
অনেকদিন থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে লিখব লিখব করেও লেখা হয়ে উঠছিলো না সময়ের অভাবে। মূলত এই প্রসঙ্গে আমাদের সমাজের উন্নাসিক মনোভাব দেখেই নিজের ভেতরে একটা তাগাদা অনুভব করছিলাম এটা নিয়ে একটা কিছু লেখার জন্যে। আজ সময় পেলাম, তাই বসে গেলাম লেখার প্রস্তুতি নিয়ে।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আমাদের তথাকথিত ভদ্র সমাজের “ভদ্রলোক”দের মত আমিও সমকামিতাকে দেখতাম একটা মানসিক ব্যাধি হিসেবে, আর সমকামীদেরকে মনে করতাম বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন। কিন্তু আমার ভুল ভাঙলো তখন, যখন আমি এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করলাম। আমি বরাবরই পাঠ্যবইয়ের তুলনায় বাইরের বই বেশি পড়ি। আর সমকামিতা নিয়ে পড়তে গিয়ে আমি টের পেলাম, কত বড় ভুল ধারণার মধ্যেই না আমি ডুবে ছিলাম! আর আমাদের সমাজ তো এখনো ডুবে আছে সেই অজ্ঞতার মহাসাগরে!
যদি প্রশ্ন করা হয়, সমকামিতা কী? তাহলে অধিকাংশ “ভদ্রলোক”-ই যে উত্তর দেবেন, তা হল-
#সমকামিতা একটা মানসিক রোগ।
#সমকামিতা বিকৃত রুচি ছাড়া কিছুই নয়!
#সমকামিতা হচ্ছে প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌনাচার!
#সমকামিতা বিকৃত মানসিকতার পরিচয়।
#সমকামিতা হারাম!!!
“ভদ্রলোক”রা তো সমকামিতাকে কোন অপবাদ দিতেই বাকি রাখে নি! আসলে তাদেরও দোষ দেয়া যায় না। প্রথমত, তথাকথিত ভদ্রসমাজ তাদের হাতে পায়ে বেড়ি লাগিয়ে দিয়েছে, তাই উঠতে বসতে তাদের কেবল একই চিন্তা- লোকে কী বলবে? আর দ্বিতীয়ত, তাদের জানার অভাব। অন্যান্য দেশের কথা নাহয় বাদ-ই দিলাম, আমাদের দেশেই ক’জন লোক বই পড়ে? অনেক খুজলেও লাখে একজন পাওয়া মুশকিল! আর যারা একটু পড়ে, তারাও অনেক সময় কঠিন বা ভারী বই দেখলে ভিরমী খায়(কারণ তারা পড়ে হয় “ঠাকুরমার ঝুলি” আর নাহয় “আরব্য রজনী”)। যেহেতু বই পড়ার প্রতি তাদের এই অনীহা, সেহেতু “সমকামীতা” সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান থাকবে শূন্যের কোঠায়, এটাই স্বাভাবিক। আর অল্প বিদ্যার ফল সর্বদাই ভয়ঙ্কর!
