somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র: সব ধরনের চলচ্চিত্রের পূর্ণ তালিকা

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিনেমা নির্মানের শুরুর দিকেই যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা নির্মান হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব সিনেমার তালিকায় ‘যুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমা’ (War Films) আসন পাকা করে নিল। গত শতকে পৃথিবীতে যত যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে তার প্রায় সব নিয়েই সিনেমা নির্মিত হয়েছে, এমনকি আরও অতীতের বিভিন্ন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের কাহিনীতে সিনেমা নির্মিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। ১৯৭১ সালে সংগঠিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা নির্মান হওয়া তাই স্বাভাবিক এবং হয়েছে। বিজয়ের ৪১ বছরে এসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমাগুলোর দিকে ফিরে তাকানো, আশা প্রত্যাশার হিসেব কষা যেতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনাবলী এবং এ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তাই মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্র – এই তিন ধারায় নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহের আংশিক বা পূর্নাংশে যদি মুক্তিযুদ্ধ প্রতিফলিত হয় বা কোনভাবে প্রভাব বিস্তার করে তবে এ সকল চলচ্চিত্রকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। এসকল সিনেমার মাঝে যে সকল সিনেমার দৈর্ঘ্য ৬০ মিনিটের কম তাকে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং ৬০ মিনিটের বেশী দৈর্ঘ্যের সিনেমাকে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে গন্য করা হয়েছে। পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ তিন ভাবে এসেছে। প্রথমত, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ, দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরিবেশের ঘটনাবলী এবং তৃতীয়ত, ভিন্ন কোন প্রেক্ষাপটে রচিত কাহিনীচিত্রে ফ্ল্যাশব্যাক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলোর কিছু তৈরী হয়েছে সরাসরি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে তুলে ধরে। বাকীগুলো মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধকালীন নির্যাতিত মানুষ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে নির্মিত হয়েছে।

যুদ্ধকালীন চলচ্চিত্র
মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যে সকল চলচ্চিত্র তৈরী হয়েছে তার কিছু তৈরী হয়েছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই। বাংলার সাহসী তরুন যুবারা যখন দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্নে হাতে তুলে নিয়েছিল রাইফেল, তখনই দেশের এই দুর্দশা ও সংগ্রামকে বিশ্বের কাছে পৌছে দেয়ার ইচ্ছায় কিছু তরুন শক্ত হাতে ধরেছিলেন ক্যামেরা, জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন দৃশ্য সেই ক্যামেরায় ধারণ করে পৌছে দিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, স্বাধীন একটি দেশের পক্ষে জনমত তৈরী করতে।

২৫শে মার্চ রাতের গণহত্যার ছবি তুলেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল্লাহ। হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর জীবনের ঝুকি নিয়ে তার বাসায় পড়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিচুমানের ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে গণহত্যার দৃশ্য ধারণ করেছিলেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ২৫শে মার্চের হত্যাকান্ডের একমাত্র ভিডিওচিত্রের ব্যবহারযোগ্য কোন প্রিন্ট কোথাও নেই।

মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর আবদুল জব্বার খানকে পরিচালক করে একটি চলচ্চিত্র বিভাগ খোলা হলেও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত চলচ্চিত্র নির্মানের প্রথম সিরিয়াস প্রচেষ্টা হয় বেসরকারী উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ লিবারেশ কাউন্সিল অব দি ইনটেলিজেনশিয়া’ এবং ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী কলাকুশলী সহায়ক সমিতি’র যৌথ উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তায়। নভেম্বর মাসের মধ্যেই বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। এগুলো হল – জহির রায়হান পরিচালিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এ স্টেইট ইজ বর্ণ’, আলমগীর কবির পরিচালিত ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরীর পরিচালনায় ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’ নির্মানের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার দেড় মাসের মধ্যেই জহির রায়হান নিখোঁজ হন। পরবর্তীতে আলমগীর কবির এই সিনেমাটি নির্মান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে উল্লিখিত চারটি প্রামাণ্য চিত্র ছাড়াও দশমিনিটের একটি সংবাদচিত্র নির্মিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিছু পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা করা হয়। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতাই এগিয়ে আসেন মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মানে। ১৯৭২, ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে মোট দশটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র তৈরী হয়। ১৯৭৫ সালে এ ধারার কোন চলচ্চিত্র নির্মিত হয় নি। ২০০৪ সালে আবার একই বছরে তিনটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

