somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গপ্পোসপ্পো: আমরা অপরাহ্ণে

১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথমে দশ জন, এরপর আট জন, তারপর ছয় জন, এবং সবশেষে পাঁচ জন- ডা. ফজলে রাব্বী হলে এই শেষের পাঁচ জন দীর্ঘ সময় একসাথে ছিলাম । আমরা ছিলাম মেইন বিল্ডিংয়ের ৩ নং ঘরে । তখন মনে হতো, এই বিল্ডিংয়ের প্রতিটা ঘর এক একটা পরিরবারের মতো । সেখানে একসাথে গল্প গুজব হত, কথা কাটাকাটি হত, এমনকি হাতাহাতিও । অবশ্য একাজগুলো নিয়মিত হত না । নিয়মিত যে কাজটা হতো তা হলো পড়াশোনা ।

এভাবে পাশাপাশি কয়েককটা ঘর ছিল একটা পাড়ার মতো । প্রায় সবাই নিজের পাড়ার চেয়ে অন্যের পাড়ার খোঁজ খবর বেশি রাখত । আর এভাবেই স্বল্প দূরুত্বের কয়েকটা পাড়া ছিল এক একটা গ্রামের মতো । গ্রামগুলোর আবার আলাদা আলাদা নামও ছিল । সব গ্রামে সব রকমের মানুষের বসবাস হলেও কিছু নির্দিষ্ট পাড়ার নির্দিষ্ট নাম ছিল । সে নাম অনেকে নিজে থেকেই জেনে নিত, অনেকেই আবার জানিয়ে দিত ।

এই নয় জনের ঘরে দশম ব্যক্তি হিসেবে জায়গা করে নেওয়ার জন্য উপরতলার কোন দরজার সামনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে । ধৈর্য হারিয়ে ফেলার অনেক আগেই সে দরজায় কড়া নাড়তে হয়েছে সশব্দে এবং সুশব্দে । মাঝেমধ্যে আগ্রহ ধরে রাখতে পাড়তাম না । একটা অনধিকার চর্চা হয়ে যেত । দরজার ফাঁক গলে চোখ চলে যেত অন্দর মহলে । তখন চোখ বড় করে দেখতাম, সেখানে বেডের সংখ্যা তিন, আর মানুষের সংখ্যা হলো দুই । ওদের সবারই একটা সাধারণ ডাক নাম ছিল। ‘বড় ভাই’(BV) ।

সেই আবদ্ধ ঘরে মাঝেমধ্যে দম আটকে যেত, কিন্তু কখনো দম বের হয়ে যেত না । তবে কিছুদিনের মধ্যে সবাই পুরোদমে মানিয়ে নিলাম । সেখানে চুপচাপ বসে থেকেও অনেকে ভবিষ্যত জীবনের পথ চলার শব্দ শুনতে পেত । কেউ শুনত, কেউ শোনাত । অনেকে সুর ধরে গান গাইত । দু’একজন সেই সুরেলা গান গাইতে গিয়ে হঠাৎ ছন্দ হারিয়ে ফেলত । আর তখন চালিয়ে দিত, আরে এটা আসলে কোন গান না, এই গল্প আর কি।
আমার একটা কবিতা ছিল, মাত্র ৩ লাইনের ।
“আমিই হব সেই সার্জন,
হোক না সে কাম শুধুই Circumcision
মানে-খতনাকরণ।”


কিন্তু জীবনের এই অপরাহ্ণ বেলায় আমাদের পঞ্চ মানবের আবার দেখা হতে পারে একথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না । তারপরেও দেখা হয়ে গেলো । সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত । এদের সবাইকে এক নজর দেখলেই প্রথমে যেকথা মনে হবে, অকাজ করার মতো সময় এদের হাতে নেই । তরপরেও হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন মাথা তুলে দাঁড়ায়, আমরা কি সত্যি সত্যি পেরেছি আমাদের গন্তব্যের পথ ধরে চলতে?

