somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই মেলার দিনগুলো।

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


উনিশশো ছিয়াশি সালের বই মেলার দিনগুলো বিশেষ্ করে মনে পড়ে। এর আগে এবং পরে আরো অনেকবার যাওয়া পড়েছে একুশের বইমেলায় কিন্তু আমাদের জন্য সে বছরের বইমেলা ছিল অসাধারন। শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত প্রতিদিন বইমেলায় আড্ডা দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল সে বছর। সেই গল্পটাই এখন বলি।

উনিশশো ছিয়াশির জানুয়ারীতে এফ,সি,ফি,এস প্রথম পর্ব পরীক্ষার আগে আগে আমাদের সারাদিনের রুটিন ছিল ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা, আর পড়া শেষে ঘুমাতে যাওয়া। সিরাজ, রিদওয়ান, নুরুদ্দিন, আকবর,আমি সবাই মিলে তখন কঠোর বিদ্যাভাসরত । বিরামহীন,শ্রান্তিহীন এবং ক্লান্তিহীন সে পড়াশোনা চলত দিনের পর দিন। পিজি হোস্টেলের সাত তলার সাতশ একুশ নম্বর রুমের আমাদের আস্তানায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্য্যন্ত চলত এনাটমী, ফিজিওলজীর উচ্চস্বরের আলোচনা। আশে পাশের অনেকেই অসন্তুস্ট ছিলেন আমাদের পড়াশোনার শব্দে। সে পড়াশোনার গুতোয় বিশেষভাবে নাখোশ ছিলেন উলটো দিকের রুমের ফিরোজভাই এবং বকুল ভাই । ফিরোজ ভাই তখন পিজিহাসপাতালে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করেন আর বকুল ভাই পড়তেন ফার্মাকোলজীতে, তাদের পড়াশোনার চাপ অপেক্ষাকৃত কম ছিল। মাঝে মধ্যেই উল্টোদিকের ফিরোজভাইদের রুম থেকে বিরুপ মন্তব্য ভেসে আসত। সে রুম আবার ছিল ছাত্রমৈত্রীর কর্মীদের আড্ডাখানা। আমাদের রুমে যখন এনাটমী ফিজিওলজীর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলত ফিরোজভাইদের রুম তখন সরগরম থাকত মার্ক্স, লেনিন, এঙ্গেলস এর দর্শন চর্চায়। মজার ব্যাপার ছিল যে দুই রুমের বাসিন্দাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ঘটত শুধুমাত্র রুমে থাকা কালীন সময়েই, রুমের বাইরে এলে আমরা একে অপরকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম, ভাবখানা এমন যে কিছুই হয় নি বা একে অন্যকে চিনি না । জানুয়ারীর বিশ তারিখের মধ্যে সবার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল।কোর্স শেষে নতুন করে পোস্টিং এর পালা। পোস্টিং নিয়ে আমার খুব মাথা ব্যাথা ছিল না কারন যে কোন মেডিকেল কলেজে পোস্টিং হলেই আমার জন্য কোন সমস্যা ছিল না।

