somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জল দাও আমার শিকড়ে...

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষের মন কখনো কখনো ভবিষ্যত দেখায়। খুব আচমকা...হতে পারে ক্ষীণ...এবং প্রখর দ্রুতির। এমন হয়, এই অতিপ্রাকৃত পূর্বাভাস কখনো কখনো দ্রষ্টার উপলব্ধির বাইরে চলে যায়। পরে আবার সময় মত ফিরে আসে। যদিও তখন দৃশ্যগুলো পরিচিত মনে হয়; মনে হয় এরকম আগেও কখনো ঘটেছে...কিন্তু সত্যিকার অর্থেই ঘটনাটি প্রথম ঘটেছে। অনেকটা 'রূবি রায়'-এর মত তখন চোখ কপালে তুলে বলতে হয়...কোথায় যেন দেখেছি!

এই আচমকা ভবিষ্যতের পাশাপাশি-কিছু কিছু সময় যেন সামনে এসে দাঁড়ায় নিয়তির মত। হঠাৎ দেখা কোন ছোট্ট ছিমছাম বাড়ি দেখে স্কুল পড়ুয়া কোন মেয়ে হয়তো একদিন পথ চলা থামিয়ে দিয়েছিল; ভেবেছিল, 'আমাদের যদি এরকম একটা বাড়ি থাকতো, তাহলে আমি এককোনে একটা বনঝাউ-এর গাছ লাগাতাম!' সেই ছোট্ট সময়ের সন্তুষ্টি কিংবা অপ্রাপ্তি নিয়ে সময় যেন তার ভবিতব্য ঠিক করে রেখেছে। মেয়েটির হয়তোবা মনেও নেই, অথচ কুড়ি বছর পরে সে ঠিকই সে বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। বনঝাউ-এর গাছটা বোনার সময় তার মনে হচ্ছিল-এরকমটা যেন আগেও করেছি!

আমার দর্শন শাস্ত্রের ক্লাস আপাতত শেষ। এবার ক্যাম্পাস অধ্যায়ে প্রবেশ করব।

ক্যাম্পাসে প্রথম যেদিন পা রাখলাম, এককিলো পার হয়েই হাতের বাঁদিকে স্টুডেন্টস ক্যান্টিন। সিগারেটের তেষ্টায় পড়িমড়ি করে দে ছুট! ক্যান্টিনের দরজা দিয়ে বের হতে গিয়েই পোস্টার-টার দিকে নজর পড়ল। প্রথমে লোগো। একটা তবলা...তার গায়ে লিখা শিকড়, শা.বি.প্র.বি...নিচে সুন্দর একটা শ্লোগানঃ 'মুক্ত সংস্কৃতিতে গড়ে তুলি মানববন্ধন'। লেখাটা পড়লাম; একবার, দুবার, তিনবার। একটা মাত্রাবৃত্ত ছন্দের টান আছে কথাটাতে। আওড়াতে ভালো লাগে। পুরো পোস্টারটা পড়লাম-সদস্য সংগ্রহ সপ্তাহ চলছে। একটু হাসলাম। সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াটা সবখানেই বোধহয় একরকম। পেছনের অনেক চড়াই উৎরাইয়ের কথা মনে পড়ল। ক্যান্টিন থেকে বের হলাম এবং ভর্তি সংক্রান্ত জটিলতায় একসময় পোস্টারটার কথা ভুলে গেলাম। বেমালুম।