বিজয় অর্জনের পরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মান করেন চাষী নজরুল ইসলাম, নাম ‘ওরা ১১ জন’। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন মাসুদ পারভেজ, জাগ্রত কথাচিত্রের ব্যানারে। চাষী নজরুল ইসলামের এটিই প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র যার কাহিনীকার আল মাসুদ, চিত্রনাট্যকার কাজী আজিজ, সংলাপে এটিএম শামসুজ্জামান। অভিনয় করেছিলেন খসরু, শাবানা, রাজ্জাক, নূতন, সুমিতা দেবী, রওশন জামিল, এটিএম শামসুজ্জামান সহ আরও অনেকে। ১৯৭১ সালে ১১জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত গেরিলা দলের পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান এবং দেশ স্বাধীন নিয়ে এই চলচ্চিত্র নির্মিত। এই এগারোজনের দশজনই বাস্তবের মুক্তিযোদ্ধা, সিনেমা নির্মানে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র ও বুলেটের সবকটিই আসল। ১১ই আগস্ট ১৯৭২ এ মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রটি।

১৯৭২ সালের ৮ই নভেম্বর মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সুভাষ দত্ত পরিচালিত সিনেমা ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। কুসুমপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ড, নির্যাতন, নারী ধর্ষন এবং প্রতিবাদে বাঙালিদের মুক্তি সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্র নির্মিত। যুদ্ধ শিশুর মত বিষয় বেশ গুরুত্বের সাথে ফুটে উঠেছে এই চলচ্চিত্রে। শতদল কথাচিত্রের প্রযোজনায় এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন, ববিতা, উজ্জ্বল প্রমুখ।

বিজয়ের ঠিক এক বছর পর ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় ও চতুর্থ চলচ্চিত্র – ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং ‘বাঘা বাঙালী’। ‘রক্তাক্ত বাংলা’ পরিচালনা করেন মমতাজ আলী এবং ‘বাঘা বাঙালী’ পরিচালনা করেন আনন্দ। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় আলমগীর কবির পরিচালিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’, আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’ এবং খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’, নারায়ন ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ এবং আনন্দের ‘কার হাসি কে হাসে’।

১৯৭২ থেকে শুরু করে ২০১২ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর একটি তালিকা দেয়া যেতে পারে।

