বসে যা চিন্তার বাইরে। মাস দুই আগে হঠাৎ করেই একদিন ধারাবাহিক চন্দ্রগ্রহন, রক্তিম চাদ ইত্যাদি নিয়ে মাশুক একটা লেকচার দিয়েছিল ওকে। তারপরে ও নিজেও কিছুটা কৌতুহলী হয়ে এ ব্যাপারে একটু পড়েছিল, ব্যাস, ওই পর্যন্তই। আজ কথা নাই, বার্তা নাই; হঠৎ করে রক্তিম চাদের প্রসঙ্গ! তাও ইংল্যান্ডে বসে! নিশ্চয়ই ওর মাথায় কিছু একটা ঘুরছে।

- শোন। মাশুক একটু ঝুকে এলো। ওর চোখেমুখে উত্তেজনা। তুই তো জানিস, স্টোনহেইন্জ দেখার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের।
- তো? সজীব ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করছে।
- আমি পড়েছি, রক্তিম চাদের রাতে স্টোনহেইন্জকে নাকি খুবই রহস্যময় দেখায়। স্টোনহেইন্জ এমনিতেই রহস্যময় স্থাপনা। যীশুখৃষ্টের জন্মেরও তিন হাজার বছর আগে কে বা কারা এটা তৈরী করেছিল, কেউ জানে না। অনুমান করা হয়, এটা একটা প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র। সে ব্যাপারেও কেউ খুব একটা নিশ্চিত না। তার মধ্যে ব্লাড মুন! চিন্তা করেই আমার পালস বীট বেড়ে যাচ্ছে!
- স্টোনহেইন্জ আর ব্লাড মুন; তার সাথে তোর পালস বীটের সম্পর্ক কি?
- আছে। সম্পর্ক আছে। আমি পরশুদিন ভোরে এ্যামেসব্যারী যাচ্ছি। হোটেল দেখছি। আজই বুকিং দিয়ে ফেলতে পারবো আশাকরি। তুই যাবি তো?

এতোদিনে সজীবের কাছে ব্যাপারটা পরিস্কার হলো। সেমিস্টার শুরুর এতো আগে আসার জন্য মাশুকের ব্যাকুলতার একটা গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া গেল শেষমেষ। দেশে সবাই বলেছিল আর কিছুদিন পরে আসার জন্য, কিন্তু মাশুক একেবারেই দেরী করতে চায়নি। সে যাই হোক, ওর অবশ্য না যাওয়ার কোন কারন নেই। মাত্র ওরা সবকিছু গুছিয়ে বসেছে। নতুন দেশ, নতুন জায়গা। মাশুককে একা ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া, এসব প্রাচীন কীর্তি দেখার ব্যাপারে মাশুকের মতো ক্রেইজী না হলেও ওরও আগ্রহ আছে।

কাজেই ঠিক হলো, পরশু ভোরে ওরা দু’জনেই যাবে। তবে, দেশে বা এখানে আংকেল-আন্টিকে কিছুই জানানো যাবে না। কারন, এসব নিয়ে কথা বলতে গেলেই এখন হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে!

ফটো ক্রেডিটঃ গুগল।

ইচ্ছা পূরণের গল্পঃ চতুর্থ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৫৫
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×