সমকামিতা ও প্রকৃতিঃ


এখন দেখা যাক, সমকামিতা আসলেই প্রকৃতি বিরুদ্ধ কিনা। আমি এখানে খুব সরল ভাষায় সমকামিতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছি, যাতে করে এই সহজ বিষয়টি সবার বোধগম্য হয়। এরপরেও যদি কারও বুঝতে কোন কষ্ট থাকে, তাহলে বুঝতে হবে- হয় আমার চেষ্টায় কোন ত্রুটি থেকে যাচ্ছে, আর নাহয় আপনারা বুঝেও বুঝতে চাচ্ছেন না।
কিছুদিন আগে ড. অভিজিৎ রায়ের লেখা ‘সমকামিতা” বইটা পড়লাম। আর সেটা পড়তে গিয়েই পেলাম ‘সমকামিতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কিনা’-এই প্রশ্নের জবাব। এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই- “প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ তথা প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ কারা করতে পারে?” উত্তরঃ “যারা প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারে।” এবং পৃথিবী নামক এই গ্রহে প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনকারী প্রাণী একমাত্র মানুষ। সুতরাং এই মানুষ-ই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবার ক্ষমতা রাখে। আর যারা প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারে না, তাদেরকে প্রকৃতির প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করেই চলতে হয়। প্রকৃতি বিরোধী কোন কাজ করার ক্ষমতা তাদের থাকার কথা নয়। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে “হুইপটেইল” নামক এক জাতের গিরগিটির কথা, যারা কিনা তথাকথিত ভদ্র সমাজের বাসিন্দাদের মতে “প্রকৃতি বিরুদ্ধ” কাজ করেই যাচ্ছে[সূত্রঃ Click This Link ]! আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, হুইপটেইল জাতের গিরগিটিদের কোন পুংলিঙ্গ নেই, তারা সবাই-ই স্ত্রী লিঙ্গের। এরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিজ দেহের ভেতরেই শুক্রাণু উৎপাদন করে, ডিম্বাণুর সাথে শুক্রাণুর মিলন ঘটায় এবং তারপর নিষেক ঘটে। অর্থাৎ সম্পুর্ণ জনন প্রক্রিয়া ঘটে এদের দেহের ভেতরেই, তাই এদের যৌন সংগম করারও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে দেখা যায়, দুটো স্ত্রী হুইপটেইল গিরগিটি পরস্পরের সাথে যৌন সংগম করছে! অর্থাৎ সমকামিতা তাদের মধ্যেও রয়েছে যাদের কিনা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতাই নেই! শুধু হুইপটেইল গিরগিটিই নয়; ডলফিন, ভাল্লুক, আফ্রিকার রাজা সিংহ সহ প্রায় ১৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যেও সমকামিতা দেখা গেছে। এখনও কী কেউ বলবেন যে সমকামিতা প্রকৃতি বিরুদ্ধ?
বিজ্ঞান কী বলেঃ

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সমকামীদের মস্তিষ্কের “হাইপোথ্যালামাস” নামক অংশের গঠন আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের মত নয়; তাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের গঠন ভিন্ন। হাইপোথ্যালামাস হচ্ছে মস্তিষ্কের সেই অংশ, যেখানে যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। সমকামীদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের গঠন ভিন্ন হয় হাইপোথ্যালামাসের একটি বিশেষ অংশের আকারের ভিন্নতার কারণে; সেই অংশটি হচ্ছে- Interstitial Nucleus of the Anterior Hypothalamus(সংক্ষেপে INAH3)। এখন, যাদের মস্তিষ্কের যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী অংশটির গঠনই আলাদা, তাদের যৌন প্রবৃত্তি যে আলাদা হবে এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?
আসলে সমকামিতা হচ্ছে একটা জিনগত বৈশিষ্ট্য, যা জিনের মাধ্যমে বাহিত হয়। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র এবং জেনেটিক্স পড়েছেন তারা এই ব্যাপারটা ভালো বুঝবেন। একজন সমকামী, যে কিনা সমকামের জিন বহন করছে, তার জিন তাকে সবসময়ই সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার জন্য সিগন্যাল প্রেরণ করবে। তাই সে চাইলেও তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারবে না। এখন যদি তাকে জোর করেও বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে বিয়ে দেয়া হয়, কিংবা সমাজের ভয়ে সে যদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিয়ে করে; তাহলেও তার কাম জাগবে সর্বদাই সমলিঙ্গের প্রতি, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি নয়। জিনগত ব্যাপার, চাইলেই তো আর ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায় না!
