somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমকামিতা: The Taboo!!! (পর্ব-২)

১৮ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
মফিজ মিয়ার অনেক ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার দাপটে আজ সে পুরো গ্রাম দাপিয়ে বেড়ায়! সাথে থাকে তার অনুগত একপাল সাঙ্গপাঙ্গ, যারা তার হুকুমে যে কারো মুণ্ডু কেটে নিয়ে আসতে প্রস্তুত! আর তাই মফিজ মিয়ার ভয়ে পুরো গ্রামবাসী সবসময় তটস্থ থাকে!
ক’দিন যাবত মফিজ মিয়া ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে। তার দুশ্চিন্তার বিষয় হল চোখ। নীল চোখ তার একদম পছন্দ না। তার নিজের চোখের মণির রঙ কালো, তার সাঙ্গপাঙ্গদের চোখের মণিও কালো। গ্রামের সবারই চোখ কালো। কিন্তু কয়েকদিন হল সে খেয়াল করেছে এ গ্রামেরই দু’জন কিশোরের চোখের রঙ নীল। নীল চোখের এই দুই কিশোরকে দেখলেই এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করতে শুরু করে মফিজ মিয়ার ভেতরে, এই অস্বস্তির সঠিক কারণ তার নিজেরও জানা নেই। যতই সে ঐ দুই কিশোরের নীল চোখ দেখে, ততই তার অস্বস্তি বাড়তে থাকে। এ কেমন কথা? যেখানে তার চোখ কালো, গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজনের চোখ কালো, সেখানে কারো চোখ নীল কেন থাকবে?! নাহ! এটা মেনে নেয়া যায় না! কিছুতেই না! সবার চোখের রঙ কালোই হতে হবে। সে ফতোয়া জারি করল- “নীল চোখের মানুষেরা সব শয়তানের পূজারী, তাই ওদের চোখ শয়তানের চোখের মতই নীল! ওদের দেখা মাত্রই পাথর ছুড়ে, পানিতে ডুবিয়ে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করো!!” মফিজ মিয়ার এহেন ফতোয়া শুনে তার মুরিদরা হৈ হৈ করতে করতে ছুটলো “শয়তানের পূজারী” দুই কিশোরকে হত্যা করতে। আর মফিজ মিয়া? একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে মুচকি হাসল সে। যাক! তার এতদিনের অস্বস্তির একটা সমাধান হল তবে!!

২.


এতক্ষণ ধরে যারা মফিজ মিয়ার গল্পটি পড়লেন তারা হয়ত ভাবছেন, এটা কী করে সম্ভব? শুধুমাত্র চোখের রঙ অপছন্দ হওয়ার কারণে একটা মানুষের আরেকটা মানুষের প্রতি এত বিদ্বেষ? আপনারা হয়ত মানতেই পারছেন না, একটা মানুষের পক্ষে এতটাও অমানবিক হওয়া সম্ভব! তাও আবার নিজের ব্যক্তিগত অস্বস্তির কারণে!! যারা মানতে পারছেন না, তাদেরকে এবারে একটু নিজের কল্পনাশক্তি (যদি থাকে) কাজে লাগাতে হবে। ধরুন, আপনি-ই মফিজ মিয়া। হ্যা, নিজেকে “চোখ সংখ্যাগরিষ্ঠ” মফিজ মিয়ার জায়গায় দাড় করান, আর “চোখ সংখ্যালঘু” নীল চোখের কিশোরদের জায়গায় দাড় করান যৌন সংখ্যালঘু সমকামীদের। জানি, এ পর্যন্ত পড়েই অনেকে তেড়ে আসবেন। কিন্তু একবার নিজের বিবেক বোধ(যদি থাকে) থেকে ভাবুন তো, ভিন্ন ভিন্ন চোখের রঙ বিশিষ্ট মানুষ যদি এ সমাজে থাকতে পারে, তবে ভিন্ন যৌন প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষেরা কেন থাকতে পারবে না?
একজন মানুষের চোখের রঙ নীল হওয়া, গায়ের রং কালো হওয়া, চুলের রং সোনালি হওয়া ইত্যাদি যেমন তার প্রকৃতি প্রদত্ত বৈশিষ্ট্য, তেমনি সকামিতাও একজন মানুষের প্রকৃতি প্রদত্ত বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে তার নিজের কিছুই করার নেই। সমকামিতা যে কোন প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌনাচার নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক, এ বিষয়ে সমকামিতা নিয়ে আমার লেখা পূর্ববর্তী প্রবন্ধে আমি আলোচনা করেছি(“সমকামিতাঃ The Taboo!!! (পর্ব-১)” লিংকঃ http://bit.ly/2uwaNJ3 )। এখানে তারই কিছু খুঁটিনাটি বিষয় আরো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।

৩.


