Time Travel বা সময় পরিভ্রমণ, আক্ষরিক অর্থে 'সময় অক্ষ' বরাবর সঞ্চারণ। ন্যূনতম চতুর্মাত্রিক (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এবং সময়) এই ব্রহ্মাণ্ডে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা বরাবর স্থান পরিবর্তনের অনুরূপ এক ধারণা হল এই সময় অক্ষ বরাবর সঞ্চরণ বা কালমাত্রিক সরণ (temporal displacement)।
টাইম ট্রাভেল সায়েন্স ফিকশন লেখদের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি বিষয়। হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে: Time Travel History, Faster, What just happend, Time machine। বাংলাদেশে জাফর ইকবাল,সত্যজিৎ রায় প্রচুর বইয়ে অসংখ্য বার উল্লেখ করেছেন এর কথা। শয়ের উপর মুভি,কার্টুন বানানো হয়েছে টাইম ট্রাভেল নিয়ে। Men in Black Series, Frequency, Timecrimes, Source Code, X-men the future past, Star trek, Time machine, Terminator টাইম ট্রাভেলের উপর বানানো ছবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ও অনেক উল্লেখযোগ্য ছবি আছে।যেমন: 24, Time Machine, Action Replay, Baarar baar dekho, Love story 2050। কার্টুনে এসেছে বারবার,Ben 10, Superman, Tom & Jerry, Ultimate Spiderman, Doramonর মত নাম করা কার্টুন গুলোতে টাইম ট্রাভেল দেখানো হয়েছেন।
এখন কথা হচ্ছে যেটা নিয়ে এত মাতামাতি সেই টাইম ট্রাভেল কি সত্যিই সম্ভব?!?!? হ্যা, থিওরিট্যাকলি সম্ভব। টাইম ট্রাভেল ২ ধরনের হতে পারে।
১/ সময়ের পিছনের দিকে যাওয়া বা অতীতে যাওয়া
২/ সময়কে অতিক্রম করে ভবিষ্যতে যাওয়া।
আমরা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ভবিষ্যতে যেতে পারি। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে,সময়ের আপেক্ষিকতার সাহায্যে ভবিষ্যতে যাওয়া সম্ভব। আপেক্ষিকতাকে ব্যবহার করে সময়কে সম্প্রসারণ করা হয়। এক্ষেত্রে সময়ের পরিবর্তন ঘটে। এই পরির্বতনের ঘটার কারণ,সময় গতির এর উপর নির্ভর করে। আর এর সত্যতা প্রমাণিত। International Space Station (ISS) এ নভোচারীরা ৬ মাস থাকার পর পৃথিবীর সময় থেকে তাদের ০.০০৫ সেকেন্ডেরের ব্যবধান দেখা য়ায। এখানে তারা ৬ মাসে ০.০০৫ সেকেন্ডের টাইম ট্রাভেল করছে । ০.০০৫ সেকেন্ডে খুবই কম হলেও আমরা এর মাধ্যমে খুব সহজেই প্রমাণ পাই আলোর বেগকে কাজে লাগিয়ে টাইম ট্রাভেল সম্ভব। আপনি আলোর চেয়ে দ্রুত চলতে পারলে আপনি ভবিষ্যতে চলে যাবেন।
১৯৭৪ সালে ফ্রাঙ্ক টিপলার তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেন নিজের অক্ষের চারিদিকে দ্রুত ঘূর্ণায়মান এক অসীম দৈর্ঘ্যের চোঙ আদতে একটি সময় যন্ত্র এবং এর সাহায্যে সময় ভ্রমণ সম্ভব। টিপলারের অনুমান ছিল, যথেষ্ট বেগে ঘূর্ণায়মান সসীম দৈর্ঘ্যের চোঙের সাহায্যও সময় ভ্রমণের ধারণাটি বাস্তবায়িত করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে হকিং অবশ্য প্রমাণ করেন- কখনোই কোন সসীম দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা বিশিষ্ট সময় যন্ত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