হাই-থট সজীব(HTS) । ঘরের এক কোণায়, বন্ধ জানালার পাশে আরাম চেয়ারের উপর হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে । সে চুপচাপ বসে থাকলেও তার মাথা কিন্তু চুপচাপ নেই । সেই পুরোনো চিন্তাটা আবারো ঘুরঘুর করতে শুরু করেছে । হাইজেনবার্গের ‘আনিশ্চয়তা নীতি’ ( যদি কোন গতিশীল কণার অবস্থান নির্ভূলভাবে নির্ধারণ করা যায় তখন এর গতিবেগ নির্ধারণ অনিশ্চিত হয়ে পরে। অথবা এর উল্টোটা )।
দুনিয়ার বুকে এত ধর্ম, এত সব দর্শন, এত মতবাদ, সে কোনটাকে ধরবে? যদিও বা একটা নির্ধারণ করে বাকিগুলো ধারণ করা অনিশ্চিত হয়ে যাবে ।
তারপরও তাকে একটা ধরতে হবে। এবং এই কাজটা করতে হবে অনেক চিন্তা ভাবনা করে । এগুতে হবে ধাপে ধাপে । প্রথমে সেই ধর্ম, দর্শন বা মতবাদ থেকে তৈরী করতে হবে একটা সাজানো গোছানো ‘অনুসিদ্ধান্ত’ । অবশ্য এই অনুসিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। সেটাকে ‘প্রমাণ’ করার জন্য অনেক কাঠখড় যোগার করতে হবে । অতপর, সময়মত সেই কাঠখড় ভালোভাবে পোড়াতে পারলেই একটা চুড়ান্ত ‘সিদ্ধান্ত’-এ আসা সম্ভব হতে পারে ।
সজীব দুই হাতে মাথার চুল খাঁমচি দিয়ে ধরে । তারপর মুখ হা করে লম্বা করে একবার শ্বাস নেয় । কিছুক্ষণ তা ধরে রাখার পর আবার লম্বা করেই ছেড়ে দেয় । এরপর অস্ফূট স্বরে বিড়বিড় করে কি জানি বলতে শুরু করে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই সজীব আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । তারপর চোখ বাঁকা করে সামনে রাখা দৈনিক পত্রিকাটার দিকে তাকায় । পত্রিকার শিরোনামে লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা ‘বাংলার জমিনে নিমোকহারাম শুদ্ধিকরণ প্রকল্পে(নিশুপ্র) সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিৎ’ । সজীব একটু হাসার চেষ্টা করে । সামনে থেকে কয়েকটা দাঁত বের হয়ে আসে, কিন্তু কোন শব্দ বের হয় না । পদার্থের কোন অবস্থার সাথেই এর কোন মিল নেই। অপদার্থ!
এরপর সজীব খবরের কাগজের কালো লেখার সেই অন্ধকার কারাগারে হারিয়ে যায় নিমিষের মধ্যে । কিছুক্ষণ পর কারাগারের দেওয়াল ভেদ করে হাইজেনবার্গ মাথা তোলে, ‘আমি উপস্থিত!’

পত্রিকা রেখে দিয়ে সজীব একটা লম্বা হাই তোলে । যথেষ্ট অবহলার সাথে আরাম চেয়ারে মাথাটা লাগিয়ে দিয়ে হালকা করে চোখ দুটা বন্ধ করে । বুঝতে কোন অসুবিধা নেই যে এ জগতের সমম্ত সংযোগ থেকে সে এখন বিচ্ছিন্ন । হাইজেনবার্গ আবারো হিসহিস করে ওঠে, আমি উপস্থিত!
চোখ না খুলেই সজীব অস্ফূট স্বরে বলতে থাকে, ‘আসলে দুনিয়ার সবকিছুই অনিশ্চয়তার অনিয়ন্ত্রিত কক্ষপথে নিয়মিত ঘুরপাক খাচ্ছে ।’
হাইজেনবার্গ খুশি হয় ।

