আমাদের বাড়ি একেবারে গ্রামে । যাকে বলে অজপাড়া গাঁ। বাড়ির চারদিকে অনেক গাছপালা। কোনদিকে বাঁশবাগান, কোনদিকে আমবাগান অন্যদিকে বড় তাল নারকেলের গাছ। সন্ধ্যা হলে বেশ অন্ধকার হয়ে যায়। ভুতুরে পরিবেশ যাকে বলে। সেই ছোটবেলা দেখতাম আমাদের বাড়িতেই সন্ধ্যার পর কেউ ঘরের বাইরে গেলে অন্যকাউকে সাথে নিয়ে যেত। সে যে কাজে যেত তা করত আর সাথে যাকে নিয়ে গেছে তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলত। সারাদিন যেভাবে কথা বলত , এই রাতের বেলা তার থেকে অনেক জোর গলায় বলত। এই কাজ তারা কেন করত জানেন ? কারন সন্ধ্যা হলেই সবার মনে ভয় কাজ করত । সেই ভয় দূর করার জন্য তারা খুব জোরে আওয়াজ করত একি সাথে সে যে ভয় পেয়েছে তা যেন তার সাথের মানুষ বুঝতে না পারে সেজন্য জোরে কথা বলত। ঘরে চলে এলেই তাদের আওয়াজ স্বাভাবিক হয়ে যেত ।
ইদানিং মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। প্রবাসী সাংবাদিক সিরাজুর রহমান অনেক আগেই বলেছেন মিলিয়ন আর লাখের লেজেগোবরে অবস্থার কথা । ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখিকা তার বইয়ে সে বিষয়ে গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই বিষয়ে যারাই কথা বলেছে তাদের রাজাকার ট্যাগ দিয়ে থামানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সর্বশেষ বোমাটি ফাটিয়েছেন একজন মহিলা। যার স্বামী ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, সেক্টর কমান্ডার , রণাঙ্গনের সক্রিয় যোদ্ধা । তিনি হলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়ার স্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ।
তারপর পরই সে আলোচনায় যোগ দিয়েছেন বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় । এই প্রত্যুত্তরে সরকারদলীয় নেতাদের খুব বেশি উচ্চস্বরে চিৎকার করতে শোনা যাচ্ছে। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাও হয়ে গেছে।
অনেকের চিৎকারের মাঝে প্রয়াত শিল্পী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে মিসেস শাওন মাহমুদের কথা একটু ব্যতিক্রম লেগেছে। তিনি বাবু গয়েসশর চন্দ্র রায়ের বাড়ির ঠিকানা চেয়েছেন সাংবাদিকদের কাছে । তার ইচ্ছা হাত থাকতে মুখে মুখে তিনি করবেন না। এই সংখ্যা নিয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আগেই বক্তব্য দিয়েছেন, যা মুলত নতুন করে বলেছেন বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় । মিসেস মাহমুদের কথার জবাবে মিনার চৌধুরি আবার প্রশ্ন করেন , তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বাসার ঠিকানাও চাইবেন কিনা ? যদিও পরিবারের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে আলতাফ মাহমুদকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন একজন বীরপ্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। সে বিষয় নিয়ে মিসেস মাহমুদ বা অন্য নেতাদের খুব বেশি প্রতিবাদ বা বিচার চাইতে দেখা যায়নি।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যার সাথে কিছু মানুষ যারা যুদ্ধের একেবারে শেষ বেলা মারা যায় তাদের ভুমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জনাব বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।
https://www.youtube.com/watch?v=7LnusjgVNjo&feature=youtu.be
তারা অনেকেই পাক সরকারের অধীনে বহাল তবিয়তে চাকুরি করেছেন। অনেকেই নাকি রেডিওতে পাকসেনাদের উতসাহ দিতে কবিতা আবৃতি করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পাকসেনাদের হামলার শিকার শুরুর দিকে হলেও শিক্ষকদের অনেকেই ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরাপদে তাদের সরকারী বাসভবনে থেকেছেন।
আর জহির রায়হান মারা গেলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর। অনেকেই বলে কলকাতায় বাংলাদেশের নেতাদের কর্মকাণ্ডের তিনি সাক্ষী ছিলেন , সেইসব যাতে ফাঁস না হয় তার জন্য তাকে আমাদের দেশের মানুষ আরো পরিষ্কার করে বললে মুজিবনগর সরকারের নেতারা হত্যা করে যার লাশ আজো তার পরিবার পায়নি। এই হত্যাকাণ্ড নিয়েও খুব বেশি কথা কাউকে বলতে শোনা যায় না। কোন শহীদের জন্য আমরা জীবন দিয়ে দেই আবার কারো জন্য নীরব দর্শক হয়ে যাই।
এমন হাজারো বিতর্কিত বিষয় জড়িয়ে আছে। আমরা তরুন প্রজন্ম , আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, বইয়ে পড়েছি । ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বর স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে যুদ্ধের গল্প শুনেছি । শুনে শুনে আমাদের শিহরন জেগেছে। নিজের অজান্তেই মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তরে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে দিয়েছি।
আজ যখন সংখ্যানিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে , তখন উচিত ছিলো অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত উপায়ে এই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে আসলে কতজন শহীদ হয়েছে – ৩ লক্ষ নাকি ৩ মিলিয়ন – তা জাতিকে জানানো।
তা না করে যখন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের খুব জোরে চিৎকার করতে দেখি , তখন মনে হয় তারা হয়ত কোন অজানা ভয় দুর করার জন্য মুল আলোচনা বাদ দিয়ে উচ্চস্বরে আওয়াজ করছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৩৯