এবার ”আইনষ্টাইন-রোজেন ব্রীজ বা ওয়ার্মহোল ” দ্বারা টাইম ট্রাভেলের ধারণায় আসি । ওয়ার্মহোল হচ্ছে অতি অল্প সময়ে মহাজাগতিক দূরত্ব অতিক্রম করার এক তাত্ত্বিক সম্ভাবনা।মনে করি, কোন ওয়ার্মহোলের দুই মুখে দু’টি ঘড়ি রয়েছে যা উভয়েই ২০০০ সাল দেখাচ্ছে, আপেক্ষিক গতিতে ঘুরে এলে ওয়ার্মহোলের ত্বরাণ্বিত মুখ এই অঞ্চলে ফিরে আসবে, স্থির মুখের মত ত্বরাণ্বিত মুখের ঘড়ির পাঠের সাথে ধরে নেই তা ২০০৪ যখন স্থির মুখের ঘড়ির সময় হবে ২০১২। একই অঞ্চল,কিন্ত এখন 8 আট বছরের অতীতে।ওয়ার্মহোল আমাদের আসেপাশেই থাকতেও পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম অস্থিরতার কারণে সেটা টিকিয়ে রাখা যাবে না বললেই চলে। ১ মিটার চওড়া একটি ওয়ার্মহোলকে স্থির রাখার জন্য সূর্যের ১০ বিলিয়ন বছরেরও অধিক সময়ে উৎপাদিত শক্তির সমান ঋণাত্মক শক্তির যোগান দিতে হবে । যেই কারণে অনেক বিজ্ঞানী ই ওয়ার্মহোল কে গাঁজাখুরি সায়েন্স ফিকশন বলে মনে করেন। আবার যাদের মতে ওয়ার্মহোল থাকার যটেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে তাদের মধ্যে স্টিফেন হকিং অন্যতম একজন। তিনি জীবদ্দশায় ওয়ার্মহোল নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন।
পদার্থবিজ্ঞানীদের অনেকেই বিশ্বাস করেন তত্ত্বগত ভাবে সময় ভ্রমণ সম্ভব হলেও তা বাস্তবসম্মত নয় কারণ এতে 'কার্যকারণ সম্পর্ক' (Causality) বিঘ্নিত হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী সময় ভ্রমণের সম্ভাবনাশূন্যতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বহু Paradox-র অবতারণা করেছেন। প্যারাডক্স মানে হল পরস্পরবিরোধী বক্ত্যব বা যুক্তি। এ প্রসঙ্গে হকিংয়ের Mad scientist paradox বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। ধরা যাক এক উন্মত্ত বিজ্ঞানী কোনভাবে তাঁর নিজস্ব অতীতে ফিরে গিয়ে নিজেকে হত্যা করলেন। এক্ষেত্রে যেহেতু সেই বিজ্ঞানীর অতীত প্রতিভূ নিহত হলেন, সেহেতু সেই হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময় থেকে এই ব্রহ্মাণ্ডে আর তাঁর কোন অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে যে, তাহলে সেই বিজ্ঞানীর হত্যাকারী কে???
এমন ই আরেকটি সবচেয়ে বিখ্যাত প্যারাডক্স Grandfather পারাডক্স। আপনি যদি অতীত গিয়ে আপনার বালক দাদাকে হত্যা করেন,তাহলে আপনি আসলেন কোথাথেকে?!?!? সময় ভ্রমণের সম্ভাবনার কথা স্বীকার করে নিলে আমাদের এমন আরও বহু কূটাভাসের সম্মুখীন হতে হয়।অবশ্য রাশিয়ার পদার্থবিদ নভিকভের মতে, পদার্থবিদ্যায় যদি বহুবিশ্ব বা Paralal Universe-র অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়, তাহলে সময় ভ্রমণ সংক্রান্ত প্যারাডক্সের উত্তর দেওয়া সম্ভব হবে। এই থিউরি অনুযায়ী আমরা যে মহাবিশ্বে আছি সেরকম অসীম সংখ্যক মহাবিশ্ব বর্তমান। এই মহাবিশ্বগুলো প্রায় একই রকম কিন্তু একটু আলাদা। সেখানে আমি আপনি সবাই আছি কিন্তু একটু আলাদা ধরনের। যেমন এখানে আমি মেটালহেড (মেটাল গান লাভার), ওখানে হয়ত হিপহপ (একধরনের গান) লাভার!!
