somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলার ঐতিহ্য সরাইলের শিকারী কুকুর

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কুকুর নিয়ে কয়েকটা ভালো সিনেমার নাম বলতে পারেন? বলতে পারারই কথা। স্কুিব ডু সিনেমায় কুকুরের ভূমিকা বিশাল। কিংবা অ্যানিমেশন সিনেমা 'বোল্ট'? সুপারডগ। একটা বিখ্যাত সিনেমা আছে কুকুর নিয়ে -হাচি: আ ডগস টেল। আমার অনেক পছন্দের একটা সিনেমা 'এইট বিলো'। আটটা কুকুর কিভাবে বরফের মধ্যে আটকা পড়ে, তারপর বেচে উঠে এই নিয়ে কাহিনী। আবছাভাবে আরেকটা সিনেমার একটা দৃশ্য মনে পড়ছে। একটা কুকুর হারিয়ে গিয়েছিল - তারপর কিভাবে যেন অনেক দিন পরে ঘুরে ফিরে সে আবার ফিরে আসে মনিবের কাছে। সিনেমার নাম মনে করতে পারছি না। কুকুর প্রধান চরিত্র না হলেও সিনেমায় নায়কের সাথে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবেও কুকুর বেশ দারুন। এই পোস্টটা কুকুরদের সিনেমা নিয়ে নয়, এই পোস্টটা কুকুর নিয়ে।

কিছুদিন আগে ভোলার চর কুকড়ি মুকড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। শোনা গেল সেখানে আছে কিছু কুকুর। কেশরওয়ালা কুকুর। পর্তুগীজরা নিয়ে এসেছিল, দ্বীপেই থেকে যায় ওগুলো। এখন জঙ্গলে থাকে, হরিন মেরে খায়। চর কুকড়ি মুকড়িেত আছে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও চর মনপুরায় আছে এমন তথ্য পেয়েছি। কেশরওয়ালা কুকুর দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি। কুকুর দেখার জন্য মনপুরা যাবার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। এইরকম কুকুর সম্পর্কে শুনেছি হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে গিয়ে। দ্বীপে নামার আগেই সাবধান করে দেয়া হয়েছিল - যদি জঙ্গলে যাই, তবে যেন কুকুর থেেক সাবধান থাকি। একাকী বনে ঘোরা উচিত হবে না, কুকুর দেখলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা জরুরী। নিঝুম দ্বীপের ওই কুকুরগুলো আমাদের দেশী নেড়ী কুকুরই। যারা গিয়েছিল, সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। পর্যাপ্ত খাদ্য দেয়ার সুেযাগ ছিল না গরীব মানুষগুলোর। কুকুরগুলো তাই খােদ্যর খোজে বনের দিকে সরে গেল। তারাই বংশানুক্রমে এখন বন্য কুকুর হয়ে গিয়েছে। দল বেধে থাকে, হরিন শিকার করে খায়। নিঝুম দ্বীপে বন্য কুকুরের আক্রমেনর শিকার হওয়া একটি হরিন শাবক পাওয়া গিয়েছিল সেবার।


বাচ্চাকালে কুকুর পালবো এরকম একটা শখ ছিল। শখটা মারা গেছে ঠিক তা নয়, তবে অনেক সংকীর্ণ হয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, শুধু সরাইলের কুকুর হলেই পালবো, অন্য কিছু নয়। সরাইলের কুকুর সম্পর্কে আমার একটা দুর্বলতা আছে, অনেক আগে যখন গোগ্রাসে বই গিলতাম, তখন কোথাও সরাইলের কুকুেরর কথা জানতে পেরেছিলাম। চর কুকড়ি মুকড়ির কেশরওয়ালা কুকুর খুজতে গিয়ে আবারও সেই সরাইলের কুকুেরর কথা চলে এল।

সরাইল ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার একটি উপজেলা। সরাইলের কুকুর পাওয়া যায় এখানেই। সরাইলের কুকুর মূলত একপ্রকার গ্রে-হাউন্ড। এই কুকুর অন্যান্য কুকুরের মত নয়, চেহারা আকৃতি আচরন - সব দিকেই আলাদা। মুখের আদল অনেকটা শেয়ালের মত। কান ও লেজ লম্বা। সরাইলের কুকুেরর গায়ে বাঘের মত ডোরাকাটা দাগ আছে। সরাইলের ককুরের মধ্যে সবই খাটি সরাইল নয়। সংকর সরাইল রয়েছে। সরাইলের কুকুর অন্যান্য কুকুরের মত আহ্লাদী নয়। জড়িয়ে ধরা টাইপের আদর পছন্দ করে না। শিকারী কুকুর। খুব দ্রুত ছুটতে পারে।