এভাবে অনেকটা সময় পার হয়ে যায় । কতটা সময় সেটা সজীব জানে না, তার জানার কথাও না । আমি শেষবারের মত মুখ খোলার আগেই সজীব আমার উপর রেগে গেল,
‘তুমি বলতে চাও, আামি অসুস্থ্য?’
‘এরকম বলাতে আমিতো তেমন কোন সমস্যা দেখি না।’
‘তার মানে?’
‘দুনিয়ার সব মানুষই একটু আধটু অসুস্থ্য, শারিরিকভাবে না হলেও মানসিকভাবে।’
সজীব চোখ বড় করে আমার দিকে তাকায় । সেই চোখ দেখে যে কোন সুস্থ্য মানুষেরই ভয় পাওয়া উচিৎ । তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আমার মাথার উপর দিয়ে পিছন দিকে তাকালো । আমি মাথা ঘুরে পিছনে তাকানোর আগেই দেখি সজীবের সহধর্মিনী দ্রুত পায়ে এদিকে এগিয়ে আসছে, হাতে একটা মোবাইল ফোন । একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সজীব ফোনটা হাতে নেয় । মৃদু সুরের বাজনা বন্ধ হতেই অপর পাশ থেকে একজন গদগদ কন্ঠে একটানা বলতে থাকে, ‘আস্সালামুয়ালাইকুম, স্যার কিছু মনে করবেন না । আপনাকে এক্ষুনি একবার হাসপাতালে আসতে হবে । জরুরি দরকার ।’

‘আমাদের তানবীর’(ATB), নট্ তানভীর । একবার ছোটখাটো এক অনুষ্ঠানে তানবীরের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ভাইয়া’ । সেই থেকে আমাদের পাঁচ জনের মাঝে সে ভাইয়া নামেই সুপরিচিত ছিল। এখনও আছে । অবশ্য এই সার্থক নামকরণের তেমন কোন কার্যকারণ নেই । সে সময়ে ভাইয়ার বড় ভাই ছিল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্র । আমাদের হলে মাঝেমধ্যেই আাসত । সিনিয়র হিসেবে আমরা তাকে যথেষ্ট সন্মান করতাম । কিন্তু আসল ব্যাপার এখানে না । কথা হলো তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে অসম্ভব রকমের ভালো সম্পর্ক, প্রায় বন্ধুর মতো । এরকম বন্ধু সদৃশ দুই ভাই আমার জীবনে এক রকম দেখিনি বললেই চলে । তাদের এতদিনের সাধনার ফসলের নাম হলো ’দি হেভেন হসপিটাল’ । স্বার্বিক পরিচালনায়, ওরা দুইজন ।
তানবীরের দৈন্যন্দিন জীবন প্রবাহে অনেক পরিবর্তন এসেছে । বর্তমানে তার নাওয়া খাওয়া, কথাবার্তা এমনকি নড়াচড়া পর্যন্ত নিয়ন্ত্রনে রাখা হয়েছে । না বলা কথাগুলো বলার অনেক চেষ্টা করেও আর কোন লাভ হয় না । তারপরেও ভাইয়া তার গোলাপি হাসিটা এখনো হাসে, কারণে অকারণেই হাসে । শরীর স্বাস্থ্যের যথেষ্ট উন্নতির পেছনে এর একটা বিশেষ ভূমিকা থাকতে পারে ।
হঠাৎ তানবীরের সাথে দেখা হলো পিচ ঢালা রাস্তায় । কথা শোনাতে গিয়ে শুনতে হলো । প্রথমে শুরু করলাম আমি।
তারপর, দিনকাল কেমন যাচ্ছে?
এইতো আগের মতই।
আগের মতই কি, ভালো না খারাপ?’
এর উত্তরে কোন কথা শুনতে পেলাম না । শুধু মৃদু শব্দে একবার হেসে উঠল । এর নাম বুঝি গোলাপি হাসি । এই হাসির মানে খুঁজে বের করার আগেই আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বসল,
‘তোমার দিনকাল কেমন চলছে?’
‘এইতো চলছে এক রকম।’
‘এখনও কি একাই আছ, না কি...’
কথাটা শেষ করার আগেই তানবীরের গোলাপি হাসি হঠাৎ গোপালি হাসিতে রুপ নিল । আমাকে জবর রকম ঠকিয়েছে । কি বলব বুঝতে না পেরে আমিও ওর সাথে সুর মিলিয়ে নিলাম । দুজনেই প্রাণ খোলা হাসিতে আশেপাোশর সবাইকে চমক লাগিয়ে দিলাম । একটুপর চারপাশে আবার তাকাতেই সব ঝাপসা হয়ে আসল। দেখি চোখে পানি এসে গেছে । এটা কি দম আটকে যাওয়া হাসির চোটে নাকি আমার প্রথম স্ত্রীর শোকে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না । সামনে আরো কিছুদূর যাওয়ার পর তানবীরকে ছেড়ে দিলাম । যথেষ্ট হয়েছে।
তানবীরের সকাল সন্ধ্যা আগে যেমন কেটে যাচ্ছিল এখনও তেমনি যাচ্ছে । আশা করা যায় ভবিষ্যতেও এভাবেই যাবে । তারা দুই ভাই এখনো একসাথে বাজারে যায় , একসাথে রাস্তায় হাঁটাহাটি করে । হঠাৎ করে কোন একদিন চলে যায় সমুদ্র সৈকতে । কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ডুবন্ত সূর্যটাকে সাক্ষী রেখে ছবিও ওঠায় ।

