©কাজী ফাতেমা ছবি
#বাচ্চাদের_প্রতি_নজর_দিন
দীর্ঘ দুই মাস আমার ছোট ছেলে তা-মীমের ক্লাসের সামনে দাঁড়াতে হতো-কারণ সে তখনো স্কুলে অভ্যস্ত হয়নি-খুব কান্নাকাটি করতো, তাই বাধ্য হয়েই আমাকে তার সামনে থাকতে হতো। এখন আল্লাহর রহমতে স্কুলে যা্ওয়ার জন্য পাগল।তাই স্কুল সম্পর্কে আর ছাত্র/ছাত্রী/শিক্ষকদের সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা হয়ে গেছে। তাছাড়া,বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে আসা যাওয়ার ফলে স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কেও ভাল ধারণা হয়ে গেছে। বাচ্চারা কেমন, তাদের মা বাবা বা গার্ডিয়ান কেমন, শিক্ষক/শিক্ষিরা'রা কেমন এক নিমেষেই বুঝা হয়ে যায়। আর বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরলে তাদের সাথে স্কুলের গল্প শুনে শুনে কত মারাত্মক ঘটনা দুর্ঘটনা চোখের সামনে দেখতে পাই। একটা স্কুলের পরিবেশ শিক্ষকরা ঠিক করতে পারেন কিন্তু আদৌ কি তাদের আয়ত্তে থাকে বাচ্চাদের কন্ট্রোল করার ক্ষমতা?
আমরাও পড়াশুনা করেছি-একেকজন শিক্ষককে আমরা বাঘের মত ভয় পেয়েছি। স্যারদের হাতে সব সময় বেত থাকতো-না মারলেও থাকতো। স্যারদের ম্যাডামদের সামনে দিয়ে গেলে আমরা মাথা নিচু করে হেঁটে যেতাম। ক্লাসে পড়াশুনা পারলে স্যার মেডামদের চেয়ে আদর হয়তো কেউ করে না। একটা ছাত্র ছাত্রীর প্রতি স্যারদের মায়া তখনই পড়ে যায় যখন বাচ্চাটা স্যারের ক্লাসে মনোযোগী হয়। ঠিকমতো হোমওয়ার্ক করে এবং ক্লাসের পড়াগুলো ঠিকঠাক টুকে আনে এবং ক্লাসের পড়াগুলো স্যারের কাছে দেয়। এই-যে বললাম এমন ছাত্র/ছাত্রীদের প্রতি স্যার-মেডামদের আলাদা টান থাকে।
যুগ পাল্টেছে-সভ্যতা পাল্টেছে, মানুষের ধ্যান ধারণা পাল্টেছে-মানুষ শিক্ষিত হয়েছে জ্ঞানে গরিমায়, বিত্ত বৈভবে আমাদের দেশের মানুষ দৌড়েঁর উপরই যেনো বড় হচ্ছে। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম -এক নিয়ম শৃঙ্খলার মাঝেই আমরা ক্লাসেও দুষ্টামি করতাম অথবা টিফিনের টাইমে সবাই মিলে মাঠে খেলতাম। কোনদিন স্যারদের সাথে বেয়াদবি করার চিন্তাই আসতো না। আমাদের মা-বাবা আমাদেরকে ঘরেই শিখিয়ে দিয়েছিলেন-শিক্ষকদের মনে কষ্ট দিলে তোমার কখনো পড়াশুনা হবে না-তুমি সাফল্য লাভ করবে না। খবরদার কখনো শিক্ষকদের সাথে উচ্চবাচ্য বা বেয়াদবী করবে না। সেই চিন্তাটা এখনো মাথায় সেঁটে আছে। এখনো স্কুলের শিক্ষক হয়তো আমার বড় হয়তো আমার ছোটও আছে-সামনে দিয়ে গেলে মনে হয় যেনো আমারই শিক্ষক যাচ্ছেন।
আসল কথায় আসি-আমার বাচ্চারা আগে অন্য একটা স্কুলে পড়তো। বাসা পাল্টানোর কারণে এখন আরেকটা স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। আমার ছেলেরা আসলেই একটু ভিতু টাইপের-এতটা চালাক বাচ্চা না তবে ছোটটা একটু চালাক আছে-চতুর নয়। বড় ছেলে এসে তার স্কুলের ঘটনা এসে খুলে বলতো-সে তখন ক্লাস ফাইভে পড়তো, বলতো মা-বন্ধুরা টিফিনের সময় ছাদে গিয়ে সিগারেট খায়। কোনোদিন বলতো মা-বাচ্চারা বোতলে প্রস্রাব করে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়েঁ মারতো। কোনোদিন বলতো মা-স্যারের সাথে বেয়াদবি করে ছাত্ররা। স্যার কথা বললে উল্টো স্যারকে দু চার কথা শুনিয়ে দেয়। অতিরিক্ত দুষ্টামির ফলে স্যার যদি কোনোদিন মারতো-তবে গার্ডিয়ানের সাথে বিরাট ঝামেলা হতো। এ নিয়ে বিচার আচার কত কিছু হয়ে যেতো।
