গত বছর এই সময়ে লিখেছিলাম হ্যালোউইন নিয়ে (এখানে) আমার সে লেখার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিল অনেক ভুত। এবারকার হ্যালোউইনে ব্লগে ভুতের উপর সচিত্র প্রতিবেদন লিখেছিলাম দু’দিন আগে((এখানে) , সে লেখায় দেশ বিদেশের ভুতেরা যারপরনাই খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানানোর সাথে সাথে এক অদ্ভুত আবদার করে বসে। জাপানের ভুত, চীনের ভুত, ভারতের ভুত, ইউরোপের ভুত, মধ্যপ্রাচ্যের ভুত সবারই দাবী তাদেরকে নিয়ে, তাদের সমস্যা নিয়ে কিছু লিখতে হবে। তিব্বতের অহিংস ভুত রীতিমত হুমকি দিয়ে ই মেইল পাঠিয়েছে “আমাদেরকে নিয়ে না লিখলে দেখে নেওয়া হবে” আমি নিতান্ত নিরীহ গোবেচারা মানুষ। কোন কুক্ষনে যে ভুতের চিন্তা মাথায় এসেছিল? আবার ভাবি ভুতদের মানবিক দিকটাও দেখা উচিত। অনেক ভুত কস্টে আছে, নানান সমস্যা তাদের। প্রধান সমস্যা আবাসিক। দিন দিন কমে আসছে ভুতদের বসবাসের উপযক্ত আবাস ভুমি। এই তো অল্প কিছুদিন আগে তিন পুরুষ ধরে বসবাস করে আসা ভুতদের বাসা ছিল যে শ্যাওড়া গাছে তা কেটে ফেলল চন্ডিদাস। বটতলার ভুত পেত্নী দুজনকে মাটির কলসীতে পুরে ফেলে মুখ সীল গালা করে কীর্তনখোলায় ডুবিয়ে দিল হাসেম ওঝা। ভুত পেত্নীদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই কারো। ভুত পেত্নীদের উপর অত্যাচার নির্য্যাতন চলছে সমানে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে ভুতেরাও মানুষ।
প্রথমেই ভুত অবিশ্বাসীদের সতর্ক করে দিচ্ছি যারা এই গুরুত্বপূর্ন প্রতিবেদনের সাথে দ্বিমত পোষন করবেন তার দায়িত্ব তাদের নিজেদেরই। যদি কোন ভুত রাত বিরেতে কোন অবিশ্বাসীর ঘাড় মটকায় তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবেন না।
মানব সভ্যতার মতই পূরনো ভুতদের ইতিহাস। ভুতদের রাজা ছিল, রানী ছিল, ভুতদের রাজত্বও ছিল, ছিল গৌরবময় ঐতিহ্য। জনসংখ্যার চাপে ভুতেরা আজ কোণ ঠাসা। শহর থেকে ভুতেরা বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই, গ্রামেও আজকাল আর আগের মত ভূত দেখা যায় না। মানুষের এই অন্যায়ের প্রতিবাদে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে ভুতেরা। আমার আশঙ্কা হচ্ছে যদি এখনই সরকার এবং রাজনীতিবিদেরা ভুত সংরক্ষনে উদ্যোগ না নেন তবে এই গুরুত্বপূর্ন প্রজাতি চিরবিদায় নেবে পৃথিবী থেকে, ফলে ঘটবে পরিবেশ বিপর্য্যয় , সুনামী্, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
প্রাচীন যুগের ভুত-
সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ বিশ্বাস করে এসেছে পরজগতে। শরীর এবং মন নিয়েই ইহজাগতিক মানুষ। মৃত্যুর পর শরীরের বিনাশ ঘটলেও মৃতের আত্মার বিনাশ হয় না। এই আত্মাই কখনো সখনো দেখা দেয় ভুত হিসেবে। খৃস্ট পূর্ব কালে মেসোপটেমিয়ার সুমের,ব্যাবীলন এবং এসীরিয়ায় দেখা মেলে ভুতদের। সুমের ভাষায় মৃতের আত্মাকে বা ভুতকে বলা হত “গিদিম” তারা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর আত্মা পরজগতে মৃতের কায়া এবং ব্যাক্তিত্ব নিয়ে ইহজগতের মতই পরজগতে বিরাজ করে। প্রাচীন মিশরীয়রা পিরামিডের কাল থেকেই বিশ্বাস করে এসেছে পরজগতে। মৃত্যুর পর দেহের সাথে আত্মার পুনর্মিলন