ভার্সিটিতে আমার বয়স তখন একমাস। আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা ক'জন লাইব্রেরীর পাশে বসে। হামজা ভাই এসে ডাকলেন আমাকে আর যুথিকে। হামজা ভাইয়ের ডাকার স্টাইলটা অদ্ভুত। দূরে বসা কাউকে ডাকতে হলে আমরা হাত দিয়ে ইশারা করি। অথচ হামজা ভাই একবার মাত্র মাথা ঝাঁকিয়ে মিটি মিটি হাসতে থাকেন। উপেক্ষা করার উপায় নেই। তিনি আমাকে বললেন, 'শার্লি তোমাদের দুজনকে খুঁজছে। এ'বিল্ডিং ৩১০ নাম্বার রুমে চলে যাও। কুইক।
আমরা দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম! আমাদের অপরাধ? হামজা ভাই বললেন; আগে তো যাও। আমি টিউশনি সেরে আসছি।'
চলে গেলেন তিনি।
আমরা দুজন মোটামুটি দ্বিধাগ্রস্থের মত গেলাম এ'বিল্ডিং এ। দেখি ওখানে কিসের যেন একটা রিহার্সাল হচ্ছে। আমাদের দেখে সবাই থেমে গেল। পরিস্থিতিটা কিছুটা বিব্রতকর তো বটেই! আমি তাড়াহুড়ো করে নিজেদের পরিচয় দিলামঃ ইকনমিক্স, ১/১। শ্যামলা মতন একটা আপু, যিনি ধমকে ধমকে কথা বলছিলেন (পরে বুঝেছি, উনি এভাবেই কথা বলেন), তিনি বললেন, 'ও তোমরা? এতো দেরি করেছ কেন? কয়টা বাজে?'
আমাদের তো প্রায় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা!
তিনি এসে আমার হাত ধরলেন-এসো। তারপর হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন পাশের রুমে। ওখানে নাচের রিহার্সাল হচ্ছিল। ইন্সট্রাক্টর আনন্দ দা। উনার পরিচয় দিয়ে শার্লি আপু আমাকে দেখিয়ে আনন্দ দা কে বললেন, 'এই নাও তোমার নাচের পারফরমার'।
উনার কথা শুনে আমার তো আক্কেল গুরুম! জীবনে কখনো জোড়ে লাফও দেইনি, আর আমি করব নাচ! প্রতিবাদ করার আগেই শার্লি আপু উধাও।
আসলে সমস্যার মূলে ছিল সম্ভবত শুভ। সে শার্লি আপুকে আমাদের দুজনের নাম পরিচয় বলেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের প্রতিভা(!)-র কথা বলতে গিয়ে উদো-বুধো গোলমাল করে ফেলেছে। এবং এই ঘটনার অব্যবহৃত পরের মূহুর্তেই যুথিকে দেখা গেছে গানের ফ্লোরে গোমড়া মুখে বসে থাকতে।
এই ছিল শিকড়ে আমার প্রথম দিন। কিংবা বলা যায় ক্যাম্পাসের আমার প্রাণময় জীবনের প্রথম দিন। সেই প্রথমদিন ক্যান্টিনে যে পোস্টার দেখে আমি থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যে মন্ত্রটা আওড়েছিলাম আনমনে, সেই মন্ত্রই একসময় আমার উপলক্ষ হয়ে উঠল। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু সময়।
চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসে। কেন? মমতার এই চিরন্তনী রূপ আর কোথায় পাব?
সেদিন খুব ঝড়-জল ছিল। গানের রিহার্সাল চলছে। আমার গানের সাথে লাইভ কোরিওগ্রাফি যাবে। তাই নির্ভুল ভাবে আমার গানটা রেকর্ড করা হচ্ছে। গিটারে আমি, সাথি, অনল; বাঁশিতে অপু, তবলায় কল্লোল, মৃদঙ্গ বাজাচ্ছে প্রতিক, মন্দিরায় সিজু ভাই, হারমোনিয়ামে মামুন ভাই, গানের হামিং এ আছে ইয়েন, মামুন ভাই, সিজুভাই, কনা, ঈশিতা, চৈতি, হিমেল, আর কোরিওগ্রাফিতে যুথি আর মৌলি।
প্রচন্ড বৃষ্টি। আমি জানালার দিকে পেছন ফিরে গাইছিঃ

"আমরা জেগে আছি এই ধূসর রাত্রিতে,
তোমাকেই এনে দেব পৃথিবীর সবচেয়ে উজ্জ্বল দিন;
প্রিয় মৃত্তিকা।"

হঠাৎ লক্ষ করলাম, ভাঙ্গা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে আমার চারপাশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। গান তো থামানোর উপায় নেই! রেকর্ড হচ্ছে। তবু আমি চোখ বন্ধ করে গাইছিঃ

"তোমার বুকের মমতায় কেঁদে ওঠে মাগো একদিন..."