প্রথমেই আসা যাক, সমকামীদের মস্তিষ্ক প্রসঙ্গে। যেহেতু প্রাণীদেহের সমস্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের দ্বারা, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই প্রাণীদের যৌনপ্রবৃত্তিও মস্তিষ্কের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। আবার যেহেতু একজন নারী এবং একজন পুরুষের যৌন প্রবৃত্তি “প্রাকৃতিক নিয়ম” অনুযায়ী পরস্পর থেকে আলাদা হওয়া উচিত, তাই স্বাভাবিকভাবেই নারী এবং পুরুষের মস্তিষ্কের যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণকারী অংশের গঠনও আলাদা হওয়া উচিত। এই বিশ্বাস থেকেই ১৯৭৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করেছিলেন ইঁদুরদের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় রজার গোর্কি আবিষ্কার করেন পুরুষ ইঁদুরের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস স্ত্রী ইঁদুরের হাইপোথালামাস অপেক্ষা তিনগুণ বড়। এই হাইপোথ্যালামাস হচ্ছে মস্তিষ্কের সেই অংশ, যেখানে প্রাণীর যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টি এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। পরবর্তীতে বানরের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েও বিজ্ঞানীরা একই ফলাফল পান। ইঁদুর এবং বানরের মস্তিষ্ক আরো সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের মধ্যে “মেডিয়াল প্রি-অপটিক” নামক একটি অংশ আছে, এই অংশটি কোনো কারণবশত ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা এই অংশে কোনো রকম পরিবর্তন দেখা দিলে যৌনতার পরিবর্তন দেখা দেয়। এর ফলে পুরুষ ইঁদুর বা বানর স্ত্রী ইঁদুর বা বানরের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে মস্তিষ্কের যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণকারী অংশ হাইপোথ্যালামাসের গঠনগত ভিন্নতার কারণেই প্রাণীদের যৌন প্রবৃত্তিতেও ভিন্নতা দেখা দেয়।


একই ঘটনা ঘটে মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রজার গোর্কি এবং তার ছাত্রী লরা এলেন ইঁদুর এবং বানরের মস্তিষ্কের পর যখন মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন, তখন তারা দেখতে পান নারী এবং পুরুষ মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লিয়ি অব দ্য এ্যান্টেরিয়র হাইপোথ্যালামাস(INAH1, INAH2 এবং INAH4)-এর গঠন অনেকটা একই রকম। অনেকেই হয়ত ভাবছেন, হাইপোথ্যালামাসের তিনটা নিউক্লিয়াসেরই গঠন একই রকম হলে নারী এবং পুরুষের যৌনতায় পার্থক্যটা তাহলে কীভাবে হয়? পার্থক্যটা হয় মূলত তৃতীয় ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লিয়ি অব দ্য এ্যান্টেরিয়র হাইপোথ্যালামাস(INAH3)-এর কারণে। রজার গোর্কি এবং লরা এলেনের গবেষণালব্ধ ফলাফল অনুযায়ী INAH1, INAH2 এবং INAH4-এর গঠন প্রায় একই রকম হলেও INAH3-এর গঠন নারী এবং পুরুষের মস্তিষ্কে আলাদা হয়। পুরুষদের মস্তিষ্কের INAH3 নারীদের মস্তিষ্কের INAH3 অপেক্ষা অন্তত তিনগুণ বড় হয়! এরপর ১৯৯০ সালে আমেরিকান স্নায়ুবিজ্ঞানী সিমন লেভি সমকামীদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস বিশ্লেষণ করার কথা ভাবলেন। তিনি ১৬ জন পুরুষ সমকামী এবং ৬ জন স্ত্রী সমকামীর হাইপোথ্যালামাসের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন। দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা চালানোর পর তিনি যে ফলাফল পেলেন তা হল, সমকামী পুরুষদের INAH3 বিষমকামী পুরুষদের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ ছোট। অর্থাৎ সমকামী পুরুষদের INAH3-এর আকার নারীদের INAH3-এর সমান! আর এই কারণেই সমকামী পুরুষদের যৌন প্রবৃত্তি হয় নারীদের মত। যাদের যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণকারী অংশের গঠনই নারীদের মত, তাদের যৌনপ্রবৃত্তি তো নারীদের মতই হবে, তাই না? তর্কের খাতিরে কেউ কেউ হয়ত বলবেন, কারো মস্তিষ্কের একটা অংশের গঠন কাকতালীয় ভাবে ভিন্ন হতেই পারে। কেউ কেউ হয়ত আরো এক ধাপ এগিয়ে এসে মস্তিষ্কের একটা অংশের গঠন ভিন্ন হওয়ার কারণে সমকামীদেরকে প্রতিবন্ধীদের কাতারেই ফেলে দেবেন! সেসব ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলব, একজন দুইজনের মস্তিষ্কের গঠন ভিন্ন হলে সেটা কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে, সেটাকে হয়ত প্রতিবন্ধীতার কাতারেও ফেলা যেতে পারে। কিন্তু সব সমকামীদের মস্তিষ্কের গঠন যেখানে বিষমকামীদের মস্তিষ্কের তুলনায় একই রকমভাবে আলাদা, সেখানে ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলা যায় কি? এক্ষেত্রে ব্যাপারটা কাকতালীয় তো নয়ই, বরং কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতাও নয়। সমকামীরা “প্রাকৃতিক নিয়ম” অনুযায়ী-ই সমকামী।


