somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমাজতন্ত্রের শেষ দুর্গে (দশম পর্ব)

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিউবাতে চতুর্থ দিনে সারাদিন ধরে কিউবার তিন শহর ঘুরে ফিরে দেখার টিকেট কেটে রেখেছিলাম দুই দিন আগে।ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে, স্নান সেরে,সারাদিনের প্রস্তুতি নিয়ে রুম থেকে বেরোলাম সাতটার কিছুক্ষন পরে।নাস্তা শেষ করে হোটেল লবীতে পৌছানোর কিছুক্ষনের মধ্যেই মিঃ রামন তার ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হলেন।খাল পার বেয়ে ব্রীজের উপর দিয়ে ট্যাক্সি কিউবার মুল ভুখন্ডে ঢুকল। ভারাডেরো বিমানবন্দরকে বাঁয়ে রেখে হাইওয়ে দিয়ে ট্যক্সি ছুটল সান্তা ক্লারার দিকে। ভারাডেরো কিউবার মাতানজা প্রদেশের শহর এবং সান্তা ক্লারা শহর হল অন্য প্রদেশে। এ দেশের হাইওয়ে কানাডা আমেরিকার মত প্রশস্ত নয়, কিন্তু মসৃন। গাড়ীঘোড়া অনেক কম কিন্তু ভাঙ্গাচোরা নেই কোথাও।পনের বিশ কিলোমিটার পর ছোট এক শহরে পৌছলাম, নাম কার্ডিনাস। বাংলাদেশের উপজেলা শহরের মত ঘিঞ্জি, একটার গায়ে দাঁড়িয়ে আরেকটা বিল্ডিং। মূল শহরে রাস্তা গুলো সরু সরু এবং ঘোড়ার গাড়ি, পর্যটন বাস, স্কুটার প্রভৃতিতে মিলিয়ে ছোট খাট জ্যাম লেগে আছে। এ শহর পেরোতে সময় লাগল পনের বিশ মিনিটের মত।শহর কেন্দ্রে বেশ বড় পাচিল ঘেরা যায়গায় দাঁড়িয়ে আছে স্প্যানিশ আমলে নির্মিত গির্জা।সামান্য কয়েকটা দেশ ঘোরার অভিজ্ঞতায় যতটা দেখেছি সব দেশেই দখল করার পর বিজয়ী শাসকেরা সুন্দর করে তৈরী করেছে ধর্মীয় উপাসনালয়।শাসন শোষন টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্ম যে বিশেষভাবে উপযোগী তা বিলক্ষন জানতেন সে সময়ের দখলদারেরা।
কার্ডিনাস ছাড়িয়ে আবার উঠলাম হাইওয়েতে। এ হাইওয়ে বেশ প্রশস্ত ।ঘন্টাখানেক চলার পর রেল লাইন পেরিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে কয়েকটা ছোট ফলের দোকানে গাড়ী থামালাম।দোকানে কলা,তরমুজের পাশাপাশি আমাদের দেশের সফেদার মত কিন্তু আকারে কিছুটা বড় অচেনা ফল দেখে কিনে ফেললাম কয়েকটা। ত্রিনিদাদের একই রকম ফলকে ওরা বলতো সাফাডিলা যা আমাদের দেশের সফেদা।অনেকটা পোড়া বেল এর স্বাদের এই ফল গুলোর স্থানীয় নাম হল মায়া।ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে অধিকাংশ ফলই বেশ সুস্বাদু। কিউবার পেপে স্বাদে,গন্ধে এবং রঙ্গে অতুলনীয়।ভারাডেরো থেকে যতদুর যাচ্ছি পুরোটাই সবুজ সমতলভূমি এবং বিভিন্ন ধরনের ফলের বাগান দু’ধারে।কমলা,আখ,কলা এবং আমের বিশাল বিশাল বাগান। সান্তা ক্লারার থেকে ঘন্টা খানেক আগে ডানদিকে পড়ল ভাংগা মরচে পড়া পরিত্যাক্ত চিনির মিল। দু’হাজার সালের দিকে বিশ্বব্যাপী চিনির বাজারে ধ্বস নামে।কিউবার প্রধান রফতানী পন্য চিনি অবিক্রীত থেকে যায়। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর নির্দেশে তখন বন্ধ করে দেওয়া হয় অনেক চিনিকল।ফিদেলের এ সিদ্ধান্ত ছিল আত্মঘাতী কারন কিছুদিন পরেই যখন চিনির দাম বাড়তে থাকে ততদিনে চিনির বাজার তখন কিউবার হাতছাড়া হয়ে যায়।এই মিল হয়ত সেই সময়ে বন্ধ করে দেওয়া চিনিকলগুলোর একটি।
সান্তা ক্লারা শহরে পৌছলাম দুপুর বারোটার দিকে। বাংলার শহর ইংরেজীতে হল town, স্প্যানশে villa, এবং ফরাসীতে ville। সে হিসেবে কিউবাতে এ শহরের নাম Villa Clara। শহরের প্রবেশমুখেই পড়ল চে'র মুর্তি, তার নীচে লেখা শহরের নাম। প্রচন্ড কাঠফাটা রোদ্দুরের মধ্যে টাক্সি গিয়ে থামল শহরের একপ্রান্তে চে’গুয়েভারা’র স্মৃতিসৌধে ।এ স্মৃতিসৌধে শায়িত আছেন অমর বিপ্লবী আরনেস্টো চে গুয়েভারা এবং তার উনত্রিশজন সঙ্গী।
চে’র সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ- ১৯২৮ সালের ১৪ই জুন আরজেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্ম নেন চে’ গুয়েভারা।বাবা মা নাম রাখেন আরনেস্টো।মেডিকেল স্কুলে ছাত্র থাকা অবস্থায়ই তিনি মোটর সাইকেলে সারা দক্ষিন আমেরিকা ঘুরে সাধারন জনগনের দুর্দশা দেখে ব্যাথিত হন।চিলির তামা খনির শ্রমিকদের কস্টকর জীবন, পেরুর চাষীদের দুরবস্থা ইত্যাদি দেখে তার বদ্ধমুল ধারনা জন্মে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ নিংড়ে নিচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে এবং শুধুমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই মেহনতী মানুষের মুক্তি সম্ভব।