ক্রম চলচ্চিত্র - পরিচালক - মুক্তির সন
১ ওরা ১১ জন - চাষী নজরুল ইসলাম - ১৯৭২
২ অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী - সুভাষ দত্ত - ১৯৭২
৩ রক্তাক্ত বাংলা - মমতাজ আলী - ১৯৭২
৪ বাঘা বাঙালী - আনন্দ - ১৯৭২
৫ ধীরে বহে মেঘনা - আলমগীর কবির - ১৯৭৩
৬ আমার জন্মভূমি - আলমগীর কুমকুম - ১৯৭৩
৭ আবার তোরা মানুষ হ - খান আতাউর রহমান - ১৯৭৩
৮ সংগ্রাম চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৭৪
৯ আলোর মিছিল নারায়ণ ঘোষ মিতা ১৯৭৪
১০ কার হাসি কে হাসে আনন্দ ১৯৭৪
১১ মেঘের অনেক রং হারুনুর রশীদ ১৯৭৬
১২ কলমীলতা শহীদুল হক খান ১৯৮১
১৩ আমরা তোমাদের ভুলবো না* হারুনর রশীদ ১৯৯৩
১৪ একাত্তরের যীশু* নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ১৯৯৩
১৫ আগুনের পরশমনি হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯৪
১৬ সিপাহী কাজী হায়াৎ ১৯৯৪
১৭ নদীর নাম মধুমতি তানভীর মোকাম্মেল ১৯৯৬
১৮ হাঙর নদী গ্রেনেড চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৯৭
১৯ এখনো অনেক রাত খান আতাউর রহমান ১৯৯৭
২০ ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ* বাদল রহমান ১৯৯৮
২১ ’৭১ এর লাশ নাজির উদ্দীন রিজভী ১৯৯৮
২২ ইতিহাস কন্যা** শামীম আখতার ২০০০
২৩ একজন মুক্তিযোদ্ধা বি.এম সালাউদ্দিন ২০০১
২৪ শিলালিপি** শামীম আখতার ২০০২
২৫ মেঘের পরে মেঘ চাষী নজরুল ইসলাম ২০০৪
২৬ শ্যামল ছায়া হুমায়ূন আহমেদ ২০০৪
২৭ জয়যাত্রা তৌকির আহমেদ ২০০৪
২৮ ধ্রুবতারা চাষী নজরুল ইসলাম ২০০৬
২৯ খেলাঘর মোরশেদুল ইসলাম ২০০৬
৩০ অস্তিত্বে আমার দেশ** খিজির হায়াত খান ২০০৭
৩১ স্পার্টাকাস’৭১** মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী ২০০৭
৩২ গহিনে শব্দ খালিদ মাহমুদ মিঠু ২০১০
৩৩ নিঝুম অরন্যে মুশফিকুর রহমান গুলজার ২০১০
৩৪ রাবেয়া তানভীর মোকাম্মেল ২০১০
৩৫ গেরিলা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ২০১১
৩৬ আমার বন্ধু রাশেদ মোরশেদুল ইসলাম ২০১১
৩৭ মেহেরজান রুবাইয়াত হোসেন ২০১১
৩৮ আত্মদান শাহজাহান চোধুরী ২০১২
৩৯ কারিগর আনোয়ার শাহাদাত ২০১২
৪০ খন্ড গল্প’ ৭১ বদরুল আনাম সৌদ ২০১২
৪১ পিতা মাসুদ আখন্দ ২০১২
* বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া হয় নি
**ভিডিও ফরম্যাটে নির্মিত
***পিতা আগামী ২১ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে


তালিকাটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে এরকম সিনেমা তালিকায় স্থান পায় নি। চলচ্চিত্র গবেষকরা ২০০৭ সাল পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাকে তালিকাভুক্ত করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আছে এমন বেশ কিছু ছবিকে এই তালিকার বাইরে রেখেছেন। এগুলো হল আবদুস সামাদের ‘সূর্যগ্রহণ’, মতিন রহমানের ‘চিৎকার’, এ জে মিন্টুর ‘বাঁধন হারা’, শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বিপ্লব’, ‘সন্ত্রাস’, ‘কমান্ডার’, ‘ঘাতক’, ও ‘লাল সবুজ’, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘বীর সৈনিক’, তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’, গাজী জাহাঙ্গীরের ‘জীবন সীমান্তে’ প্রভৃতি। এই বিবেচনায় ২০০৭ সালের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার কোন কোনটি হয়তো উপরোক্ত তালিকা থেকে বাদ পড়বে। (ধারণা করছি, এ সকল সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধ উপজীব্য নয় অথবা কাহিনীতে প্রভাব বেশী নয়, তাই তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে – দারাশিকো)

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে চলচ্চিত্র বলতে প্রামাণ্যচিত্র ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকেই বোঝানো হত। স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মান শুরু হয় আশির দশকে। বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট ও আর্কাইভ (বর্তমানে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ) এর ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের তরুণ ছাত্র মোরশেদুল ইসলাম প্রথম শর্টফিল্ম বা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মান করেন। তার এই ২৫ মিনিট স্থায়িত্বের চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও বটে। সেন্সরবোর্ডের নানা বাধা পেরিয়ে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে এবং ১৯৮৫ সালে নয়াদিল্লী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পায় ১৯৮৫ সালে।

পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মানের বিশাল বাজেট ও কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি মোরশেদুল ইসলামের মত আরও কিছু তরুন ১৬মিমি ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পাওয়া যায় এ সকল তরুণের কাছ থেকে। তানভীর মোকাম্মেল, এনায়েত করিম বাবুল, মোস্তফা কামাল, আবু সায়ীদ এদের কয়েকজন। কোন এক অজানা কারণে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের অল্প কিছু নামই ঘুরে ফিরে আসে। এ সকল নামের সমন্বয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করা যায়।

ক্রম চলচ্চিত্র পরিচালক মুক্তির সন
১ আগামী মোরশেদুল ইসলাম ১৯৮৪
২ হুলিয়া তানভীর মোকাম্মেল ১৯৮৫
৩ চাক্কি এনায়েত করিম বাবুল ১৯৮৫
৪ প্রত্যাবর্তন মোস্তফা কামাল ১৯৮৬
৫ সূচনা মোরশেদুল ইসলাম ১৯৮৮
৬ ছাড়পত্র জামিউল রহমান লেমন ১৯৮৮
৭ বখাটে হাবিবুল ইসলাম হাবিব ১৯৮৯
৮ দুরন্ত খান আখতার হোসেন ১৯৮৯
৯ পতাকা এনায়েত করিম বাবুল ১৯৮৯
১০ একজন মুক্তিযোদ্ধা দিলদার হোসেন ১৯৯০
১১ কালোচিল’৭১ সাদুল্লা আল মাসুদ ১৯৯০
১২ ধূসরযাত্রা আবু সায়ীদ ১৯৯২
১৩ গৌরব হারুনর রশীদ ১৯৯৮
১৪ শোভনের একাত্তর দেবাশীস সরকার ২০০০
১৫ শরৎ’৭১ মোরশেদুল ইসলাম ২০০০
১৬ মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন ছটকু আহমদ ২০০০
১৭ একাত্তরের মিছিল কবরী সারওয়ার ২০০১
১৮ একাত্তরের রং পেন্সিল মান্নান হীরা ২০০১
১৯ হৃদয় গাঁথা রহমান মুস্তাফিজ ২০০২
২০ যন্ত্রনার জঠরে সূর্যোদয় সৈয়দ রেজাউর রহমান ২০০৪
২১ নরসুন্দর তারেক মাসুদ ২০১০
*স্বল্পদৈর্ঘ্যের এই তালিকাটি অসম্পূর্ন। ইন্টারনেটে যে সকল তালিকা পাওয়া গেছে সেখানে স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্নদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্রের প্রকারভেদ পাওয়া যায় না। কিছু তালিকা পাওয়া গেলেও সেখানে নির্মান সাল অনুপস্থিত। সুমন আহমেদের ‘নীল দংশন’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মান সাল জানা না থাকায় তালিকায় উল্লেখ করা হয় নি।


মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্রগুলোর চারটি নির্মান হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করে নির্মিত হয় বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে আলমগীর কবির ‘ডায়েরিজ অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মান করেন। পাশাপাশি সরকারী প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর তৈরী করে ‘দেশে আগমন’। আলমগীর কবির ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে আরও দুটি ডকিউমেন্টারি নির্মান করেন। সৈয়দ শামসুল হকের পরিচালনায় সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ-র নামে একটি করে তথ্যচিত্র তৈরী হয় ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে। ১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ধারার প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ নির্মান করেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশী শিল্পীরা বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও রণাঙ্গনে গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার যে বিশাল ভূমিকা পালন করেছিলেন তা উঠে এসেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। আবার এই ‘মুক্তির গান’সহ গণহত্যার ফুটেজ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে প্রদর্শন করে। তারেক ও ক্যাথেরিন মাসুদ দর্শকদের বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নিয়ে নির্মান করেন ‘মুক্তির কথা’। এছাড়া মানজারে হাসীনের ‘চারুকলায় মুক্তিযুদ্ধ’, কাওসার চৌধুরীর ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘তাজউদ্দীন: নিসঙ্গ সারথি’ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন প্রামাণ্যচিত্র।