পরীক্ষা শেষে আমাদের আড্ডা বসত সোহরওয়ার্দী উদ্যানে। পড়াশোনা শেষে আমোদ ফুর্তি করা তখন ফরজ ছিল। সকালের নাস্তা করেই তড়িঘড়ি করে ছুটতাম সোহরওয়ার্দী উদ্যানে। তখনকার সোহরওয়ার্দী উদ্যান ছিল অনেক বেশী সবুজ, গাছপালায় ভর্তি এবং মানুষজনের ভীড়ও ছিল অনেক কম। নিরিবিলিতে আড্ডা দেওয়ার এর চেয়ে ভাল যায়গা আর ছিল না। দুপুরে ঘন্টা দুয়েক বিরতি দিয়ে শুরু হত বৈকালিক অধিবেশন এবং তা চলত রাত আটটা অবধি। সকালের আড্ডা বসত উদ্যানের মাঝখানে রাস্তাঘাটের কোলাহল থেকে দূরে কোন ঝোপের আড়ালে আর বিকেলের আসর বসত রাস্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র বা টি,এস,সি এর কাছাকাছি। উদ্যানের টি এস, সি’এর দিকের গেটের ভেতরের বাধানো বেদীতে প্রফেসর আহমদ শরীফ এবং আরো কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়মিত আড্ডা দিতেন বিকেলবেলায়। প্রতিদিন সকালে উঠে ধানমন্ডীর চাচীর বাসায় দেখা করতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করত আলী আকবর কিন্তু আড্ডা দিতে শুরু করে তা প্রতিদিনই ভুলে যেত, ফলে বইমেলা শেষ হওয়ার পরই সে তার চাচীর বাসায় হাজিরা দিতে সমর্থ হয়। মাঝে মধ্যে আড্ডায় যোগ দিত আদিল, বাশার, জিয়া, বা অন্য বন্ধুরা। বন্ধুদের বিশেষ বিশেষ নাম দিয়েছিল রিদওয়ান। আমি ছিলাম ভুত আর আমার পার্টনার হিসেবে আলী আকবর নাম পেয়েছিল পেত্নী, ছাত্র জীবন থেকেই সিরাজের নাম ছিল মোটালোক, আদিলের নাম ছিল জীন এবং বাশারের নাম হয়েছিল চোরাকারবারী। সিগারেট ধরানোর সময় রিদওয়া্নের প্রিয় শ্লোগান ছিল “ ভুত পেত্নীর গদিতে আগুন জালো একসাথে” যা আজো আছে।

দেখতে দেখতে ফেব্রুয়ারী মাস এসে গেল। সোহরওয়ার্দী উদ্যান ছেড়ে আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাড়ালো একুশের বই মেলা। তখনকার বই মেলা ছিল অনেক ছোট, বাংলা একাডেমীর ভেতরের আঙ্গিনাটুকুতেই সীমাবদ্ধ। একাডেমীর ভিতরের পুকুরের পেছনের দিকের অংশটুকুতে তখন সবেমাত্র দু’একটা বইয়ের স্টল গড়ে উঠেছে। বেলা এগারোটায় বাংলা একাডেমীর গেট খুললেও দুপুরের আগে মেলা খুব একটা জমত না। যাদুঘর থেকে বাংগালী মনীষিদের ছবিগুলো এনে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল বটতলার চারদিক ঘিরে। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকলে বা দিকের ছোট মাঠে বাংলাসাহিত্য এবং বাংগালী সংস্কৃতির উপর আলোচনা সভা বসত বিকেলে। মাঝে মাঝে আলোচনা শুনতাম ভাষা আন্দোলনের। একদিনের প্রধান আলোচক ছিলেন ভাষা সৈনিক এডভোকেট গাজীউল হক। তিনি বলেছিলেন পাকিস্তানের গোড়ার দিকের ভাষা আন্দোলনের কথা, একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভংগ করে মিছিল করার কথা। উনিশশো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারী দিনে সালাম,বরকত,রফিক্‌, জব্বরেরা গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সময়ে তাদের পাশেই মিছিলে ছিলেন এডভোকেট গাজীউল হক। তার বক্তৃতায় দুই বাংলাদেশী কুলাঙ্গারের নাম উল্লেখ করেছিলেন গাজীউল হক। প্রথমজন হলেন ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দীন । তিনি জিন্নাহর পর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলন চলা সময়ে ১৯৫২ সালে ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। নাজিমুদ্দীন বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন এবং উর্দুকে রাস্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী ছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান এই বাংলাভাষা বিরোধীর মাজার নির্মান করেন বাংলা একাডেমী থেকে সামান্য দূরে। তিন নেতার যে মাজার তৈরী করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া তার মাঝখানেরটি হল নাজিমুদ্দিনের। অপর কুলাঙ্গার হলেন নুরুল আমীন। নুরুল আমীন বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য মন্ত্রী। তার কার্য্যালয় ছিল আজকের বাংলা একাডেমীর প্রধান ভবন। সেই সময়ে এ ভবনের নাম ছিল বর্ধমান হাউস। এখানে বসেই নুরুল আমীন আন্দোলনকারী মিছিলের উপর গুলি চালানোর হুকুম দেন। নুরুল আমীন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

বিকেলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একদিন রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা’র পরিবেশন করা রবীন্দ্র সংগীত শুনেছিলাম প্রানভরে। সন্ধ্যার আগে আগে কানায় কানায় ভরে যেত বই মেলা। এক বিকেলে বই মেলায় হঠাৎ দেখি প্রচন্ড হুল্লোড়। ব্যাপার কি? অভিনেতা আবুল খয়ের এসেছিলেন বইমেলায়। তখন তিনি দারুন জনপ্রিয়। তাকে নিয়ে সে জটলা। বই মেলার কোন এক স্টলে ঢুকে পড়ে ভক্তদের হাত থেকে আত্মরক্ষা করেছিলেন আবুল খয়ের। অন্য আরেক দিন হঠাৎ শুরু হয় ভাংচুর। সেদিনের ভাংচুর ছিল জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ প্রফেসর “ মহাজাতক”কে নিয়ে। প্রফেসর মহাজাতকের স্টল ছিল পরমানু শক্তি কমিশনের গেটের পাশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক ছাত্রনেতার প্রেম নিয়ে ভবিষ্যদবানী করেছিলেন মহাজাতক যা ছিল সম্পূর্ন মিথ্যে। সে ভাংচুরের পর মহাজাতকের স্টল আর খোলে নি। কবি নির্মলেন্দু গুন পুকুর পাড়ের বইয়ের স্টলে বসে অটোগ্রাফ দিতেন। খুব সম্ভবত সে বছরের বইমেলাতেই এক বিকেলে বাংলা একাডেমীর মাঠের চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছিলাম ঝাকড়া চুলের বাবরী দোলানো শিল্পী এস,এম সুলতানকে।

গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল একুশে ফেব্রুয়ারী । বিশে ফেব্রুয়ারী রাত বারোটার আগে আগে শহীদ মিনারে গিয়ে হাজির হলাম।শহীদ মিনারে একে একে টানানো হচ্ছিল শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের এর ছবিগুলো। এই ছবি টানানো নিয়ে মারামারি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে। বেশ কয়েকটা বোমাও ফাটে সে রাতে।এর পর থেকে শহীদ মিনারে ছবি টানানো নিষিদ্ধ করে দেন কর্তৃপক্ষ। রাতে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে পিজি হোস্টেলে ফিরে এসেছিলাম সবাই । পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারীর জনতার ঢলে যোগ দিয়ে সারাদিন হৈহুল্লোড় করে কাটিয়েছিলাম।সে বছরের একুশে ফেব্রুয়ারী দিনের সবচে’ মজার ব্যাপার যা মনে পড়ে তা হল ডাঃ শাকিলকে নিয়ে। আমাদের বন্ধু ডাঃ শাকিলের ডাক নাম ছিল আব্দুস শা। ঠিক এক বছর পর একুশে ফেব্রুয়ারীতেই দোয়েল চত্বরের কাছে লাল পাড়ের সাদা শাড়ী পরা তরুনী বান্ধবীকে খুজে পেয়েছিল আব্দুস শা । নিয়ম অনুযায়ী একুশে ফেব্রুয়ারীর পর বইমেলা চলেছিল আরো এক সপ্তাহ। কিন্তু বইমেলার সে টান আর খুজে পেতাম না একুশে ফেব্রুয়ারীর পর থেকে। একে একে আমাদের সবার পোস্টিং হয়ে গেল বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে। সে বছরের জন্য ভেঙ্গে গেল একুশের বই মেলা, ভেঙ্গে গেল আমাদের আড্ডা, কিন্তু রয়ে গেল ছিয়াশির বই মেলার স্মৃতি যা আজও অনেকাংশে উজ্জ্বল।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×