আমার এক কলিগ আপা উনি অই স্কুলের কমিটির অভিভাবক সদস্য ছিলেন। তার কাছ থেকে শুনা নানা ঘটনা শুনে আতকে উঠতে হয় রীতিমত। এক বাচ্চাকে স্যার মেরেছিল দুষ্টামির কারণে, সে বাচ্চা বাসায় গিয়ে বিচার দিলে সেই অভিভাবক'রা এলাকার মাস্তান ঠিক করে স্যার-কে মারার জন্য। এই কথা এক কান দুই কান হওয়ার পর হেড স্যারের কানে আসে। তখন কমিটি এবং হেড স্যারের মধ্যস্থতায় স্যারকে অভিভাবকদের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। আমি তাজ্জব বনে যাই এমন অভিভাবক দেখে, যারা কি-না সন্তানকে ছোট বয়সেই এসব শিখাচ্ছে। ছেলেটি কি শিখলো? সে বড় হয়ে ঠিক এমনি মাস্তানদের কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করবে। তার কি এমন কল্যাণ তারা ডেকে আনলো।
আরেকটা ঘটনা এমন-একজন অংক টিচার তার ছাত্র/ছাত্রীদের খুব প্রিয়। কারণ তিনি নিজের চেষ্টায় যারা ভাল ছাত্র নয় তাদেরকে নিজের মত করে গড়ে নেন এবঙ সে ছাত্র/ছাত্রীরা পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করে। ফলে অনেক অভিভাবক চান যে এই শিক্ষকই যেনো তার বাচ্চাকে পড়ান। এ নিয়ে আবার অন্য শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অন্য শিক্ষকরা মিলে একজন ছাত্রীকে ট্রেনিং দিলো, যে যেনো স্যারের নামে শ্লীলতাহানির বদনাম তুলে। ঐ ছাত্রীর অভিভাবকরা মিলে এ কাজ করে। অবশেষে সেই ছাত্রী স্যারের নামে কুৎসা রটনা করে আর সাথে সাথেই ঐ স্যার সাময়িক বরখাস্ত হন। বেশ কয়েকদিন বিচার সালিশের পর দেখা যায় সে ছাত্রী মিথ্যে বলেছে। সে ছাত্রী এবং অভিভাবক স্যারের কাছে বিচারেই ক্ষমা চান এবং আসল ঘটনা খুলে বলেন। স্যার আবার বহাল হন-মাঝে থেকে স্যারের কিছুটা সম্মান হানি হলো। তো ঐ ছাত্রী কি শিখলো? যখন তখন স্বার্থ উদ্ধার না হলেই তার চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটনা করবে সেই-তো শিখলো সে।
আরো অনেক ঘটনা আমার চোখের সামনে ঘটে যায়। এত বললে বলা শেষ হবে না। নতুন স্কুলেও একই সমস্যা। ছাত্র/ছাত্রীরা অতিরিক্ত বেয়াদব। স্যারদের কথা তো শুনেই না। উল্টো স্যারদের কে নিয়ে নানান বাজে কথা বলে । এক স্যার নাকি ক্লাসের সামনে দিয়ে গেলে ছাত্র'রা সমস্বরে ব লে উঠে বাদাম বুট বাদাম বুট-কোনো এক ছাত্র স্যারকে ডেকে বলে ফেলে স্যার বাদাম বুট বেচবেন? উফ কি ভয়ানক বেয়াদব। অথবা স্যার ক্লাস নিচ্ছেন-তো এক ছাত্র পিছন থেকে বলে উঠলো ভ্যা......স্যার ধমক দিলেন মারতে গেলেন-দেখা গেলো অন্য দিকে আরেকটা ছাত্র ভ্যা ভ্যা করে উঠছে। স্যারের পক্ষে আর ক্লাস সামলানো সম্ভব হয়ে উঠে না। আমার বাচ্চা এসে বলে-মা মাঝে মাঝে স্যারেদের মাথা এত গরম হয়। পিঠনি দিতে দিতে স্যার’রা বেঞ্চে উঠে যান। সহ্য ধৈর্য্যেরও একটা ক্ষমতা আছে। প্রতিটা ক্লাসেই দেখলাম এমন ছাত্র অহরহ। এত বেয়াদব যে স্যারদের কোনো কথাই তারা শুনতে চায় না। স্যারকে ক্লাসে রেখেই ছাত্র’রা ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে।
আগের স্কুলের কলগুলো ছিলো স্টিলের -সেই স্টিল বা লোহার কলগুলো ছাত্র'রা খুলে নিয়ে যায় এবং বেচে দেয়। এমন করে স্কুলে গেলে দেখা যায় একটা কলেরও মাথা নেই। শেষ পর্যন্ত প্লাস্টিকের গুলো লাগানো হয়। এই যে ছাত্ররা এইসব জিনিস নিয়ে বিক্রি করলো-টাকা দিয়ে কি করলো-সিগারেট খেলো নাকি মদ গাঁজা? এ খবর কি তার পরিবার/অভিভাবক জানে?