ক্রম চলচ্চিত্র পরিচালক মুক্তির সন
১ ডায়েরিজ অব বাংলাদেশ আলমগীর কবীর ১৯৭২
২ দেশে আগমণ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ১৯৭২
৩ পোগ্রাম ইন বাংলাদেশ আলমগীর কবীর ১৯৭৩
৪ লংমার্চ টুওয়ার্ডস গোল্ডেন বাংলা আলমগীর কবীর ১৯৭৪
৫ মুক্তিযোদ্ধা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ১৯৭৬
৬ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৩
৭ বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৩
৮ বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৪
৯ জেনারেল এম এ জি ওসমানী চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ১৯৮৪
১০ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৪
১১ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীন সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৪
১২ বীরশ্রেষ্ঠ মুনশী আবদুর রউফ সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৫
১৩ বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল সৈয়দ শামসুল হক ১৯৮৫
১৪ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আলমগীর কবীর ১৯৮৫
১৫ মুক্তির গান তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ ১৯৯৫
১৬ চারুকলায় মুক্তিযুদ্ধ মানজারে হাসীন ১৯৯৭
১৭ মুক্তির কথা তারেক মাসুদ ১৯৯৮
১৮ কামালপুরের যুদ্ধ চাষী নজরুল ইসলাম ২০০১
১৯ দেশ জাতি জিয়াউর রহমান চাষী নজরুল ইসলাম ২০০১
২০ মৃত্যূঞ্জয়ী সাজ্জাদ জহির ২০০১
২১ প্রতিকূলের যাত্রী কাওসার চৌধুরী ২০০১
২২ সেই রাতের কথা বলতে এসেছি কাওসার চৌধুরী ২০০২
২৩ স্বাধীনতা ইয়াসমিন কবির ২০০২
২৪ ফিনিক্স নিশাত জাহান রানা ২০০৩
২৫ প্রিয়ভাষিণী মাহবুব আলম ২০০৩
২৬ মুক্তিযোদ্ধা আমরাও সৈয়দ তারেক ২০০৩
২৭ তখন এনামুল করিম নির্ঝর ২০০৪
২৮ তাজউদ্দীন: নিসঙ্গ সারথি তানভীর মোকাম্মেল ২০০৭
২৯ আমি স্বাধীনতা এনেছি সাগর লোহানী ২০০৭
৩০ অনেক কথার একটি কথা আনন্দ ২০০৭
৩১ অন্য মুক্তিযোদ্ধা লুৎফুন্নাহার মৌসুমী ২০০৭
৩২ কালরাত্রি অশোক কর্মকার ও মানজারে হাসীন ২০০৭
৩৩ ১৯৭১ তানভীর মোকাম্মেল ২০১১