‘রসালো-আশরাফ’ (RA) । এখনো রসে টসটস । তবে চাপ না দিলে এখন আর রস বের হয় না । সম্ভবত রসের ঘনত্ব অনেক বেড়ে গেছে । এর পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে । এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে গেলেই আশরাফুল তাড়াতাড়ি থামিয়ে দেয়। বলে, বয়সটা অনেক বেড়ে গেছে বন্ধু।
আশরাফুল এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল, সাথে চিন্তাশীলও । তবে মাঝে মধ্যে, হঠাৎ করে কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে যায় । এর পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, যেটা সঙ্গত অথবা অসঙ্গত ।
হয়ত কোন একদিন তার তরমুজাকৃতির ভুঁড়িটার দিকে সুনজর পরে । কিছুক্ষণ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে । মনটা খারাপ হয়ে যায় । কারণ সেটা কমানোর আর কোন চেষ্টাই সে করছে না ।
একটা ব্যাপারে আশরাফুলের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে । সে আগের চেয়ে এখন অনেক দ্রুত টাকা গুণতে পারে । গুণতে পারে বলতে গুণতে হয় । মনে হয় পরিমাণটা অনেক বেড়ে গেছে । এখনও কোন চকচকে নতুন টাকার নোট পেলে প্রথমে চোখ দুটা অনেক বড় হয়ে যায় । তারপর দুই হাতে সেই নোট আস্তে করে নাকের কাছে ধরে । এরপর দুই চোখ বন্ধ করে জোরে একটা টান দেয় । সুগন্ধ বা দূর্গন্ধ যাই হোক না কেন, টাকার একটা আলাদা গন্ধ আছে। যেটা দুনিয়ার আর কোন জিনিসের ভিতরে পাওয়া সম্ভব না ।
সখের সঙ্গিনীর সাথে এই ব্যাপারাটা নিয়ে তার মাঝে মধ্যেই কথা কাটাকাটি হয় । সেটা যে এখনো মান অভিমানের পর্যায়ে আছে এমন বলাটা কোন ভাবেই উচিৎ হবে না । সঙ্গিনী একদিন আশরাফুলের সামনে এসে দাঁড়ায় । দীপ্ত কন্ঠে আর বলিষ্ট উচ্চারণে আশরাফুলকে জানিয়ে দেয়, টাকা মানে সবকিছু নয়। টাকা দিয়ে কিন্তু ‍সুখ কিনে পাওয়া যায় না।
আশরাফুল প্রথমে রাগের মাথায় কিছু একটা বলতে চেয়ে মাঝপথে থেমে যায় । আসলে সে একটু রসিকতা করতে চায়। শীতল চোখে তাকায় সঙ্গিনীর দিকে । সে তার কথায় পুরোপুরি সায় দেয় । টাকা মানে ‘সবকিছু’ হতে যাবে কেন, টাকা একটা বাংলা শব্দ, এর মানে তো শুধুই ‘টাকা’। আর টাকা ‍দিয়ে সুখ ‍কিনতে যাব কেন? টাকার অন্য নামই তো ‍সুখ!
কথা শেষ করে আশরাফুল শব্দ করে হেসে ওঠে । মাধুর্যহীন প্রাচুর্যের হাসি । যে হাসি কেবলু নিজেই হাসে, হাসাতে পারে না ।
এই রসিক লোকটা এখনো নিয়মিত নাটক সিনেমার মাঝে ডুব দেয় । শুধু ডুব দেয় না, তলিয়ে যায় গভির থেকে গভিরে । তারপর সেখান থেকে তালুবব্ধ করে আনে কিছু বাস্তবধর্মী জ্ঞান । তারপরও মনটা কেন জানি আবারো খারাপ হয়ে যায় । স্বাভাবিক বিনোদনের মাঝে বিরতি পরে । বালিশে মাথা লাগিয়ে সোজা উপরে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ । অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সেখানে কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করে । একসময় মনে মনে বলতে থাকে, আমার দাদা কিন্তু তিনটা বিয়ে করেছিল!
তার দুই চোখের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা আস্তে আস্তে সরু হয়ে আসে ।