১৯৫৩ সালে গুয়াতেমালায় থাকা অবস্থায় কিউবার বিপ্লবীদের সাথে তার যোগাযোগ ঘটে। সে সময়ে গুয়াতেমালার গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ভুমি সংস্কার শুরু করেন।ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানীর দখলে বেশীরভাগ জমি থাকার কারনে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তারা। আমেরিকার পররাস্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডুলেস ছিলেন এ কোম্পানীর কর্নধার।সি আই এ’র মদদে সামরিক অভ্যুথানে উৎখাত হলেন প্রেসিডেন্ট Arbenz।পরবর্তিতে মেক্সিকো সিটিতে তার পরিচয় ঘটে দুই কিউবান বিপ্লবী ফিদেল এবং রাউল ক্যাস্ট্রোর সাথে। এ বছরে্র ২৬ শে জুলাই কিউবার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের সেনবাহিনীর গ্যারিসনে ব্যার্থ হামলার পর ফিদেল এবং এবং রাউল ক্যাস্ট্রো মেক্সিকোতে নির্বাসিত হন।সেখানে চে’ গুয়েভারা কিউবার নির্বাসিত বিপ্লবীদের সাথে সশস্ত্র সংগ্রামের ছক কাটেন।১৯৫৬ সালের ২৫শে নিভেম্বর পুরোনো ছোট জাহাজ "গ্রান্ড মা"তে করে তারা কিউবায় পৌছান। কিউবাতে পা রাখা মাত্রই বাতিস্তার সেনাবাহিনী আক্রমন চালায়। সে জাহাজের ৮২ জনের মধ্যে মাত্র ২২ জন বেঁচে ছিলেন। দুই বছর ধরে কিউবার বিভিন্ন পাহাড়,বন জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করেন চে'। ১৯৫৮ সালের ৩১ডিসেম্বর সান্তা ক্লারার যুদ্ধে কিউবার প্রেসিডেন্ট একনায়ক জেনারেল বাতিস্তার বাহিনীকে পরাজিত করে চে’র গেরিলা বাহিনী সান্তা ক্লারা দখল করে নেয়। সফল হয় কিউবার সশস্ত্র বিপ্লব।সান্তা ক্লারা পতনের মাত্র ১২ ঘন্টা পর হাভানা ছেড়ে পালিয়ে যান জেনারেল ফুলজেনসিয়ো বাতিস্তা। বিপ্লবোত্তর কিউবার পূনর্গঠন যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, স্বাক্ষরতা অভিযান, ভূমি সংস্কার,ইত্যাদিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন চে’।শিল্প মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী,সেনাবাহিনীর পরিচালক,কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইত্যাদির দায়িত্ব পালন করেন।১৯৬২ সালে সি আই এর মদদে ভিন্নমতাবলম্বীরা কিউবার Bay of PIgs এ হামলা চালালে চে’ তা কঠোর হস্তে দমন করেন।এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে কৌশলগত আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহ করতে সম্মত হয়।এই ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে রাশিয়া এবং আমেরিকা পৌছে যায় পারমানবিক সংঘাতের কাছাকাছি যা কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৫ সালে তিনি কিউবা ছেড়ে যান কঙ্গোতে। সেখানে বিপ্লব সঙ্গঠিত করার ব্যার্থ চেস্টা চালান। কোনমতে প্রান নিয়ে পালিয়ে আসেন। এরপর তিনি বলিভিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করার চেস্টা চালান।১৯৬৭সালের ৭ই অক্টোবর সি,আইএ’এর যোগসাজশে তিনি বলিভিয়ার সরকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।৯ই অক্টোবর আমেরিকার সমর্থনপুস্ট প্রেসিডেন্ট René Barrientos এর আদেশে হত্যা করা হয় চে’কে। তারপর তাকে অজ্ঞাত স্থানে কবর দেওয়া হয়।
চে’গুয়েভারা ছিলেন একজন শক্তিমান লেখক, সুবক্তা,দক্ষ সামরিক সংগঠক, আদর্শবাদী বিপ্লবী। চে’র জীবনীর উপর নির্মিত হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র, লেখা হয়েছে অনেক বই।শ্রেনী সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ, পুজিবাদ, মার্কসবাদ, গেরিলাযুদ্ধ, আত্মজীবনী ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর তার অসংখ্য রচনা রয়েছে।তার “মোটর সাইকেল ডায়েরী” বই অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র অন্যতম জনপ্রিয় চললচ্চিত্রগুলোর একটি। টাইম ম্যাগাজিনের জরীপে তিনি উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত শত ব্যাক্তিদের একজন। Alberto Korda এর তোলা “বীর গেরিলা”(Guerrillero Heroico ) শিরোনামে চে’র আলোকচিত্র Maryland Institute College of Art এর মতে পৃথিবীর সবচে’ বিখ্যাত আলোকচিত্র (চলবে)


সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ ভোর ৬:৩৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×