ঘটবে পরজগতে। এই আত্মা হয়ত একদিন ফিরে আসবে তাদের পুরোন দেহে। এমন বিশ্বাস থেকেই তারা মমি করে রাখত মৃতদেহকে। ১৫৫০ খৃস্টপূর্বাব্দ থেকে দেড় হাজার বছর ধরে মিশরীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল The Book of the Dead । । এই বইয়ে থাকত পরজগতের মৃতের আত্মার প্রতি বিভিন্ন উপদেশ, থাকত বিভিন্ন মন্ত্র। এই বইয়ের বিভিন্ন মন্ত্র লেখা থাকত কবরের দেওয়ালে, মৃতের কফিনে। মমির সাথে কফিনে দেওয়া হত প্যাপিরাস এ লেখা এই বই। । পরজগতে মৃতের যাত্রাপথ, মৃতের আত্মারুপী বিভিন্ন পশু পাখির অসংখ্য ছবি আঁকা থাকত প্রাচীন মিশরীয় সমাধি ক্ষেত্রে। মমীর প্রেতাত্মা নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক সিনেমা। আছে অনেক প্রবাদ মমীর অভিশাপ নিয়ে।
প্রাচীন মিশরের সমাধি দেওয়ালের ছবিতে মৃতের হৃতপিন্ডকে ওজন করে দেখছেন দেবতা আইবিস।
প্রাচীন গ্রীস এবং রোমেও দেখা মেলে ভুতদের। হোমারের ওডেসী এবং ইলিয়াড কাব্যে ভুতদের বর্ননা মেলে অশরীরি বাস্পের আকারে । খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর নাটক Oresteia তে কাল্পনিক ভুত চরিত্রের দেখা মেলে। গ্রীকরা ভুতদের উদ্দেশ্যে বাৎসরিক ভোজ এবং পুজার আয়োজন করত যাতে কিনা তারা জীবিতদের কোন ক্ষতি সাধন না করে। রোম সাম্রাজ্যের বিখ্যাত দার্শনিক প্লুটার্কের লেখাতেও পাওয়া ভুতএর উল্লেখ পাওয়া যায় । রোমানরা বিশ্বাস করত ভুতদের প্রতিশোধের।
মধ্যযুগীয় ভূত- মধ্যযুগের ইউরোপে ভুতেরা ছিল মৃতের আত্মা কিংবা দানব হিসেবে। এই সময়ে ভুতদের দেখা হত ইহকালে করা পাপের ফলে শাস্তিভোগরত মৃতের আত্মা হিসেবে। তারা জীবিতদের কাছে ফিরে আসত এই শাস্তিরত অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে। ভুতেরা অনেক সময় জীবিতদের মুখোমুখি হত প্রতিশোধ নিতে। ইংলয়ান্ডে যুদ্ধে হেরে যাওয়া নাইটের ভুত জীবিত নাইটকে যুদ্ধে আহবান জানাত এমন কথারও উল্লেখ মেলে। ১২১১ খৃস্টাব্দের ফ্রান্সের আভিগ্নোর যুদ্ধে দেখা মেলে বালক ভুত এর। কেম্ব্রিজের কাছের বনে ভুত সেনাবাহিনীর যুদ্ধের বর্ননা পাওয়া যায়।মধ্যযুগীয় ভুতুড়ে বাড়ী এবং দুর্গের বর্ননাও আছে। শেক্সপীয়ারের হ্যামলেট নাটকে প্রেতাত্মা ভুতের প্রতিশোধ নেওয়া ভুতের দেখা মেলে। আরব্য উপন্যাসে ভুতড়ে বাড়ী পাওয়া যায় " চৌকিদার আলী এবং ভুতুড়ে বাড়ী” গল্পে।
চীনদেশের ভুত- চীন দেশের সংস্কৃতিতে ভুতদের এক বিশাল ভুমিকা আছে। কনফুসিয়াস তার শিশ্যদের বলতেন “ ভুত এবং ঈশ্বরকে ভয় কর এবং তাদের থেকে সাবধানে থেকো” চীনারা পুর্বপুরুষদের আত্মা বা ভুতকে স্মরন করে থাকেন যা “তাও” ধর্মের অংশ। ভুতদের স্মরনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চীনারা “ভুতোৎসব পালন করে থাকেন। অধিকাংশ চীনারা ভুতে বিশ্বাস করেন এবং বিশ্বাস কোরেন ভুতদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ের চায়না পোস্টের এক জরীপে দেখা গেছে চীনের ৮৭% অফিস কর্মচারী ভুতে বিশ্বাস করেন এবং ৫২% কর্মচারী ভুতদের হাত থেকে বাচার জন্য, ক্রস, উল্কি, এবং কাচের টুকরো ব্যাবহার করেন।