মনে করেন আমাদের মহাবিশ্বে আপনি একটা লুডুর ছক্কা ছুঁড়ে মারলেন। ছক্কাটা মাটিতে পড়ার পর আপনি দেখলেন উপরের পিঠে ৪ পড়েছে। অন্য মহাবিশ্বের অন্য আপনি দেখবেন উপরের পিঠে ৩। আরেক মহাবিশ্বের আরেক আপনি দেখবেন উপরের পিঠে ৬ পড়েছে!!!
সময় পরিভ্রমণ সম্ভব হলে তা হবে মূলত এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে। অর্থাৎ সময় পরিভ্রমণ করে আপনি যদি অতীতে গিয়ে আপনার দাদাকে মেরে ফেলেন তাহলে মূলত যা ঘটবে তা হচ্ছে আপনি সময় পরিভ্রমণ করে আমাদের চেনাজানা মহাবিশ্ব থেকে অন্য মহাবিশ্বে চলে যাবেন। সেখানে গিয়ে উপস্থিত হওয়া মাত্র সেই মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। সময়ের সাথে সাথে আপনি যত বিশৃঙ্খলা তৈরি করবেন ততোই মহাবিশ্ব দুটোর মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। একবার সময় পরিভ্রমণ শুরু হলে আপনি আর কোনভাবেই আপনার নিজের জগতে ফিরে আসতে পারবেন না।আপনি যদি অতীতে গিয়ে আপনার দাদার মত দেখতে কাউকে বালক বয়সে মেরে ফেলেন, তাহলে সে আসলে আপনার দাদা না। আপনার দাদার প্যারালাল কপি। ওই দুনিয়াতে করিম মারা যাওয়ায় করিম নাতি রহিমের জন্ম হবেনা। কিন্তু বাকি ইউনিভার্সগুলোতে ঠিক ই রহিমের জন্ম হবে।
অনেকেই মনে করেন যদি সময় পরিভ্রমণ আদৌ সম্ভব হত, তাহলে পৃথিবীতে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের সময়সঞ্চারীদের দেখা মিলত। কার্ল সেগান একবার বলেছিলেন,"কে বলতে পারে! হয়তো ভবিষ্যতের সময়ভ্রমণপিয়াসীরা ছদ্মবেশে আমাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।" অনেক সময়ই অনেকে দাবি করেছেন যে তাঁরা ভবিষ্যতের সময়সঞ্চারীদের চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের দাবির সমর্থনে তাঁরা সকলের সামনে কিছু প্রমাণও পেশ করেছেন। এর মধ্যে চার্লি চ্যাপলিনের 'দ্য সার্কাস'চলচ্চিত্রের একটি ছোট্ট অংশ (এটি Chaplin's Time Traveller নামে আন্তর্জাল দুনিয়ায় জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল) এবং ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার অন্তর্গত গোল্ডব্রিজে একটি সেতুর পুনরুদ্বোধন অনুষ্ঠানে গৃহীত একটি আলোকচিত্র উল্লেখযোগ্য। সময় ভ্রমণ নিয়ে অসংখ্য কাহিনীও শোনা গেছে বিভিন্ন সময়। প্রচলিত এই সব কাহিনীর মুখ্যচরিত্র, যেমন জন টাইটার, বব হোয়াইট, অ্যান্ড্রুুু কার্লসিন এবং এরকম আরও অনেককে বাস্তব চরিত্র বলে দাবি করেছেন অনেকেই। তবে এসমস্ত প্রমাণ বা গল্প- কোনটিই কখনো সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে নি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৮