সেদিন আশরাফুলের সাথে তার গ্রামের রাস্তায় দেখা হলো । সেন্ডেল পায়ে লুঙ্গি পড়ে খুব দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে । পিছন থেকে ডাক দিতেই থেমে গেলো । তারপর একসাথে পা চালাতে শুরু করলাম । চলতে চলতে আশরাফুল আমাকে তার পটল বাড়ির গল্প শোনাল । সামনে কিছুদূর যাওয়ার পর চট করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলো । আঙ্গুলের ইশারায় আমাকে কিছু একটা দেখিয়ে দিয়ে বলল,
‘এদিকে কি দেখ ?’
‘ধানখেত।’
‘তুমি ধানক্ষেত দেখলেও আমি দেখতে পাচ্ছি অন্য কিছু ।’
এরপর শুরু করল তার কৈশরের গল্প । হাসি না বের হলেও আগ্রহ নিয়ে শোনার মত একটা গল্প । সে সময়ে এখানে কোন ধানক্ষেত ছিল না । দুই বিঘা জমিতে লাগানো হয়েছিল পটল । এ রকম দুঃসাহস এর আগে কেউ কখনো করেনি । অনেকেই মুখে বলাবলি করতে লাগল, ‘বাপের বেটা, সাহস আছে!’
তারা অবশ্য বুকের ভিতর একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখেছিল, ‘এই সব শেষ হলো বলে!’
কিন্তু সবার আশা দুরাশায় শেষ হলো । প্রচন্ড শীতের মৌসুম পার করে ঘরে ফসল আসতে শুরু করল । সেই স্মৃতি আশরাফুল এখনো ভুলতে পারেনি । আর কোনদিন যাতে ভুলতে না হয় সেই ব্যবস্থা করে ফেলেছে । শহরে তার নিজস্ব যে ফ্ল্যাট বাড়িটা তৈরি হচ্ছে সেটার নাম দিবে ‘পটল কুঞ্জ’(Pottol Kunja) ।

ফেরার পথে আশরাফুল তার জুতা খুলে হাতে নিল । খালি পায়ে মাটির উপর দিয়ে হাঁটার এক অন্য রকম অনুভূতি আছে । এই সহজ কথাটা সে আমাকে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিল । আশরাফুল আমার সামনে দিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে । আমি তাকিয়ে আছি তার খালি পায়ের দিকে । একজন সত্যিকারের মাটির মানুষ । একেবারে বিশুদ্ধ মাটি দিয়ে গড়া।