উপমহাদেশ এবং ভুত- সেই প্রাচীন কাল থেকেই উপমহাদেশে চলে আসছে ভুত চর্চা। ভুতকে দেখা হয় অশরীরি মৃতের আত্মা হিসেবে। উপমহাদেশে বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে অতৃপ্ত , অভিশপ্ত, দুর্ঘটনায় বা অস্বভাবিকভাবে মৃত ব্যাক্তির আত্মা, স্বর্গ বা নরকে যাওয়ার আগে ভুত হিসেবে বিচরন করে থাকে। জীবিতদেরকে ভুতে ধরা এবং ভুতের ওঝার ভুত তাড়ানোর গল্প প্রচলিত আছে সারা উপমহাদেশ জুড়ে। ভুতদের নিয়ে অনেক বিশ্বাস প্রচলিত আছে যেমন ভুতেরা আগুনকে ভয় পায়, ভুতের ছায়া পড়ে না, ভুতের পা উলটো দিকে ঘোরানো থাকে, লোহা বা তাবিজ সাথে থাকলে ভুতে ধরতে পারে না ইত্যাদি। হিন্দু পৌরানিক কাহিনী “বেতাল পঞ্চ বিংশতি” তে শ্মশানের ভুতের দেখা মেলে। বিশেষ ধরনের ভুত হল “পিশাচ” যারা পচা মাংশ বা মাছ খেয়ে থাকে। শরৎ চন্দ্র তার “শ্রীকান্ত” উপন্যাসে ভুতের সন্ধানে অমাবস্যার রাতে শ্মশানে ভবঘুরে শ্রীকান্তের অভিযানের উল্লেখ করেছেন।
ইউরোপের ভুত- ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইংল্যান্ড, জার্মানী ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ভুতুড়ে বাড়ি, ভুতুড়ে শহর,এমনকি ভুতড়ে জাহাজ, বা ভুতুড়ে ট্রেনের উল্লেখ আছে। ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ার, বেলজিয়ামের এন্টোয়ের্প, নেদারল্যান্ডের ম্যাস্ট্রিখট, চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রাগ প্রভৃতি শহর ভুতের জন্য বিখ্যাত। চার্লস ডিকেন্সের A Christmas Carol , অস্কার ওয়াইল্ডের ভুত নিয়ে লেখা বিখ্যাত উপন্যাস “The Canterville Ghost” এবং পল গঁগ্যা (Paul Gauguin ) র বিখ্যাত ছবি Spirit of the Dead Watching এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।বাচ্চাদের কার্টুন ছবি Casper the Friendly Ghost, The Uninvited, The Haunting, The Ghost and Mrs. Muir, ইত্যাদি বিখ্যাত বইয়ের উল্লেখ না করলেই নয়। রোমানিয়ার বিখ্যাত ভুত ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ার, ফ্যান্টম , ইত্যাদি ভুতের নাম শোনেন নি এমন লোক খুজে পাওয়া দুস্কর।
পল গঁগার বিখ্যাত ছবি ।
জাপানীজ ভুত- জাপানে ভুতকে বলা হয়ে থাকে উরেই Yūrei । চীন, ভারত এবং ইউরোপের মতই জাপানীরা ভুতকে দেখেন অতৃপ্ত আত্মা হিসেবে।
জাপানী ভুত উরেই।
উত্তর আমেরিকার ভুত- যুক্ত রাস্ট্র কানাডা এবং মেক্সিকোতেও ভুতের দেখা মেলে। ২০০৫ সালের এক জরীপে দেখানো হয় যে ৩২% আমেরিকান ভুত বিশ্বাস করেন। মেক্সিকানরা বিশেষ দিন “ Day of the Dead” এ ভুতদেরকে স্মরন করে থাকেন।
মেক্সিকোতে “ Day of the Dead” এ জনপ্রিয় চরিত্র ক্যাটরিনা
উপসংহার- ভুতদের নিয়ে নির্মিত হয়েছে হাজার চলচ্চিত্র, লেখা হয়েছে অনেক বই , , অনেক ছবি, ভাস্কর্য্য এবং অনান্য শিল্প কর্ম। ভুতদের অস্বীকার করা মানেই নিজেদেরকে অস্বীকার করা।
সবশেষে ভুত অবিশ্বাসীদের সাবধান করে দিচ্ছি শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের কবিতার কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত দুই লাইন দিয়ে -
“ মিথ্যে ভেবে এসব কথা করবে যারা হেলা/ ভুতেরা সব জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠ্যালা”
সুত্র- প্রধানতঃ এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