(সূত্রঃ
* “A Difference in Hypothalamic Structure Between Homosexual and Heterosexual Men”- Simon Levay. PDF: http://bit.ly/2tVKdZ6
* “সমকামিতাঃ একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান”- অভিজিৎ রায়)

৪.

এবারে আসি সমকামীদের জীন প্রসঙ্গে, যাকে “গে জীন” বলা হয়ে থাকে। ১৯৯৩ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের জীনতত্ত্ববিদ ডিন হ্যামার এই গে জীন সনাক্তকরণের লক্ষ্যে সমকামী পুরুষদের ১১৪ টি পরিবারের ওপর গবেষণা করে দেখলেন, এই সমকামী পুরুষদের মামা এবং মাতৃসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে উচ্চমাত্রার সমকামিতা রয়েছে, কিন্তু পিতৃসম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনদের মাঝে সেরকমটা নেই। অর্থাৎ সমকামিতার বৈশিষ্ট্য তারা তাদের মায়ের দিক থেকে পেয়েছে। এ থেকে ডিন হ্যামার অনুমান করেন, যেহেতু পুরুষ সন্তানরা এক্স-ক্রোমোজোমের প্রতিলিপি তাদের মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে(পুরুষ দেহে দুই ধরনের ক্রোমোজোম থাকে, একটি হল Y-ক্রোমোজোম যা সে তার বাবার কাছ থেকে পায়, অন্যটি X-ক্রোমোজোম যা সে তার মায়ের কাছ থেকে পায়), তাই এক্স-ক্রোমোসোমের সঙ্গে সমকামিতার কোনো না কোনো যোগসূত্র অবশ্যই আছে। আর একারণেই মাতৃসম্পর্কীয় পূর্বসূরীদের মাঝে সমকামিতা থাকলে সেই মায়ের পুরুষ সন্তানদের মধ্যেও সমকামিতা ত্বরান্বিত হয়। এরপর হ্যামার দুই সমকামী ভাইয়ের এক্স-ক্রোমোজোমের জেনেটিক মার্কার নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন। ফলশ্রুতিতে দুই ভাইয়ের এক্স-ক্রোমোজোমের Xq28 অংশের মার্কারের মধ্যে লক্ষণীয় ভাবে উচ্চমাত্রার মিল খুজে পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায় পুরুষের সমকামিতার সঙ্গে Xq28-এর একটি সম্পর্ক রয়েছে। ডিন হ্যামার প্রাথমিকভাবে এই অঞ্চলের জীনকেই গে জীন হিসবে চিহ্নিত করেন।