সেই ‘চল-চঞ্চল মোস্তাক’(CCM), এখন অনেক বেশি শান্তশিষ্ট । তবে এটা শুধু বাহির থেকে দেখলে মনে হয় । ভিতরে সে আগের চেয়ে তিন গুণ বেশি অশান্ত । শরীরের ভারে নয় শুধুমাত্র বয়সের ভারে তার মেরুদণ্ডের বক্রতা আরো একটু বেড়ে গেছে । তারপরেও সে বুক টান করে হাঁটতে চায় । কারণ বুকের ভেতরের অংশে নাকি সাহসের অভাব নেই । অনেক মানুষ তাকে দেখলে কোন এক অনাকাংখিত সংকোচে এক পা পিছিয়ে যায় । মোস্তাকিম পিছায় না, দুই পা সামনে গিয়ে হাত ধরে ফেলে ।
দু একটা সরল, কিছুটা যৌগিক, আর বেশ খানিকটা জটিল, এরকম হাজারো মহামূল্যবান চিন্তা তার মগজের পুরো অংশটা দখল করে বসে আছে । তবে এসব চিন্তার ভারে মোস্তাকিম কখনো শুয়ে পড়ে না । আর শুয়ে পড়লেও কখনো নাক ডেকে ঘুমায় না ।
শহুরে জীবনের হাজারো পিছুটান উপেক্ষা করে মাঝে মধ্যেই তার সশরীরে আবির্ভাব ঘটে মফস্বলে । এখানে সেখানে অনর্থক হাঁটাহাঁটি করে । অবশ্য পথ চলতে তার কোন কষ্ট হয় না । কারণ এপথের পুরোটাই তার মুখস্থ । কোন রাস্তায় কয়টা ভাঁজ, কয়টা বাঁক। বাঁকটা মাঝখানে প্রথমে নাকি শেষে, সেটাও ।
তার সাথে কথা হলো এক বক্তৃতা মঞ্চের উপরে । মোস্তাকিম সেখানে অনেকের মধ্য একজন । সে তার কথা শুরু করল তার ছাত্রজীবনের একটা গল্প দিয়ে । গল্পটা তার এক স্যারের ছাত্রজীবনের । তিনি তখন রংপুরে পড়াশোনা করতেন । মোস্তাকিম তার স্যারের কথার হুবহু উদ্ধৃতি দিল । ‘আমি তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়াশুনা করতাম । সেখানে গণিত বিভাগে একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যাক্তি ছিলেন । তার নাম ছিল প্রফেসর আলম চৌধুরী । আমার জীবনে তার মত জ্ঞানী মানুষ আমি কখনো দেখিনি । তিনি একবার বলেছিলেন, এই দেশ একদিন ধ্বংস হবে ।’
মঞ্চের সবাই একটু নড়েচড়ে উঠল । আমি নড়েচড়ে উঠে পড়লাম । তারপর মোস্তাকিমের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘এখানে বক্তৃতা দিতে এসেছ নাকি মার খেতে?’
‘দুটাই।’
মোস্তাকিম ধারালো চোখে আমার দিকে তাকালো । আমি আহত হয়ে ফেরত আসলাম । আমার সমস্যা আসলে অন্য কোথাও । সবার গল্প নিয়ে এভাবে টানাটানি করাটা আইন সঙ্গত না । এই অনধিকার চর্চার কোন মানেই হয় না। আর এসব গল্প পড়ার চেয়ে শোনা সহজ। আবার শোনার চেয়ে শোনার ভান করে বসে থাকা আরো বেশি সহজ । ইচ্ছা না থাকলেও আমাকে তাই করতে হলো।