হঠাৎ চোখ খুলে দেখি, আমার পেছনে বাকীরা সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পিঠে পড়া বৃষ্টির জল ওরা নিজেদের পিঠে নিয়ে আমাকে গেয়ে যাবার সুযোগ করে দিচ্ছে। চোখে পানি এসে গেল দেখে। সেদিন যে অনুভূতি নিয়ে গানটা আমি করেছিলাম, তেমন করে সারাজীবনেও আর গাইতে পারব না। এই ছেলে মেয়ে গুলোর মমতায় সেদিন সিক্ত হয়ে উঠেছিল প্রিয় মৃত্তিকা স্বয়ং। আমার পেছনে সামনে একপাল পাগল ছেলে মেয়েরা-যাদের দেখলে আমার পাগলই থাকতে ইচ্ছে করে।
অদ্ভুত ভালো মানুষ কিছু পাগল।

হ্যাঁ চলে আসার দিন আমি কেঁদেছিলাম। নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। ওরা হয়তো ভেবেছিল, এই কঠোর মানুষটা কাঁদতে জানে? আশ্চর্য! অথচ ওরা জানেনা, ওদের মত শিল্পীর সামনে, পাথরও নরম কাঁদামাটির দলা হয়ে যায়। ওরাই পারে সবাইকে নিজের করে নিতে। নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে, একটা শ্লোগানের নিচে জমা পড়ে যায় আজীবনের জন্য।

আর আমি আজো সেই সব দিনের কথা মনে করে করে উদাস হয়ে নিজের স্টেশনে নামতে ভুলে যাই। নিজের বোকামিতে হেসে ফেলে, নেমে পড়ি দু-এক স্টেশন পরে। নিজেকে তখন আমার তোমাদেরই মত মনে হয়। মনে হয়, এইতো আছি! নতুন দিনের মোড় ঘুরেই দেখা হবে তোমাদের সাথে! আমি আনন্দে হাঁটতে থাকি গন্তব্যহীন...।
তখন আমি আনমনে বলি,
কখনোবা চিৎকার করে বলি,

"আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়;
এই হোক শেষ পরিচয়।"


শিকড় আড্ডায় সিনেমা চলছে

নবীনবরণ

নাটক শেষে বাউ

কথকের গান-প্রিয় মৃত্তিকা

সিজু ভাইয়ের গান

১০ বছর পূর্তির র‌্যালি

দশ বছর পূর্তি-শিকড় কর্নার

১৬ই ডিসেম্বরের অনুষ্ঠান

শিকড়ের মঞ্চ

শিকড়ের তিন নিবেদিত প্রাণ

মেগা গেট টুগেদার (ফার্স্ট টু লাস্ট ব্যাচ)

শিকড় আড্ডা

পহেলা বৈশাখে শিকড়ের প্রধান উপদেষ্টা জাফর স্যারের সাথে শিকড়ের টেন্টবাসীরা

শিকড়ের অনুষ্ঠানে দম্পতি

বৈশাখ বরণ র‌্যালি

শিকড় পিকনিক-ক্যাম্পাস টিলা

আমাদের শহীদ মিনারে ওঠার সিঁড়ি, যে শহীদ মিনারে প্রথম অনুষ্ঠান শিকড়ের

শহীদ মিনার

সাংগঠনিক সপ্তাহ

স্বাধীনতা দিবস

ক্যাম্পাস আড্ডায় শিকড়ের সাথে কথক




সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১২:০১
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয় দিবসের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানিয়ে । সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ২০২৫, ১৬ই ডিসেম্বর।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১৯




দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রানের এক সাগর রক্তের বিনিময়। দুই লক্ষাধিক মা বোনের সম্ভ্রম হারানো। লক্ষ শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত‍্যু। এক কোটি মানুষের বাস্তুহারা জিবন। লক্ষ কোটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×