জেনেটিক্স নিয়ে যারা পড়েছেন, তারা অবশ্যই এটাও জানবেন যে জিন কখনো বিলুপ্ত হয় না বা ধ্বংস হয় না। বরং বংশ থেকে বংশান্তরে বাহিত হতে থাকে। তাই একজন সমকামীকে যতই বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে বিয়ে দেয়া হোক না কেন, আর সেই সমকামী যতই নিজেকে লুকিয়ে রাখুক না কেন; তার সমকামের জিন কিন্তু হারিয়ে যাবে না। সে নিজেকে নিজে চেপে রাখলেও তার সেই জিন বাহিত হবে তার সন্তান সন্ততির দেহে। যদি সেই সন্তান সন্ততির দেহে সমকামের জিন প্রচ্ছন্নও থাকে, তাহলেও কিন্তু সেই জিন হারিয়ে যাচ্ছে না। বরং সেই জিন আবার তাদের সন্তানদের দেহে বাহিত হবে, এবং প্রকট রূপে ধরা পড়বে! তখন দেখা যাবে, একজন সমকামীর সন্তানরা সমকামী না হলেও তার নাতি-নাতনিদের মধ্য থেকে একজন না একজন সমকামী বেরিয়ে আসবেই। অথচ সমকামীরা যদি নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? কেউ একবারও ভেবে দেখেছেন কি? সমকামীরা নিজেদের মধ্যে বিয়ে করে সংসার করলেও তারা প্রজনন করতে পারবে না, নতুন কোনো সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না। তাই তাদের কোনো বংশধরও থাকবে না। ফলে তাদের সমকামিতা বহনকারী জিন, যা বংশপরম্পরায় তারা বহন করে আসছে, সেই জিন তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং তাদের মৃত্যুর পরে তাদের সাথেই হারিয়ে যাবে। অর্থাৎ তাদের থেকে আর নতুন করে কোনো সমকামীর জন্ম হবে না! সুতরাং সমকামী বিবাহ নিষিদ্ধ করে এবং একজন সমকামীকে বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে বিয়ে দিলেই যে সমকামীতা বলে কিছু থাকবে না, এটা নিতান্তই ভুল ধারনা! বরং এ পর্যন্ত আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি, তা থেকে এটাই পরিষ্কার হয় যে সমকামী বিবাহকে বৈধতা দিলেই একটা সময় সমকামিতা বিলুপ্ত হতে শুরু করবে। আর সমকামী বিবাহকে অবৈধ ঘোষণা করে আমরা যদি সমকামীদেরকে তাদের বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে বাধ্য করি, তাহলে সমকামীদের সংখ্যা তো কমবেই না, বরং ভবিষ্যতে তাদের সংখ্যা বেড়ে এখনকার তুলনায় তিনগুণ হয়ে দাঁড়াবে!
পরিশিষ্টঃ
যারা এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে পুরো লেখাটা পড়ে এ পর্যন্ত এসেছেন, তাদের এতক্ষণে অবশ্যই এটা বুঝে যাওয়ার কথা যে সমকামীতা কোন মানসিক রোগ নয়, আর প্রকৃতি বিরুদ্ধ তো নয়-ই। সমকামীতা মানুষের একটি অতি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আমাদের কাছে যেমন ওদের সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে আজব মনে হয়, ওদের কাছেও ঠিক তেমনি আমাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াকে আজব মনে হয়।
আর পুরোটা পড়ার পরেও যদি আপনার মনে হয় যে সমকামী বিবাহ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত, তাহলে আপনার কাছে আমার প্রশ্ন- “ধরুন, আপনার বাবা একজন সমকামী, এবং তিনি চান যে আপনার বিয়ে আপনার সমলিঙ্গের কারো সাথে হোক। কিন্তু আপনি সমকামী নন। এখন যদি আপনার ওপর জোরপূর্বক সমকামিতা চাপিয়ে দিয়ে আপনাকে সমলিঙ্গের কাউকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়, তাহলে আপনার কেমন লাগবে?!” আপনার সে সময়কার অনুভুতি হবে হুবহু একজন সমকামীর ঠিক সেই সময়কার অনুভুতির মতই, যখন তাকে সমাজের চাপে বাধ্য হয়ে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিয়ে করতে হয়!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