বিদেশীদের নির্মানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বহু বিদেশী সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেরিয়েছেন ক্যামেরা নিয়ে। সেইসব দুর্লভ ফুটেজের সমন্বয়ে তৈরী হয়েছে ডকিউমেন্টারী বা প্রামাণ্যচিত্র। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্রে। এর মাঝে ভারতের আই.এস.জহর পরিচালিত ‘জয় বাংলাদেশ’, উমা প্রাসাদ মৈত্রের ‘জয়বাংলা’, শুকদেবের ‘নাইন মান্হস টু ফ্রিডম’, ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘দুর্বার গতি পদ্মা’, দূর্গা প্রসাদের ‘দুরন্ত পদ্মা’, বিনয় রায়ের ‘রিফিউজি ‘৭১’, এইচএস আদভানী ও অন্যান্যদের ‘লুট অ্যান্ড লাস্ট’, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রবার্ট রজার্সের ‘দি কান্ট্রি মেড ফর ডিজাস্টার’, যুক্তরাজ্যের ব্রেন টাগের ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ’, গীতা সায়গল ও ডেভিড বার্গম্যান এর ‘ওয়ারক্রাইম ফাইলস’, তানিয়া কাউলের ‘মেজর খালেদ’স ওয়ার’, জাপানের নাগিসা ওসিমার ‘জয়বাংলা’ ও ‘রহমান: দি ফাদার অব নেশন’, ‘লিগেসি অব ব্লাড’, বিবিসি’র ‘হাউ দি ইস্ট ওয়াজ ওয়ান’, গ্রানাডা টিভির ‘দি ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন’, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’, মিডিয়া এন্টারটেইনমেন্টের ‘জেনোসাইড ফ্যাক্টর’, ম্যাকুম্বা ইন্টারন্যাশনালের ‘ওয়ার বেবিজ’, বাংলাদেশের সেন্টু রায় কর্তৃক বিদেশে নির্মিত ‘টিয়ারস অব ফায়ার’, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’ ইত্যাদি। (২০০৭ পর্যন্ত নির্মিত মুভির তালিকা)

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা তৈরীর যে জোয়ার লক্ষ্য করা যায় তা ভাটায় রূপ নেয় তার মৃত্যুর সাথে সাথেই। পরবর্তী শাসকরা বঙ্গবন্ধুর ছবি কর্তন করে ছবি মুক্তির চেষ্ট করেছিল বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আবারও মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা তৈরী শুরু হয় এবং চাষী নজরুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামের মত চলচ্চিত্রকাররা একাধিক চলচ্চিত্র নির্মান করেন। হুমায়ূন আহমেদ, তৌকির আহমেদ, খিজির হায়াত খান, খালিদ মাহমুদ মিঠু, রুবাইয়্যাত হোসেন, শাহজাহান চৌধুরী, আনোয়ার শাহাদাতের মত নবীন পরিচালকরা তাদের ক্যারিয়ার শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মানের মধ্য দিয়ে।

তালিকায় স্থানপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর বেশ ক’টি অত্যন্ত ভালো মানের নির্মান এবং এদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করেছে। ‘ওরা ১১ জন’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘নদীর নাম মধুমতি’, ‘আগুনের পরশমনি’ ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ এর সাথে যুক্ত হয়েছে ‘জয়যাত্রা’, ‘রাবেয়া’, ‘গেরিলা’ ইত্যাদি সিনেমা। আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিন্দনীয় ও সমালোচিত সিনেমাও মুক্তি পেয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ও ‘বাঘা বাঙালী’ সমালোচিত হয়েছে ধর্ষণ দৃশ্য ও অ্যাকশন দৃশ্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টার কারনে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে রুবাইয়্যাত হোসেন পরিচালিত সিনেমা ‘মেহেরজান’ সমালোচিত ও প্রদর্শন বন্ধ হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানিদের বিতর্কিত চিত্রায়নের জন্য। বাজেট ও কারিগরী সীমাবদ্ধতার মাঝে নির্মিত সিনেমাগুলোর ত্রুটি বিচ্যুতি কম বেশী চিহ্নিত করেছেন সমালোচকরা।

মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যে সকল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সেগুলোর গল্প ও কাহিনী বিশ্লেষণ করতে গেলে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো পাওয়া যায়। প্রায় সকল সিনেমাই সম্মুখ যুদ্ধ-কে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করে। দেশের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ন কর্মকান্ড অবশ্যই তুলে ধরা প্রয়োজন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকেও তুলে আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ একটি চরম বাস্তবতা, মিথ নয় – কাহিনীকারকেও সতর্ক হতে হবে। দেশের আনাচে কানাচে যে বীরত্বপূর্ণ ও হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো ছড়িয়ে আছে, সেগুলোর চিত্রায়নের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে নিন্দনীয় ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত এবং প্রমাণিত – এমন ব্যক্তিবর্গকে নিরপেক্ষভাবে চরিত্র হিসেবে তুলে এনে তাদের কর্মকান্ডকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।