স্বাভাবিক ভাবেই সরাইলের কুকুর নিয়ে কিছু কিংবদ্ন্তী চালু আছে। সরাইল কুকুরের জন্ম নিয়ে এই মিথ। মুখায়ব শেয়ালের মত হওয়ায় একটি মিথ শেয়ালের সাথে সম্পৃক্ত। বলা হয় একবার সরাইলের দেওয়ান জমিদার হাতি নিয়ে কলকাতা যাচ্ছিলেন। পথে তিনি এই কুকুরটি দেখতে পান। কেনার চেষ্টা করেন কিন্তু মালিক রাজী ছিল না। শেষ পর্যন্ত হাতির বিনিময়ে এই কুকুর কেনা হল । পরে কুকুরের সাথে শেয়ালের সংমিশ্রনে যে প্রজাতি তৈরী হয় তাই সরাইলের কুকুর। অপর মিথটি সরাইলের গায়ের রঙ এর কারণে। বলা হয় জমিদার দেওয়ানের এই কুকুর একসময় হারিয়ে যায় বনে। বেশ কিছুদিন পরে কুকুরটি ফিরে আসে গর্ভবতী হয়ে। বাচ্চা প্রসব করার পরে দেখা গেল এর সাথে বাঘের বেশ মিল। ধারণা করা হয়, বাঘের সাথে মিলনে এই প্রজাতির উতপন্ন। মিথ যাই বলুক না কেন, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এই ধরনের মিলন প্রাকৃতিক নয়। এক প্রজাতির কুকুরের সাথে আরেক প্রজাতির কুকুরের মিলন হতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্কর পিতা-মাতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট নিয়ে জন্মাতে পারে। কিন্তু এক প্রানী অন্য প্রাণীর সাথে মিলন প্রাকৃতিক নয়। অবশ্য বর্তমানে বিজ্ঞান এ ধরনের সংকর তৈরী করার চেষ্টা করছে। ঢাকা চিড়িয়াখানায়ও এক সময় বাঘ এবং সিংহী একত্রে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর - আশা ছিল তেমন কিছু একটা হবে। হয়নি। অবশ্য উন্নত বিশ্বে এই ধরনের সঙ্কর প্রাণী রয়েছে।


সরাইলের কুকুর বর্তমানে অস্তিত্বের হুমকীতে আছে। সারা দেশে খাটি সরাইল কুকুর আছে হাতে গোনা। একসময় সরাইলের কুকুর পালন করতো সরাইলের বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু পারিবািরক এই ব্যাবসা থেকে সরে এসেছে অনেকেই। রয়ে গেছে সরাইল উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের অজিত লাল দাস। বাচ্চা সরাইল বিক্রি হয়, পাশাপাশি পূর্ণ বয়স্ক সরাইলও। বাচ্চা সরাইলের দাম ২০/২৫ হাার আর বড় সরাইলের দাম ৬০/৬৫ কিংবা আরও বেশী। এই সরাইল কুকুর পালেন বিত্তশালী মানুষরা। প্রতিদিন দুই আড়াই কেজি খাদ্য দিতে হয় একটি পূর্ণবয়স্ক সরাইলকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর দুটো সরাইল কুকুর ছিল। এই সরাইল কুকুর নিয়ে বেশ কিছু কাহিনী রয়েছে। শোনা যায়, গেটে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপস্থিতি জানিয়ে দিয়েছিল এই কুকুরগুলো। ফলে জেনারেল ওসমানী বেচে গিয়েছিলেন। আরেকটি কাহিনী থেকে জানা যায়, পাশের বাড়ির আদুরে কুকুরকে নাকি ছিড়ে ফেলেছিল এই সরাইলরা। প্রচন্ড প্রভুভক্ত এই কুকুর হিংস্রতায় কম নয়। শিকার এদের রক্তে। সরাইলের কুকুরের মূল ক্ষমতা কিন্তু তার ঘ্রাণশক্তিতে নয় বরং তার দৃষ্টিশক্তিতে। খরগোস, শেয়াল, বাঘডাশ ইত্যাদি শিকারে খুব দক্ষ।

ড: শাহজাহান ঠাকুর নামে একজন গবেষক ২০০১ সালে বানিজ্যিক ভিত্তিতে সরাইল প্রজননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিভিন্ন গবেষনায় তিনি প্রমান করেছিলেন সরাইলের কুকুর আমাদের ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিভিন্ন কারণে তার এই উদ্যোগ শেষ পর্য়ন্ত টিকে থাকে নি। সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে RAB তাদের ডগস্কোয়াডে বারটি সরাইলের কুকুর যোগ করতে যাচ্ছে। প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এদেরকে তৈরী করা হবে। এই উদ্যোগটা ভালো। প্রয়োজন আছে সরকারী উদ্যোগে এবং বানিজ্যিক উদ্যোগে সরাইলের কুকুর প্রজনন এবং রপ্তানি করা। রয়াল বেঙ্গল টাইগারের মত হয়তো সরাইলের কুকুরও একসময় বাংলাদেশকে চিনতে সাহায্য করবে।

সরাইলের কুকুর দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। সরাইলের গল্প শুনেছি, পড়েছি, লিখলাম। দেখার আশা এখনো ছাড়ি নাই, এই কুকুর না দেখে মরা ঠিক হবে না। খুব শীঘ্রই হয়তো বেড়িয়ে পড়ব সরাইলের সন্ধানে।

তথ্যসূত্র:
Click This Link

Click This Link

ছবি কৃতজ্ঞতা:
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:৪৯
৬৩টি মন্তব্য ৬২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×