বক্তৃতা মঞ্চটাকে প্রথমে রঙ্গ মঞ্চ মনে হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হলো এটা রণ মঞ্চ। মোস্তাকিম কোন বিশ্রাম ছাড়াই বকে যাচ্ছে । ‘এই দুনিয়ায় ভালোও না আবার খারাপও না, এরকম মানুষের সংখ্যায় বেশি । অথচ আমরা ভালো মানুষেরা, আমাদের দলটাকে ভারি করতে পারছিনা । এর কারণ কী? এর কারণ একটাই, আমাদের ভালো মানুষির মধ্যে ভেজাল আছে !’
একটুপর সে এক পুরনো পথের গল্প শুরু করল । কিভাবে একদিন অন্ধকার রাতে সেই পথে চলতে গিয়ে বড় দিঘির সেই মস্ত বট গাছটার মাথায় কতগুলো রক্ত চোষা বাদুর দেখেছিল । বাদুরগুলো মানুষের বাচ্চার মত চিৎকার দিচ্ছিল । সমতল শুকনো রাস্তাতেও সে আচমকা হোঁচট খায় । নাক ফেটে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসে । বাদুরগুলো এবার গাছ থেকে নেমে আসে মুহূর্তের মধ্যে । সবাই একসাথে রক্ত খেতে শুরু করে । অনেক চেষ্টা করেও সে রক্ত ঝরা বন্ধ করতে পারে না । উঠে দাঁড়িয়ে আবারো হাঁটতে শুরু করে । রক্তচোষা বাদুরেরা তার পিছু ছাড়ে না । রক্তের প্রতিটি ফোটায় একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে । সেই অন্ধকার রাতে ওগুলোর ডাকহাক অতিপ্রাকৃতিক এ অনুভূতি জাগায় । পা দুটা শক্ত করে এবার সে দৌড়াতে শুরু করে । দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় হাঁপিয়ে ওঠে । মোস্তাকিমের গল্প চলতে থাকে। তারপর দ্বিতীয় সকালে সে এক পতাকাবাহীর সাক্ষাত পায়। যার হাতে ছিল বিরাট আয়তনের এক শুভ্র পতাকা ।

মোস্তাকিমের গল্পে অভিভূত হয়েই হোক অথবা আমার ঘুম ঘুম ভাবটা ছুটাতেই হোক , আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় । তারপর হাজারো জনতাকে সামনে রেখে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠি । পরক্ষণেই আমার চিৎকারের জবাব আসে । এরপর একের পর এক আসতেই থাকে । চারপাশের আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে এক অনিন্দ্য সুন্দরের আহবানে ।

কানের কাছে সেই প্রান্তর কাঁপানো শব্দটা হঠাৎ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকল । অনেক চেষ্টা করেও আমি আর সেটা ধরে রাখতে পারলাম না । একসময় কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো । খানিকবাদে আরেকটা শব্দ তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্মতর হতে শুরু করল । এতটাই তীক্ষ্ম যে আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় । ডান হাতে চারপাশটা হাতরে সেই শব্দের উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করি । কিন্তু তা খুঁজে বের করার আগেই শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল । এরপর আস্তে আস্তে চোখ খুলে সামনে তাকালাম । মাথা ঘুরিয়ে ঘরের ভিতরটা একনজর দেখে নিলাম । আমি সহ বাকি চারজন, প্রায় সবাই যে যার জায়গায় ঠিকঠাক আছে । শুধু সজীবের বিছানার উপর একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো হয়েছে । ল্যাম্পের ফোকাস করা হয়েছে একটা বইয়ের উপর । যে বইয়ের বাইরের শক্ত মলাটটা হাজারো রঙে রঙিন, তবে ভিতরটায় শুধুই সাদা কালো ।

মোবাইল ফোনে আবারো এলার্ম বেজে উঠল । দ্বিতীয়বার এবং শেষবারের মতো এলার্ম বন্ধ দেওয়ার সময় একবার মনে হলো, আজকেও সকাল ৭ টার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসটা আমার অনুপস্থিতেই শেষ হয়ে যাবে ।
........




সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×