তবে এই Xq28 মার্কারটি সমকামী প্রবৃত্তির অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক কিনা, এই নিয়েও এক পর্যায়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ডিন হ্যামার ৪০টি সমকামী ভ্রাতৃযুগলের এক্স-ক্রোমোজোমের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে দেখলেন, ৩৩টি যুগলের মধ্যেই Xq28 মার্কারের যথেষ্ট মিল রয়েছে, বাকি ৭টি যুগলের Xq28 মার্কারে কোনো মিল পাওয়া যায় নি। যদি এই জেনেটিক মার্কারটি(Xq28) সমকামিতার অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক হত, তাহলে তো বাকি ৭ জোড়া ভাইয়ের মধ্যেও মিল থাকত। কিন্তু সেরকমটা তো নেই! আবার সমকামিতার সাথে যে এই মার্কারটির কোনো সম্পর্কই নেই, এরকমটা বলারও কিন্তু কোনো উপায় নেই। কারণ সমকামিতার সঙ্গে যদি এই Xq28 জীনের কোনো সম্পর্ক না-ই থাকত, তবে বাকি ৩৩ জোড়া ভাইয়ের মধ্যেও Xq28-এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যেত না। অথচ এখানে দেখা যাচ্ছে যে ৩৩ জোড়া ভাইয়ের Xq28-এর মধ্যে উচ্চমাত্রার মিল রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে পুরুষের সমকামী প্রবৃত্তির সাথে এই Xq28-এর কিছুটা হলেও সম্পর্ক রয়েছে। আর বাকি ৭ জোড়া ভাইয়ের মধ্যে Xq28-এর মিল না থাকায় এটাও প্রমাণিত হয় যে, Xq28-ই সমকামী প্রবৃত্তির একমাত্র নিয়ামক নয়, বরং এক্স-ক্রোমোজোমেই এমন আরো জেনেটিক মার্কার রয়েছে যা বংশানুক্রমে সমকামিতাকে ত্বরান্বিত করে থাকে।
ডিন হ্যামারের এই গবেষণায় সমকামী প্রবৃত্তির প্রধান বা অত্যাবশ্যকীয় নিয়ামক তথা “গে জীন” সুনির্দিষ্টভাবে সনাক্ত না হলেও এটা অন্তত নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে সমকামিতা একটি জীন তাড়িত বৈশিষ্ট্য, যাকে গায়ের জোরে পরিবর্তন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
(সূত্রঃ
*NCBI জার্নালে প্রকাশিত ডিন হ্যামারের গবেষণাপত্রঃ http://bit.ly/2tfRapf
* Dean Hamer Talks About Gay Gene Study and Research on Sexual Orientation: https://youtu.be/9zno8e4R6gA )

পরিশিষ্টঃ
মফিজ মিয়া আজ বেচে নেই। তার সাঙ্গপাঙ্গদেরও অনেক বয়স হয়ে গেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে শান্তি ফিরে আসার কথা। কিন্তু না, গ্রামে শান্তি ফিরে আসে নি। বরং অশান্তি যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে! আর এই অশান্তির কারণ মফিজ মিয়ার সাঙ্গপাঙ্গদের নাতিপুতিরা। তারা এখন পশু শিকারের মতই পুরো গ্রামে নীল চোখের মানুষ শিকার করে বেড়ায়! যখনই খবর পায় এ গ্রামের কারো চোখ নীল, সঙ্গে সঙ্গে দলবল নিয়ে হামলা চালায় তার বাড়িতে, তাকে মারধর করে, তার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়! এ গ্রামে তারা কারো নীল চোখ বরদাস্ত করবে না। কিছুদিন আগে তারা খবর পেয়েছিল গ্রামের পাঠশালায় নীল চোখের এক কিশোর পড়ে। ওমনি তারা লাঠিসোটা, রামদা, চাপাতি নিয়ে পুরো পাঠশালা ঘেরাও করল। পাঠশালার গুরুমশাই বেচারা আর কী করবে? এদের কথা না শুনলে যে তার পাঠশালাই থাকবে না আর! অগত্যা গুরুমশাই সেই নীল চোখের ছেলেটিকে বের করে দেন পাঠশালা থেকে। এরপর কতদিন যে তাকে "চোখ সংখ্যাগরিষ্ঠ"দের হাতে থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, তা সে নিজেও জানে না!
যাক মফিজ মিয়ার গ্রামের কথা! এবার মফিজ মিয়ার গ্রাম থেকে আমাদের শহরে ফিরে আসা যাক। কিছুদিন আগে ISTT থেকে বের করে দেয়া হয় সেখানকার এক ছাত্রকে, তার নাম নাবিল। নাবিলের অপরাধ- সে একজন সমকামী এবং সম্প্রতি সে একটা ইউটিউব চ্যানেলের ইন্টারভিউতে নিজেকে সমকামী বলে আত্মপ্রকাশ করেছে। আচ্ছা, নাবিলের নিজেকে সমকামী বলে আত্মপ্রকাশ করাটা বড় অপরাধ, নাকি সমকামী হয়েও বিষমকামী সাজা, চারপাশের সবার কাছে নিজেকে বিষমকামী বলে মিথ্যাচার করা, বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিয়ে করে একই সঙ্গে নিজের এবং তার জীবন নষ্ট করে দেয়াটা বড় অপরাধ? আমাদের আশেপাশে এমন অনেক সমকামীরাই আছে যারা সমাজের ভয়ে বিষমকামী সেজে থাকে এবং একটা সময় পর সমাজের চাপে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু শত হলেও তো সে একজন সমকামী! একজন বিষমকামীর সঙ্গে সে কী করে সংসার করবে? ফলাফল স্বরূপ তাদের দু’জনের জীবনেই নেমে আসে অশান্তির কালো ছায়া। এভাবে দু দু’টো জীবন হয়ত নষ্ট হত না, যদি সে আগেই নিজেকে সমকামী বলে আত্মপ্রকাশ করতে পারত। ঠিক এই কারণেই নাবিল নিজের সমকামিতাকে চেপে রেখে বিষমকামী সেজে থাকতে চায় নি, সে চায় নি দ্বিতীয় কারো জীবন নষ্ট হওয়ার কারণ হতে! আর তাই সে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করেছে। তার এই সাহসিকতা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাবার যোগ্য।