আমার ছেলে ক্লাসটিচার থেসে সীট আনবে-ওকে একশত টাকার নোট দিলাম। স্যার ক্লাসে আসার পর সে তার ব্যাগে হাত দিয়ে দেখে যে টাকা নেই। এমন প্রায়ই বাচ্চাদের টাকা চুরি যায়-রাবার পেন্সিল কলমের কথা বাদই দিলাম।
আচ্ছা এ বাচ্চাগুলো কি এসব শিক্ষকদের কাছ থেকে শিখবে? নাকি আপনাদের কাছ থেকে? পরিবার/অভিভাবকদের কাছ থেকে? বাচ্চাদের আপনার কি শিখাচ্ছেন? আসল শিক্ষার শুরু তবে কোথায়-নিজের ঘরে নাকি বিদ্যালয়ে? এমনও হয়েছে স্যার'রা বাচ্চাদেরকে মারলে আপনারা রাকডাক করে বিচার নিয়ে আসেন। এটা নৈমিত্তিক ঘটনা। তো ওদের আপনারা শাসন করুন। ওদের আসল শিক্ষা দিন। ওদের বুঝান শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি করার ফলাফল কি! আপনার বাচ্চার ভবিষ্যত সাফল্য কিন্তু আপনারাই খাচ্ছেন। ওদের যে মেধা তাতে একটু সভ্য হওয়ার মন্ত্র ছেড়ে দিলেই কিন্তু নিখাদ সোনা হাতের মুঠোয়।
আজ যখন তা-মীম'কে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলাম তখন এক স্যার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তা-মীমের মাথায় হাত দিয়ে অনেক দোয়া করলেন-বললেন অনেক মেধাবী ছেলে, কোনো ফাঁকি দেয় না ক্লাসে আর তার আদব কায়দা খুব ভাল। দোয়া করি বাবা অনেক বড় হও অনেক পড়াশুনা কর। আমার চোখে পানি এসে গেছে সুখে। স্যার গেলে দুষ্টুটাকে বললাম-বাবা দেখ্ না স্যার কত সুনাম করলেন কত ভাল লেগেছে বাবা তুই জানিস। এখন তো আমাদের কিছু লাগে না বাবা কেবল তোদের ভাল দেখতে চাই তোদের সাফল্য দেখতে চাই-মানুষ যেনো তোদের ভাল বলে-এটাই তো আসল সুখরে বাবা। বেটা দেখি মিচকি মিচকি হাসে। বললাম খবরদার ক্লাসে কিন্তু দুষ্টামি করবি না।
বড় ছেলে তা-সীনকে নিয়েও স্যার'রা প্রশংসা করেন-বলেন ছেলেটা অনেক ভাল ক্লাসে দুষ্টামি বা বেয়াদবী করে না। আপনারা আরো একটু নজর দিবেন ওর প্রতি। এসব শুনে কোন অভিভাবক আছে যে তার ভাল লাগবে না শুনি? তো এতেই বুঝা যায় ছাত্র/ছাত্রীদের প্রতি স্যার'রা ইদানিং অনেক অসন্তুষ্ট। আপনারা প্লিজ বাচ্চাদের বুঝান শিখান একটু নজর দিন-তাদের সাথে স্কুলের গল্প করুন। ভাল মন্দ শুদ্ধ অশুদ্ধ-কোন পথে গেলে ভাল হবে কোন পথে গেলে বিপদ হবে এসব শিখান। ওরা কার সাথে মিশছে কার সাথে খেলছে এসবের খবর রাখেন দয়া করে। আর আপনাদের এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলি কিন্তু স্কুলে গিয়েই সিগারেট খায়। এসব বিষয়ে এখন থেকেই নজর দিন। আমার বড় ছেলে বলল -এইটের এক ছেলে ইলেকট্রনিক সিগারেট খায়-শুনলেই মাথা দিয়ে আগুনের হল্কা উঠে। আল্লাহ আমাদের বাচ্চাদের তুমি হেফাজত করো মাবুদ। তোমার দয়ার ছায়া ওদের উপর রেখো-আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:১৩