স্বাধীনতার এই একচল্লিশ বছরে গড়ে একটি করে মুক্তিযুদ্ধের ছবি মুক্তি পেলেও সব ছবি মুক্তিযুদ্ধের ছবি, গণমানুষের ছবি হয়ে উঠতে পারে নি বিভিন্ন কারণে। কিছু ছবি বানিজ্যিকভাবে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া হয় নি, আবার ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলো হাতে গোনা নির্দিষ্ট কিছু প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার ফলে সারা দেশের মানুষের নাগালের মধ্যে পৌছুতে পারে না। টেলিভিশনে প্রচারের উদ্দেশ্য নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো যদিওবা মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরে, এই তুলে ধরায় শুধু ব্যবসা-ই হয়, দর্শকের হৃদয় ছোঁয়া যায় না।

সরকারি ও বেসরকারী উদ্যোগ জরুরী। প্রতি বছর অন্তত একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় অনুদান প্রদান করা যেতে পারে। পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগকে স্বাগত জানানো উচিত। সেন্সরবোর্ডের যথাযোগ্য ভূমিকা পালন নিশ্চিত করতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র যেন প্রপাগান্ডা আর চাটুকারিতার উপকরণে পরিণত না হয় তা দেখভাল করার দায়িত্ব সেন্সরবোর্ডেরই।

এ ছাড়াও এই লেখাটি তৈরী করতে গিয়ে তথ্যের অভাবজনিত কারনে যে তীব্র সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা দূর করারও পদক্ষেপ নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের কোন পূর্ণাঙ্গ তালিকা ওয়েব জগতে পাওয়া যায় না। অথচ গুরুত্বপূর্ন এই তথ্যটি প্রতিবছর যথাযথ গুরুত্বসহকারে আপডেট করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য ভিডিও ফর‌ম্যাটে নির্মিত টিভি নাটকগুলো যা দৈর্ঘ্যৈর বিচারে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য হতে পারে তা সম্পূর্ন হিসাবের আওতাবহির্ভূত থেকে যাচ্ছে। সেই সাথে, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলোকে বিভিন্নরকম গবেষণার অন্তর্ভূক্ত করা উচিত।

শেষ কথা
স্বাধীনতার একচল্লিশ বছর শেষে পেছন দিকে ফিরে তাকালে অনেক উত্থান-পতন দেখা যাবে। কিন্তু ২০১২ সালের বিজয় দিবসে সামনের দিকে তাকালে একটি অগ্রসরমান চলচ্চিত্র শিল্পের সংকেত দেখতে পাওয়া যায়। উন্নততর প্রযুক্তি, অধিকতর বাজেটের সিনেমা তৈরী শুরু হয়েছে। এর একটি অংশ যদি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মানে ব্যবহৃত হয়, তবে নতুন প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধকে দেখে নি, তারা অনুভব করতে পারবে তাদের পূর্বপুরুষ কোন ধরনের পরিস্থিতিতে কি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের জন্য একটি দেশ নির্মানের জন্য আত্মত্যাগ করেছিল। (সমাপ্ত)


টীকা:
এই লেখার বেশীর ভাগ তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক অনুপম হায়াৎ রচিত গবেষনাগ্রন্হ 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র'(বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, মে ২০১১) থেকে। বইয়ে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিনেমার তালিকা পাওয়া যায়। পরবর্তী সালগুলোয় মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার তালিকা ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরী করা হয়েছে। যেহেতু এ ধরনের তালিকা তৈরী গবেষণাকর্মের আওতাভুক্ত এবং এই লেখাটি কোন গবেষণাকর্ম নয়, তাই এই তথ্য যাচাই করে ব্যবহার করার অনুরোধ থাকল।



লেখাটি প্রথমে দারাশিকো'র ব্লগে প্রকাশিত। আজ নতুনবার্তায় প্রকাশিত।

ফেসবুকে দারাশিকো'র ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:১০
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×