যারা এই ভেবে সমকামীদের সমাজ ছাড়া করতে ব্যস্ত যে তাদের দেখাদেখি সমাজের বিষমকামীরাও সমকামী হয়ে যাবে, তারা একটু চিন্তা করে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো! সমকামীরা কি তাদের আশেপাশের বিষমকামীদের দেখে বিষমকামী হয়ে যায়? না, যায় না। তাহলে আপনাদের মনে এই ধারণা কোথা থেকে এলো যে বিষমকামীরা আশেপাশের সমকামীদের দেখে সমকামী হয়ে যাবে?! আরো একটা কথা, চোখে কালো রঙের লেন্স পড়লেই যেমন নীল চোখ সত্যি সত্যি কালো হয়ে যায় না, তেমনি সমাজের চাপে একজন সমকামী বিষমকামী সাজলেই সে বিষমকামী হয়ে যায় না। ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে, সমকামীদের মস্তিষ্কের তৃতীয় ইন্টারস্টিয়াল নিউক্লিয়ি অব দ্য এ্যান্টেরিয়র হাইপোথ্যালামাস(INAH3)-এর গঠনের ভিন্নতা এবং এক্স-ক্রোমোজোমে “গে জিন”-এর উপস্থিতির কারণেই মূলত তারা সমকামী হয়। সুতরাং একজন সমকামী হাজার চেষ্টা করলেও কখনোই বিষমকামীতে পরিণত হতে পারবে না। তার সমকামিতা তার হাতে নয়, প্রকৃতির হাতে। আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার ফলাফল যে বরাবরই অশুভ, ইতিহাসই তার সাক্ষী!
পরিশেষে একটা কথাই বলব- গল্পের নীল চোখওয়ালাদের প্রতি মফিজ মিয়া, মফিজ মিয়ার সাঙ্গপাঙ্গ এবং তাদের নাতিপুতিদের যে নিষ্ঠুর আচরণ, তার চাইতেও অনেক বেশি নিষ্ঠুর আচরণ আমরা যুগ যুগ ধরে করে আসছি সমকামীদের সঙ্গে! আমরা তাদের ওপর জোরপূর্বক বিষমকামিতা চাপিয়ে দিচ্ছি; তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের চাপের মুখে পড়ে বিষমকামী সাজছে, আর বাকি যারা বিষমকামী সাজতে পারছে না তাদেরকে আমরা একঘরে করে দিচ্ছি। একবার নিজেদের জায়গায় তাদের এবং তাদের জায়গায় নিজেদের দাঁড় করিয়ে ভাবুন তো, এভাবে বেঁচে থাকার অনুভূতিটা ঠিক কীরকম! কী? ভাবনার শক্তি কিছু অবশিষ্ট্ আছে তো? নাকি সেটাও সপে দিয়েছেন মফিজ মিয়াদের কাছে?!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:৩৮
১২টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×